জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২৫৩চীন (এশিয়া)এক আকাশে দশ-দশটা সুর্য /চিন্ময় দাশ


দূর দেশের লোকগল্প— ২৫৩

চীন (এশিয়া)

এক আকাশে দশ-দশটা সুর্য

চিন্ময় দাশ


সেই কোন আদ্যিকালের কথা। আকাশে যে দেবতারা থাকেন, তাদের রাজা হলেন বিধাতা। দশ-দশটি ছেলে সেই বিধাতার। সকলেরই নাম সূর্য। প্রত্যেকেই তারা বেশ জোয়ান মদ্দ। আর, গায়ের কী রঙ তাদের। একেবারে উজ্বল সোনার বরণ। আলো ছিটকে বেরোচ্ছে তাদের শরীর থেকে। চোখ ঝলসে যায় সে আলোয়।

এতগুলো ছেলে। থাকবে কোথায়? অনেক ভেবে, পারিজাত গাছের কথা মনে পড়ল বিধাতার। স্বর্গের সেরা গাছ হোল পারিজাত। সেখানেই একটা ব্যবস্থা করলেন তিনি। বিশাল আকারের ঝাঁকড়া একটা পারিজাত গাছ বেছে নিলেন। তার ডালে দশজনের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। 

পৃথিবীতে তখন তেমন আলো ছিল না। বিধাতা একটা নিয়ম করে দিলেন। প্রতিদিন একটি করে সূর্য গাছ থেকে নেমে, আকাশে উঠে যাবে। সারা দিন আকাশে থেকে, সন্ধ্যে বেলায় গাছে ফিরে আসবে। পরের দিন আর একজন ছেলে যাবে আকাশে। প্রথম দিন বড় ছেলে যাবে আকাশে। পরের দিন মেজো ছেলে। তার পরের দিন সেজো। এইভাবে ছোট ছেলের আকাশ সফর হয়ে গেলে, আট দিনের আবার বড় ছেলে গিয়ে উদয় হবে আকাশে। এইভাবে এক একজন সূর্য এক একদিন আকাশে উঠে বিরাজ করবে। আলো পাবে পৃথিবী। 

🍂

আকাশে একটা সূর্য মানেই নিয়মিত আলো আর উত্তাপ। পৃথিবীর মানুষজন, জীবজন্তু, পাখ-পাখালি, বন-পাহাড়, নদী-নালা, পাহাড়-প্রান্তর সকলেরই সুবিধা হোল তাতে। বেশ সুখে শান্তিতে নির্বিবাদে জীবন বয়ে যেতে লাগল সকলের।

এই ভাবে দিন যায়, মাস যায়, বছরের পর বছর যায়। হঠাৎ একবার ঝামেলা বেধে গেল। পোকা কিলবিল করে উঠল বিধাতার দশ ছেলের মাথায়। তাদের মনে হতে লাগল, যেদিন যে আকাশে উঠল, সারাটা দিন তাকে একলাটি কাটাতে হয়। দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার উপায় নাই। দুটো কথা বলবে কারও সাথে, উপায় নাই তারও। সারা দিন একলা একলা আকাশের এ মাথা ও মাথা ঘুরে বেড়াও। ভারি একঘেয়ে ব্যাপার। এটা চলতে পারে না। 

সবাই এক মত হয়ে ঠিক করল, দশ জন মিলে একসাথে আকাশে যাবে। সারা দিন খেলাধুলো হই-হুল্লোড় হবে। কারুরই মন খারাপের ব্যাপার থাকবে না তাতে। 

কিন্তু একসাথে দশখানা সূর্য আকাশে থাকলে যা হয়। ভয়াণক গরম। খেতের ফসল শুকিয়ে খড় হয়ে গেল। ছোটবড় গাছপালা  পুড়ে খাক। খাল-বিল শুকিয়ে কাঠ। 

পেটে দেওয়ার খাবার চাই, গলায় ঢালবার জল চাই। মানুষজন, জীবজন্তুর পরিত্রাহী অবস্থা। চারদিকে হাহাকার। গরু-ভেড়া মারা পড়তে লাগল। রোদের তাতে মুখ-চোখ জ্বলে যাওয়ার জোগাড়। দিনমানে বাইরে বের হতে পারছে না কেউ। ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে মানুষজনকে।

দেশের রাজা অসহায়ের মত দেখছেন। করবার কিছু নাই তাঁর। সারাদিন মন্দিরে পড়ে থেকে, ভগবানকে ডাকেন কেবল। 

একদিন রাজার কাতর আবেদন শুনলেন বিধাতা। বুঝলেন, তাঁর ছেলেরাই ঝামেলা পাকিয়েছে। তাঁকেই এর বিধান করতে হবে। একজন নামকরা তীরন্দাজকে পাঠালেন রাজার কাছে। 

সে তীরন্দাজ নামকরা বলে নামকরা। মাইলের পর মাইল দূর থেকে, এক তীরে একটা গাছকে মাটিতে শুইয়ে দিতে পারে সে। তীরন্দাজ এসে হাঁটু মুড়ে বসল রাজার সামনে—বলুন, হুজুর! কী করতে হবে। 

রাজা তাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন। চারদিক থেকে প্রজাদের কান্না ভেসে আসছে। এভাবে চললে, গোটা রাজ্যটাই পুড়ে খাক হয়ে যাবে। বেশি সময় লাগবে না।

পরদিন সকাল। রাজাকে নিয়ে খোলা মাঠে এসে দাঁড়িয়েছে তীরন্দাজ। হাতে বিশাল একখানা ধনুক। পিঠের তূণীরে গুণে গুণে দশটা তীর। রাজাকে কূর্ণিশ ঠুকে বলল—আপনি কেবল দাঁড়িয়ে দেখুন। চরম শিক্ষা দেব আজ আমি বদমাসগুলোকে। দশ তীরে দশটার খেলা সাঙ্গ করে দেব এখুনি।

দশটি সূর্য উঠেছে আকাশে। একটা তীর ধনুকে জুড়েছে তীরন্দাজ। রাজামশাই বুঝতে পারছেন না, ব্যাপারখানা কী হচ্ছে। 

 প্রথম তীরেই একটা সূর্যকে গেঁথে দিয়েছে তীরন্দাজ। কিছুক্ষণ বাদেই একঝাঁক পালক উড়তে দেখা গেল বাতাসে। তারপর বিশাল চেহারার একটা কাক এসে আছড়ে পড়ল মাটিতে। তীরটা তার বকে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেঁথে আছে। আকাশে তখন একটা সূর্য কম। নটা সূর্য দেখা যাচ্ছে কেবল। 

এইভাবে একটা করে তীর ছুটে যাচ্ছে আকাশে। একটা করে কাক এসে পড়ছে মাটিতে। আটটা কাক পড়ে গিয়েছে। নবম সূর্যের জন্য তীর হাতে নিয়েছে তীরন্দাজ। রাজামশাই ভারি ভড়কে গেলেন। শেষ সূর্যটাকেও যদি মেরে ফেলে, তাহলে নতুন বিপদের সামনে পড়তে হবে। আলো থাকবে না। রোদের তাত থাকবে না। অন্ধকারে ঢেকে যাবে পৃথিবী। প্রাণ থাকবে কী করে? 

তীরন্দাজকে কিছু না বলে, টুক করে তার তূণীর থেকে শেষ তীরটা তুলে নিলেন রাজা। নিজের জোব্বার ভিতরে লুকিয়ে রেখে দিলেন।

নবম কাকটা পড়ে যেতে, শেষ তীরের জন্য তুণীরে হাত বাড়িয়েছে তীরন্দাজ। তীর তো তখন উধাও। তুণীর খালি। রাজার মুখে মিষ্টি হাসি। বললেন—তোমার কাজ শেষ। চলো, রাজবাড়িতে তোমার ভোজের আয়োজন করা হয়েছে।

সেদিন থেকে আকাশে আর দশটা সূর্য নাই। সূর্য একটাই। আলো দেয়। উত্তাপ দেয়। মানুষজন, জীবজন্তু, গাছপালা প্রাণে বেঁচে থাকতে অসুবিধা হয় না কারও।

অসুবিধা কেবল একজনের। সে হোল বেচারা দশ নম্বর সূর্য। বিধাতা পুরুষের ছোট ছেলে। সারাদিন একেবারে একা। কথা বলবার কেউ নাই। খেলাধুলার কেউ নাই। আকাশে এ মাথা ও মাথা একেবারে একলাটিই ঘুরে বেড়াতে হয় বেচারাকে।

Post a Comment

0 Comments