জ্বলদর্চি

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি/(ষষ্ঠপর্ব)/চিত্রা ভট্টাচার্য্য

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি     (ষষ্ঠপর্ব)
চিত্রা ভট্টাচার্য্য

(গদ্য রচনা, গল্প ও উপন্যাস।)

নজরুল তাঁর ‘'যৌবনের গানে’ বলেছিলেন, '‘বনের পাখির মত স্বভাব আমার গান করায়। কাহারও ভালো লাগিলেও গাই, ভালো না লাগিলেও গাহিয়া যাই। 'আত্মসচেতন কবি সুনির্দিষ্ট ভাবে নিজের সাহিত্যকর্মের বৈশিষ্ট্যকে শনাক্ত করতে গিয়ে বলেছেন যৌবনের সীমা পরিক্রমণ আজও আমার শেষ হয় নাই, কাজেই আমি যে গান গাই, তাহা যৌবনের গান।’’   

 একজন সাহিত্যিকের আত্মসচেতনতাই যে তাঁর শিল্পশক্তি ও আত্মশক্তিরই এক অনন্য নিদর্শন – সেটি অনুধাবনের সামর্থ্য সাধারণ মানুষের মন জগতে প্রায় ই  থাকে না । প্রাজ্ঞ নজরুল গবেষক আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেছিলেন, ‘' জনগণের নাড়ী কোনখান দিয়ে বয়, সে বিষযয়ে নজরুল ইসলামের জ্ঞান ছিলো অব্যর্থ।’ শুধুই জনগণের নাড়ীর খবরই নয়, নিজের নাড়ী-নক্ষত্রের বিষয়েও তাঁর জ্ঞান ছিল অসামান্য।নজরুল শুধু নিজেরই নয়, সেইসঙ্গে সমাজের মানুষগুলির অন্তর্নিহিত শক্তিকেও বোঝার চেষ্টা করেছিলেন, সেই সক্ষমতা তিনি অর্জন করেছিলেন যুক্তি দিয়েই কেবল নয়, আবেগ দিয়েও। আবার এটিও সত্যি যে, নজরুল শুধুই  আবেগপ্রবণ ছিলেন না; আবেগের শক্তিকে ও তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন।'' তাও অনেকে সে-কারণেই বিশ্বাস করতেন, ''He who knows others is wise; he who knows himself is enlightene ''

 কবির জীবনীকার গবেষকদের মতে , ‘সাহিত্যিক তো শুধু সমালোচক নয়,সমাজের অন্তর্নিহিত জীবনীশক্তির সে প্রতিপালক ও বটে।" আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নজরুল প্রতিভা অতুলনীয়। কারণ পরাধীন ভারতের ‘জাতীয় বিপ্লবের সার্থক সাহিত্যিক প্রতিভূ ’ হিসেবে তিনি নিজেকে সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এই কারণে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো রাজনৈতিক নেতা বলেছিলেন ,  ‘স্বাধীন দেশে জীবনের সহিত সাহিত্যের স্পষ্ট সম্বন্ধ আছে। আমাদের দেশে তা নাই। দেশ পরাধীন বলে এদেশের লোকেরা জীবনের সকল ঘটনা থেকে উপাদান সংগ্রহ করতে পারে না। নজরুলের লেখায় তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। নজরুল জীবনের নানাদিক থেকে উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। এতেই বুঝা যায় যে নজরুল একটা জীবন্ত মানুষ।'  
🍂
ad

নজরুল তাঁর প্রবন্ধে বলিষ্ঠ ভাষায় দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন,''‘আমি পরম আত্মবিশ্বাসী । তাই যা অন্যায় বলে বুঝেছি, তাকে অন্যায় বলেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি, কাহারো তোষামোদ করি নাই, প্রশংসা ও প্রসাদের লোভে কাহারো পিছনে পোঁ ধরি নাই।’ এখানেই শুধু থামেননি  ; এসবের সঙ্গে তিনি আরো যুক্ত করেছেন তাঁর এই উপলব্ধিকে ''আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই, সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য-তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।’' 

আসলে , নজরুল কখনোই কোনো অবস্থাতেই নিজের আত্মশক্তিকে খর্ব হতে দেননি। নজরুল প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, '‘আপনাকে যে খর্ব করে, সে কেবল নিজেকেই কমিয়ে রাখে তা নয়। মোটের উপর সমস্ত মানুষের মূল্য সে হ্রাস করে।’ নজরুল ইসলাম নিজেকে কখনোই যেমন খর্ব করেননি, ঠিক তেমনই আবার, সমাজের অন্যসব মানুষের মূল্যকেও কমিয়ে রাখার মতো অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকেননি।''

  প্রেম-বিদ্রোহ-সাম্যের কবি কাজী নজরুলের কাব্য সাম্রাজের পাশাপাশি রয়েছে অনন্য গদ্যের ভুবন--লিখেছেন বহু গল্প-নাটক-উপন্যাস-প্রবন্ধ। যদিও কবি সর্বাধিক পরিচিত গীত সংগীত ,কবিতার ঝঙ্কারে, তবুও গল্প-নাটক- প্রবন্ধ উপন্যাসের পৃথিবীতে তাঁর অবাধ বিচরণ। নজরুল তার সৃষ্টিতে নিজস্ব দ্রোহ-কাব্যিক ভাষা ও চমৎকার সুখপাঠ্য কাহিনী বিন্যাসে নিঃসন্দেহে সচেষ্ট ছিলেন। 

 নজরুলের সাহিত্য জগতে প্রথম প্রবেশ গদ্যের মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে তিনি কবিতায় মনোনিবেশ করলেও সেই সাথে গদ্যচর্চা অব্যাহত রেখেছেন। গল্প-উপন্যাসে যা বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে ভিন্নতার ছোঁয়া। ‘তাঁর রচিত বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’ ও ‘কুহেলিকা’ এ তিনটি ই উপন্যাস ই স্বতন্ত্র মহিমায় উজ্জ্বল।  

কাজী নজরুলের লেখা  প্রথম গদ্য রচনা ছিল "বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী"। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচি সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেছিলেন। এখান থেকেই মূলত তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটেছিল। এখানে বসেই বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে: "হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে"। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় যার নাম ব্যথার দান- এছাড়া একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী প্রকাশিত হয়। 

কাজী কবি সম্পাদকীয় ছাড়াও বিস্তর প্রবন্ধ লিখেছেন এবং  তিনি এই প্রবন্ধ রচনার  তাগিদ অনুভব করেছিলেন -তাঁর সম্পাদিত দৈনিক নবযুগ (১৯২৩, ১৯৩৫ খ্রি.), অর্দ্ধ সাপ্তাহিক ধূমকেতু (১৯২২ খ্রি.) ও সাপ্তাহিক লাঙ্গল (১৯২৫ খ্রি.) পত্রিকার কাছ থেকে।  করাচি সেনানিবাসে বাঙালি পল্টনে সৈনিক থাকাকালীন তাঁর  প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা’ (  কার্ত্তিক ১৩২৬)।   তিনি এই প্রবন্ধটি লিখে পাঠান কলকাতা থেকে প্রকাশিত সওগাত পত্রিকাটিতে। 

এরপরে  নজরুলের তিনটি প্রবন্ধ ‘জননীদের প্রতি’, ‘পশুর খুঁটিনাটি বিশেষত্ব’ ও ‘জীবন বিজ্ঞান’ প্রকাশিত হয় মোসলেম ভারত পত্রিকায়। নজরুলের প্রথম প্রকাশিত মৌলিক প্রবন্ধ একটি আবেগ প্রবণ রচনা‘উদ্বোধন’ (বকুল ফুল , আষাঢ় ১৩২৭) পরে এটি ‘জাগরনী’ নামে ‘যুগবাণী’ গ্রন্থে সংকলিত হয়।  নজরুল গবেষক ও প্রবন্ধিক দের মতে নজরুলের সাহিত্যে বিকাশ ঘটে সাংবাদিক হওয়ার পর থেকে। সান্ধ্য  সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’ (১৯২৬ খ্রি.) সমকালীন দেশকাল ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের ঘটনাবলী নিয়ে প্রকাশিত নজরুলের রচনা বা নিবন্ধে। প্রবন্ধসমূহ পাঁচটি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ‘যুগবাণী’ (১৯২২ খ্রি.), ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ (১৯২৩ খ্রি.), ‘দুর্দিনের যাত্রী’ (১৯২৬ খ্রি.), ‘রুদ্র-মঙ্গল’ (১৯২৬ খ্রি.)। নজরুলের আরও অনেক প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে। এ ছাড়াও নজরুল যে অনেক গ্রন্থের ভূমিকা লিখে দিয়েছেন যে অভিভাষণ, প্রতিভাষণও  দিয়েছেন।  
 
আলোচনার সুবিধানুসারে তাঁর প্রবন্ধ সমূহকে বিষয়ানুসারে নিন্মোক্ত ভাগে বিভক্ত করে নেওয়া হলো।   

(১)  রাষ্ট্রধর্ম ও স্বাধীনতা বিষয়কপ্রবন্ধ : 
যুগবাণীর নবযুগ , গেছে দেশ দুঃখ নাই , আবার তোরা মানুষ হ , ধর্মঘট, মহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে ? উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন, মুখবন্ধ, আমাদের শক্তি স্থায়ী হয় না কেন, কালা আদমীদের গুলি মারো, শ্যাম রাখি না কুল রাখি, জাগরণী, দুর্দিনের যাত্রীর মোরা লক্ষ্মী ছাড়ার দল, তুবরী বাঁশীর ডাক, মোরা সবাই স্বাধীন : মোরা সবাই রাজা, মেয় ভূখা হু , পথিক  তুমি পথ হারাইয়াছ, আমি সৈনিক, রাজবন্দীর জবানবন্দী , লাঙ্গল পলিটিক্যাল তুবড়ি অবাজি, বাঙালীর বাংলা  প্রভৃতি।

(২) শিক্ষাদর্শমূলক : সত্যমিক্ষা, জাতীয় শিক্ষা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (যুগবাণী থেকে)। 
(৩)ধর্মাদর্শমূলক : যুগবাণী-র ছু’ঃমার্গ, রুদ্রমঙ্গল-এর মোহররম মন্দির ও মসজিদ, হিন্দু মুসলমান আমার ধর্ম, সত্যবাণী
 (৪). বিজ্ঞান বিষয়ক : রোজ কেয়াতম বা প্রলয়দিন (যুবাণী), পশুর খুঁটিনাটি বিশেষত্ব, জীবন-বিজ্ঞান। 
(৫). চরিতাদর্শমূলক : যুবাণরি ডায়ারের স্মৃতি স্তম্ভ, লোকমান্য তিলকের মৃত্যুতে বেদনাতুর কলিকাতার দৃশ্য, লাট প্রেমিক আলী ইমাম, দুর্দিনের যাত্রীর স্বাগত, ধূমকেতুর কামাল।
(৬). সাহিত্য ও শিল্প ভাবনা বিষয়ক : যুগবাণী-র বাংলা সাহিত্যে মুসলমান, ধূমকেতু-র বর্তমান বিশ্ব-সাহিত্য বড়র পীড়িতি বালির বাঁধ বর্ষারম্ভে, আমার সুন্দর (ধূমকেতু)। 
(৭). বিবিধঃ যুগবাণীর বাঙালীর ব্যবসাদারী, ভাব ও কাজ, ধূমকেতু-র ভাববার কথা। জননীদের প্রতি, তৃর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা। 
(৮).  অভিভাষণ চট্টগ্রাম বুলবুল সোসাইটি ভাষণ (১৯২৯ খ্রি.)। 
চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটি ভাষণ (১৯২৯ খ্রি.),
 সিরাজগঞ্জ মুসলিম তরুণ সম্মেলনে ভাষণ (১৯৩২ খ্রি.), 
জন সাহিত্য সংসদ উদ্বোধনী ভাষণ (১৯৩৮ খ্রি.), 
কলকাতা এলবার্ট হলে ভাষণ (১৯৩৯ খ্রি.),
 কলকাতা মুসলিম ইন্সস্টিটিউটে শেষ ভাষণ (১৯৪১ খ্রি.)।, ইত্যাদি বহু বিখ্যাত জায়গাতে তাঁর ভাষণ  আলোচিত  হয়েছে।  
  
(৯) পুস্তক-সমালোচনা : স্মৃতি লেখা কাব্য?-খগেন ঘোষ, 
আয়না আবুল মনসুর আহমদ, 
পথ হারার পথ-শ্রী বরদা চরণ মজুমদার, এমন বহু পুস্তকে তিনি তাঁর মন্তব্য লিখেছেন। 
    সম্পাদকীয় ছাড়াও তিনি বিস্তর প্রবন্ধ লিখেছেন তাঁর প্রবন্ধ রচনার তাগিদ অনুভব করেছিলেন দৈনিক নবযুগ (১৯২৩, ১৯৩৫ খ্রি.), অর্দ্ধ সাপ্তাহিক ধূমকেতু (১৯২২ খ্রি.) ও সাপ্তাহিক লাঙ্গল (১৯২৫ খ্রি.) পত্রিকার সম্পাদনা করতে গিয়ে গল্প ও প্রবন্ধ লেখার তাগিদ তিনি রীতিমত অনুভব করতেন ।  
 
  পরাধীন ভারতবর্ষের শাসন-কর্তাব্রিটিশ বেনিয়া সরকারের অত্যাচার অবিচারের লীলাভূমি  তৎকালীন ভারতবর্ষ।  পরাধীনতার শৃঙ্খলে জর্জরিত মাতৃভূমির অসম্মান নজরুলের লেখনী তাই প্রতিবাদে বারেবারে গর্জে উঠেছে। তাঁর রাষ্ট্রাদর্শ ও স্বাধীনতা বিষয়ক (-রাজবন্দীর জবানবন্দী) প্রবন্ধতে লিখলেন ,''আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে এ’ রাজত্বে তা’ হবে রাজদ্রোহ। এ তো ন্যায়ের শাসন হতে পারে না। এই যে জোরকরে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো একি সত্য সহ্য করতে পারে? এতদিন হয়েছিল, হয়তো সত্য উদাসীন ছিল বলে।’' 

  ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে রাজদ্রোহের অপরাধে ধৃত হয়ে ইংরেজ বিচারক সুইনহো-এর আদালতে এ জবানবন্দী দিয়েছিলেন নজরুল। তিনি তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধেই দেশের স্বাধীনতার কথা বিভিন্নভাবে বলবার চেষ্টা করেছেন-;'‘সর্ব প্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোন বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে  আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল কিছু নিয়ম, বাঁধন-শৃঙ্খলা মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।’;- (ধূমকেতুর পথ-রুদ্র মঙ্গল)। ‘ভারত হবে ভারতবাসীর’-এ হল নজরুলের রাষ্ট্রদর্শ ও স্বাধীনতা বিষয়ক চিন্তা প্রবন্ধ গুলোর সারমর্ম। দেশ ও স্বাধীনতার কথা লিখতে গিয়ে তিনি দেশের মানুষের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছেন। কাব্যের মতো প্রবন্ধেও তিনি কৃষক-শ্রমিক মজদুর মানুষের হয়ে সংগ্রাম করেছেন, শোষণহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা দৃঢ়কণ্ঠে গোষণা করেছেন। 

কবি নজরুলের  বিদ্রোহের মূলে স্বভাবগত অকৃত্রিম মানব প্রেম এবং সে প্রেমের প্রকাশ তাঁর অন্তরের নির্দেশানুসারে। কোন বিশেষ মতবাদের ধারায় প্রবাহিত নয়। শুধু স্বদেশেই নয়, বিশ্বমানব গোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি একাত্মতা অনুভব করেছেন  বলেই তাঁর রোমান্টিক কবি-চিত্ত মানুষের নির্যাতন, লাঞ্ছনা, শোষণ প্রভৃতি উচ্ছেদ করতে বিদ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

তাঁর  শিক্ষাদর্শনমূলক প্রবন্ধতে দেখাযায় : যে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিদেশী অনুকরণ সবচেয়ে প্রবল, নজরুল তা বর্জন করতে বলেছেন। তাঁর মতে আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি এমন হউক, যাহা আমাদের জীবন শক্তিকে ক্রমেই সজাগ জীবন্ত করিয়া তুলিবে। যে শিক্ষা ছেলেদের দেহ-মন দুইকে পুষ্ট করে তাহাই হইবে আমাদের শিক্ষা। ‘মেদা-মারা’ ছেলের চেয়ে যে ছেলে ডানপিটে ছেলে বরং অনেক ভাল। কারণ পূর্বোক্ত নিরীহ জীবরূপী ছেলেদের ‘জান’ থাকে না। আর যাহার ‘জান’ নাই সে ‘মোর্দা’ দিয়া কোন কাজই হয় না, আর হইবেও না।''                      -(জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়-যুগবাণী)।
   
শুধু স্কুল কলেজ দাঁড় করলেই চলবে না। সেখানে প্রকৃত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং প্রকৃত শিক্ষা বলতে নজরুল বললেন ‘ ভাবী দেশ সেবকদের স্বজাতি-স্বদেশের প্রতি অনাস্থা শেখানো নয়, তাহারা শিখিবে দেশের কাহিনী, জাতীর বীরত্ব, ভ্রাতার পৌরুষ, স্বধর্মের সত্য.''.।-(সত্য শিক্ষা-যুগবাণী)।
 ধর্মদর্শনমূলক রচনাতে ও  নজরুল  হিন্দু, মুসলমানের পরিপূর্ণ শিলনে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর ধর্ম কবির ধর্ম। শিল্পীর ধর্ম। কোন ভেদ জ্ঞান নয়-সবাই তার আপন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মিল আছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ধর্ম সম্পর্কে বলেছেন -¸My religion is essentially a poet religion. Its touch comes to me through the same unseen and trackless channels as does the inspiration of my music, ¸ religions life has fallowed the same mysterious line of grouth as has my poetrical life. (The religion of an art-Rabindranath Tagore.1953, page 10).

'' নজরুলের সোচ্চারিত কণ্ঠে প্রকাশ করেছিলেন ‘হিন্দু হিন্দু থাক, মুসলমান মুসলমান থাক, শুধু একবার এই মহাগগন তলের সীমাহারা মুক্তির মাঝে দাঁড়াইয়া-মানব!-তোমার কণ্ঠে সেই সৃষ্টির আদি-বাণী ফুটাও দেখি- ‘আমার মানুষ ধর্ম।’;-(ছুগমার্গ-যুগবাণী)। নজরুলের ধর্মাদর্শমূলক প্রবন্ধের এই হ’ল মূল বক্তব্য । ‘নজরুল ইসলাম কোন বিশেষ ধর্মের অনুসারী ছিলেন বলা যায় না। তিনি দেশ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমান উদারতায় ভালবাসতে পেরেছেন।'' (বিচিত্র-চিন্তা-ড. আহমদ শরীফ, ১৯৬৮, পৃষ্ঠা ৪০০)।

বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা নজরুলের বেশি নেই তবে যে ক’টি আছে, তাতে তাঁর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রতুলতা পাওয়া  যায়। তিনি রোজ-কিয়ামত বা প্রলয়-দিন প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘কয়লা-যুগের সময় এই পৃথিবীর বাতাস কার্বলিক এসিডের দরুণ ভারী ছিল। সে সময় সে বাতাস মানুষে সহ্য করিতে পারিত না। কেবল মৎস্য ও সরীসৃপ জাতীয় জীববৃন্দ পূতিগন্ধ ময় জলাভূমিতে নিশ্চল বাতাসে বাঁচিয়াছিল। ক্রমশঃ উদ্ভিদ ও গাছ-গাছরায় বিপুল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঐ বিষাক্ত নিশ্চল বাতাস দূর হইয়া যাইতে লাগিল। আকাশ পরিষ্কার হইল এইরূপে এই বাতাস উষ্ণ রক্তময় জীবের উপযোগী হইয়া উঠিল।’-(যুগবানী)

চরিতার্থমূলক প্রবন্ধ : সাহিত্য জীবনের প্রথম যুগে নজরুল  কামাল-পন্থী ছিলেন। কামাল আতাতুর্কের দেশপ্রেম তাঁকে দেশ উদ্ধারের প্রেরণা যুগিয়েছিল। তাই কামাল প্রবন্ধে দেখা- ‘সত্য মুসলমান কামাল বুঝেছিল যে খিলাফত উদ্ধার ও দেশ উদ্ধার করতে হ’লে ‘হায়দারী হাঁক হাঁকা চাই।’ মানুষের জাতির, দেশের যখন চরম অবনতি হয়, তখন নরপিশাচ জালিমের আবির্ভাব অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড ভারতের ‘গোলাম-কা-জাতকে’ নতুন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে।      

নজরুল তাঁর রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে ‘প্রাণের ধর্ম’ হিসেবে তারুণ্যকে, যৌবনকে বিভিন্নভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তিনি এই বিশ্বাসের ওপর ভর দিয়ে বলতে পেরেছিলেন – ‘আমাদের দেশ নাই, জাতি নাই, অন্য ধর্ম নাই। … প্রাণের ধর্ম আমাদের তারুণ্য, যৌবন। আমরা সকল দেশের, সকল জাতির, সকল ধর্মের, সকল কালের। আমরা মুরীদ যৌবনের।’ নজরুলের এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে আমরা শুধু তাঁর রাজনৈতিক চেতনার কথা নয়, সেইসঙ্গে তার মধ্যে এক বিরুদ্ধতার কণ্ঠস্বরও যেন সেদিন বিশ শতকে শুনতে পেয়েছিলাম।

          
তথ্য সূত্র:    ১) বিশ্বজিৎ ঘোষ /নজরুল জীবন ও সাহিত্য।
২)শিশির কর/ ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই।
৩) ড:রফিকুল ইসলাম/ কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও 
কাজী নজরুল-রচনাবলী (জন্মশতবর্ষ সংস্করণ), (সম্পাদনা-পরিষদ : রফিকুল ইসলাম), বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

২. কাজী নজরুল ইসলাম, ২০১৬। প্রবন্ধ-সমগ্র (প্রথম সংস্করণ : ১৯৯৭), নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

ক্রমশঃ

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJuly 13, 2025

    খুব সুন্দর তথ্য সমৃদ্ধ লেখা, ভালো লাগলো।

    ReplyDelete