জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে( অষ্টাদশ পর্ব) /মলয় সরকার

মার্কেজের খোঁজে
( অষ্টাদশ পর্ব)

মলয় সরকার
জিপাকুরা চার্চ


জিপাকুরা লবণের খনি থেকে বেরিয়ে আমরা এলাম জিপাকুরা শহরে, বা গ্রামে দুটোই বলা যায়। বেশ একটা গ্রাম্য ভাবটাই বেশি। রাস্তাঘাট, বাড়িঘর,দোকানপাট আর্থিক দিক থেকে বেশ একটু নিম্নবিত্তের বলেই মনে হল। 
এখানে ড্রাইভার উইলিয়াম এনে দাঁড় করাল এক ক্যাথেড্রালের সামনে, যেটি হল জিপাকুরা ক্যাথেড্রাল। বেশ পুরানো দেখতে। দেওয়ালের প্লাস্টার খসে গেছে , দাঁড়িয়ে আছে সামনে বিশাল ফাঁকা জায়গা নিয়ে এবং এর মাথায় রয়েছে দুটি সুউচ্চ বেল টাওয়ার ,চার্চের দুই পাশে। এটি রোমান ক্যাথলিক চার্চ।সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিঃসঙ্গ দু’ একটি পামগাছ।আর রয়েছে গুটিকতক পায়রা এবং কিছু ছোট ছোট আইসক্রিম বা ফলের রসের গাড়ি। সামনের চত্বরটি পুরোটাই ইঁট দিয়ে বাঁধানো।পাশের বাড়িগুলির চাল প্রায়ই টালির। দূরে দেখা যাচ্ছে উঁচু পাহাড়ের গায়ে প্রেমিকার মত আটকে রয়েছে সাদা মেঘ।আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাল্কা মেঘের ভেলা।
বোতেরোর মোনালিসা

চার্চটি সেন্ট আন্টনী অফ পাদুয়ার প্রতি উৎসর্গীকৃত। ১৯১৬ সালে সমাপ্ত হওয়া এই চার্চটি যদিও বেশি পুরানো নয়, মাত্র ১০৯ বছর, তবু দেখে  মনে হয় যেন, বেশ পুরানো।চার্চের সমস্ত দেওয়ালটাই প্লাস্টার ছাড়ানো। হয়ত নতুন করে প্লাস্টার করা হবে।

 আমরা যখন গিয়ে পৌঁছেছি, তখন বেলা দ্বিপ্রহরের শেষভাগ। লোকজন প্রায় কেউ নেই। সারা অঞ্চল মনে হল দিবানিদ্রায় ব্যস্ত, কোথাও কোন চাঞ্চল্য নেই।
আমরা ধীরে ধীরে ঢুকলাম সেই চার্চের ভিতরে। ভিতরে বিশ্রামরত একজন সাদর আহ্বান জানিয়ে বললেন,আসুন ,আসুন। যান ঘুরে আসুন উপরে। 
ঝকঝকে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আমরা অনেকখনিই ঘুরে দেখলাম। কাঠের পালিশ করা মেঝে ও সাদা রঙের শুভ্র পবিত্র পরিবেশ মনকে শান্ত করে দেয়।এবং সবচেয়ে ভাল লাগে আমাদের এই পরিচ্ছন্নতা ও নিস্তব্ধ পরিবেশ।দোতলা এই চার্চে খুব যে দর্শনীয় কিছু রয়েছে তা নয়, তবে অতিরিক্ত পরিচ্ছন্নতা ও নিঃস্তব্ধতা ছাড়া বারান্দা ঘেরা এই বেশ বড় চার্চে আর কিছুই তেমন মনকে টানল না।
বোতেরোর শিল্পকর্ম

বেরিয়ে এলাম এখান থেকে। এবার আমরা এগোলাম ফিরে চলার পথে। দেখলাম বেশ কিছু, দুই বা তিন কামরার ট্রান্সমিলেনিয়াম বাস ও তাদের স্টেশন।এখানে একটা জিনিস লক্ষ্য করার , তা হল সমস্ত রাস্তাই, শহরের মধ্যে বা বাইরে, প্রত্যেকটিই সোজা; কোন বাঁকাচোরা নেই। আর নেই কোন দেওয়াল কুশ্রীকরণ অর্থাৎ কোন দেওয়ালে আজেবাজে লেখা বা রাস্তায় আমাদের দেশের মত ‘মুখ ঢেকে যাওয়া বিজ্ঞাপন’ নেই। কবি শঙ্খ ঘোষ এখানে থাকলে, কবিতাটা হয়ত লেখাই হত না।দেওয়ালগুলোতে নানা ধরণের ছবি আঁকা রয়েছে বেশ ঊজ্বল রঙে। সেগুলোকে বিকৃত করার কোন চেষ্টা নেই। এই ছবি যেমন শহরের সরু রাস্তার ধারেও দেখেছি, দেখেছি হাইওয়ের ধরেও। এগুলোতে মনে হল যেন শহরের নান্দনিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই শহরটার পিছনেই দাঁড়িয়ে থাকা দূরের আন্দিজ পর্বতমালার পাহাড়ের সারি শহরটাকে এক আশ্চর্য সৌন্দর্য দিয়েছে।৮৬৬০ ফুট উচ্চতায় শহরটা পৃথিবীর সমস্ত উচ্চতম রাজধানীগুলির একটি হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছে। 
 প্লাজাতে পায়রার মেলা

পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে প্রথমেই হাঁটতে হাঁটতে গেলাম এখানকার বিখ্যাত বোতেরো আর্ট মিউজিয়ামে। এখানে রাস্তায় আশেপাশে দেখেছি অনেক ছোটখাট মিউজিয়াম। তবে সব ঢুঁ মারা তো সম্ভব নয়, তাই গেলাম এখানকার বিখ্যাত শিল্পী বোতেরোর ছবির মিউজিয়াম (Museo Botero) দেখতে।
এই বিখ্যাত শিল্পীর পুরো নাম ফার্নান্দো বোতেরো এংগুলো। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯ শে এপ্রিল ১৯৩২এ ম্যাডেলিনে এবং মারা যান মাত্র দু বছর আগে ১৫ই সেপ্টেম্বর ২০২৩ এ।ছোটবেলায় পিতৃহারা এই শিল্পী ছিলেন প্রকৃপক্ষে চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর।তাঁর পৃথিবীজোড়া খ্যাতি তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে এত আপন করে তুলেছে। সারা জীবনে পেয়েছেন প্রচুর সম্মান ও পুরস্কার। তাঁর ছবি ও ভাস্কর্যগুলি মোটামুটি একটু স্থুলকায়।এটিই তাঁর ছবিগুলির একটা বিরাট বৈশিষ্ট্য।নিউ ইয়র্কে তাঁর একটি ছবি বিক্রী হয়েছে ২০২৩ এ ৫১৩২০০০ আমেরিকান ডলারে। এটি একটি রেকর্ড। তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘মোনালিসা’দেখে, যাঁরা দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা দেখেছেন, তাঁদের চোখে ধাক্কা লাগবেই। কিন্তু এই নতুন ভাবে আঁকা মোনালিসা অবশ্যই একটা নতুনত্বের ও নান্দনিকতার দাবী রাখে।আসলে দ্য ভিঞ্চির অনুপ্রেরণায় প্রভাবশালী রেনেশাঁ ও বারোখ শিল্পীদের প্রতি ভালবাসাই এর কারণ।এই শিল্পটি একটি মাস্টারপিস।
🍂

তাঁর স্টিল লাইফ ও ল্যাণ্ডস্কেপগুলি উল্লেখযোগ্য। আমরা কার্তাহেনাতে যে পৃথুলা শয়ান নগ্নিকার মূর্তি দেখেছিলাম, তা এই বোতেরোরই তৈরী ভাস্কর্য।তাঁর আঁকার রঙ, বিদ্রুপ ও সংবেদনশীলতাকে এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে একত্রিত করে যা রূপের ইন্দ্রিয়কে প্রকাশ করে।তিনি ‘ বোতেরিসমো’ শৈলীর প্রবক্তা।
এখানে এসে আমার লাভ হল যে, বোতেরোর সাথে সাথে সেজান, পিকাসো ও অন্যান্য শিল্পীদের ছবিও আবার দেখা হয়ে গেল।আমি বরাবরই বিভিন্ন শিল্পীদের আঁকা ছবি দেখতে পছন্দ করি। আমার মনে হল এখানে এসে বোতেরোকে না দেখলে হয়ত আমার জীবনের একটা বিরাট জিনিস অধরা থেকে যেত। পিকাসোর মিউজিয়াম , মাইকেল এঞ্জেলোর মিউজিয়াম, ভ্যান গখের মিউজিয়াম, ল্যুভ্রে, ফ্লোরেন্সের মিউজিয়ামগুলো ইত্যাদি ছবি তো কম দেখলাম না। তবু যেন আশা মেটে না।বুলবুল তো বোতেরোর  এত ছবি একসঙ্গে দেখে নড়তেই চায় না।একটা ছবির কাছে গিয়ে , দূর থেকে, বিভিন্ন কৌণীক দূরত্বে দেখেও তার আশ মেটে না।বললাম চল, এবার তো যেতে হয়। আসলে, ওকে কি বলব, আমার নিজেরই যেতে ইচ্ছা করছিল না। এই সমস্ত মিউজিয়াম দেখা জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি।
এখানে থাকার ইচ্ছা ছিল আরও অনেক অনেক সময়, তবে আর সময় দেওয়া গেল না। 

 এই মিউজিয়ামে বছরে প্রায় পাঁচ লক্ষ দর্শক আসেন , তাঁদের চক্ষু সার্থক করতে।এখানে ২০০০ সালের পয়লা নভেম্বর থেকে কোন প্রবেশ মূল্য নেই। এখানে বোতেরোর ১২৩ টি শিল্পকর্ম রয়েছে, এছাড়া ৮৫ টি রয়েছে অন্যান্য শিল্পীদের।এখানে রয়েছে বালথাস, সালভাদর দালি, পিকাসো, ক্লদ মনে, হেনরি মাতিস ইত্যাদি শিল্পীদের ছবিও ।এ ছাড়া বোতেরোর অন্যান্য ছবিগুলি রয়েছে কলম্বিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। সেখানে যাওয়ারও ইচ্ছা ছিল, তবে যাওয়ার সময় হবে না।

বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি, মনে হচ্ছে নিউ মার্কেটে ঢোকার আগে হকারদের ভিড়। ভিড়ের চোটে গাড়ি প্রায় চলতে পারছে না। ফুটপাথ বা রাস্তায় বিক্রেতা হকারে একেবারে ছেয়ে আছে।আর কি যে বিক্রী হচ্ছে না বলতে পারব না। বুলবুল বলে, চল, কেনার না হলেও দেখতে দেখতে তো যাই, ভালই লাগছে সব। এগোলাম দেখতে দেখতে প্লাজা ডি বলিভারের দিকে।একটু এগিয়েই বিশাল বড় প্লাজা ডি বলিভার। 
এটি বোগোটার সবচেয়ে বড় এবং প্রথম প্লাজা। এর আগে নাম ছিল প্লাজা ডি মেয়র। এর মাঝে একটি বীর সাইমন বলিভারের ব্রোঞ্জমূর্তি আছে যেটি ১৮৪৬ এ তৈরী হয়েছিল। এটিই বোগোটায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম মনুমেন্ট।
এই জায়গাটি অতীতে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হত, কোন মিটিং,স্পেনীয়দের বিখ্যাত ষাঁড়ের লড়াই, সার্কাস ইত্যাদির জন্য।তবে এই জায়গাটি স্প্যানিশরা তৈরী করে নি , করেছিল এ অঞ্চলের আদিম অধিবাসী মুইস্কারা, যারা পৃথিবীর যে বিস্ময়কর চারটি প্রাচীন সভ্যতা আছে, যেমন ইনকা, মায়া, আজটেক, ওলমা ইত্যাদিদের  সমসাময়িক।পরবর্তীকালে স্প্যানিশরা একে কাজে লাগিয়েছে নিজেদের মত করে।
প্লাজা ডি বলিভারের চার্চ

এখানে এসে দেখি, প্রচুর পায়রা। এত পায়রা আমি একসঙ্গেকোথাও দেখিনি। তারা এত মানুষ ঘেঁষা যে কহতব্য নয়।বুলবুল তো এত পায়রা দেখে ঊচ্ছ্বসিত। এক ভদ্রলোক কিছু বীজ বেচছেন, আসলে তা পায়রাদের খাদ্য। আর দেখি ভদ্রলোকের দুই হাতে কাঁধে মাথায় পায়রারা বসে আছে আর ওনার হাতের থেকে সেই খাবার খাচ্ছে। এটাই ভদ্রলোকের ব্যবসার বিজ্ঞাপন। তাই দেখে অনেকে এই বীজ কিনছে। পায়রারা তাদের হাত থেকেও সেই বীজ , নির্ভয়ে গায়ে মাথায় চেপে, খাচ্ছে।সবাই এই নিয়ে বেশ আমোদ করছে।তাই দেখে বুলবুলও খুব  ঊচ্ছ্বসিত। ও বলে, আমরা কত এরকম বীজ ফেলে দিই ঘরে , এবার থেকে আমিও সব বীজ রেখে দেব ওদের জন্য।আমি হেসে বললাম, হ্যাঁ আমাদের বাড়ির ছাদে তুমি ঐ রকম দুহাত ছড়িয়ে হাতে মাথায় পায়রা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর আমি পাড়ার লোক ডেকে এনে দেখাব। ও হেসে উঠল আমার কথায়।হাসলে ওকে ভালই লাগে, যা অনেক সময়েই আমার কাছে দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়।

ক্রমশঃ-
আপাততঃ আজকের মত বিদায় নিই। বলার রয়েছে অনেক কথা।সঙ্গে থাকুন বন্ধুরা , শোনা যাবে আগামী দিনে।

Post a Comment

0 Comments