চিত্র-শুভম দাস
ট্রায়াল
পুলককান্তি কর
ফোনে কথা বললে বলতে নীলা বলল, ‘পিকলু বাপিকে একটু দে তো!’
- বাপি তো টয়লেটে গেল মাম্মা।
- একটু আওয়াজ দে, বল আমি কথা বলতে চাইছি।
পিকলু একটু থেমে বলল, ‘দাঁড়াও, দরজা খোলার শব্দ পেলাম। বাপি বেরলো বোধহয়!’
ত্রিশ সেকেন্ড পরে হালকা গম্ভীর গলায় প্রলয় বলল, ‘কী ব্যাপার, কী কথা বলবে শুনি?’
- ছেলেটার পড়াশোনা তো গোল্লায় গেছে দেখলাম। যদি ঠিকমতো খেয়াল রাখতে না পারো তো দায়িত্ব নিলে কেন?
- তুমি কি এখন দোষারোপ করার মুডে আছো? তাহলে ছেড়ে দাও এই সক্কাল সক্কাল তোমার গ্যাজগ্যাজানি ভালো লাগছে না।
- ঠিকমতো দায়িত্ব নাও তবে, যাতে আমাকে গ্যাজগ্যাজ না করতে হয়।
- ছেলে সারাদিন বই খুলে বসে থাকে, সব সাবজেক্টে টিউশনি দিচ্ছি - আর কী করতে পারি?
- টিউশানে কী পড়াচ্ছে, ছেলে ঠিক মতো পড়ছে কিনা - সেসব নজরদারিও তো রাখতে হবে!
- আমি যতটুকু থাকি দেখার চেষ্টা করি, এর বেশি সম্ভব নয়।
- তাহলে আর ছেলের কাস্টডি নিয়ে তোমার এত আদিখ্যেতা কেন? পারছো না যখন ছেড়ে দাও, আমি দেখি।
- ছেলে যখন তোমার কাছে থাকতে চায় না, আমি কী করতে পারি? ছেলে সপ্তাহে একদিন করে তোমার কাছে যায় যখন, তখন বুঝিয়ে শুনিয়ে দ্যাখো ও তোমার কাছে থাকতে চায় কিনা! অন্তত পড়াশোনাটুকু ঠিকমতো করছে কিনা সেটাও তো দেখিয়ে দিতে পারো!
- সপ্তাহে একদিন পড়া দেখিয়ে কী হবে?
- তুমি কদিন দেখাতে চাইছো।
- অন্তত তিনদিন।
- তুমি কি এভাবে দখলদারী কায়েম করতে চাইছো?
- আমি জানি তুমি এভাবে কথা বলবে। ছেড়ে দাও, ছেলেকে পাঠানোর দরকার নেই। নীলার গলায় বেশ তপ্ত সুর। প্রলয় খানিকটা সময় নিয়ে বলল, তোমার কাছে গেলে ছেলের যদি পড়াশুনায় উন্নতি হয়, তবে আমার কিছু বলার থাকে না। আমার তো বরং উল্টো মনে হয়, তোমার কাছে গেলে ওর মনের চঞ্চলতা বাড়বে।
- আমার কাছে ওর যখন থাকতে ভালো লাগে না, তখন মানসিক চাঞ্চল্য বাড়ার কোনো কারণ থাকতে পারে বলে তো আমার মনে হয় না।
- বেশ, আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বাকি দুদিন কখন যাবে শুনি? ওই দুদিনও কি শনিবারের মতো তোমার কাছে রাতে থাকবে?
- ইচ্ছে হলে থাকবে, না হলে থাকবে না।
- ওই দিনের টিউশানিগুলো?
- আমার কাছে এলে আর টিউশনের দরকার কী? ছাড়িয়ে দাও। মিছিমিছি টাকা আর সময় নষ্ট করে কী লাভ?
- ঠিক আছে। তোমার সময় আর সুযোগ বুঝে পিকলুকে বুঝিয়ে দাও কবে কবে যাবে, আমার কোনো আপত্তি নেই।
বুকের একেবারে গভীর থেকে মস্ত একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বের হলো নীলার। প্রলয়ের মতো একগুঁয়ে গোঁয়ারগোবিন্দ যে ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে এত সহজে, এটা তার ধারণার অতীত ছিল। প্রলয় কি তবে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে? এবার একটু গলায় নৈর্ব্যক্তিক ভাব ফুটিয়ে নীলা বলল, ‘তুমি আমাদের বিষয়টা এভাবে ঝুলিয়ে রাখছো কেন? এবার তো ডিভোর্সটা দাও’।
- কেন তোমার দ্বিতীয় বিয়ের সুবিধা হবে বুঝি তাতে?
- সেটা আমার ব্যাপার। তোমার তাতে কী যাবে আসবে?
- শোন নীলা তোমার সব খবর আমি রাখি। বয়ফ্রেন্ডের সাথে যতই আসনাই করো না কেন, স্পষ্ট বলে দিও বিয়ের স্বপ্ন যেন না দেখে। তোমাকে ডিভোর্স আমি কোন মর্মেই দেব না।
- এতে তোমার লাভ কী প্রলয়? তোমার এই নন-রিয়েলিস্টিক অবসেসিভ অকুপাইং মেন্টালিটিতে কোন পক্ষের কী লাভ হচ্ছে?
চুপ করে রইল প্রলয়।
- কী হল, চুপ করে আছো কেন? বেশ অসহিষ্ণু শোনালো নীলার গলা। ‘তুমি আজ পরিষ্কার করে বলো।’
- কী বলবো নীলা? তোমার এত কঠিন ইংরাজির মানেই তো বুঝলাম না।
- দখলদারি বোঝ তো? দখলদারি? তোমার ওই দখলদারির মেন্টালিটিটা ছাড়ো।
- দখল আর কী করতে পেরেছি নীলা। তোমার শরীর মনের কোনও দখল কি আর আছে? এর ওর সাথে এখানে ওখানে শুচ্ছ। খবর তো পাই সব।
- 'এর ওর' মানে? মুখ সামলে কথা বল।
- সমস্যাটা কি বহুবচনে?
- শোনও প্রলয়, তোমার সাথে এসব ফালতু কথা আমি আলোচনা করতে চাই না।
- আমি তো আগবাড়িয়ে কিছু বলিনি নীলা। এখনও বলতে চাই না। বারবার এক কথা বলে লাভ নেই। আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে ডিভোর্স দেব না। তুমি যদি কেস-কাছারি করে আদায় করতে পারো করো, নইলে আমি বেঁচে থাকতে তোমায় ডিভোর্স দেব না।
- তাহলে পিকলু কে কি তুমি পাঠাবে না?
- এর সাথে পিকলুর সম্পর্ক কী? তোমার যদি মনে হয় তোমার কাছে পড়লে ওর রেজাল্ট ভালো হবে, তাহলে আমার আপত্তি নেই।
- তুমি যখন ছেলের বিষয়ে এত কনসার্নড, তোমার কি মনে হয় না আমাদের এই ঝুলে থাকা ওর ক্ষতি করছে?
- সেটা তুমি নিজেকে বোঝাও। আমি তো তোমাকে আমার থেকে চলে যেতে বলিনি। ইনফ্যাক্ট তোমার এতকিছুর পরেও তুমি আমার এখানে স্বাগত। ছেলের জন্য তোমার এতখানি দয়া থাকলে একসঙ্গে বসবাস করো।
- হ্যাঁ, তাতে তো তোমারই লাভ।
- তুমি কী মিন করে এই কথাটি বলছো নীলা আমি বুঝতে পারিনি, তবে তোমাকে দুটো বিষয়ে অ্যাসিওর করতে পারি। আমাদের শোওয়ার ঘর এক হবেনা, আর তুমি চাইলে তোমার কারেন্ট অ্যাফেয়ারটি কনন্টিনিউ করতে পারো।
- তুমি কতটা লিবারেল, এটাই কি প্রমাণ করতে চাইছো?
- কার কাছে প্রমাণ করবো নীলা? আমি যাই করি না কেন আমার প্রতি তোমার ধারণা কি বদলাবে? আর তাছাড়া খুব লিবারেল আমি নই। তোমার প্রেমিক পুরুষটির কিন্তু আমার বাড়ির চারপাশে প্রবেশ নেই। আমার বাড়ির আশেপাশে দেখলে কিন্তু ওর হাড়গোড় আস্ত রাখবো না।
- তুমি কি আজকাল গুন্ডামি শুরু করেছো নাকি? ওই তো ল্যাকপেকে চেহারা!
- চেহারাতে কী হয় নীলা? তুমি তো জানোই কুকুর তার নিজের গলিতে শের হয়। আমি ওই কুকুর প্রজাতিই। ভৌ ভৌ করা ছাড়া আমার মুরোদ আর কতটুকু। বাড়িটা যেহেতু পৈতৃক, স্বর্গ থেকে বাবা মা তাদের বাড়িতে বৌমার রাসলীলা দেখবেন - এতটা সহ্য করতে পারবো না বলে একটু বেশি আস্ফালন করে ফেলেছি।
- তোমার মাতৃ-পিতৃভক্তি জেনুইন হলে তোমার দশা কি আর এরকম হতো? ওসব ফালতু কথা ছাড়ো।
- তুমি কি ঘরেও ছেলেটির এন্ট্রি চাইছো? স্যরি ওইটা পারবো না। স্বর্গে থাকা লোকদের কথা বাদ দাও, পিকলুর জন্যও তো ওটা ভালো নিদর্শন হবে না!
- এত কথা কেন হচ্ছে প্রলয়? আমি কোনও অবস্থায় তোমার বাড়িতে ফিরে যেতে চাই না।
- তাহলে আর পিকলুর ভালো-মন্দের দোহাই পেড়ো না ফারদার।
- এবার ১৩ তারিখ কোর্টের ডেট পড়েছে। তুমি কি আবার আগের খেলা দেখাবে নাকি অ্যাটেন্ড করবে?
- উকিল যেমন বলবে তেমন করব। এত আগে থেকে তোমায় বলতে পারব না।
- তোমার সাথে কথা বলা ...! বিরক্তিতে ফোনটা কেটে দিল নীলা।
(২)
ইন্দ্রের ড্রয়িংরুমটায় এলে মনটা ভালো হয়ে যায় নীলার। এত সুন্দর করে সাজানো গোছানো একটা ব্যাচেলার পুরুষ মানুষ কীভাবে মেন্টেন করে জানার খুব চেষ্টা করে নীলা। ও নিজে ভীষণ অগোছালো, প্রলয়ের সাথে এই নিয়ে বিয়ের পরে খুব লাগতো। প্রলয় নিজে বিশেষ গোছানো স্বভাবের নয়, কিন্তু ষোল আনা দাবি করে। এই নিয়ে ভবিষ্যতে ইন্দ্রের সাথেও সমস্যা হবে কিনা ভগবানই জানেন। নীলা এসে দেখল একটা আরাম চেয়ারে বসে ইন্দ্র বই পড়ছে। ও সবসময় কিছু না কিছু পড়ে, এটাও নীলার একটা ভালোলাগার জায়গা। প্রলয়ের সাথে বইয়ের কোনও সম্পর্কই ছিল না। নীলাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে ইন্দ্র বলল, ‘আজ এত দেরি হল?’
- পিকলু এসেছিল সকালে।
- পড়ালে?
- হ্যাঁ।
- ইমপ্রুভ করছে?
- বুঝতে পারছি না। বাড়িতে শাসন না থাকলে বাচ্চা মানুষ হয়? কৌটিল্য বলেছেন না, ‘দশবর্ষানি তাড়য়েৎ।’ দশ বছর হলে বাচ্চাকে কারণে অকারণে শাসন করতে হবে। দরকার পড়লে কারণ তৈরি করে শাসন করতে হবে। তবেই তাকে মানুষ করা যাবে।
- তোমার প্রলয়বাবু কি শাসন টাসন করেন না?
- বাড়িতে থাকলে তো শাসন করবে! সারাদিন তো বাইরে বাইরে, ওটাই কমপেনসেট করার জন্য লাই দেয় প্রচুর।
- লাই দেয় তুমি বোঝো কী করে?
- পিকলুর থেকে যা শুনি, তাই তো মনে হয়।
- এ তো মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি নীলা। তুমি পিকলুর অধঃপতনের কারণ খুঁজতে বসলে যত দোষের গোড়া নন্দ ঘোষের ঘাড়েই সব দোষ ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। এসব হচ্ছে না মানে ওনার তরফেই সব দোষ - এমনটা ভাবলে তোমারই সুবিধে।
- তুমি তো আমার সবটুকু জানো, আমিই বা কী করতে পারতাম।
- তোমার কিছু করতে না পারার পেছনে যে জাস্টিফিকেশন আছে তা তোমার জানা, ফলে ওটাই তোমার অভ্রান্ত মনে হয়, প্রলায়বাবুরও তেমন করে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার মতো জাস্টিফিকেশন আছে।
- জাস্টিফাই করা তো একপ্রকার নিজেকে ফাঁকি দেওয়া, তাতে কি সত্য বদলায়?
- আমরা যাকে সত্য বলছি, সেটা সত্যিকারের সত্য নয় নীলা। সত্য সবসময় এক হওয়া উচিত। আমরা কেবল আপেক্ষিকতার বিচার করি।
- তুমি কি বলতে চাও প্রলয়ের সাথে রোজ রোজ অশান্তি করেও আমার ওর সাথে থেকে যাওয়া উচিত ছিল?
- তোমার অ্যাঙ্গেলে হয়তো উচিত ছিল না, যেমনটা তোমার থেকে শুনেছি। পিকলুর দিক থেকে ভাবলে, নিশ্চয়ই ওটা ঠিক হয়নি। মানিয়ে নিয়েই তোমাকে থাকতে হতো।
- ওঃ! সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার দায় বুঝি মেয়েদেরই?
- এর মধ্যে আবার নারী পুরুষ আনছো কেন নীলা? তোমার বিরুদ্ধে কথা বলছি মানে কি প্রলয়বাবুকে সাপোর্ট করা হলো?
- মানে তো তাই দাঁড়ায়।
- ছাড়ো নীলা, এই নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। তোমার জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব একান্তই তোমার। তোমার যদি মনে হয় যা করেছ বেশ করেছ, তবে সেটাই সই; ভোগ যখন তোমাকে করতে হবে তার কার্যকারণ সবটুকুর দায়ও তোমার - এই নিয়ে অন্যরা কী পক্ষ নিতে পারে বলো!
- তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি, তুমি যদি আমার পক্ষ না নাও আমি কোন ভরসায় এগোবো?
- তোমার পক্ষ নেওয়া মানে কী নীলা? পক্ষ নেওয়া মানে কি তোমার সমস্ত ভাবনায় সহমত হওয়া?
- আমি তো তাই মনে করি।
- আমি তা মনে করি না নীলা। আমার কাছে তোমার পক্ষে থাকা মানে তোমার ভালো মন্দ সবকিছু জেনেও তোমার পাশে থাকা, তোমার সাথে থাকা। আমি তোমার সব অশান্তি জেনেও, পিকলুর কথা ভেবেও তোমাকে সঙ্গী করার কথা ভাবছি। তুমি যদি এখনও সিদ্ধান্ত বদলাতে চাও, সে স্বাধীনতা তোমার আছে।
- মানুষের এত সব সমস্যা – সব চেয়ে বড় জটিল সব সম্পর্ক। এর চেয়ে একা একা বেঁচে থাকাই ভালো।
- কী ধরনের একা থাকার কথা ভাবছো?
- একা মানে একেবারেই একা। আশেপাশে কেউ থাকলে থাকুক, কিন্তু আমার জীবনধারায় তার যেন ছায়া না পড়ে।
- তবে মনখারাপের নির্জনতা কার সাথে শেয়ার করবে?
- মনখারাপ হবে কেন? মনখারাপ তো সঙ্গের লোকজনেরই কারণে।
- নির্জনতারও যে একটা নিজস্ব মনখারাপ আছে!
- ওটা আমি এনজয় করি।
- তুমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'পোকা' গল্পটি পড়েছ?
- মনে নেই। শুনি কোনটা?
- এই যে তোমার মতই একটি মেয়ে, রিক্তা নাম তার। সে এমন একটা শতাব্দীতে বাস করে যখন সভ্যতা অনেক এগিয়ে গেছে। সবই যন্ত্রচালিত - ঘরে রোবট সব কাজ করে, চা ... রান্না ...
- সে তো এখনই করে ইন্দ্র। বাজারে অ্যালেক্সা এসে গেছে তো!
- এসেছে তো শুনি, তোমার চেনা পরিচিত কাউকে ব্যবহার করতে দেখেছ?
- হ্যাঁ। আমার মাসির মেয়ের ফ্ল্যাটে লাগিয়েছে। দরজা খোলা, চা করা - এইসব টুকটাক কাজ সে এখনই করতে পারে।
- তাহলে ভাবো, পঞ্চাশ বছর পরে আমরা কতখানি যন্ত্র নির্ভর হয়ে যাব!
- সে হোক গে, গল্পটা বলো।
- তার সেই সমাজে তোমার সবকিছুই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কন্ট্রোল করে। এমনকি তোমার জৈবিক প্রয়োজনে তুমি আজ রাতে কারোর সাথে শুতে চাইলেও সেটা ঠিক করে দেবে যন্ত্র। সেই মানুষটা কে তুমি চেনো না জানো না - শুধু রাতটুকু ব্যবহার করবে 'নিশিকুটুম্বের' মতো। তোমার নিজের ভেতরের সত্ত্বার কোনো আলাদা অস্তিত্ব নেই- তুমি ভীষণ একা। তুমি ভাবছো তোমার মর্জি মতন তুমি যা চাইছো তাই হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। যখন তুমি একেবারে সত্যিকারের নিজের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাইবে, তখন বুঝবে তুমি আদৌ স্বাধীন নও, তুমি কেবল মানুষের দেহ পাওয়া একটা যন্ত্র বিশেষ।
- গল্পটির ব্যাকগ্রাউন্ডটা বেশ ভালো ইন্দ্র, তবে আমি এখন সেই নির্জনতার ভয় পাচ্ছি না।
- এখন আমাদের সেই অনুভূতির মালুম হচ্ছে না ঠিক, কিন্তু একদিন না একদিন তার মুখোমুখি হতে হবে সবাইকে। সুতরাং যে কদিন বেঁচে আছো, এইসব সম্পর্কের ভালো মন্দ নিয়েই বাঁচো নীলা। তুমি মনে করো তুমি একটা বাসের জানালার পাশে বসে আছো। দ্রুতগতিতে সব দৃশ্যপট পেছনে চলে যাচ্ছে, কিছু ভালো, কিছু মন্দ। তোমার কারুর দিকেই পেছনে ফিরে আবার দেখার সুযোগ যেমন নেই, তেমনি না আছে আগাম কিছু দেখার সুযোগ। যে গতিতে যে দৃশ্যপট তোমার জন্য তৈরি হচ্ছে তুমি তাতেই থাকো।
- তুমি আজকাল বেশ সাধুবাবা টাইপের টক দিতে শিখেছ ইন্দ্র। তোমার সবকিছুতে এত বৈরাগ্য, ভয় হয় সংসারে তুমি থাকবে কিনা!
ইন্দ্র উঠে নীলাকে সজোরে জড়িয়ে ধরল। ‘বৈরাগ্য যে একেবারে নেই, বিশেষ করে তুমি সামনে এসে পড়লে যে আমি পুরোপুরি লোক জগতে থাকি - চলো প্রমাণ করে দি!’
(৩)
জানলার ফাঁক দিয়ে পেছনের বকুল গাছটার দিকে একমনে তাকিয়েছিল নীলা। পিকলু ব্যাগ গোছাতে গোঝাতে বলল, ‘মাম্মা, বাপি তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছে শনিবার তোমার কাছে না এলে চলবে কিনা।’
- কেন শনিবারে কী?
- রোহিতের বার্থডে। রাতের ডিনারে ডেকেছে।
- ডিনার থেকে এখানে চলে আসবি।
- ও মা, অত রাতে আসবো কী করে?
- কেন বাপি এইটুকু দিয়ে যেতে পারবে না?
- তা জানি না। ওইটুকু তো এসে শুয়ে পড়া! তার চেয়ে বরং রোববার সকাল সকাল চলে আসবো। দুপুরে খেয়েদেয়ে ফের বিকেলে চলে যাব।
- তোর কি আমার কাছে থাকতে কষ্ট হয় পিকলু?
- কষ্ট হবে কেন?
- তাহলে কি বাপি এখানে থাকতে মানা করে?
- তা কেন?
- তবে তুই বললি কেন সপ্তাহে তিনদিন আমার কাছে থাকবি না? বহু কষ্টে তোর বাপিকে রাজি করিয়েছিলাম।
- রোজ রোজ বইপত্র এপাশ-ওপাশ করতে অসুবিধা হয়।
- বই এর বাহানা দিসনা পিকলু। পড়ার জন্য বইগুলো সঙ্গে আনছিস। রাত্রে বইগুলো থাকলে কি তোর ঘুমের মধ্যে বেশি বোঝা হয়ে যেত?
চুপ করে রইল পিকলু। একটু পরে জিজ্ঞাসা করল, ‘শনিবার কী করব?’
- তোর যা ইচ্ছে।
- ঠিক আছে তাহলে রবিবার সকালেই আসবো
বুকের মধ্যে অব্যক্ত যন্ত্রণায় এবং তীব্র ক্রোধে যেন হৃদপিণ্ড ফেটে যেতে চাইলো। ও বেশ অনুভব করল পিকলু বেরিয়ে গেল দরজা খুলে। কাজের মেয়েটি বলল, ‘দু কাপ চায়ের জল চড়িয়ে দিয়েছি। আমি চলে গেলাম, খেয়াল রেখো।’ ইন্দ্রের আসার কথা। আজ ওর সাথে একটু মার্কেটিং এ যাবে প্ল্যান করে রেখেছে কদিন আগে থেকে। একটু বাদে ইন্দ্র এল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার নীলা! মনে হচ্ছে এক্ষুনি আগ্নেয়গিরি ফাটবে।’
- সব বেইমান। রাগে গজগজ করতে করতে বলল নীলা।
- কে আবার বেইমানি করল?
- পেটের ছেলে। ন মাস পেটে ধরে এই পরিনাম?
- কী করলো সে?
- আচ্ছা ইন্দ্র, বাপের কাছে কী এমন এক্সট্রা পায় পিকলু, যার জন্য ও আমার কাছে থাকতে চায় না? নির্ঘাত ওর বাবা প্রশ্রয় দেয় আর সমস্ত অন্যায় আবদার মেটায় - ওই জন্যই তো পিকলুর পড়াশুনোর ওই অবস্থা!
- এই নিয়ে মন খারাপ করোনা নীলা। পেটে ধরলেই বাচ্চা নাড়ির টান অনুভব করবে, এমন নয়। কোথাও পিকলু বাবার কাছে একটা ফ্রিডম বোধ করে যেটা তোমার কাছে পায় না।
- বাচ্চাদের ফ্রিডম দিলে সে কি মানুষ হবে? যে তাকে সত্যিকারের ভালবাসবে সে কি তাকে অন্যায় প্রশ্রয় দেবে?
- অন্যায় প্রশ্রয় তো তুমি ভেবে নিচ্ছ নীলা, বিষয়টা তেমন নাও হতে পারে।
- তুমিই তো বললে, ওর বাবা ফ্রিডম দেয়।
- আমি তা বলিনি নীলা। আমি বলেছি পিকলু হয়তো ওর বাবার কাছে একটা ফ্রিডম ফিল করে।তার ফ্রিডম ফিল করা মানে কিন্তু প্রশ্রয় পাওয়া নয়। ওটা একপ্রকার স্বস্তি, একটা আশ্বাস।
- হ্যাঁ বদমায়েসী করলেও বকবে না, মারবে না - এমন ভরসা।
- নীলা তুমি সব কিছুতেই বড্ড হাইপার হয়ে যাও। সব সময় অন্যের ঘাড়ে দোষ ফেলে রিলিফ পাওয়ার মেন্টালিটি ত্যাগ করো। এটা মানুষকে তৎক্ষণিক রিলিফ দেয় বটে, কিন্তু আখেরে ভালো করে না।
- স্বস্তি, আশ্বাসের আর কী মানে হয় ইন্দ্র?
- তুমি নিজের বাড়ির টয়লেটে যতটা ফ্রি, অন্যের বাড়িতে গেলে সেটা ফিল করো না কেন? ওখানেও দরজা বন্ধ থাকে, কেউ এসে তোমাকে টোকা মেরে উত্যক্ত করছে না, কেউ লাইনেও দাঁড়িয়ে নেই বাইরে। যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন - তাও দেখবে তুমি ওখানে স্বস্তি পাচ্ছো না, যতটা স্বস্তি তুমি নিজের বাড়ির টয়লেটে পাও! ব্যাপারটা ওভাবেই দ্যাখো। পিকলু সারা সপ্তাহ ওখানেই থাকে, ওখানেই ওর স্বস্তি পাওয়া উচিৎ।
- আচ্ছা ইন্দ্র, তুমি সত্যি করে বলতো, পিকলু ওর বাবার কাছে সেটল করলে তুমি কি বেশি খুশি হবে? সবৎস্যা গাভীকে কেই বা ভালোবাসে বলো?
- তুমি এতদিনে আমাকে এই চিনলে? আমি সব সময় মনে করি শিশুদের সম্পর্কের বাঁধন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ না করে দায়িত্বের বাঁধনে নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ। তোমার যেটুকু করা উচিত বলে মনে করো, সেটুকুই করো। তার বিনিময়ে কী পাচ্ছ, সেটা মাথায় রেখো না। যাকগে যাক, এবারের ইস্যুটা কী নিয়ে?
- আসছে শনিবার পিকলু আসবে না।
- বেশ তো।
- ‘বেশ তো,’ মানে কী ইন্দ্র? এটা ওর বাপেরই বুদ্ধি। সপ্তাহে ওই একটা দিনই ছেলেটা আমার কাছে থাকে শোয়, সেটাও হড়কে নেওয়ার চেষ্টা।
ইন্দ্র হাসলো। এই কথার উত্তরে বলার কিছু নেই, মায়ের অভিমানও ফেলে দেওয়া যায় না। ও সান্ত্বনা দেওয়ার ঢঙে বলল, চিন্তা করোনা তোমার একা লাগবেনা।
- সারারাত ফোন করবে নাকি? ঝামটে দিল নীলা।
ইন্দ্র একটু হেসে তরল গলায় বলল ‘ফোন করবো কেন? সশরীরে উপস্থিত থাকবো। আপাতত রেডি হও।’
- আসলে রাগটা কেন ধরে জানো? পিকলুর শনিবারের না আসার জন্য অপশনটা তোলাই উচিত ছিল না। ওই যে রাত্রি হলে ওর বাপিকে এ বাড়িতে দিতে আসতে হবে, সমস্যা ওটাই!
- কেন, প্রলয়বাবু তোমাদের বাড়ি আসেন না?
- বিয়ের পর একবারই এসেছে - ওই সবাই যখন বিয়েটা মেনে নিল, সেই সময় একবার। তবে রাতে থাকে নি। সবচেয়ে বড় কথা পিকলু হওয়ার পরও আসেনি। তার কিছু পরে তো আমি চলে এলাম।
- পাড়ারই তো ছেলে, আসেন না কেন?
- কে জানে! ওর হাজার রকমের মুড, হাজার রকমের ইগো, কেন যে আসতো না পরিষ্কার করে বলেনি। মনে হয় বাড়ির অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম বলে বাপি বা মা কিছু বলে থাকবে ওকে - সেই রাগ থেকেই হয়তো।
- এখন তো তোমার বাবা-মা বেঁচে নেই। ওইসব দিনও গেছে, কথাও গেছে ... যাগ গে যাক, রেডি হও। দেরি হয়ে গেল অনেক।
- ফেরার পথে উকিলের চেম্বারে যেতে হবে, মনে আছে তো? আজকের ভিজিট কি তোমাদের এক সপ্তাহ একসাথে থাকার ট্রায়ালটাকে চ্যালেঞ্জ করে?
- ওটাও ইস্যু, আরো কিছু ব্যাপার আছে। চলো, পথে বলা যাবে।
(৪)
গায়ের ওপর থেকে ইন্দ্রকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল নীলা। ইন্দ্র কিছুটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কী হলো?’
- দরজায় টানা কেউ টোকা দিচ্ছে মনে হয়।
- এত রাত্রে কে আসবে? আর তাছাড়া লোকে বেল বাজায়। দরজায় টোকা কে মারে?
- এইতো আবার টোকা দিচ্ছে। তুমি জামা কাপড় ঠিক করো। আমি দেখে আসছি।
কোনওরকমে একটা হাউসকোট জড়িয়ে বাইরে এলো নীলা। বাইরে এসে কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল, 'তুমি?'
প্রলয় ওর আলুথালু বেশ, এলোমেলো চুল, কপালের মাঝখান থেকে সরে যাওয়া টিপ দেখে কিছুটা ইতস্তত করে বলল, ‘স্যরি! অসময়ে এসে পড়লাম। আসলে ...
- কী হয়েছে বলবে তো! গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল নীলা।
- আসলে তো জানোই আমি এসবে ভয় পাই - পিকলুর বোধ হয় হাত ভেঙেছে।
- ওমা! কী করে? খানিকটা উচ্চকণ্ঠে আর্তনাদ করে উঠল নীলা।
- রিক্সাতে রোহিতের বাড়ি থেকে আসছিলাম, একটা বাইক এসে পেছন থেকে ধাক্কা মারল। রিক্সা থেকে পিকলু ছিটকে গিয়ে পড়ল রাস্তায়, হাতটা ফুলে কেমন ঝুলে গেছে।
- পিকলু এখন কোথায়?
উঁচু গলায় কথার আভাস পেয়ে দরজা থেকে উঁকি মারল ইন্দ্র। প্রলয়ের সাথে চোখাচোখি হল তার। ইন্দ্র গলার উৎকন্ঠা কমিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই নীলা। তোমাকে না জানালে আবার বলবে, তোমার মাতৃত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছি না, একতরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। নইলে এত রাতে না বললেই চলতো। তুমি তাড়াহুড়ো কোরো না, আমি এখন অ্যাপোলোতে নিয়ে যাচ্ছি। যদি ভর্তি করে নেয় ভালো, তুমি বরং কালকে টেলিফোন করো, লেটেস্ট খবর জানিয়ে দেবো। সেই মতো তুমি ব্যবস্থা নিও।’
মুহূর্তকাল চুপ করে থাকল নীলা। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তুমি বাড়ি গিয়ে পিকলুর জামাকাপড় গোছাও, আধার কার্ড নাও, আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।’
0 Comments