জ্বলদর্চি

হীরে আর ব্যাঙ /সংগ্রাহক- পূর্ণিমা দাস/কথক-শম্ভু দাস, গ্রাম- যুগীশোল, থানা-নয়াগ্রাম, জেলা-ঝাড়গ্রাম

হীরে আর ব্যাঙ

সংগ্রাহক- পূর্ণিমা দাস

কথক-শম্ভু দাস, গ্রাম- যুগীশোল, থানা-নয়াগ্রাম, জেলা-ঝাড়গ্রাম


বিলাসপুর নামে একটি রাজ্যে সদাগর নামে এক জেলে তার পরিবার নিয়ে বাস করত। পরিবারের মধ্যে দিল তার বউ ও সদ্যোজাত মেয়ে, সদাগর তার পরিবারকে নিয়ে সুখে শান্তিতেই বসবাস করত। সে প্রতিদিন সকালে উঠে নদীতে মাছ ধরতে যেত। তারপর মাছ ধরে এনে সেগুলো বাজারে বিক্রি করত। মাছ বিক্রি করে যা পেত তাই দিয়ে তাদের সংসার চলত। এইভাবে তাদের দিন কাটতে থাকে। প্রতিদিনের মতো জেলে একদিন মাছ ধরতে গিয়ে দেখে নদীর জলে যেন কিছু একটা ভেসে আসছে। সেটি তার কাছে আসতে সে দেখে একটা ঝুড়িতে এক ছোটো শিশু ভেসে এসেছে। জেলে ছিল প্রচুর দয়ালু। তাই শিশুটাকে দেখে তার করুণা হয়। তাই সে সেই শিশুটাকে নদীর জল থেকে তুলে নিজের বাড়ি নিয়ে আসে। বাড়িতে এসে সে তার বউকে সব কথা খুলে বলে। আর এই শিশুটি ছিল একটি মেয়ে। জেলের নিজেরও একটা মেয়ে আছে। তাই জেলে বলে-“আমার মেয়ের মতো এই মেয়েটিও আজ থেকে এই বাড়িতে আমার মেয়ের মতো থাকবে। আর আজ থেকে আমার দুটো মেয়ে।” কিন্তু জেলের বউ এইসব মেনে নিতে পারে না। কিন্তু জেলের মুখের উপরেও সে কথা বলতে পারে না। জেলে বলে-“আমার মেয়ের নাম হচ্ছে লীনা, আর আজ থেকে আমার এই মেয়ের নাম রাখলাম এলিনা।” এইভাবে দিন কাটতে থাকে। জেলের দুই মেয়ে ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে। লীনাকে তার মা খুব ভালোবাসে কিন্তু এলিনাকে সহ্য করতে পারে না। কারণ এলিনা তার নিজের মেয়ে নয় কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে বলে। কিন্তু এলিনাকে তার বাবা অর্থাৎ জেলে খুব ভালোবাসত, এমনকি এলিনাও তার বাবাকে খুবই ভালোবাসত। এইভাবে দিন পার হতে থাকে। বয়সের কারণে জেলে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। যা দেখে এলিনা খুব কষ্ট পায়। কারণ এই পৃথিবীতে তার বাবা ছাড়া তাকে কেউ ভালোবাসে না। কিন্তু এদিকে জেলে আর সুস্থ হয়ে উঠে না আর কিছুদিনের মধ্যেই মারাও যায়। বাবা মারা যাওয়ার পর এলিনা একেবারে একা হয়ে পড়ে। এমনকি বাবা মারা যাওয়ার পর তার মায়ের অত্যাচার আরও বেড়ে যায়। কারণ তার মা তাকে কোনোদিন নিজের মেয়ের মতো মনে করত না। এলিনাকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করাতো। তাকে ঠিকমতো খেতে দিত না। এলিনাও মুখ বুজে সব সহ্য করে নিতে, কারণ তার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। তাকে দিয়ে ঘর মোছা, ঘর ঝাট দেওয়া, বাগান পরিষ্কার করা, দূরে ঝর্না থেকে জল আনা প্রভৃতি সবরকমের কাজ করাতো। এলিনা সব কাজ করত কিন্তু তার সবচেয়ে কষ্ট হতো দূরে ঝর্না থেকে জল আনতে যেতে। কিন্তু তাও সে কিছু বলতো না সব সহ্য করত। একদিন বাড়ির সমস্ত কাজ সেরে সে ঝর্নাতে জল আনতে গেল। ঝর্নার কাছে গিয়ে সে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কলসিতে জল ভরতে লাগল আর নিজের মনে মনে বলতে লাগল-“হে ভগবান, তুমি আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছ কেন?” 

🍂
ad

এই বলে সে আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। সেই সময় পাশের জঙ্গল থেকে এক বুড়ি বেরিয়ে ঝর্নার কাছে এসে এলিনাকে বলে-“মা, আমার খুব জল তেষ্টা পেয়েছে, তুমি আমায় একটু জল দেবে।” এলিনা ছিল তার বাবার মতো সৎ, দয়ালু আর পরোপকারী। তাই বুড়িমা জল চাইতে এলিনা সহজ মনে তাকে জল খেতে দিল। বুড়ি জল খেয়ে বলল-“খুব তেষ্টা দেয়েছিল মা, এবার অনেক শান্তি পেলাম।” এলিনা খুশি হল। বুড়ি বলল-“তুমি এত কাঁদছিলে কেন মা?” এলিনা তখন তার সব কথা বুড়িকে খুলে বলে। বুড়ি তখন এলিনাকে তার আসল রূপ দেখায়। আসলে এই বুড়ি ছিল এক পরী সে ছদ্মবেশে এলিনার চরিত্র যাচাই করছিল। তারপর সেই পরী এলিনাকে বলল-“তুমি কষ্ট পেও না। তোমার সরলতা দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি তোমাকে আর্শীবাদ করলাম আজ থেকে তুমি যখনই তোমার চোখের জল ফেলবে তা জলের পরিবর্তে হীরে হয়ে ঝড়ে পড়বে। তোমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না।” এই বলে পরী তার জাদুর কাঠির সাহায্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর এলিনা ঝর্নার জল নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। কিন্তু এদিকে তার আসতে দেরি হতে দেখে জেলের বউ অর্থাৎ তার মা খুব রেখে ছিল। এলিনা যখন জল নিয়ে বাড়ি ফিরল, তখন তার মা বলল-“তোমার জল আনতে এত দেরি হল কেন? এদিকে আমি আর আমার মেয়ে তেষ্টায় মরে যাচ্ছি। তুমি কী স্বর্গ থেকে জল আনতে গিয়েছিলে।” এছাড়া আরও নানা কটুকথা তার মা এলিনাকে বলতে থাকে। কিন্তু এলিনা কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মা বলে-“দাঁড়িয়ে আছ কেন নবাব নন্দিনী? যাও রান্নাঘরে জলটা রেখে আমাকে আর আমার লীনা মাকে জল দাও। আমরা তেষ্টায় মরে যাচ্ছি।” এলিনা তখন দৌড়ে রান্নাঘরে চলে যায়, আর তার মায়ের কথাগুলো মনে করে কাঁদতে থাকে। আর সে যখনই চোখের জল ফেলে তখন তা জল নয় হীরে হয়ে ঝড়ে পড়তে থাকে। তার মা এইসব দেখে অবাক হয়ে যায়। সে এলিনাকে বলে এইসব কী হচ্ছে। এলিনা তখন তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা তার মাকে বলতে থাকে। সব কথা শুনে তার মা ভাবতে লাগল “যদি এটা আমার মেয়ের সঙ্গেও হয় তাহলে তো আমার মেয়ের আর কোনো অভাব থাকবে না।” এই ভেবে সে তার মেয়ে লীনাকে ডাকতে থাকে। মায়ের ডাক শুনে লীনা রান্নাঘরে আসে। লীনা বলে-“কী হয়েছে মা, ডাকছ কেন?” তার মা তখন লীনাকে বলে-“তুমি এখনই কলসি নিয়ে ঝর্নার কাছে যাও, আর সেখানে এক বুড়ি যখনই তোমাকে জল চাইতে আসবে তখনই তুমি তাকে জল দিবে। আর তখন ওই বুড়িরূপী পরী খুশি হয়ে তোমাকে বর দিবে।”  

কিন্তু লীনা ছিল খুবই কুঁড়ে প্রকৃতির। সে যেতে চাইল না জল আনতে। কিন্তু তার মা জোর করতে সে আর না করতে পারল না। লীনা কলসি নিয়ে ঝর্নার জল আনতে গেল। ঝর্নার কাছে গিয়ে সে কলসিতে জল ভরতে লাগল। সেই সময় পাশের জঙ্গল থেকে এক সুন্দরী মেয়ে বেরিয়ে এসে লীনাকে বলল-“হে সুন্দরী মেয়ে, আমার খুব জল তেষ্টা পেয়েছে, তুমি আমাকে একটু জল দিবে।” লীনা ছিল ভার মায়ের মতোই হিংসুটে ও স্বার্থপর। লীনা বলল-“না, আমি তোমাকে জল দেব না, আমার মা এক বুড়িকে জল দিতে বলেছে। আর তুমি তো বুড়ি নও, নিজের তেষ্টা নিজে মিটিয়ে নাও। আমি পারবো না।” কিন্তু লীনা এটা জানত না যে এই সুন্দরী মেয়েটাই আসলে পরী। সুন্দরী মেয়েটা তখন তার আসল রূপে অর্থাৎ পরীতে পরিণত হয়। পরী লীনাকে বলল-“তুমি খুবই হিংসুটে ও স্বার্থপর মেয়ে। আমি তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি-তুমি এখন থেকে যখনই কথা বলবে তোমার গলা থেকে কথার বদলে শুধু ব্যাঙের আওয়াজ বের হবে।” পরী এই বলে জাদুর কাঠির দ্বারা অদৃশ্য হয়ে গেল। লীনা তখন আর কিছু না বলে মনের দুঃখে ঘরে ফিরে এল। ঘরে ফিরে আসতে তার মা তাকে বলল-“কী হয়েছে, পরী তোমাকে বর দিল?” লীনা তখন তার মাকে সব কথা বলতে চাইল কিন্তু তার গলা থেকে শুধু ব্যাঙের আওয়াজ বের হল। তার মা কোনো কথাই বুঝতে পারল না। লীনা তখন কোনোমতে পরীর অভিশাপের কথাটা তার মাকে বলল। লীনার মা তখন এইসবের জন্য নিজের দোষ না ধরে এলিনাকে দোষ দিতে লাগল। এলিনা চুপচাপ সব সহ্য করে নিল। এইভাবে কিছুদিন কেটে গেল, লীনা আর ঠিক হল না। একদিন এলিনা ঘরের বাইরে বাগানে ফুলের গাছে জল দিতে দিতে গুনগুন করে গান গাইছিল। সেই সময় সেখান থেকে রাজপুত্র যাচ্ছিলেন তিনি লীনার গান শুনে মুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। আর মনে মনে ভাবতে লাগলেন-“আহা! কী সুন্দর গানের গলা। আমি যদি এই মেয়েকে বিয়ে করি তো আমার জীবন সুরময় হয়ে উঠবে।” এদিকে এলিনা গাছে জল দেওয়া শেষ করে ঘরে চলে যায়। রাজপুত্র এলিনার গান শুনলেও তাকে ঠিকমতো দেখতে পাননি, তাই তাকে ঠিকমতো দেখার জন্য তাদের ঘরের সামনে চলে যান। সেই সময় ঘর থেকে লীনার মা বেরিয়ে এসে রাজপুত্রকে দেখে অবাক হয়ে যায়। সে বলে-“রাজপুত্র, আপনি এখানে কী মনে করে। কোনো দরকার হলে আমাদের ডাকতে পারতেন, আমরা চলে যেতাম। আপনি এত কষ্ট করতে গেলেন কেন?” রাজপুত্র বললেন-“না না ঠিক আছে। আসলে আমি বলছি যে, এখানে একটি মেয়ে গান গাইছিল। সেটি কে? আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।” লীনার মা তথন বলে-“ও আমার মেয়ে।” রাজপুত্র বললেন-“ওকে একটু ডেকে দেবেন। আমি আর একবার ওর গান শুনতে চাই।” তখন লীনার মা এলিনার বদলে লীনাকে রাজপুত্রের সামনে নিয়ে এল। রাজপুত্র লীনাকে বললেন-“তোমার গানের গলা খুব মিষ্টি। তুমি আর একবার গান গাও। আমি এই শঙ্খের মধ্যে তোমার গান ভরে নিয়ে গিয়ে আমার মাকে শোনাব, তিনি খুব খুশি হবেন। আর তোমাকে পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করতে চাইবেন।” 

লীনা তখন গান গাইবার চেষ্টা করল কিন্তু গানের পরিবর্তে তার গলা থেকে শুধু ব্যাঙের আওয়াজ বের হল। রাজপুত্র তখন খুব রেগে গেলেন, তিনি বললেন-“মজা করছ আমার সঙ্গে, তুমি জানো এর শাস্তি কী হতে পারে।” এরপর তিনি তার প্রহরীদের ডেকে বললেন-“প্রহরী, বন্দী করে নিয়ে চল এই মেয়েকে।” সেই সময় ঘর থেকে এলিনা বেরিয়ে এল, সে রাজপুত্রকে বলল-“রাজপুত্র আপনি যে গান শুনেছেন সেই গান আমি গাইছিলাম। আমার বোন লীনা না। লীনা এক পরীর অভিশাপে জন্য এই রকম হয়েছে। ওর কোনো দোষ নেই।” রাজপুত্র এলিনা কে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এমনকি তার সাহসিকতা ও পরিবারের প্রতি ভালোবাসা দেখে খুব খুশি হলেন। এলিনা বলল-“আমার বোন খুব ভালো, আপনি ওকে বিয়ে করতে পারেন। আমি এখনই পরীকে ডেকে ওকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে বলছি।” এই বলে এলিনা পরীকে ডাকে। পরী সেখানে এলে এলিনা পরীকে বলে-“পরী তুমি আমার বোনকে ঠিক করে দাও। তুমি বরং আমাকে যে আশীর্বাদ দিয়েছিলে তা আমার বোনকে দাও আর বোনের অভিশাপ আমাকে দাও।” পরী এলিনার এই সরলতা দেখে খুশি হয় এবং লীনাকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করে এবং বলে-“এলিনা তোমার আর্শীবাদ তোমার কাছেই থাক্।” এই বলে পরী অদৃশ্য হয়ে যায়। এলিনার এই ভালোবাসা দেখে লীনা ও তার মা তাদের ভুল বুঝতে পারে। রাজপুত্র এলিনার এই সৎ, দয়ালু চরিত্র দেখে খুশি হয়ে এলিনা কে বলেন -“এলিনা আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আর তুমি চিন্তা করো না তোমার এই বোনকেও আমার ছোটো ভাই খুশি মনেই বিয়ে করবে।” তারপর কিছুদিনের মধ্যেই দুই রাজপুত্রের সঙ্গে দুই বোনের বিয়ে হয়ে যায়, আর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।

Post a Comment

0 Comments