জ্বলদর্চি

মধুবাবুর একদিন /কমলিকা ভট্টাচার্য

মধুবাবুর একদিন 

কমলিকা ভট্টাচার্য 

বাজার থেকে ফিরে মধুবাবু বাজারের থলিটা আস্তে করে দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে রাখলেন। তারপর সোফায় গিয়ে বসলেন। কল্যাণী দেবী রান্নাঘরে কিছু একটা করছিলেন। হাওয়ার গতি তাকে একটু চিন্তিত করল। অন্যদিন মধুবাবু বাজার থেকে ফেরেন ঝড়ের মতো, সঙ্গে করে উড়িয়ে আনেন আশেপাশের ফুল পাতা ধুলো  সবকিছু। মানে কল্যাণী দেবীর জন্য মধুবাবু হলেন পাড়ার নিউজ পেপার। আর বাজার থেকে ফেরার পর এই টাইমটি হল কল্যাণী দেবীর জন্য নিউজ শোনার সময়। আজ তাই এইরকম চুপচাপ মধু বাবুকে দেখে কল্যাণী দেবী একটু অবাক হলেন।
তাই মধুবাবু বলার আগেই এক কাপ চা বানিয়ে মধু বাবুর পাশে,সোফায় এসে বসলেন। 
মধুবাবু ততক্ষণে অন্যমনস্কভাবে খবরের কাগজের পাতাটা উল্টে দেখছিলেন। কল্যাণী দেবী চা টা এগিয়ে দিয়ে বললেন,"তোমার চা, কিছু বলছো না যে ,হঠাৎ কি হল?"
মধুবাবু চায়ের  কাপে একবার চুমুক দিয়ে বললেন"কাল থেকে তুমিও আমার সঙ্গে বাজারে এসো।"
এবার একটু বিরক্ত হয়ে কল্যাণী দেবী বললেন "মানে? এখন কি এই দোকান বাজার করার কাজটাও আমাকে দিয়ে করাতে চাও।"

মধুবাবু শান্তভাবে বললেন "আজ বাজারে সন্ধ্যার সঙ্গে দেখা, দেখা বললে ভুল হবে, বাজার থেকে জিনিস কিনেছে তারপর ব্যাগটা রেখেই চলে এসেছে ,দোকানের ছেলেটি আমার হাতে ব্যাগটি দিয়ে বলল "আঙ্কেল উনি ব্যাগটা ভুলেই চলে যাচ্ছেন, ওনাকে একটু এগিয়ে ব্যাগটা দিয়ে দিন না".আমি তাই ব্যাগটা একটু এগিয়ে দিতে গিয়ে দেখি সন্ধ্যা, বিশ্বাস কর দেখে প্রথমে আমি ওকে চিনতেই পারিনি। চোখে মুখে কালি পড়ে গেছে,কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাব। আমাকে দেখে বিশেষ কিছু বলল না খালি জানতে চাইল আমরা  কেমন আছি ,তারপর আর কথা না বাড়িয়ে শান্ত পায়ে আগে হেঁটে চলে গেল । ওকে দেখে মনে হচ্ছিল সত্যিই যেন অসময়ে সন্ধ্যা নেমেছে আমি তাই আর সাহস করে জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না কেমন আছে। "

কল্যাণী দেবী বলে উঠলেন "অখিলেশদার এইভাবে হঠাৎ করে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারিনি, আমরাও কি পেরেছি বল?"
🍂

"তোমার মনে আছে কল্যাণী গত বার পিকনিকে অখিলেশ আর সন্ধ্যা বেস্ট কাপল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিল, তখন তুমি কত রাগ করে বলেছিলে আমি নাকি চোখ খোলা অবস্থাতেও  পাঁচ জন মহিলার মাঝে তোমায় চিনতে পারবো না আর চোখ বেঁধে কি করে চিনবো, 
তখন অখিলেশ মজা করে বলেছিল বউকে দিয়ে রোজ হাত পা টেপা, তাহলেই চোখ বন্ধ করে একবারই কার হাত বুঝতে পারবি। সব সময় মজা করত। 

তুমি জানো কল্যাণী!, স্কুলে টিফিনে রোজ ও একটা করে মিষ্টি নিয়ে আসতো কিন্তু কোনদিন খেতো না ,আমায় দিত বলতো ওর মিষ্টি নাকি একদম ভালো লাগে না। 
পরে একদিন ওর জন্মদিনে ওর বাড়িতে গিয়ে জেনেছিলাম ও মিষ্টি খেতে ভীষণ ভালোবাসে। ও জানতো আমি মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসি কিন্তু রোজ মিষ্টি খাওয়ার বিলাসিতা করার মত স্বাচ্ছন্দ্য আমাদের সংসারে ছিল না।

পড়ালেখায় ও ছিল দুর্দান্ত। সব সময় প্রথম হত আর তারপর আমি।
কলেজে বৃত্তি পরীক্ষার দিনের কথা আজও আমার মনে পড়ে। বৃত্তি পরীক্ষার সকাল বেলায় আমাদের দুজনের একসঙ্গে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার কথা ছিল। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে হঠাৎ করে বলল তুই বেরিয়ে পর আমি একটা জরুরি কাজ সেরে আসছি। 
পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি ওর জন্য অপেক্ষায় থেকে গেলাম ও এলো না।পরীক্ষা শেষ হলে ফিরে এসে দেখি ও পুকুর ধারে বসে একটা একটা করে ঢিল জলের ভেতর ফেলছে। আমাকে দেখেই তাড়াতাড়ি করে উঠে এলো। বলল "আরে পরীক্ষা কেমন হলো?" আমি বললাম "ভালো ,তুই কেন আসিসনি পরীক্ষা দিতে? "ও হেসে বলল "আরে যাব বলে সবে ভাবছি বিড়ালটা রাস্তা কেটে দিল ,তুই তো জানিস আমি আবার এসব কুসংস্কার খুব মানি।"
কিন্তু জানো কল্যাণী ও সেদিন আমার জন্যই পরীক্ষা দিতে যাইনি। ও জানতো ও পরীক্ষা লিখলে ঐ ফাস্ট আসতো আর বৃত্তির টাকা একজনই পেত। 
মধু বাবুর গলা ধীরে ধীরে ভারী হচ্ছিল। উনি উঠে গিয়ে জানলার ধারে দাঁড়ালেন। 

কল্যাণী দেবী চায়ের কাপগুলো রান্নাঘরের বেসিনে রেখে মধু বাবুর পাশে জানলার ধারে এসে দাঁড়ালেন। বললেন "আজ আমি আর খোকন যে বেঁচে আছি তাও তো অখিলেশদার জন্যই। তুমি অফিসে জরুরী কাজে বাইরে ,আমার যখন লেবার পেইন উঠলো, এই অজানা শহরে কাউকে জানা নেই, অসম্ভব বৃষ্টিতে পুরো শহর ভেসে যাচ্ছে,কোন গাড়ি নেই ,কোন অ্যাম্বুলেন্স আসছেনা ,তখন রিকশায় আমাকে তুলে সেই রিকশা নিজে টেনে আমাকে হসপিটালে পৌঁছেছিলেন। তারপর সেই রিক্সা নিয়ে গিয়ে ডাক্তারকেও তার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলেন। ডাক্তার বলেছিলেন ,সেদিন আর একটুও দেরি হলে বেবি আর মা কাউকেই বাঁচানো যেত না।"

"কিন্তু দেখো কল্যাণী অখিলেশ কে আমরা ফিরিয়ে আনতে পারলাম না,
যেদিন ওর স্ট্রোক হল সবাই মিলে যখন ওকে হসপিটালে নিয়ে গেলাম অপারেশন থিয়েটারে ঢোকাবার আগেও যখন নার্স সাদা চাদরটি ওর বুক পর্যন্ত টেনে দিচ্ছিল তখন ঐ নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যেও ও আমাদের সবার চিন্তা ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল " ও সিস্টার তুমি একটু দাঁড়িয়ে যাও একটু বাদে না হয় একেবারে মাথা পর্যন্ত টেনে দিও।"
নার্স একটু হকচকিয়ে গেলেও ,আমরা সবাই হেসে উঠলাম বললাম "তোর এই অবস্থাতেও মজা করতে ইচ্ছে করছে।" ও হাসতে হাসতে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে গেল আর যখন বেরোলো তখন ওর পুরো শরীরই সাদা চাদরে ঢাকা। সেদিনও পরে বুঝেছিলাম চলে যাবার আগে ও আমাদের হাসি মুখটা দেখতে চেয়েছিল। ও চিরকাল জিতে গেল আর আমরা গো হারান হেরে গেলাম....."

দরজায় বেল বাজলো। কল্যানী দেবী আঁচলের খোঁটে চোখের কোণ মুছে দরজা খুলতে গেলেন। মধুবাবু জানলার বাইরে দিয়ে পার্কে খেলতে থাকা দুটো বাচ্চা ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

কল্যাণী দেবী দরজা খুলে দেখলেন পিওন এসেছে একটা পার্সেল দিতে। পার্সেলটি আর কিছু নয় একটি  অ্যানুয়াল ম্যাগাজিন। এই ম্যাগাজিনে অখিলেশ বাবু নিজের লেখা দিতেন, ওনার লেখার হাত ছিল অসাধারণ। ওনার উৎসাহতেই প্রতি মাসে ওনার বাড়িতেই সাহিত্য সভার আয়োজন হতো। সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে বেশ একটা ঘরোয়া আড্ডা , গান বাজনা খাওয়া-দাওয়া,হাসি ঠাট্টা সব মিলিয়ে একটা জমজমাটি সন্ধ্যা। 
আর তার মাঝে সন্ধ্যার গান সেই আড্ডার আসরকে প্রাণবন্ত করে রাখত। আজ প্রায় এক বছর হতে চলেছে অখিলেশ বাবু চলে গেছেন, তারপর থেকে সাহিত্য সভার জন্য কেউ সেরকম ভাবে আর আগ্রহ দেখায়নি কিছুটা  দোনামনা আর বেশি টাই নিজেদের জন্য নিজেদের ব্যস্ততা।

কল্যাণী দেবী ম্যাগাজিনটি নিয়ে গিয়ে মধু বাবুর হাতে দিলেন। তারপর দুজনেই পার্কের মাঠে  খেলতে থাকা বাচ্চাগুলোর দিকে একভাবে চেয়ে রইলেন। ওদের হুড়োপাটি চিৎকার হাসির আওয়াজ ঘর পর্যন্ত ভেসে আসছিল।
মধুবাবু এবার বলে উঠলেন"কল্যাণী দেখো কি অদ্ভুত ব্যাপার আজই এই ম্যাগাজিন টা আমাদের হাতে এলো ,এতে অখিলেশের লেখা লাস্ট কবিতা ছাপা হয়েছে....."
মধুবাবু আবার জানলার বাইরে তাকালেন, একরাশ অনুশোচনা ওনাকে ভিতর থেকে ওলট-পালট করছিল।
কিছুক্ষণ পর
কল্যাণী দেবী ঘুরে মধু বাবুর মুখের দিকে তাকালেন,তারপর বললেন," হ্যাঁ গো, আমরা সাহিত্য সভাটা আবার শুরু করতে পারি না?"
মধুবাবু পরম তৃপ্তির সঙ্গে বলে উঠলেন"আজকে আমি তোমাকে বেস্ট কাপল অ্যাওয়ার্ড  দিচ্ছি,আমার মুখের কথাটা তুমি কেড়ে নিলে। যে অখিলেশ সবার জন্য সব সময় করেছে ,সবার ভালো চেয়েছে ,সবাইকে খুশি রাখতে চেয়েছে, আর তার ভালো লাগার মানুষটির জন্য আমরা এইটুকু করতে পারব না।"
কল্যাণী দেবী বললেন" আমি অনিন্দিতা ,কৃষ্ণা ,সঞ্জয় সুধীর সবাইকে ফোন করে ব্যবস্থাটা করে ফেলি, তুমিও বাকিদের ফোন করে বলে দাও আগামী রবিবার আমরা সবাই অখিলেশদার বাড়িতে মিলছি।"

পরের রবিবার সন্ধ্যায় অখিলেশবাবুর বাড়ি জমজমাট, সেদিন সন্ধ্যায় সন্ধ্যার মুখে গোধূলির লালিমা না থাকলেও মুষলধারা বৃষ্টির পর ধুয়ে যাওয়া প্রকৃতির স্বচ্ছতা ওর দুচোখে। সবাই মিলে অনেক অনুরোধ করার পর সন্ধ্যা দেবী গান ধরলেন ,আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে, বসন্তের বাতাসটুকুর মতো......সে চলে গেল বলে গেল না.......

মধুবাবু দেখলেন অখিলেশের ফটোর উপর থেকে রজনীগন্ধার মালাটা যেন সরে গেছে , অখিলেশ সোফার উপর বসে মুগ্ধ হয়ে সন্ধ্যার গান শুনছে,মুখে লেগে আছে ওর সেই চিরাচরিত হাসি....

Post a Comment

9 Comments

  1. AnonymousJuly 30, 2025

    ভালো লাগলো ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. কমলিকাJuly 31, 2025

      ধন্যবাদ

      Delete
  2. AnonymousJuly 31, 2025

    খুব সুন্দর।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কমলিকাJuly 31, 2025

      ধন্যবাদ

      Delete
  3. ভাস্কর সেনJuly 31, 2025

    'শেষ হয়ে হইল না শেষ'...এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কমলিকাJuly 31, 2025

      মধুবাবুর গল্প তো শেষ হয়নি। চলবেই ..
      ধন্যবাদ

      Delete
  4. AnonymousJuly 31, 2025

    ভীষন ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  5. AnonymousJuly 31, 2025

    বর্ষায় মধুগুলগুলি আম

    ReplyDelete
  6. AnonymousJuly 31, 2025

    খুব ভালো লাগলো 🥰🥰

    ReplyDelete