ত্রয়োদশ পর্ব
প্রসূন কাঞ্জিলাল
ম য় দা ন ব ---
ব্যাসদেব রচিত মহাভারতের আদিপর্বের এই কাহিনীতে দেখা যায় যে, একদিন যমুনার তীরে থাকা এক শুভ্র উপলখণ্ডে উপবিষ্ট হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন নিজেদের মধ্যে বাক্যালাপ করছিলেন। সাথে চঞ্চলা যমুনার শব্দে বারবার তাঁদের মন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিল। ঠিক এমনি সময়ে অশীতিপর ও শীর্ণদেহের একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এই ব্রাহ্মণের মাথায় ছিল ত্রিজটা, তাঁর চক্ষুদ্বয় ছিল পিঙ্গলবর্ণ, এবং তাঁর গায়ের রং ছিল তপ্তকাঞ্চনের মত। তিনি কোন ধরণের ভূমিকা না করে তাঁদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠেছিলেন —
‘হে যদুকুলশ্রেষ্ঠ এবং পাণ্ডবকুলগৌরব, দয়া করে অনাহারক্লিষ্ট এই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের ক্ষুন্নিবৃত্তির উপযুক্ত ব্যবস্থা করুন। আমি আর ক্ষুধার জ্বলা সহ্য করতে পারছি না।’
কিন্তু তাঁর একথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ কোন প্রত্যুত্তর করেননি, তিনি শুধু যমুনার প্রবাহমান জলস্রোতের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হেসে গিয়েছিলেন।
অন্যদিকে অর্জুন প্রথমে ব্রাহ্মণের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিলেন, আর তারপরে তাঁকে বলেছিলেন—
‘কী প্রকার খাদ্যে আপনার রুচি বলুন। যদি বলেন তাহলে অনতি-বিলম্বে আমি পৃথিবীর সমূহ সুখাদ্য আপনার সামনে উপস্থিত করব।’
🍂
একথা শুনে ব্রাহ্মণ তাঁকে গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন —
‘আগে কথা দাও যে, তুমি আমার ইপ্সিত খাদ্য আমাকে প্রদান করবে।’
তখন বিস্মিত অর্জুন তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন —
‘আপনি কে ব্রাহ্মণ, যিনি সামান্য খাদ্যের জন্য আমাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে বলছেন ? আপনি কি চান ? আমি কথা দিলাম, যত দুঃসাধ্যই হোক না কেন, আপনার অভিলাষিত খাদ্য আমি আপনাকে প্রদান করবই।’
এতে ব্রাহ্মণের মুখে হাসি ফুটেছিল। এরপরে তিনি প্রথমে কৃষ্ণের দিকে, আর তারপরে অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিলেন —
‘আমি দেব হুতাশন। খাণ্ডব নামে যে মহাবন আছে, সেটিই আপনাদের দহন করতে হবে। তবেই আমার ক্ষুন্নিবৃত্তি ঘুচবে।’
তাঁর মুখ থেকে একথা শোনবার পরে বিস্মিত অর্জুন সসম্ভ্রমে শিলাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন —
‘আপনি দেব হুতাশন ! প্রণাম গ্রহণ করুন দেব। কিন্তু আমি শুনেছি যে, এই মহাবনে অজস্র পশুপক্ষী, সর্প, যক্ষ-রক্ষ-গন্ধর্ব ও কিন্নরেরা বাস করেন। স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র এই বনের রক্ষক। তাই হে অগ্নিদেব! দয়া করে বলুন যে, এই পৃথিবীতে এত সুখাদ্য থাকা সত্ত্বেও খাণ্ডব বনের প্রতি আপনার লোভ কেন?’
তাঁর প্রশ্ন শুনে দেব বৈশ্বানর মৃদু হেসে তাঁকে বলেছিলেন —
‘এ এক অদ্ভুত কাহিনী পার্থ। সত্যযুগে শ্বেতকী নামের একজন ধর্মপ্রাণ রাজা ছিলেন। নিরন্তর যজ্ঞ করাই তাঁর নেশা ছিল ! কিন্তু তখন যে সমস্ত ঋত্বিক তাঁর যজ্ঞের ভার নিয়েছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে যজ্ঞ করবার ক্লেশ তাঁরা আর সহ্য করতে পারেননি। তাই একদিন সমস্ত ঋত্বিকগন রাজাকে জানিয়েছিলেন — হে রাজন! দিবানিশি যজ্ঞকুণ্ডের পাশে বসে বসে আমাদের শরীরগুলি যেন একখণ্ড শুষ্ক কাঠ হয়ে গিয়েছে। এই দেখুন, আমাদের শরীর তাম্রবর্ণ, শরীরে একটিও রোম অবশিষ্ট নেই। তাই হে নরশ্রেষ্ঠ, অনুগ্রহ করে একাজ থেকে এবারে আমাদের অব্যাহতি দিন।
একথা শুনে রাজা ব্যথিত চিত্তে ঋত্বিকদের বিদায় দিয়েছিলেন, আর নিজেও প্রাসাদ পরিত্যাগ করে এক গভীর বনে গিয়ে মহাদেবের তপস্যা আরম্ভ করেছিলেন। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে তপস্যা করবার পরে দেবাদিদেব তাঁর উপরে সদয় হয়ে তাঁকে দেখা দিয়ে বলেছিলেন — আমি তোমার কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়েছি বৎস। নিজের মনোমত বর প্রার্থনা করো। তখন করজোড়ে রাজা শ্বেতকী তাঁকে বলেছিলেন —
হে সর্বশক্তিমান! যদি অধমের প্রতি কৃপা করে থাকেন, তাহলে দয়া করে আমার যজ্ঞের ভার নিন। সুদীর্ঘ কাল ধরে যজ্ঞ করবার শক্তি মানুষের মধ্যে নেই। তাই বিপদে পড়েই আমি আপনার শরণ নিয়েছি।
একথা শুনে মহাদেব তাঁকে বলেছিলেন—প্রিয় বৎস, যজ্ঞ করবার মত সময় আমার নেই। তাছাড়া যজ্ঞ আমি করিনা। আমার আশীর্বাদেই বিনা যজ্ঞেই তুমি তোমার ইপ্সিত ফল প্রাপ্ত হবে। কিন্তু তাঁর এই আশীর্বাদ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন রাজা।
শ্বেতকী তাঁকে বলেছিলেন —কর্মব্যতীত কর্মফল প্রাপ্তির প্রত্যাশা আমার অভিপ্রেত নয় দেবাদিদেব। এত বড় অন্যায় করবার জন্য আপনি আমায় আর অনুরোধ করবেন না। তাঁর একথা শুনে মহাদেব খুশি হয়ে তাঁকে বলেছিলেন —আমি মহর্ষি দুর্বাসাকে বলছি; তিনিই তোমার যজ্ঞের ভার নেবেন। তুমি নিজের রাজ্যে ফিরে গিয়ে তাঁর মনোমত যজ্ঞের আয়োজন কর।
এরপরে মহাদেবকে প্রণাম করে উৎফুল্লচিত্তে রাজা যজ্ঞের আয়োজন করবার জন্য চলে গিয়েছিলেন, আর দ্বাদশ বর্ষ ধরে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। অন্যদিকে মহাক্রোধী ঋষি দুর্বাসা শিব আজ্ঞাকে অবহেলা করতে না পেরে নিজের কুপিত মন নিয়েই একদিন সেই যজ্ঞশালায় প্রবেশ করেছিলেন। আর তারপরে রাজাকে জব্দ করবার জন্য দ্বাদশ বৎসর ধরে অগ্নিতে রাশি রাশি ঘৃত আহুতি দিয়েছিলেন। তাই তখন নিতান্ত বাধ্য হয়েই আমাকে সেসব ঘৃত ভক্ষণ করতে হয়েছে। আর সে থেকে আমি অগ্নিমান্দ্য রোগে আক্রান্ত হয়েছি, ফলে এখন আমি কিছুই খেতে পারছি না। নিজের এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য একদিন অনন্যোপায় হয়ে আমি প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তিনি সব কিছু শুনে আমাকে বলেছিলেন —
‘পৃথিবীতে খাণ্ডব নামের এক মহাবন আছে। সেখানে বহু জাতীয় জীব বাস করে। যদি সেই বনকে দহন করে সেসব দগ্ধ জীবদের আহার করতে পারো, তাহলেই তোমার অগ্নিমান্দ্য দূর হবে।’
ব্রহ্মার কথা শুনে আমি তক্ষুণি খাণ্ডব দহন করতে চলে গিয়েছিলাম, আর নিজের সমূহ তেজোরাশিকে একত্রিত করে তীব্রভাবে জ্বলে উঠেছিলাম। ফলে খাণ্ডবের একাংশ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে, তখনি কোথা থেকে যেন কোটি কোটি হাতি শুঁড়ে করে জল নিয়ে সেখানে ছুটে এসেছিল, আর অল্পক্ষণের মধ্যেই অগ্নি নিভিয়ে ফেলেছিল। তাই তখন আমি হতাশ হয়ে আবার ব্রহ্মার কাছে খাণ্ডব দহন করবার উপায় জানতে ফিরে গিয়েছিলাম। এসময়ে প্রজাপতি আমাকে বলেছিলেন—
‘তোমাকে আরও অনেকদিন ধরে রোগ ভোগ করতে হবে অগ্নি। দ্বাপরে স্বয়ং নারায়ণ ধরার পাপভার লাঘব করবার জন্য নরনারায়ণরূপে অবতীর্ন হবেন, তখন তিনিই দহন করবেন খাণ্ডব বন। আর সাথে তোমারও রোগমুক্তি ঘটবে।’
এরপরে একটু থেমে শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে অগ্নিদেব বলেছিলেন—
‘হে নারায়ণ! সুদীর্ঘ তিন যুগ ধরে আমি এই রোগ ভোগ করছি, তাই এবারে দয়া করে খাণ্ডব বন দহন করে আমায় রোগমুক্ত করুন।’
তাঁর এই আবেদনে অর্জুন ও কৃষ্ণ বাসুদেব সম্মত হওয়ার পরে অগ্নিদেব খুশী হয়ে অর্জুনকে বরুণদেবের কাছ থেকে কপিধ্বজ রথ, অক্ষয় তূণ ও গাণ্ডীব ধনু নিয়ে এসে উপহারস্বরূপ প্রদান করেছিলেন। আর গোবিন্দকে দিয়েছিলেন কৌমদকী গদা ও সুদর্শন চক্র ।
এরপরে এক শুভক্ষণে কৃষ্ণার্জুন খাণ্ডব বনে অগ্নিসংযোগ করেছিলেন। সেই আগুন ধীরে ধীরে বনময় ছড়িয়ে পড়েছিল আর পশুপাখি, যক্ষ-রক্ষ-গন্ধর্ব-কিন্নররা একে একে সেই আগুনে পুড়ে মারা যেতে শুরু করেছিলেন এবং অগ্নিদেব একে একে তাঁদের সবাইকে মুখে পুরতে শুরু করেছিলেন ।
কিন্তু কৃষ্ণার্জুন খাণ্ডব বনে অগ্নি সংযোগ করেছেন শুনতে পেয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র সসৈন্যে তাঁদের আক্রমণ করেছিলেন। ফলে উভয়পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। তাতে দেবরাজ সুবিধা করতে না পেরে একটা সময়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে নিজের দলবল সহ পলায়ন করেছিলেন।
অন্যদিকে খাণ্ডব বন আরও তীব্রভাবে জ্বলতে শুরু করেছিল, আর এর লেলিহান অগ্নিশিখা আকাশকে স্পর্শ করেছিল। ঠিক এমনি একসময়ে অগ্নিদেব দেখতে পেয়েছিলেন যে, এক বিরাটকায় বৃদ্ধ দানব বন ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যাচ্ছেন।
তাই অগ্নিদেব তখন তাঁকে ধরবার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন, আর শ্রীকৃষ্ণও দেবতাদের চিরবৈরী দানবকে সংহার করবার জন্য নিজের সুদর্শনকে এগিয়ে দিয়েছিলেন।
এরফলে প্রাণভয়ে ভীত সেই দানব চিৎকার করে উঠেছিলেন —
‘হে বীর ধনঞ্জয়। রক্ষা কর, রক্ষা কর আমায়।’ তখন তাঁর এই আবেদনে সাড়া দিয়ে স্থান কাল পাত্র ভুলে শরণাপন্নকে রক্ষা করবার জন্য অর্জুন এগিয়ে যেতে চাইলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বাধা দিয়েছিলেন আর ভক্তের সম্মান রক্ষার্থে নিজের সুদর্শনকে সংবরণ করেছিলেন।
একইসাথে তিনি অগ্নিদেবকেও এই দানবকে সংহার করতে নিষেধ করেছিলেন। এরপরে ছুটতে ছুটতে এসে এই দানব কৃষ্ণার্জুনের পদতলে লুটিয়ে পড়লে অর্জুন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—‘কে তুমি?’ তখন দানব ধীরে ধীরে বলেছিলেন — ‘আমি মহর্ষি কশ্যপের পুত্র দানবশ্রেষ্ঠ ময় । দক্ষকন্যা দিতি আমার মা, আর নমুচি হলেন আমার সহোদর।’ এরপরে একটু থেমে তিনি আবার বলেছিলেন — ‘ত্রেতায় রক্ষঃশ্রেষ্ঠ রাবণের প্রধানা মহিষী মন্দোদরীর পিতা ছিলাম আমি। যন্ত্রবিদ্যা ও স্থাপত্যবিদ্যায় আমি হলাম দানবকুলের বিশ্বকর্মা। বলুন ধনঞ্জয়, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি ?’
তাঁর কথা শুনে অর্জুন হেসে বলেছিলেন— ‘স্বয়ং গোবিন্দ যাঁর সহায়, তাঁর পার্থিব সম্পদের প্রয়োজন কী ! বরং বাসুদেবকেই জিজ্ঞাসা করুন যে, আপনি তাঁর কোন উপকার করতে পাররেন কিনা ?’ একথা শুনে কৃষ্ণ হেসে তাঁকে বলেছিলেন — ‘হে দানব-শ্রেষ্ঠ ময়, শুনেছি আপনার তুল্য শিল্পী এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ নেই। তাই আপনি যদি নিতান্তই অর্জুনের জন্য কিছু করতে চান, তাহলে ইন্দ্রপ্রস্থে এমন এক মনোহর প্রাসাদপুরী নির্মাণ করুন, যার তুল্য পুরী এই ত্রিভুবনে থাকবে না।’ একথার পরে ময় দানব খুশি হয়ে সেখান থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, আর পরবর্তী একমাসের মধ্যে এমন এক অতুলনীয় মনোহর প্রাসাদ এবং দুর্লভ মণিমুক্তাখচিত ও অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত এক রাজসভা নির্মাণ করেছিলেন, যা দেখে দেবতারাও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু এতেও ময় দানব সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাই তিনি মৈনাক পর্বত থেকে অসুররাজ বৃষপর্বার গদা নিয়ে এসে মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন কে এবং অর্জুন কে দেবদত্ত শঙ্খ উপহার দিয়েছিলেন।
মহাভারতে উল্লিখিত খাণ্ডব দাহনের এই কাহিনী আদৌ বিশ্বাসযোগ্য কিনা —এ প্রশ্ন নিরর্থক। তবে ইন্দ্রপ্রস্থ নামের একটি সুপরিকল্পিত নগরী প্রাচীন ভারতে যে বর্তমান ছিল, এবিষয়ে বিশ্বাস না করবার কোন কারণ অন্ততঃ দেখা যায় না। তবে শুধুমাত্র ইন্দ্রপ্রস্থ নয়, আরও বহু নগরী ময় দানবের পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছিল বলে বহু প্রাচীন পুরাণে বর্ণিত হয়েছে বলেও দেখা যায়।
এমনকি অসুররাজ বৃষপর্বার রাজধানীও ময় দানবই তৈরি করে দিয়েছিলেন। অতএব একথা অনুমান করতে কোন অসুবিধা হয় না যে, ময় দানব একজন বড় স্থপতি ও গণিতজ্ঞ ছিলেন। তবে শুধু এটুকুই নয়, তিনি যন্ত্রবিদ্যায়তেও কুশলী ছিলেন। বিশেষতঃ যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণে তাঁর সমকক্ষ কেউই ছিলেন না। তিনি নিজের জামাতা রাবণকে যে মহা শক্তিশেল দান করেছিলেন, সেটাকে ব্যর্থ করবার ক্ষমতা তৎকালীন দেবতা, অসুর, মানব — কারো মধ্যেই ছিল না। তাঁর তৈরি এই এই অস্ত্রের জন্যই লক্ষ্মণ প্রায় মৃত্যুমুখে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
প্রাচীন ভারতে প্রচলিত থাকা ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ নামের একটি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও যন্ত্রবিদ্যার গ্রন্থ ঐতিহাসিকেরা অতীতে উদ্ধার করেছিলেন। এই গ্রন্থটি আজও প্রচলিত রয়েছে। অনেকের মতে এই সূর্যসিদ্ধান্তই হল এদেশের গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার আদি গ্রন্থ, আর ময় দানবই এর রচয়িতা ছিলেন।
কিন্তু প্রাচীন পুরাণে বর্ণিত ময় দানব ও সূর্যসিদ্ধান্তের রচয়িতা ময় দানব — আদৌ একই ব্যক্তি ছিলেন কিনা, এবিষয়ে সঠিকভাবে কিছু বলবার উপায় নেই। তবে প্রাচীন পুরাণ গুলিতে ময় দানবের যেসব পরিচয় ইতস্ততঃ ছড়িয়ে রয়েছে বলে দেখা যায়, তা থেকে তাঁকেই সূর্যসিদ্ধান্তের রচয়িতা বলে মনে করবার যথেষ্ট কারণও পাওয়া যায়।
প্রাচীন ভারতীয় পুরাণের ময় দানব একজন শিল্প-পণ্ডিত ও যন্ত্রবিদ্যা-কুশলী ছিলেন। মৎস্যপুরাণ অনুসারে, তিনি দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য প্রবর্তিত নিখিল শিল্পবিদ্যার অধীশ্বর ছিলেন। ময় নিজের কাজের জন্য স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র এমনকি লৌহের ব্যবহারও করতেন। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, তাঁরই স্বর্ণ, রৌপ্য ও লৌহ নির্মিত তিনটি দুর্ভেদ্য পুরী ধ্বংস করেই মহাদেব ‘ত্রিপুরারি’ বলে আখ্যা লাভ করেছিলেন। তবে ময় দানব বলে প্রাচীনকালে কেউ থাকুন বা না থাকুন, এবং তিনি সূর্যসিদ্ধান্ত রচনা করুন বা না করুন, কিন্তু এই গ্রন্থটি আজও ঐতিহাসিকদের কাছে এক পরম বিস্ময়ের বস্তু হয়ে রয়েছে ।
প্রসঙ্গতঃ একথাও উল্লেখ্য যে, বর্তমানে সূর্যসিদ্ধান্ত বলে যে গ্রন্থটি প্রচলিত রয়েছে, সেটি অবশ্য আদি গ্রন্থ নয়। এর কারণ হিসেবে বলা চলে যে, খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির তাঁর গ্রন্থে সূর্যসিদ্ধান্ত থেকে যে সমস্ত শ্লোক উদ্ধৃত করেছিলেন, সেসব শ্লোক কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত থাকা সূর্যসিদ্ধান্তে পাওয়া যায় না। এমনকি খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতকে সেনবংশীয় রাজা বল্লাল সেন তাঁর ‘অদ্ভুতসাগর’ নামক গ্রন্থেও সূর্যসিদ্ধান্তের যে ক’টি শ্লোক উদ্ধৃত করেছিলেন, সেগুলিও এখনকার সূর্যসিদ্ধান্তে পাওয়া যায় না। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, আদি সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থটি বহুকাল আগেই লুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
ঐতিহাসিকদের মোতে সূর্যসিদ্ধান্তে শুধুমাত্র গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা আলোচিত হয় নি, যন্ত্রাদি নির্মাণ পদ্ধতির বর্ণনা এই গ্রন্থের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। সেযুগে যন্ত্রাদি নির্মাণের জন্য কাঠ, তামা, পারদ, বালি তেল, সুতো প্রভৃতি উপাদানের প্রয়োজন হত। সূর্যসিদ্ধান্তে শঙ্কু, ধনু, চক্র, বানর, ময়ূর প্রভৃতি যন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু তখনকার এসব যন্ত্র যে প্রকৃতপক্ষে কি ধরণের ছিল, একথা এখন আর সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে এথেকে একথা অবশ্যই প্রমাণিত হয় যে, প্রাচীন ভারতেও বিভিন্ন ধরণের যন্ত্র যে নির্মিত হত।
আধুনিক সময়ে পণ্ডিতদের মতে রামায়ণ ও মহাভারত যেমন একাধারে ইতিহাস, আখ্যান, পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্র, ঠিক তেমনি আবার প্রাচীন ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতির এক মহাকোষগ্রন্থও বটে। তাঁদের এই মতবাদ যদি অভ্রান্ত হয়, তাহলে কিন্তু ময় দানব বলে কোন প্রাচীন ব্যক্তিকেও অস্বীকার করা চলে না। কারণ, সূর্যসিদ্ধান্ত আজও প্রচলিত রয়েছে। আর যদি ময় দানবই এর রচয়িতা হয়ে থাকেন, তাহলে এযুগে যাঁরা রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনীতে সংশয় প্রকাশ করেন, তাঁরাও ভেবে দেখতে পারেন যে, এই দুই মহাকাব্যের কাহিনীতে যদিও বা কিছুটা অতিরঞ্জন থাকে, তাহলেও সেটাকে একেবারেই ভিত্তিহীন বলা চলে না ।।
0 Comments