জ্বলদর্চি

বকফুল /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৮২
বকফুল

ভাস্করব্রত পতি

“বকফুল, বেগুনের ফুল, কুমড়ো ফুল, এইসব রইল কাব্যের বাহির দরজায় মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে। রান্নাঘর ওদের জাত মেরেছে। কবির কথা ছেড়ে দাও, কবির সীমন্তিনীও অলকে সজনে মঞ্জরি পরতে দ্বিধা করেন। বকফুলের মালায় তাঁর বেণী জড়ালে ক্ষতি হত না। কিন্তু সে কথাটা মনেও আমল পায় না।" 
       -- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'সাহিত্যের পথ' প্রবন্ধ সংকলনের 'সাহিত্যধর্ম' প্রবন্ধতে রান্নাঘরে বকফুলের জনপ্রিয়তা বিধৃত করেছে। আসলে হেঁসেলঘরের অতি পরিচিত সব্জি হল এই বকফুল। প্রাচীন সাহিত্য থেকে বর্তমানের রসনাপ্রিয় খাদ্যরসিকদের কাছে সমীহ আদায়কারী গাছ। ভারতই হল বকফুলের আদিভূমি। তবে কেউ কেউ একে মালয়েশিয়া থেকে আগত বলে উল্লেখ করেছেন। বকফুল পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, আসাম, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, আন্দামান, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, গুজরাট এলাকায় জন্মায়। অন্যান্য গাছের মতো সচরাচর দেখতে পাওয়া না গেলেও যথেষ্ট পরিমাণেই জন্মায়। 

চরক একে উল্লেখ করেছে অবাকপুষ্পী ও বসুক নামেও। এক ভেষজকারের লেখায় আছে --
"মর্মাণি তে বর্মণা ছাদয়সি অগস্তিঃ ত্বা রাজামৃতেন অনুবস্তাম্। 
যত্র কবচং ঊরো বরীয়ো বরুণ স্তে কৃণোতু।"
অর্থাৎ, তুমি অগস্তি, পর্বত ত্যাগ করে বকের মত কুটিল গতিতে তুমি পুষ্প প্রকাশ কর। তোমার কবচ মুক্ত করে মর্তের অমৃত রাজভিষক গ্রহণ করেন। তোমার বক্ষ বরুণের চেয়ে বরীয়ান। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে পাই 'বাকসনা ফুল যেন দুদিকে দশন।' এখানেই অন্যত্র রয়েছে -- 'কুন্দ কুসুম বক বকুল রঙ্গণ।' আবার বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলেও উল্লেখ রয়েছে বকফুলের কথা - 'কেওয়া কেতকী বকফুল।' 

বাংলায় যা বাসনা ফুল বা বক ফুল, সেটাই সংস্কৃতে অগস্তি, অগস্ত্যপুষ্প, বক্রপুষ্প, তেলেগুতে অবিষি, গুজরাটিতে অগথিয়ো, কন্নড়ে অগস্তো, মারাঠিতে অগাস্ত, সিভরি, তামিলে অগতি, হেতিয়া নামে পরিচিত। এই বকফুলকে 'অগস্ত্যপুষ্প' বলার পেছনে খুব সুন্দর কারণ রয়েছে। 

কোনও এক সময়ে দক্ষিণ ভারতের বিন্ধ্যপর্বত ক্রমশঃ উঁচু হ'য়ে বাড়ছিল উপরদিকে। এরফলে দেশের অনেক অংশে জলাধার তৈরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তখন বিপদ বুঝে সবাই শরণাপন্ন হয় অগস্ত্য মুনির কাছে। আবেদন করে বিন্ধ্যপর্বতের বৃদ্ধি থামিয়ে দেওয়ার জন্য। উপর দিকে আর যেন লম্বা হতে না পারে। তখন ভাদ্র মাসের প্রথম তারিখে অগস্ত্যমুনি বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করে দক্ষিণ দিকে যেতে চাইলেন। এবং যাওয়ার সময় বিন্ধ্যপর্বতকে বলে গেলেন যে যতদিন না তিনি ফিরে আসেন ততদিন যেন আর সে মাথা উঁচু না করে। ফলে বিন্ধ্যপর্বত তাঁর বৃদ্ধি থামিয়ে রাখলো। এদিকে আর কখনও অগস্ত্য মুনি ফিরে আসেননি। ফলে আর কখনও বিন্ধ্যপর্বত ঊর্ধ্বগতিসম্পন্ন হয়ে মাথা তুলতে পারেনি। অগস্ত্য মুনির এই যাত্রাই বাংলা প্রবাদে 'অগস্ত্য যাত্রা' নামে খ্যাত। তাই ভাদ্রমাসের প্রথম দিনটিতে দূর দূরান্তে যাত্রা করতে নেই। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রাচীন সংস্কার। মানুষের ধারনা এই দিন কেউ কোথাও যাত্রা করলে আর বাড়ি ফিরে আসে না। যেমন আসেনি অগস্ত্য মুনি। 

যেহেতু বিন্ধ্যপর্বত তাঁর মাথা নামিয়ে অধোমুখী হয়েছিল অগস্ত্য মুনির ফেরার আশায় এবং বকফুলের মাথাও নিম্নমুখী -- তাই ঐ ঘটনার কথা স্মরণ করে এই ফুলের নাম হয়েছে 'অগস্ত্যপুষ্প'। অগকে অর্থাৎ পর্বতকে যিনি থামিয়ে দিয়েছিলেন, অর্থাৎ অবদমিত করে দিয়েছিলেন উপর দিকে বৃদ্ধি হওয়া থেকে, তিনিই অগস্ত্য। 

তাছাড়া সৌর ভাদ্র মাসের সতেরো তম দিনে আকাশে অগস্ত্য নক্ষত্রের উদয় হয়। আর এই দিনেই জলের মলাংশ অধস্থ হ'তে থাকে। আবার এই ভাদ্রমাসের শেষের দিক থেকেই বকফুল ফুটতে শুরু করে। তাই হয়তো বকফুলের অন্য নাম 'অগস্ত্যপুষ্প' হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য। 

'রাজনিঘন্ট'তে মেলে বকফুলের আরও অনেক নাম -- মুণিদ্রুম, ব্রণারি, দীর্ঘফলক, অগস্ত্য, শ্রীঘ্রপুষ্প, অগস্তি,  বক্রপুষ্প, সুরপ্রিয় ইত্যাদি। বকফুলের বিজ্ঞানসম্মত নাম Sesbania grandiflora pers। এটি Fabaceae পরিবারের অন্তর্গত। এছাড়াও আরও কিছু প্রজাতির বকফুলের দেখা মেলে --
Aeschynomene grandiflora Linn
Agati grandiflora Linn
Agati grandiflora var. albiflora 
Coronilla grandiflora Linn
Dolichos arborescens
Dolichos arboreus 
Emerus grandiflorus Linn
Resupinaria grandiflora Linn
Robinia grandiflora Linn
Sesbania mannii 

প্রায় ৩০ ফুট লম্বা হয় বকফুলের গাছ। কাণ্ডের গঠন খুব শক্ত নয়। পাতাগুলো যৌগিক আকারের। অনেকটা তেঁতুল বা আমলকি পাতার মত দেখতে। কিন্তু আকারে আরো বড় হয়। বকফুল দেখতে অনেকটা পলাশ ফুলের মতো। প্রায় ৪ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা এবং সামনের দিকটি একটু বাঁকা। অধোমুখী। ফুলের পাঁপড়ি পাঁচটি। বকফুলকে সিত, পীত, নীল ও লাল এই চার ভাগে ভাগ করেছেন 'রাজনিঘণ্ট'কার নরহরি পণ্ডিত। তবে সাদা রংয়ের ফুলই বেশি দেখা যায়। 
বক ফুলের মধ্যে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, আয়োডিন, থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, পেকটিন, নিকোটিনিক অ্যাসিড, গ্রান্ডিফ্লোরাল ইত্যাদি। বেসন কিংবা চালের গুঁড়ি দিয়ে বকফুলের বড়া ভাজার স্বাদ যে এখনও নেয়নি, সে অনেক কিছুই পায়নি। রান্নাঘরে এটি একটি অতি জনপ্রিয় খাদ্যদ্রব্য। আর অত্যন্ত উপকারী ভেষজ উদ্ভিদ এটি। ঘুসঘুসে জ্বর, এলার্জি, ক্ষয়রোগ, শূলের ব্যাথা, রাতকানা, মৃগি, বুকে সর্দি, বসন্ত, অল্প স্রাব, শুকনো কাশি, বাতরক্ত ইত্যাদি রোগে খুব উপকারী বক ফুল। বক পাতার রস অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এটি লিভারের যাবতীয় রোগ নিরাময় করে। আর রক্তে থাকা ট্রাইগ্লিসারিন, কোলেস্টরল, বিলিরুবিন কমাতে সাহায্য করে। 
'গন্ধরাজ, বনমল্লী, মালতী, বাদাম। 
অশোক, চম্পক, বক, হরীতকী, জাম।।'
    -- দীনবন্ধু মিত্রের 'দ্বাদশ কবিতা'র 'খণ্ডগিরি'

🍂

Post a Comment

0 Comments