দূর দেশের লোক কথা— ২৪৭
কোরিয়া (এশিয়া)
বাঘের ঘটকালী
চিন্ময় দাশ
বিশাল এক পাহাড়। তার তলাতেই বেশ বড়সড় এক গ্রাম। সে গ্রামের মোড়ল সকলের চেয়ে বড়লোক। পেল্লাই বাড়িখানা দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মোড়লের সন্তান বলতে একটি মেয়ে। বাবার নয়নের মণি সেই মেয়ে। দেখতেও যেমন ভারি রূপসী, স্বভাবও তেমনই মিষ্টি। গ্রামের সবাই ভালোবাসে মেয়েটিকে।
গ্রামেই খুব গরিব বাড়ির একটি ছেলে ছিল। তার সাথেই মেয়েটির যত ভাবসাব। ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছে। খেলাধুলাও করে দুজনে একসাথে। কিন্তু মোড়লের এটা মোটেই পছন্দ নয়। একটা গরীব বাড়ির ছেলের সাথে তার মেয়ে খেলাধুলা করবে, মেলামেশা করবে—মন মেনে নেয় না কিছুতেই।
কিন্তু ছেলেমানুষ এখনও। তা্ই, কী আর করে মোড়ল? মেনে নেয়। মনে ভাবে, বয়স হলে, ছেলেবেলার এসব যোগাযোগ একদিন ঠিক কেটে যাবে।
দেখতে দেখতে দুজনের বয়স হচ্ছে। আরো যখন বড় হল, এবার বিয়ে দেওয়া দরকার। আর এক বড়লোকের বাড়ি ছিল সেই গ্রামেই। মোড়ল আগে থেকেই স্থির করে রেখেছে, সেই বড়লোকের ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়ে দেবে। একটা গরীবের ছেলের সাথে তার মেয়ের বিয়ে হবে, এমনটা ভাবতেই পারে না মোড়ল।
ব্যাপারটা একদিন কানে এলো মেয়েরও। বাবার ভাবনাটা একেবারেই তার পছন্দ হয় না।
কিন্তু মেয়েটির স্বভাব খুব ভালো। বাবার কথার কোনদিন অবাধ্য হয়নি সে। এবারেও মুখ বুজেই রইল। মন না চাইলেও, মুখ ফুটে কিছুই বলল না। কিন্তু মন খারাপ মেয়ের। খাওয়ায় রুচি নেই। কোন কাজই ভালো লাগে না। দেখতে দেখতে শরীর ভাঙতে শুরু করলো মেয়ের। সবই দেখছে মোড়ল, কিন্তু কোন পাত্তাই দিল না।
মেয়েটি মন খারাপ করে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু বাবার কথার অবাধ্য হয় না। এমনকি, ছেলেটার সাথে দেখাও করে না এখন। মন চায় একবার যাই। কথা বলে আসি। কিন্তু বাবা ব্যথা পাবে, এই ভেবে পিছিয়ে আসে। কোন প্রতিবাদই করে না।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে গেল। চারদিকে সাজগোজ । সমস্ত প্রস্তুতি সারা। বিয়ের আসর বসেছে।
এদিকে গরিবের ছেলেটিরও মন খারাপ। অন্য কারো সাথে তার বন্ধুর বিয়ে হচ্ছে, এটা মেনে নিতেই পারছে না সে। শুধু মন খারাপই নয়, তার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে শুনে। কিন্তু গরিবের ছেলে সে। মোড়লের কথার বিরুদ্ধে যায় কী করে? তারও ইচ্ছা হয়, একবার গিয়ে দেখা করে আসি। কিন্তু সাহস হয়নি। ক্ষমতা কতটুকু তার।
বিয়ের আসর বসেছে। মেয়েও এসে বসেছে ছাদনাতলায়। হঠাৎই একটা হুলস্থুল কান্ড। বিশাল চেহারার আস্ত একটা বাঘ ঢুকে পড়েছে বিয়ের আসরে। বাঘ সামনে দেখলে যা হয়। সবাই ভড়কে গিয়েছে। সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছে। বাঘের হাত থেকে বাঁচতে হবে। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করেছে সবাই। বিয়ের আসর পণ্ড হয়ে যাক, আগে তো প্রাণ বাঁচানো হোক।
বিয়ের আসর ফাঁকা। যে এদিকে পেরেছে পালিয়ে বেঁচেছে। মেয়েটি দেখে, তার সামনে জ্যান্ত একটা বাঘ। ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ধপাস করে পড়ে গিয়েছে সে। বাঘ করলো কী, মেয়েটিকে পিঠের উপরে তুলে নিয়ে, লম্বা এক লাফ। আড়াল আবডালে লুকিয়ে ছিল যারা, তারা দেখল বিয়ের কনেকে বাঘ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বাঘের পিঠে ঝুলে আছে অচেতন মেয়েটা।
এদিক ওদিক থেকে দেখল সবাই উঁকি মেরে। কিন্তু ভয়ে কেউ সামনে যেতে পারছে না। আগে তো নিজের প্রাণ বাঁচাতে হবে। এমনকি, বাঘ দেখে মেয়ের বাবা মোড়লও সাহস করে এগিয়ে যেতে পারল না। চোখের নিমিষে বাঘ উধাও হয়ে গেল মেয়েকে পিঠে নিয়ে।
এদিকে বিয়ের আসরে গ্রামশুদ্ধ সবাই হাজির হলেও, গরিবের ছেলেটি বিয়ের আসরে যায়নি। সেই বাড়িতেই বিছানায় শুয়ে ছিল। হঠাৎই বাইরের বারান্দায় ধুপ করে কিসের একটা শব্দ। অবাক হয়ে গেল ছেলে।
এই মাঝরাতে দাওয়ায় শব্দ হোল কিসের? দরজা খুলে বাইরে এলো ছেলেটা। এসেই অবাক! মোড়লের মেয়ে পড়ে আছে তার বারান্দায়! আরও অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, দাওয়ার নিচে আস্ত একটা বাঘ দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে।
এদিকে রাজবাড়ীতে হইচই পড়ে গিয়েছে। বাঘ চলে যেতে, সবাই বেরিয়ে এসেছে। আর আলাপ আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে কোথায় যেতে পারে মেয়ে? কেন নিয়ে হল বাঘ?
বড়লোকের ছেলে, মানে সেদিনের হবু বর একদল লোক জড়ো করে, বাঘের খোঁজে পাঠিয়ে দিল। একদল লোক গেল মোড়লকে সান্ত্বনা দিতে।
গরিবের ছেলে মনে দুঃখ পেয়েছিল, এ কথা ঠিক। কিন্তু, এভাবে তার বাড়িতে বিয়ের রাতেই মোড়লের মেয়ে এসে হাজির হবে, এটা তার মোটেই পছন্দ নয়। স্বভাবে ভারি ভালো মানুষ সে। বাঘকে ডেকে বলল—কাজটা তুমি ঠিক করোনি, বাপু। এখন যা অলছি শোন। একে আবার তুমি পিঠে চাপিয়ে নাও। এসো আমার সাথে।
বাঘ আপত্তি করল না সে কথার। এগিয়ে এসে মেয়েকে বাঘের পিঠে চাপিয়ে, গরিবের ছেলে চলল মোড়লের বাড়ি।
হবু বরের পাঠানো খোঁজ করার লোকজন ঢুঁ মেরেছে গাঁয়ের প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে। কোথাও মেয়ের দেখা নেই। বাঘেরও দেখা নেই কোথাও। দেখা পাবে কী করে? তারা যখন ফিরে এল, তখন মোড়লের বাড়িতে হৈ-হৈ কান্ড তখন। গরীবের ছেলে বাঘের পিঠে চাপিয়ে, মেয়েকে নিয়ে মোড়লের বাড়ি এসে হাজির হয়ে গিয়েছে।
বাঘ পিঠে চাপিয়ে মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, এটা দেখে, বিয়ের আসরের লোকজন অবাক হয়েছিল। এখন তার চেয়েও অবাক। হঠাৎ বাঘের পিঠে মেয়েকে চাপিয়ে গরীবের ছেলে এসে হাজির হয়েছে! কী করেই বা এটা সম্ভব হলো? জলজ্যান্ত একটা বাঘ একটা গরিব ছেলের কথা শুনছে কেন? হাজার রকম প্রশ্ন সবার মনে।
কিছুতেই কারো মাথায় ঢুকছে না ব্যাপারটা। ঢুকল কেবল মোড়লের মাথাতেই। মোড়ল তখন হুঁশ ফিরে পেয়েছে। নিজে এগিয়ে গিয়ে, বাঘের পিঠ থেকে নামালো মেয়েকে। আবার বিয়ের আসর বসানো হলো। এবার গরীবের ছেলেকে বরের পোশাক পরিয়ে, বিয়ের আসরে বসিয়ে দিলেন নিজেই। আনন্দে হৈ-হৈ করতে লাগলো সকলে।
্মোড়ল বলল-- এ বিয়েতে মত ছিল না আমার মেয়ের। কিন্তু বাবা কষ্ট পাবে, তাই সে মেনে নিয়েছিল। এদিকে গরিবের ছেলে হলেও, সে যে কত ভালোমানুষ, সেটা তো সবাই বুঝেছে আজ। বিয়েতে আমি তাকে নেমন্তন্ন করিনি। নিজেই আমার মেয়েকে ফেরত দিতে আমার বাড়ি এসে হাজির হয়েছে।
হাজারো লোকজন বিয়ে বাড়িতে। মোড়ল সবাইকে বলল-- আমার মনে হচ্ছে কী জানো? এটা আমাদের পাহাড় দেবতার কাজ। তিনিও চাইছিলেন, আমার মেয়ে যেন কষ্ট না পায়। তিনি চাইছিলেন, এই গরিবের ছেলের সাথেই বিয়ে হোক আমার মেয়ের। তাই নিজে এসে, বিয়ের আসর থেকে মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাঘের বেশ ধরে এসেছিলেন পাহাড় দেবতাই।
দেবতা কি চাইছেন, বেশ বুঝতে পেরেছি আমি। ভুল করেছিলাম আমি। আর সে ভুল আমি করব না। এই গরীবের ছেলের সাথেই আমার মেয়ের বিয়ে দেবো। এখনই হবে। এই আসরেই বিয়ে হবে দুজনের।
সবাই হই হই করে উঠলো, সকলেই খুশি। ধুমধাম করে মোড়লের মেয়ের সাথে গরিবের ছেলের বিয়ে হয়ে গেল।
0 Comments