মার্কেজের খোঁজে
(চতুর্দশ পর্ব)
মলয় সরকার
বোগোটার রাস্তায় আজ আমাদের প্রথম দিনের হাঁটা, মানুষজনকে চেনা, জায়গা চেনা আর তার সঙ্গে খুঁজে বেড়ানো এখানকার ইতিহাস। সব কিছুর পিছনে অবশ্য মার্কেজের অস্তিত্বকে খুঁজে দেখার সন্ধানী চোখ চলতেই থাকে।
যাই হোক, আমরা দেখতে দেখতে চললাম, এত সরু ফুটপাথ, কিন্তু কোথাও এতটুকু দখলদারী নেই। পাশে পাশে প্রতিটি বাড়িতেই দোকান, সেও ছোটখাটো নয়, মোটামুটি বড় বড়ই দোকান, কিন্তু কেউ এক চিলতে ফুটপাথও দখল করে নি নিজের ব্যবসায়ের স্বার্থে। রাস্তায় অনেক জায়গাতেই ফেরিওয়ালা বেচছে, কিন্তু এমন নয় যে, তারা খুব স্থায়ী বসে আছে বা জায়গাটা নোংরা করছে।এই নোংরা করা ব্যাপারটা, আমার মনে হয়, কেবলমাত্র আমাদের মত এশিয়ার এই দিকটার দু’ একটি দেশের ছাড়া কারোরই চরিত্রের মধ্যে পড়ে না। এটা কিন্তু ধনী বা দরিদ্রের কি অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে না। এটা অভ্যাস।যেটা আমাদের দেশে সাঁওতাল বা অন্যান্য উপজাতিদের সমাজের মধ্যে দেখতে পাই। জিডিপি অনুযায়ী ভারতের স্থান যদি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পৃথিবীর মধ্যে সপ্তম স্থান হয়, কলম্বিয়ার স্থান সেখানে উনচল্লিশতম (এটা গুগল বলছে)। কাজেই অপরিচ্ছন্নতাটা অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে না , এটা প্রমাণিত। এই দেশে গরীব বড়লোক নির্বিশেষে সবাই পরিচ্ছন্ন থাকতে চায়। তাই, এই দেশের মানুষেরা , আমাদের চেয়ে পরিচ্ছন্নতা বা ভদ্রতার সংস্কৃতিতে অনেক উন্নত।
সাফাই কর্মীরা সাফাইয়ের কাজে
এখানে অনেক জায়গাতেই ইউনিফর্ম পরে সাফাই কর্মীরা সাফাই করছে দেখলাম।
এখানকার রাস্তায় ফুটপাথে যথেষ্ট ভিড়, বহু লোকই হেঁটে যাচ্ছে। শহরের মধ্যে বাসের সংখ্যা কম দেখলাম (অথচ পরিসংখ্যান বলছে অনেক বেশি, হবে হয়ত ,আমাদের চোখে পড়ে নি) গাড়ি আছে কিছু। এখানে কার্তাহেনার মত ঘোড়ার গাড়ি দেখিনি। আসলে এটা রাজধানী তো, আর ওটা ছিল (যেখানে আমরা ছিলাম) দেওয়াল ঘেরা একটা প্রাচীন শহর, যেটাকে মিউজিয়ামের মত বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, প্রাচীন ঐতিহ্যময় শহর হিসাবে। আর এখানে রাজধানীর চরিত্রটা হল আমাদের কলকাতার মত। প্রাচীনতাকে নিয়ে নতুন যুগ ছুটছে। ওখানে জীবন অনেকটা কম গতির, এখানে তীব্র গতির। আমার মনে হল তুলনা টানতে গেলে , আমাদের দেশের জয়পুর আর পুরানো জয়শলমীরের সঙ্গে তুলনীয়।
মিউজিও ডেল ওরো জেনুর সামনে ঘুরে বেড়ানো সুন্দরীরা
আবহাওয়া এখন, আমাদের দেশের যে কোন পাহাড়ী অঞ্চলের মত। অনেক সময়েই খুব গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, বা মেঘ ভেসে মুখ চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছে, আশেপাশের দৃশ্যে রোমান্টিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে দিচ্ছে। আবার একটু পরেই পরিষ্কার, জল কোথাও জমে নেই। সেটা থাকবার কথাও নয়, কারণ এটা পাহাড়ের ঢালে। অবশ্য এখানে একটা ভৌগোলিক সুবিধা আছে, তাহল, রাস্তার ধুলো ইত্যাদি যা হবে, বৃষ্টির জল এসে সব ধুয়ে দিয়ে যাবে এবং জল গড়িয়ে চলে যাবে আপনা হতেই। ফলে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ ,এর জন্য সমস্ত নিকাশীপথ আবর্জনামুক্ত চাই।
🍂
যেতে যতে একটার পর একটা রাস্তা পেরোচ্ছি, ক্রশিংগুলো সবই নিছক চৌকো চার মাথা হওয়ায় সবই একরকম। একেবারে যেন স্কেল দিয়ে মেপে চৌকো চৌকো করে জায়গাটা ভাগ করে রাস্তা তৈরী হয়েছে। সব রাস্তাই বাঁধানো বা পাথরের। এখানেও ফুটপাথ কোন কোন জায়গায় দেড় কি দু ফুট আক্ষরিক অর্থে। হঠাৎ একটা মোড়ে চোখে পড়ল বিশাল একটা অডিটোরিয়াম। তার নীচে চলছে উন্মুক্ত, তবে ছাদের নীচে, চায়ের সাথে তরুণদের আড্ডা দেওয়ার বিশাল ব্যবস্থা।আর উপরের চওড়া প্যারাপেট ওয়ালে সেই সদাহাস্যময় গার্সিয়া মার্কেজের মুখ। পাশে লেখা রয়েছে ,গার্সিয়া মার্কেজ কালচারাল সেন্টার। আমার মনে পড়ল আমাদের এখানকার রবীন্দ্রসদন। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এখানে মাঝে মাঝেই অনুষ্ঠান হয়, আর যখন তা হয়, তখনই ভিতরে ঢোকা যায়।এখানে ঢোকা সম্ভব নয়, না বুঝি এখানকার ভাষা, না এখানকার সংস্কৃতি, আর তাছাড়া সময়ও নেই। আমরা চলেছি অন্য জিনিসের খোঁজে।আজ এখন আমাদের গন্তব্য Museo Del Oro।
সেন্ট্রো কালচারাল গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সামনে সদা হাস্যময় সাহিত্যিক
যেতে যেতে এক জায়গায় দেখি বড় রাস্তার মাঝে সামনে দেখি লেখা রয়েছে একটা জায়গায় বোর্ডে ওই জায়গার নাম MUseo Del Oro । দেখে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম, এটি তো মিউজিয়ামের মত লাগছে না।এখানে আমাদের মেট্রো স্টেশনের মত একটা ছাদঢাকা অনেক লম্বা প্যাসেজ রয়েছে। ভিতরে ঢোকার মুখে টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি? যাত্রীরা বলল, ট্রান্স মিলেনিও স্টেশন। এটা হল আমাদের মেট্রোর মত ওদের র্যাপিড বাসের স্টেশন।আমাদের দেশে যেমন মেট্রোর স্টেশনের নাম ‘রবীন্দ্র সদন’, সেই রকম আর কি! বাইরের লোক হিসাবে হঠাৎ বোঝা মুস্কিল যে, এর গেটটাই আসল রবীন্দ্র সদনের মেন গেট কি না।
আমার ‘আজটেকদের দেশে’ তে মেক্সিকোর ভ্রমণ বর্ণনাতেও এই মেট্রো বাসের কথা বলেছি। এটা সেই রকমই। এর জন্য রাস্তায় একদম ভিতর দিকের ধার ঘেঁসে আলাদা ট্র্যাক আছে।সেই ট্র্যাকে কেউ অবরোধ করে গাড়ি চালাবে না। অর্থাৎ এই বাস কিছুতেই আটকাবে না একমাত্র সিগন্যাল ছাড়া। এটা সব জায়গায় দাঁড়াবেও না, অন্য বাসের মত। এর ভাড়া বেশি, যায়ও তাড়ায়াড়ি, অর্থাৎ আমাদের মেট্রো রেলকে রাস্তার উপরে চালালে যা হবে তাই। আর এর জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় চারদিক ঢাকা প্ল্যাটফর্ম আছে। তাতে কেবল কয়েকটা দরজা আছে দুদিকে রাস্তার দিকে মুখ করে, যাতে নির্দিষ্ট বাস
দরজার সাথে দরজা লাগিয়ে দাঁড়ায়, নির্দিষ্ট রুটের যাত্রীদের ওঠা নামার সুবিধার জন্য।
এ ছাড়াও অবশ্য অন্য বাসও আছে।তবে আমাদের মত সাধারণ বহিরাগতপদের পক্ষে এই সব বাসে যাতায়াত করা মুস্কিল।
আমরা এগোলাম। দু’ এক জনকে জিজ্ঞাসা করলাম রাস্তায়। আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি সব কিছু স্প্যানিশে হওয়ায়, আগেই গুগল ট্র্যানশ্লেটরে ফেলে সেই মেসেজ লোকজনকে দেখাই, তারাও বুঝে সেই মত উত্তর দেয়।
কাছেই একটা পার্কের উলটো দিকে দেখি একটা বিরাট অডিটোরিয়াম মত।তার সামনেই অনেকখানি ফাঁকা জায়গা । সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে দুটি মেয়ে অনেকখানি ঘাঘরা দেওয়া সুন্দর জামা পরে, সম্ভবতঃ , মনে হল পথচারীদের সঙ্গে ছবি তোলার বিনিময়ে কিছু পয়সা রোজগারের চেষ্টায়। পার্কটির নাম Plaza de Santander । আমরা পরে এখানে এসেছিলাম।
অডিটোরিয়ামটির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সিকিউরিটি গার্ড, আর হলের মাথায় দেখলাম লেখা রয়েছে, আমাদের ঈপ্সিত গন্তব্যের নাম, Museo Del Oro অর্থাৎ সোনার যাদুঘর।এরই ছোটো সংস্করণ আমরা দেখে এসেছি কার্তাহেনায়। ঢোকার মুখে আমরা দেখি, লেখা রয়েছে টিকিটের কথা। আমরা গেটে টিকিটের কথা বলতেই সেই সিকিউরিটি গার্ড দুজন, একেবারে সম্মান দেখিয়ে বলল, না আপনাদের জন্য কোন টিকিট লাগবে না। আপনারা সিনিয়র সিটিজেন , আমাদের সম্মানীয়। চলে আসুন। এই বলে আদর করে ভিতরে ডেকে নিয়ে পথ নির্দেশ করল। আমরা আতিথ্যে আপ্লুত হলাম।এত আতিথ্য বা এরকম সম্মান আমাদের দেশেও আমাদের কেউ কখনও দেয় নি, দেবে সেই আশাও করি না।বরং আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে কিভাবে বৃদ্ধদের সরিয়ে দেওয়া যায় তারই চেষ্টা চতুর্দিকে , সরকার থেকে নগরবাসী পর্যন্ত প্রত্যেকেরই।
এবার এটির সম্বন্ধে কিছু বলে নিই।
এই মিউজিয়ামে প্রায় ৩৪০০০ সোনার জিনিস আছে এবং প্রায় ২০০০০ মাটির, সুতির , চিনামাটির বা অন্যান্য জিনিসপত্র রয়েছে, যা সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে , অর্থাৎ প্রায় ২০০০০ বছর আগে থেকে এখানকার অধিবাসীরা ব্যবহার করত বা তৈরী করেছে।
১৯৩৯ সালে যার গোড়াপত্তন হয়েছিল Banco de la República র হাত ধরে, নানা উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে সেটি ২০০৮ সালে বর্তমান রূপ লাভ করে। এখানে বছরে প্রায় পাঁচ লক্ষ দর্শক আসেন, এবং এটি শুধু বোগোটার কেন, সারা কলম্বিয়ার অন্যতম দ্রষ্টব্যের মধ্যে একটি। এটি না দেখলে, স্থানীয় অধিবাসীদের,বা, বলা যায় মানব সভ্যতার সম্বন্ধে ইতিহাস অনেকখানিই না জানা রয়ে যাবে।
এখানে বাস করত কুইম্বায়া, ক্যালিমা, তাইরোনা,মুইসকা, জেনু, তোলিমা, তুমাকা ইত্যাদি নানা উপজাতির লোক।তারা যে খুব অজ্ঞ ছিল সমস্ত কিছু সম্বন্ধে, এমন ভাবার কারণ নেই।তদের হাতের শিল্পকর্মই তার প্রমাণ দেয়।
ক্রমশঃ-
0 Comments