জ্বলদর্চি

বই বনাম ই-বুক /প্রসেনজিৎ রায়

বই বনাম ই-বুক
       
প্রসেনজিৎ রায়


পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বই প্রকাশ করে যে দেশ, তার নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে যথাক্রমে চীন ও যুক্তরাজ্য । ভারতের স্থান এই তালিকায় প্রথম দশের মধ্যেই- নবম স্থানে আছে।তবে গড়পড়তা বই পড়ার দৌড়ে ১ম, ২য় ও ৩য় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও যুক্তরাজ্য। ১ জন  আমেরিকান যেখানে বছরে গড়ে ১৭ টা করে বই পড়েন, সেখানে একজন ভারতীয় ও ইংরেজ বছরে  গড়ে যথাক্রমে ১৬ টা ও ১৫ টা করে বই পড়েন। একজন আমেরিকান যেখানে সপ্তাহে ৭ ঘন্টা বই মুখে কাটান, সেখানে একজন ভারতীয় বই  পড়ে কাটান সপ্তাহে ৭ ঘন্টার দু-চার মিনিট কম। আর ইংরেজদের ক্ষেত্রে এই সাময়িকতা সপ্তাহে সাড়ে ছয় ঘন্টা ।

বিশ্বজোড়া বইপোকাদের প্রবণতা অনুসন্ধান করলে যে চিত্র ফুটে উঠছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশে দেশে বই-এর সাথে সময় কাটানো একটু হলেও কমছে, কিন্তু বই-এর বিক্রি, ব্যবসা তথা প্রকাশনার পরিমাণের গ্রাফ চড়াই এর দিকে। পাল্লা দিয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে ই-বুক। সাথে সাথে মানুষ অভ্যস্ত হচ্ছে অডিও-বুক শোনাতেও। 
🍂

বিতর্ক ওঠা স্বাভাবিক যে কোনটি বেশি ভালো? কোনটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য ? কাগজের পৃষ্ঠা নাকি ই-বুকের পর্দা না অডিও বুক! এখনও পর্যন্ত সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে  কাগজ এগিয়ে থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে বলা মুশকিল। 

বিজ্ঞান কিন্তু এখনও প্রমাণ করতে পারেনি যে ( অর্থনৈতিক কারণ ছাড়া) কাগজের বই ডিজিটাল বই-এর থেকে বেশি ভালো বা অধিকতর গ্রহণযোগ্য।

শিক্ষাবিজ্ঞানে 'রিটেনশন' বলে একটা কথা আছে। একাডেমিক গবেষণায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রিটেনশন বা "ধরে রাখা"র উপর জোর দেওয়া হয়। বই পড়া বা শেখার পর পাঠক পঠিত বিষয়ের কত অংশ মনে রাখতে পারে বা সম্পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে!    কাগজের বই এই নিরিখে কী এগিয়ে থাকবে ?

 এই প্রসঙ্গে দুটি গবেষণার কথা বলা যেতে পারে। প্রথমটিতে বেশ কিছু
 শিক্ষার্থীকে কাগজের উপর এবং আর এক দল শিক্ষার্থীকে অন-স্ক্রিন পিডিএফ-এ একই লেখা পড়তে দেওয়া হয়। অপর গবেষণাটিতে শ্রেণীকক্ষে কিছু শিশুকে কাগজের বই এবং কিছু শিশুকে আইপ্যাড থেকে একই বিষয়বস্তু পড়তে দেওয়া হয়। দুটি গবেষণাতেই অন-স্ক্রীণ পাঠ এবং কাগজের পৃষ্ঠা থেকে পাঠ-এর মধ্যে কোনও অর্থপূর্ণ এবং শিক্ষাবিজ্ঞানসন্মত পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় নি।

বিশ্বজুড়ে নানা গবেষণায় বারবার প্রমাণ হয়েছে পড়ার অভ্যাস শুধু শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তি বৃদ্ধির  ক্ষেত্রেই উপযোগী নয়, বরং এই অভ্যাস প্রাপ্তবয়স্কদের মস্তিষ্কের বিকাশকেও অব্যাহত রাখতে সহায়ক ভূমিকা নেয় । পাঠাভ্যাস মানুষের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে ব্যায়ামের কাজ দেয়। দেখা গেছে,  বয়স বাড়ার সাথে সাথে, স্মৃতিভ্রম বা তথ্যভান্ডার হ্রাসের প্রবণতা কমাতেও ভূমিকা নেয় লাগাতার পাঠাভ্যাস।

 সমীক্ষা করে  মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন যেসব মানুষ নিয়মিত কথাসাহিত্য পাঠ করেন তাঁদের মানসিক বুদ্ধিমত্তা তুলনায় বেশি হয়- তাঁরা নিজের এবং অন্যদের মানসিক অবস্থাকে বিশ্লেষণ  করার ক্ষমতা রাখেন অনেক বেশি। অন্যদেরও যে বিভিন্ন ইচ্ছা, আবেগ এবং চিন্তাভাবনা থাকতে পারে তা বোঝার ক্ষেত্রে কথাসাহিত্য বা বইপাঠকদের অতিরিক্ত ক্ষমতা আছে বলে গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে।  নিয়মিত যাঁরা বই পড়েন, মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা, তাঁরা অন্যান্য মানুষের প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল।

 বই পড়া-র সুঅভ্যাস যে শুধু আমাদের  মস্তিষ্কের জন্য উপকারী একটি ব্যায়াম তাই নয়, বারবার মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন,  মানসিক বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বই পড়া অন্যতম সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে।মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থকে আজকের এই জটিল যুগে ভালো খাবার দেওয়া দরকার, আর মনোবিদ-দের বই-ই হলো সেই সহজলভ্য  ভালো খাবার। 

 মস্তিষ্কের সুসংহত বিকাশের জন্য বই পড়া অপরিহার্য- এ আর কোনো গড়পড়তা কনসেপ্ট নয়।  শিশুদের বিকাশমান মস্তিষ্কের  জন্য জন্য এই অভ্যাস "ভালো" বললে কমই বলা হয়। সোসাইটি ফর রিসার্চ ইন চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট-এর  গবেষণায়
দেখা গেছে, যেসব শিশু  কম বয়সে বই পড়া শুরু করে তাদের
পারফর্ম্যান্স কিছু বুদ্ধিমত্তা-র পরীক্ষায় তুলনামূলকভাবে অনেকটাই ভালো। এইসব পরীক্ষার মধ্যে অন্যতম উপাদান ছিল বিভিন্ন শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ বা ভোক্যাবুলারি স্কিলস।
শুধু মস্তিষ্কের প্রসার বাড়ানো ছাড়াও পাঠককে  আরও ভালো মানুষ হিসাবে গড়ে  তুলতে পারে বই পড়ার অভ্যাস। শুধুমাত্র তথাকথিত উচ্চমান বা আদর্শের বই নয়,  ভালো লাগা  কল্পবিজ্ঞান, রূপকথা বা  রহস্যকাহিনী থেকেও  মস্তিষ্কের শক্তিবৃদ্ধির এইসব সুবিধা পেতে কোনো অসুবিধা নেই।

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সারা বিশ্বজুড়েই এখন বইপড়ার একটি অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ডিজিট্যাল বুক ও অডিও বুক। অনেক ক্ষেত্রে খুব কম খরচে  ডিজিটাল বই পড়া যায়। বিশ্বের বিভিন্ন লাইব্রেরি এখন মূলত কয়েকটি অ্যাপের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। শুধু অ্যাপগুলি ডাউনলোড করে,  লাইব্রেরি কার্ড নম্বরটি ব্যবহার করলেই   বিনামূল্যে ই-বুক এবং অডিওবুক-এর নাগাল পাওয়া যেতে পারে।  পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে  ডিজিটাল বা অডিও মাধ্যম-ও কম উপকারী নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বিছানায় ঘুমের আগে শুয়ে বই পড়া শরীরকে ঘুমানোর  ইঙ্গিত দেয়। আবার, আচরণবিজ্ঞানীরা মনে করেন কেউ যদি সন্ধ্যায় খবরের কাগজ পড়ায়  অনেকক্ষণ সময় কাটান, তাহলে এই অভ্যাসের কারণে  ঘুমানোর আগে ফোন দেখার  খারাপ নেশা কাটাতেও সহায়ক হতে পারে। তবে ফোনের স্ক্রীনে বই বা কাগজ পড়ার সময় স্ক্রীন-লাইটের তীব্রতা কম রাখা দরকার। অডিওবুক নিয়মিত শুনলে মস্তিষ্কে "টেম্পটেশন বান্ডলিং" প্রক্রিয়া জোরদার হয়।  পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি নিরীক্ষায় কিছু
জিম-ব্যবহারকারীকে একটি করে  রোমাঞ্চকর অডিওবুক শুনতে  দেওয়া হয়েছিল। দেখা গেছে ঐ গল্প শুনতে শুনতে যাঁরা শারীরিক কসরৎ করছিলেন তাঁদের পারফরম্যান্স অন্যদের থেকে তুলনায় অনেক ভালো।  উত্তেজক থ্রিলারগুলিকেই এক্ষেত্রে ফিট হওয়ার প্রকৃষ্ট উপায় বলে বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ। 

পড়ার অভ্যাস মস্তিষ্কের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষমতা রাখে। এক কাজ থেকে বিরতি নিয়ে  অন্য কাজে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে  বিভিন্ন মানসিক দক্ষতার প্রয়োজন হতে পারে আর নিয়মিত পড়ার অভ্যাস এই দক্ষতার সঠিক প্রয়োগ ঘটায়। নিয়মিত যিনি বই পড়েন তাঁর তাঁর তাৎক্ষণিক মনোযোগ এবং স্বল্পমেয়াদী স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে পারে। 

কর্মক্ষেত্রে কোনো কারণে আগ্রহ বা উৎসাহের অভাব ঘটলে, সমাধান হতে পারে  মধ্যাহ্নভোজের বিরতির সময় কয়েক পৃষ্ঠা বই পড়া।

 হঠাৎ করে বই পড়ার অভ্যাস যেকোনো বয়সেই গড়ে তোলা একটু মুশকিল। সেক্ষেত্রে অডিওবুক খুব ভালো বিকল্প হতে পারে।
দিনে পাঁচটি পৃষ্ঠা পড়ার জন্য প্রথম প্রথম  অডিওবুক অ্যাপ বা ই-রিডার-এর  সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

পড়ার অভ্যাস একটু একটু করে বাড়ালে ইতিবাচক মানসিক পরিবর্তন টের পাওয়া যাবেই।
 অডিওবুক শ্রোতার চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতিকে প্রভাবিত করে। এই শ্রবণ-কে মনোবিদরা  "পড়া" হিসাবেই গণ্য  করেন। আজকের ব্যস্ততার যুগে বই পড়া-র বদলে বই শুনলেও মস্তিষ্কের ব্যায়াম তো হয়-ই, মনকে একঘেয়েমি থেকে মুক্ত করতেও এই শ্রবণ অত্যন্ত উপযোগী।
গবেষণায় দেখা গেছে, অডিওবুকগুলি সাদা-কালো পৃষ্ঠার আসল বই-এর মতোই মস্তিষ্ককে গভীরভাবে উদ্দীপিত করে। তবে অনেকে মনে করেন মস্তিষ্কের ধূসর পদার্থের উপর সাধারণ কাগুজে বই যে প্রভাব ফেলে, এই শ্রাব্য বই-এর প্রভাব তার চেয়ে  কিছুটা ভিন্ন। একটা গল্প শোনার সময় আমাদের মস্তিষ্ক শব্দগুলিকে ডিকোড এবং বোঝার জন্য একটু ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে। যখন ছাপা বই পড়া হয় তখন পাঠককে নিজস্ব  প্রসোডি সৃষ্টি করে  কথার সুর এবং ছন্দ, স্বর, নির্দিষ্ট সিলেবলের উপর চাপ ইত্যাদি কল্পনা করতে হয়। কিন্তু অডিওবুক শোনার সময় কণ্ঠশিল্পীর উচ্চারণ পাঠকের মস্তিষ্কে কেবল শ্রবণ-প্রসোডি বোঝার জন্য কাজটুকুই করে।

 ই-রিডার সাথে রাখলে যেকোনো সময় আন্তর্জালের পৃষ্ঠা ঘুরে দেখা সহজ হয়ে যায়।  বিবেচনা করার মূল বিষয় হল আপনি কোন বই পড়তে পছন্দ করেন। সেই বই অনস্ক্রিণ হোক বা অফস্ক্রিন- আপনার সঙ্গী হোক, শ্রেষ্ঠ সঙ্গীর সাথে গড়ে উঠুক আত্মিক বন্ধন।

Post a Comment

1 Comments

  1. প্রয়োজনীয় কথা লিখেছেন আজকের দিনের সমস্যা নিয়ে। তবে ইবুক পড়তে গেলে আলোর দিকে তাকিয়ে পড়তে হয়। তা বেশিক্ষণ পড়লে চোখের জন্যে পীড়াদায়ক, মুদ্রিত বইয়ের ক্ষেত্রে তা নয়, পর্যাপ্ত আলো বইয়ের পাতায় পড়লে বই পড়ায় কোন অসুবিধা নেই ।

    ReplyDelete