জ্বলদর্চি

আশশ্যাওড়া /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৮০
আশশ্যাওড়া

ভাস্করব্রত পতি

...ও দিদি ও ফল খাস নি!
-- দূর আশশ্যাওড়ার ফল কি খায় রে! ও তো পাখিতে খায়---
দুর্গা পাকা ফল টিপিয়া বীজ বাহির করিতে করিতে বলিল - আয় দিকি দ্যাখ দিকি- খেয়ে মিষ্টি গুড় যেন-- কে বলেচে খায় না? আমি তো খেইচি।
অপু কঞ্চি কুড়ানো রাখিয়া দিদির কাছে আসিয়া বলিল -- খেলে যে বলে পাগল হয়? আমায় একটা দে দিকি দিদি--
পরে সে খাইয়া মুখ একটু কাচমাচু করিয়া বলিল -- একটু একটু তেতো যে দিদি
--তা এট্টু তেতো থাকবে না? তা থাক্, কেমন মিষ্টি বল দিকি, কথা শেষ করিয়া দুর্গা খুব খুশির সহিত গোটাকতক পাকা ফল মুখের মধ্যে পুরিল। 
    বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'পথের পাঁচালী'র আম আঁটির ভেঁপু (একাদশ পরিচ্ছেদ) অংশে অপু ও দুর্গার কথোপকথনে রয়েছে এই আশশ্যাওড়ার ফলের কথা। 
আশশ্যাওড়া গাছে গুচ্ছাকারে ফল ধরেছে

পশ্চিমবঙ্গের বুকে এটি পরিচিত আঁশশ্যাওড়া, আশশেওড়া বা আশশ্যাওড়া, দাঁতন, আঁশসর, মটমটি, ভাটিসটি, সটিপাটি, দাঁতমাজন, আঁশটেল, বুচফল ইত্যাদি এবং উপজাতীয় ভাষায় তাতিয়াং (মারমা), হাতিজ্ঞিরা (চাকমা), সি মা সেরে (তঞ্চগা), মোয়াতন (গারো) ইত্যাদি নামে চেনে সবাই। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এটিকে বন নেবু বা বন জামীর‌, মোলটা, চাউল ধোওয়া, সাহোড়া, সিহোড়া, রুপা, গোনজি, কোনজি ইত্যাদি বলে। এর সংস্কৃত নাম আস্যশাখোট। হিন্দিতে বননিম্ব, পোতালী নামেও পরিচিত। ইংরেজিতে বলে Toothbrush Plant, Motar Tree, Tum Berry, Orange Berry এবং Gin Berry। আয়ুর্বেদে একে বলে শাখোট (Streblus asper)।  

আশশ্যাওড়া গাছের আরও বিভিন্ন নাম পাই। বিভিন্ন এলাকায় একে বিভিন্ন নামে চেনে। বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক ভাষায় বন্জামী, বন-জামী, নরসিংদীতে মটকিলা, ফরিদপুরে আইসল, আসাইল, পাবনায় কয়া ফল, বরিশালের দশমিনায় আটালি বলে। এছাড়াও এটি পরিচিত আইসটালি, আইসখলি, আসছড়ি, আইট্টালি, আইডিয়ালি, মৌটাল ইত্যাদি নামেও। এই আসছড়ি গাছের ফল ছোটবেলায় অনেকের কাছে ছিল 'গরিবের আঙ্গুর ফল'। অনেকের শৈশব কৈশোরের সুখের সময় কেটেছে ছোটো ছোটো বনজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে পাকা মটকিলা খুঁজে বের করে। তখন মনের আনন্দে সঙ্গী সাথীদের নিয়ে সেসব ভাগ করে খাওয়ার মজাই আলাদা ছিল। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এই ফল ফটকার গুলি হিসাবে ব্যবহার করতো। আজ অবশ্য বেশিরভাগই জানেনা এই গাছের বৈশিষ্ট্য। নামই শোনেনি অনেকে। 
আশশ্যাওড়া গাছ হাতে এক যুবক

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার এক বর্ধিষ্ণু জনপদ 'দাঁতন' এর নামকরণের পেছনে উদ্ভিদ অনুষঙ্গের খোঁজ মেলে। দাঁতন নামটি একটি উদ্ভিদবাচক গ্রামনাম হতেও পারে বলে গবেষকদের অনুমান। গ্রামবাংলায় পথের ধারে কিংবা খোলা জায়গায় একটি অতি পরিচিত গাছ জন্মাতে দেখা যায়। সেটি আশশ্যাওড়া গাছ। খুবই সাধারণ মানের গাছ। আমরা প্রায়শই দেখে থাকি। আদপে এই গাছটির নরম ডাল ব্যবহার হয় দাঁতন কাঠি হিসেবে। যা মুখ পরিষ্কার করে এবং মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে সাহায্য করে। দাঁতন এলাকায় এই গাছের প্রাধান্য রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই যেখানে দাঁতনকাঠির গাছের প্রসার বেশি, সেটাই মুখে মুখে 'দাঁতন' নামের জন্ম দেওয়া স্বাভাবিক নয় কি?

যাইহোক, ঐতিহাসিক 'দাঁতন' নামটি 'দন্তপুর' থেকে সৃষ্ট না দাঁতন কাঠির গাছ থেকে সৃষ্ট তা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। বিভিন্ন এলাকায় উদ্ভিদবাচক গ্রামনাম যেভাবে সৃষ্টি হয়েছে সেই নিরিখে 'দাঁতন' নামকরণটি সৃষ্টির পেছনে উদ্ভিদ অনুষঙ্গ থাকা মোটেই কষ্টকল্পনা হতে পারেনা।
আশশ্যাওড়ার ফুল, ফল ও পাতা

আশশ্যাওড়ার বিজ্ঞানসম্মত নাম হল Glycosmis pentaphylla। এটি Rutaceae পরিবারের অন্তর্গত। এছাড়াও যেসব প্রজাতি রয়েছে --
Bursera nitida
Chionotria monogyna
Chionotria rigida
Glycosmis arborea
Glycosmis arborea var. linearifoliolata 
Glycosmis chylocarpa 
Glycosmis madagascariensis 
Glycosmis pentaphylla 
Glycosmis pentaphylla var. linearifoliolis 
Glycosmis quinquefolia
Glycosmis retzii 
Glycosmis rigida 
Limonia arborea 
Limonia pentaphylla 
Marignia nitida 
Murraya cerasiformis 
Myxospermum chylocarpum  
Sclerostylis macrophylla 

তবে আশশ্যাওড়ার আরেকটি প্রজাতি রাম দাঁতন (কুমারিকা) গাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম Smilax ovalifolia। এই রাম দাঁতন সম্পর্কে লেখা হয়েছে 'Stemps are good to use as toothbrush to stop several dental problems. The roots are used for veneral diseases. Also applied in rheumatic swellings and given in urinary complaints and dysentery'। 

এটি শাখা প্রশাখা যুক্ত গুল্মজাতীয় একপ্রকার ছোট উদ্ভিদ। গ্রামের রাস্তার দুই ধারে, শ্মশানে, জমির আলপথে, অব্যবহৃত জায়গায়, খামারে, পুরনো দেওয়ালের ইটের খাঁজে, পুকুর পাড়ে, নদীর ধারে, ঘন ঝোপের আড়ালে, পোড়ো জমিতে জন্মায়। মোটামুটি এই গাছ ৩ - ৪ ফুট লম্বা হয়। কাণ্ড বেশ শক্ত এবং ধূসর রঙের হয়। এই গাছের চারা বীজ থেকে জন্মায়। সবুজ পাতাগুলি বেশ চকচকে, পাতলা, একপক্ষল এবং উপবৃত্তাকার। অনেকটা কালোজাম গাছের পাতার মতো। পাতার দৈঘ্য ৩ - ৪ ইঞ্চি। মাঝ বরাবর প্রস্থ ২ - ২.৫ ইঞ্চি। এর পাতা স্বাদে তিক্তরসান্বিত। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা এই পাতা দিয়ে বাঁশি বানাতো। ফুলগুলি খুব ছোট, সবুজাভ সাদা রঙের এবং হালকা মিস্টি গন্ধের। মঞ্জরি বহুপুষ্পক। কাঁচা ফল সবুজ রঙের। আর পাকলে পাটল রংয়ের হয়। প্রতিটি থোকায় ছোট গোল আঙুরের মতো ২০ - ৫০ টি পর্যন্ত ফল থাকে। সাধারণতঃ নভেম্বর মাসে ফুল ও মার্চ মাসে ফল হয়।
মসৃন চকচকে পাতা

আশশ্যাওড়া গাছের মধ্যে পাওয়া যায় Furoquinoline Bases (Kokusaginine, y-Fagarine এবং Skimmianine); Alkaloids (Arborine, Arborinine, Glycosine, Glycosamine, Glycosminine, Glycosmicine, Glycorine এবং Glyborine); Triterpenes (arborinols A, B এবং Myricyl Alcohol); Sterols (3-Sitosterol এবং Stigmesterol); Sugars 2.1%; a Phlo Baphene এবং Tannin। 
কুঁড়ি

দাঁতনকাঠি হিসেবে বিশেষ খ্যাতি আছে এই গাছের। এছাড়া জ্বর, জন্ডিস, পিত্তবৃদ্ধি, বাত, হাঁপানি, চুলকানি, গাত্রদাহ, বয়োব্রণ, বগলের ঘাম, কফ, অজীর্ণ ইত্যাদি সারাতে গ্রামের মানুষ ব্যবহার করেন। এই গাছের পাতার ক্বাথ জ্বরে, যকৃতের পীড়ায় এবং ক্রিমির উপদ্রব কমানোর ক্ষেত্রে খুব উপকারী। আশশ্যাওড়ার কাঁচা শেকড় ১০ গ্ৰাম বা শুকনো শেকড় ৫ - ৬ গ্ৰাম এবং ভূঁইআমলার কাঁচা অথবা শুকনো শেকড় ৫ গ্ৰাম বা ৩ - ৪ গ্ৰাম, সঙ্গে ৩ - ৪ টি গোলমরিচ একত্রে সামান্য পান্তাভাতের আমানি সহ বেটে প্রতিদিন সকালে খালিপেটে খেলে সাতদিনের মধ্যে লিভারঘটিত সমস্ত রোগ কমে যাবে। 
কাঁচা ফল

এই দাঁতন বা আঁসঠালি বা আশশেওড়ার ফল কিন্তু বিষ নয়, তবে বেশি খেলে গা বমি বমি করে, পেটখারাপ‌ও হতে পারে। হাতির দাঁতের ওপর জমে থাকা দন্তমল পরিষ্কার করার জন্য এই আশশ্যাওড়া গাছের ডাল ব্যবহৃত হয়। সম্পূর্ণ নিরাপদ ও প্রাকৃতিকভাবে ফল পাকাতে আশশ্যাওড়া গাছের পাতা দিয়ে ফলের 'জাঁক' দেওয়ার প্রচলন আছে। কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন -- 
"ডাইনির মতো হাত তুলে তুলে ভাঁট আঁশশ্যাওড়ার বন বাতাসে কি কথা কয় বুঝি নাকো...."।

🍂
ad

Post a Comment

0 Comments