নর-রাক্ষস
অমিত কুমার রায়
রথ এলেই নানান কথা মনে পড়ে। রথের মেলায় কত রকমের খাবার সম্ভার! হাজারো সম্ভারের পরিবর্তনও হয়েছে। পুতুল নাচের আয়োজন, পরার জিনিস, মাখার জিনিস, দেখার জিনিস, চাপার জিনিসও এসে হাজির। তবে আগের মত নেই পুতুল নাচের পালা দেখার আশ্চর্য সরল চোখ আর ধৈর্য। নেই সেই গর্তের ভেতর মরণ নৃত্য, বাইকের ঘূর্ণন-গতি ভোঁ ভোঁ ভটভট ভোঁ ও ও! নিচে থেকে দেয়াল বেয়ে নির্দিষ্ট গতি বেগে ঘুরে চলা! বিনোদন সুন্দর তবে পদস্খলনের কিন্তু নেই। ওই ভয়াবহ জীবন যুদ্ধের খেলা আমার মতো ভীতু মানুষ বলবে না এই খেলা ভাল। নাগরদোলা আছে মেলায়। এই বয়সে চাপলে মাথা ঘুরে অক্কা হ'তেও পারি! সেই আশ্চর্য চোখ নেই, যে চোখে কৈশোরে বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় এক টাকায় দেখতে ঢুকেছিলাম নর রাক্ষস। বাপরে বাপ সে কি তেজ। সব্বাইকেই আগে থেকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল--- খুব সাবধান কাছে ঢুকে আসবেন না। নর রাক্ষস যদি দড়ি ছিঁড়ে ফেলে তবে সে যে কাউকে দাগি করে দিতে পারে, কামড়ে কামড়ে মাংস তুলে নিতে পারে!
সুতরাং আমরা চার বন্ধু শেষের দিকে দেখতে অসুবিধা হলেও দূরেই থাকলাম। একটা যুবক বসে আছে, তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে মোটা দড়ির টান দিয়ে বাধা হলো। তারপর একজন মন্ত্র পড়া জল তার গায়ে ছড়িয়ে দিল! তারপর সে আস্তে আস্তে রাক্ষসের মত আচরণ শুরু করল! তার চেহারা মূর্তি পাল্টে গেল। আস্ত একটা জ্যান্ত মুরগিকে সে ছিঁড়ে রক্ত সমেত খেতে লাগলো! ওই সময় আলোর ঝলকানি বড্ড বেশি থাকায় মুরগি সে খাচ্ছিল নাকি রক্ত মুখে মাখল বোঝা গেল না। মন্ত্রশক্তি হলো বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল পরিস্থিতি অর্থাৎ ম্যাজিক।
রথের মেলায় এখন আর একটা জিনিস চোখে পড়ে না তা'হল চিড়িয়াখানা, মিনি চিড়িয়াখানা। এখন জীবজন্তু রাখা নিষিদ্ধ, থাকতো কাকাতুয়া পায়রা হায়না মেছো বিড়াল ইত্যাদি।
আমাদের ঝিকিরা হাওড়াজেলার রথের মেলা শতাব্দী প্রাচীন। ন-চূড়া রথ উচ্চতায় প্রায় ত্রিশ ফুট। রথের গায়ে কত রকমের কাঠের কারুকার্য! প্রথম রথে রথের সমুখ তা ফিরতি রথে পিছনদিক হয়ে যায়। সামনে ধুতি পাঞ্জাবি পরা নব কার্তিক সারথি এবং নিচের দিকে দিল্লি চলোর মত জোড়া ঘোড়া হয়! হয়!.... ছোটবেলায় দেখলেই ভয় পেতাম কারণ পড়শী গ্রামের রথের মতো ছোট রথও নয় আর টিকটিকির মত ঘোড়া নয়! এ আস্ত আস্তাবলের কাঠের জ্যান্ত শ্বেত ঘোড়া জোড়া ডাগর হয়! হয়! দেখলেই ভয় হয়! মোটা চেইন দিয়ে টান টান করে বাঁধা। মাথার চূড়ার ওপরে মানুষ মুখ পক্ষীটি কে! পরে জেনেছিলাম গরুড় স্বয়ং নারায়ণের বাহন। রথের পিছনে ধ্যানমগ্ন এক ঋষি থাকতেন, এখন তিনি নেই। সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে হয়তো বল্মীকের মুখ্য ভক্ষ হয়েছেন! সেই মুনিকে সব্বাই এমনকি আমিও মনিবুড়ো বলতাম! অনেক ক-অক্ষর পশু-মাংসরা বুড়ো দাদুর গালে দুবেলা চড় থাপ্পর কষিয়ে দিতেও ছাড়েনি।.......
মল্লিক বাড়ির রথ হলে কি হবে মেলা মানে জনগণেশের হাজারো ঠ্যালা।
🍂
কৈশোরে দিদির সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে বেতের কুলো তালপাতার টোকা পেকে কিনে বাড়ি ফিরতাম। যদিও বাড়ি থেকে মেলার দূরত্ব মোটে একশো মিটার। আমার বায়নার মধ্যে ছিল তামার অথবা পিতলের আংটি আর কলা পাতায় ঘুগনি কিনে খাওয়া। এছাড়াও জিলাপি পাপড় বাড়িতে আসতো সন্ধ্যায়। আগে রথ টানা হলে এসে দাঁড়াতো আমাদের বাড়ির কাছে বড় রাস্তায়। গ্রামে ইলেকট্রিক আস্তেই তা ১০০ গজ দূরে চলে গেছে রথ পোস্টের তারের ক্রসিং জালের জন্য। আগে এক মাস ধরে রথের মেলা হত। সন্ধ্যে হলেই ঠ্যালা খেতে খেতে মেলায় ঢুকতে হতো। হ্যাঁ মেলায় গেলে তালপাতার সেপাই কেনার ঝোঁক বড্ড ছিল আর রহস্যের সেই বাঁদর যা পরে কে.সি নাগের অংকের মধ্যেও পেয়েছি! লোহার শিকে প্লাস্টিক বাঁদর উঠছে নামছে। এখন আমাদের এখানে বাঁদর অর্থাৎ বানর নেই আছে হনুমান তবে ওদের জন্য বড় বড় গাছ আর নেই তেঁতুল আম জাম গাব করমচা নিম। এখন মেলা ছোট করা হয়েছে ব্যস্তময় জগতের জন্য মোট ৯+১=১০ দিন। রাম যাত্রা, কেষ্ট যাত্রা নেই, পুতুল নাচের আগের মত আকর্ষণ ফুরিয়েছে।
তখন ফুচকা পাপড়ি ছিলনা ঘুগনি ছিল, ছিল জিভে গজা পাপড় ভাজা তেলেভাজা এখন দিনে দুপুরে রাত্রে ভিড় ফুচকার দোকানে! ফুচকা এখন জেনারেল কাস্ট। হ্যাঁ তালপাতার পাখা পাব কোথায়? গাছগুলোর ও তো নিপাতনে সিদ্ধি লাভ ঘটেছে। প্লাস্টিক হঠাও যতই বলি ছিনে জোঁকের মত জড়িয়ে ধরে, মুখে কে আর নুন দেবে?
আজকাল যতই প্রচার হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জন করুন কিন্তু করুণ দৃশ্য টা হল সস্তায় প্লাস্টিকের পুতুল, প্লাস্টিক কাপ, প্লেট, ব্রাশ, গ্লাস, বাটি মেলায় পাওয়া যায়। খুঁজে পাই না পোড়ামাটির পুতুল, চিনেমাটির কাপ গ্লাস থালা বাসন। দোষ দেবো কাকে অদৃষ্টকে দোষ দেয়া মুর্খামি। নাতির জন্যে একটা দুটো করে প্রায় দুটো সিমেন্টের বস্তা ভর্তি প্লাস্টিকের খেলনা সম্ভার! ভাবি ওরা কোথায় মিশবে? কোন্ মাটির সঙ্গে বিলীন হবে!
ধামা কুলো টোকা পেকে তালপাতার পাখা মনে হয় মিউজিয়াম আলো করে রেখেছে। আমার স্মৃতির একটা জিনিস তাহলো পাথরের থালা। ওই কালো দেড় ইঞ্চি বেড় উঁচু থালায় মা দীপাবলিতে প্রদীপ সাজাতো, চালের পিটুলির সুখ প্রদীপ। সেদিন বাগানের ঘাস পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখি পাথরকুচি গাছের বনে পাথরের থালা কে রেখেছে বুঝে বুঝতে পারলাম না। রাগলাম না, শুধু বুকটা অদৃশ্য পাথর হয়ে গেল!
যুগের হাওয়ায় এখন কটু কথার দুর্গন্ধ। আগের মত শ্রদ্ধাশীল মন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
রথের মেলা থেকে এবার কালী মন্দিরে আসি। শ্মশান কালী জাগ্রত কালী। প্রাচীনকাল থেকে পূজিতা। আগে ২-১০ টা গ্রামের মানুষ পূজায় অংশ নিতেন এখন তা বেড়ে অগুনতি।দূর দূরান্ত থেকে পুজো দিতে পুজো দেখতে মানত পূরণ করতে আসে।
এবার মানতপূরণ বা মানসিক কথায় আসি। মানুষের মানসিক বুদ্ধির গাছের শিকড়ের নিচে শুধুই কুসংস্কারে বদ্ধ ঘর। না আছে বায়ু না আসে আলো। পুজোর রাতে গর্বের সঙ্গে আর্তনাদ প্যাঁ প্যাঁ ভ্যা ভ্যা বলির মানসিক দিয়ে অপেক্ষা করে কূপমণ্ডকরা। গভীর রাতে কখন হবে সমাপতন। নর রাক্ষসদের চোখ জ্বলজ্বল করে জীভ লকলক করে। রাত পোহালেই আদা রসুন সহযোগে মাংস রান্না।
আমি যৌবনে বহুকাল আগে ওই নরপিশাচদের বলির উল্লাস দেখেছিলাম। সবাই মা মা বলে চিৎকার করছে ঢাক ঢোল কাশি ব্যাঞ্জোর উগ্র উল্লাসে ছাগ-কন্ঠ হরাইজনটার গতিতে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক বলেও গর্বের প্রাচীন প্রথার রেওয়াজ রেওয়াজি পাঁঠার প্রাণ জনগণমন-অধিনায়ক নর রাক্ষস হওয়ার দৌড় থেকে কেউ ফেরাতে পারছে না। কালী মায়ের দুদিকে ডাকিনী যোগিনী আছে প্রতীক মাত্র! আসলে মানুষের মনের মধ্যে কাপালিক নর রাক্ষসদের রমরমা। পুজোর মধ্যে এসে গেছে আড়ম্বর, প্যান্ডেলের জৌলুস শ্রদ্ধা ভক্তির নির্মাল্য দান নির্মল কিনা জানিনা; তবে নির্মম বলে মনে হয়। পশু বলিদানে নর রাক্ষসদের মন থেকে রাক্ষস যেদিন বিদায় নেবে সেদিন হয়তো মহামানবের সাগরতীর্থে নতুন নর দেবতার জন্ম হবে। হৃদয় কুসুমে লোভ হিংসার বলিদান হবে। নতুন পৃথিবীর শিশুরা বড় হবে মানবতার পেলব-বন্ধনে। আগামী সূর্যের মতো উজ্জ্বল আলোয় গর্ব করে বলবে আমি বিশ্বাস বিবেক বিশ্বের সত্যময় ঈশ্বর কণা।
0 Comments