দীপশ্রী সেনগুপ্ত
আজ অনেকদিন পর ওরা বেরিয়েছে।
ওরা মানে ঝিমলি আর তার ঠাকুমা মনীষাদেবী।
অনেকদিন ওদের সাথে দেখা হয়নি, আর শুধু ওরাই বা কেন? তাতান, বাপ্পা, টুকটুকি, পুতুল কাউকেই দেখা যায়নি। ক্বচিৎ কখনো ওদের বাড়ির লোকের এক ঝলক দেখা পাওয়া গেলেও, ওদের দেখা? নৈব নৈব চ।
ঝিমলিরা ছোট্ট পাহাড়ের ওপর নির্জন পায়ে চলা পথ দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে—মনীষাদেবীর পায়ের অসুবিধা, বুঝদার নাতনি ঠাকুমার পাশে পাশে একটু একটু করে এগোচ্ছে।
ছোট্ট একটা টাট্টুঘোড়া খুরের শব্দ তুলে ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল, নাম না জানা ফুলের গাছে লম্বা ঠোঁটের ম্যাগপাই পাখি ফুলের মধু খেতে ব্যস্ত। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে হঠাৎ দূরের লম্বা গাছের মাথা থেকে 'ঝুপ'; দুজনেরই পথ চলা আর কথা বলা বন্ধ।
"যাও তো রাজপুত্র, দেখো তো কিসের আওয়াজ? শত্রু সৈন্যের আক্রমণ নয়তো?"
ক্ষিপ্রবেগে রাজপুত্র দৌড়য়, ফিরে আসে, হাতে পাকা বেল—উঁচু থেকে মাটিতে পড়ে ফেটে গেছে।
"যাও রাজপুত্র, এটি অন্য কারুর treasure, যথাস্থানে রেখে দিয়ে এসো।"
ভালোলাগায় আমার শরীর মন ভরে যায়—মনীষাদেবীর পায়ে লুটিয়ে পড়ি—উজ্জ্বল কবোষ্ণ প্রণাম সেরে ঝিমলি রাজপুত্রের পায়ে পায়ে দৌড়িয়ে যাই বেলগাছের তলায়, ফিরে এসে ওদের গায়ে মাথায় মাখামাখি হয়ে ছোট্ট টিলার ওপর বসি।
আমাকে চিনতে পারছেন তো? আমি রোদ্দুর! নির্ভেজাল sunlight। রোজ সকালে আপনার বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ি—জানলা দিয়ে নেমে এসে ঘরের মেঝেয় বিছিয়ে গুছিয়ে বসি।
আমি রোদ্দুর, আর ঝিমলিরা যে পাহাড়ের পথ বেয়ে যাচ্ছিলো সেটি নিতান্তই একটি খাড়াই রাস্তা, না আছে ঘোড়া, না আছে ম্যাগপাই, সব কল্পনা। মনীষাদেবী নাতনিকে হাত ধরে কল্পনার জগতে নিয়ে যাচ্ছেন—ল্যাজ নাড়া নেড়ি কুকুর কল্পনায় হয়েছে ঘোড়া। বড়োসড়ো প্রজাপতি হলো ম্যাগপাই, আর treasure হলো পাকা বেল—আগেই তো বললাম। আর ছোট্ট টিলা কি জানেন? নিতান্তই রাস্তার ধারের কালভার্ট। এজন্যই তো মনীষাদেবীকে প্রণাম করলাম।
কি যে হয়েছিল, আপনাদের কারুর সাথে দেখা নেই. বাজার, দোকান, অফিস, সব বন্ধ। আমি, আমার বন্ধু বৃষ্টি আর বাতাস, সবাই তো রোজ যাতায়াত করেছি—না কোনো গাড়ি, ঘোড়া, না কিছু। আকাশ যেন বেশি বেশি নীল, গাছের পাতাগুলো বেশি সবুজ, ফুলের হাসি আরো চমৎকার—কিন্তু আপনাদের দেখা না পেলে ভালো লাগে বলুন?
🍂
ঘরে ঘরে সেই সময় আড়ি পেতেছি, জানেন? শুধু দুঃখ আর দীর্ঘশ্বাস। সবাই বসে আছেন কবে এই দিনের শেষ হবে—সত্যিই হবে কি? শুনলাম না কি আপনারা কি এক অসুখে ভুগছেন। সত্যি বলতে কি, আমিও আপনাদের মতো হতাশায় ভেঙে পড়েছিলাম—অনেকে চিরদিনের মতো চলে গেলেন যে। তবে মাঝে মাঝে মনটা একটু ভালোও হতো। তিন্নির দিদি তার বান্ধবীকে বলছিলো, "কতদিন দেখা হয়নি বল?” সোজা ফোনে আড়ি পাতলাম, বান্ধবী বলছে-"আমার সাথে দেখা হচ্ছেনা বলে দুঃখ পাচ্ছিস, না তোর বয়ফ্রয়েন্ডের সাথে দেখা হচ্ছে না বলে দুঃখ পাচ্ছিস?" এরপর দুই বন্ধুর হাসাহাসি, গল্প, মনটা একটু ভালো হলো, জানেন। তিন্নির মা রান্নাঘর থেকে যেই হাঁক পাড়লেন, "কার সাথে কথা বলছিস?"—অমনি আমি দে চম্পট!
কানে এলো এবার থেকে পৃথিবী নাকি এরকমই থাকবে। মানুষের আর আশা করার কিছু নেই। খুব দুঃখ হলো—আপনাদের জন্যই তো আমরা, বলুন? জলাশয়ের জল বাষ্প হয়ে মেঘ হয় কার জন্য? সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে কেন? পৃথিবী শস্যশ্যামলা হয়, প্রাণের পুষ্টি, তুষ্টি দুই-ই হয়, সেই প্রাণই কর্মযজ্ঞে অংশ নেয়—তবেই না পৃথিবী বাঁচে? আপনারা শুনতে পাননি, কিন্তু আমরাও বলেছিলাম—এ কেমন ব্যতিক্রমী ব্যতিক্রম?
তবে সেইসময় কর্মযজ্ঞ কাকে বলে তা দেখিয়ে দিয়েছেন মেডিকেল প্রফেশনাল আর পুলিশকর্মীরা। পরার্থে আত্মত্যাগ একেই বলে—স্বীকার করেন তো? দিন নেই, রাত নেই, নিজের পরিবার পরিজন সর্বস্ব ত্যাগ করে আর্তের সেবা—এই পৃথিবীর মাটিতেই আপনারাই দেখালেন।
আর আপনাদের বিজ্ঞানীরা? তাদের কথা ভাবুন একবার? কি দুশ্চর তপস্যায় সব ভেদাভেদ ভুলে নিজের স্বার্থ লাটে তুলে যাকে বলে আদা জল খেয়ে লেগে পড়লেন না? তার ফলটা দেখুন একবার...।
এই ঝিমলি আর তার ঠাকুমাকেই দেখুন না—আপনাদের ঐতিহ্য আপনাদেরই ভবিষ্যৎকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আজকাল শিক্ষাবিদরা শিশুদের কল্পনাশক্তি বিকাশের কথা বলছেন তো? তবে? এটি আপনাদেরই সাধনার ফল কিনা?
আপনারাই পারেন, একমাত্র আপনারাই...। আপনাদের জন্য অসীম শ্রদ্ধা রইলো। একবার বাইরে তাকান, প্রকৃতিতে আগমনীর সুর বাজছে, আসুন, আমাদের সাথে আনন্দযজ্ঞে যোগ দিন।
ঢাকে কাঠি পড়লো বলে।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments