গুচ্ছ কবিতা
কমলিকা ভট্টাচার্য
শেষ পাঠক
মনে পড়ে সেই বিকেলগুলি,
যেখানে শব্দেরা হাঁটতো ধীরে ধীরে,
বইয়ের পাতায় ঘুমিয়ে থাকতো কৌতুহল
তাদের জাগিয়ে তুলতাম নিঃশব্দে।
জানলার ধারে রাখা থাকতো
এক মলিন মোটা বই,
প্রতিটি পাতায় যেন সময়
একটানা গড়িয়ে চলতো
নদীর প্রবাহের মত।
বই পড়া তখন শুধুই অভ্যাস নয়
একটা ধ্যান,
একটা মনস্তাত্ত্বিক আশ্রয়,
একটা আত্মদর্শনের চুপচাপ সিঁড়ি।
আমার চুপচাপ কান্না,
প্রথম ভালোবাসা, বাবার ধমক
সব কিছুই পাতার ফাঁকে গলে গিয়ে
পেয়েছিলো আশ্রয়।
সেই সব লেখকেরা
আমার চেয়েও বেশি চিনতো আমায়,
তাদের বাক্যে ছিলো ছায়া,
আমার নিজের ছায়াও তাতে মিশে যেত।
কিন্তু এখন
বইয়ের পাতা খুলতে গিয়ে দেখি
আঙুল পেছলে যায় স্ক্রিনের অভ্যাসে।
চোখ আর ধৈর্য একে অপরের কাছে অপরিচিত।
এখন বইমেলা হয়,
তবে কাগজের গন্ধ নেই,
ছবি তোলার ভিড় আর সেলফি তুলতে তুলতে
বইগুলো দাঁড়িয়ে থাকে চুপ।
মানুষ আর গল্প পড়ে না,
মানুষ এখন শুধু খুঁজে বেড়ায়
উপসংহার, তারিখ, হেডলাইন,
অথচ জীবন—সে তো এক দীর্ঘ অনুচ্ছেদ।
আমরা হারিয়েছি বই নয়
হারিয়েছি ভাবনার গড়ন,
নীরবতার সাহস,
হারিয়েছি আত্মার ভাষা।
এখন কেউ আর রাতে আলো জ্বেলে পড়ে না,
তাদের বালিশে আর গল্প জমে না,
তারা ঘুমিয়ে পড়ে ক্লান্ত স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে
বইয়ের খোলা পাতায় তবে কি জমছে অপেক্ষা শেষ পাঠকের?
🍂
ছাড় নেই জীবনে
চেখে চেখে সব সুখ,
শেষে জমে একরাশ দুঃখ
আনন্দ যেন রসিদের হিসেব,
প্রতিটি মুহূর্তে চলে তার নিঃশব্দ ক্ষতিপূরণ।
যত বাড়ে ভোগের তালিকা,
ততই ক্ষয় হয় অস্তিত্বের সঞ্চয়।
জমে না কিছুই
অন্তরের গভীরে শুধু ক্রমাগত ক্ষয়।
সব কিছুতেই খরচ
হাসি, নিঃশ্বাস, প্রার্থনা, প্রেম,
শুধু ছাড় পাওয়া যায়
নিন্দা আর পরচর্চার সস্তা অভ্যাসে।
এই সভ্যতার শপিং মলে
চেতনা বিকোয় উঁচু দামে
আর আত্মা?
তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে বহু আগেই
শুধু পড়ে আছে কিছু দোনামনা।
এ জীবন এক অফারহীন যাত্রা,
যেখানে প্রতিটি খুশির পেছনে ব্যয়
এক চুমুক কফির সঙ্গে
নেমে আসে অপরিচিত বিষাদের ছায়া।
খরচের খতিয়ানে
যতই লিখি অস্থায়ী সুখের গল্প,
শেষ হিসেব কষলে দেখা যায়
লাভ-ক্ষতির তফাৎ প্রায় শূন্য।
যেখানে সম্পর্কের বিনিয়োগে ছিল অনাসক্তি,
সেখানে জমেছে কেবল বস্তুতান্ত্রিক বুদবুদের হিসাব।
ভুল খরচে ভরে গেছে জীবন
আর মন ছুঁয়ে যাওয়ার যেই মুহূর্ত ছিল,
তা ফুরিয়ে গেছে নিঃশব্দে...
ঠিক যেন লালচে সন্ধ্যায় মিলিয়ে যাওয়া কোনো বিস্মৃত রোদের মতো।
তবু, তবু, জীবন সত্যি রোদের মতো,
ভোরেরের কুয়াশায় জমে ওঠে ভালোবাসার কণা।
আবার গলে যায়, উবে যায়, বাষ্প হয়ে ঝরে পড়ে
এই চক্রাকারে ঘোরে, চলে জীবনের হিসেবহীন পথ।
নির্বাসনের খরচ পেরিয়েও
হঠাৎ দেখা দেয় ছেলেবেলার কোনো চেনা পাখি
যার ঠোঁটে ঝুলে থাকে নিঃশর্ত কিছু নরম সুখ।
জীবন যদি অফার না-ও দেয়,
তবু কিছু মুহূর্ত থেকে যায়
যা হিসেবের বাইরের মুনাফা হয়ে বেঁচে থাকে,
ভিতরে ভিতরে শান্তির মতো।
আশ্রয়
আশ্রয় খুঁজে ফেরে ভেজা আহত পাখি
দিগন্তে রামধনু ভেঙে উড়ে যায় মেঘ
সেই মেঘে হারিয়ে যায় ডানা ঝাপটানো কষ্ট
বোবা গাছের পাতায় লেখা সত্যি
ঝরে যায় সময়ে
কাঠগড়ায় সাক্ষী দিতে হাজির শূন্যতা
বার বার শুনানির ডাক
ক্লান্ত ডানায় রোজ মরতে থাকে ইচ্ছে
বেলে ছাড়া পায় ভ্রম
করুণার বৃষ্টি ভেজাতে পারে না ডানা
কোনো রাত জাগে না তার জন্য নিঃশব্দে পালক ঝরে পড়ে
জন্ম নেয় প্রতিদিন আত্মপরিচয়ের নতুন ধ্বংসাবশেষ
ঘুমিয়ে থাকা দেহে জেগে থাকে কাঁপন
আড়াল করে রাখা ব্যথার কোনো ডাকনাম নেই।
অন্তর্গত যন্ত্রণা এক এক করে খুঁটে খায় ডানা
ঘুর্ণিতে ছিঁড়ে যায় হাওয়ার সমস্ত শর্ত
আর শূন্যতা—সে তো একমাত্র বিশ্বস্ত ঠাঁই
যার বুকেই জায়গা হয় সমস্ত বিসর্জনের
যেখানে কেউ চায় না কিছু, কেউ রাখে না হাত
তবু বেঁচে থাকা এক পাঁজরভাঙা পাখির
একটানা উড়ে যাওয়া
নিরন্তর পতনের ভিতরেও
শুধু না পড়ে যাওয়ার ক্ষমতাই
1 Comments
তিনটে কবিতাই ব্যথাতুর। এক অচেনা কষ্টে মন ভরে ওঠে।
ReplyDelete