হলো না বলা
পুলককান্তি কর
চোখটা খুলে চারপাশে তাকাতে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ করল রীমা। চারপাশে অনেক গুলো বেড, কোণের দিকটায় কয়েকজন সিস্টার বসে আছে। ওদের সামনে ওই লোকটা। হ্যাঁ, হ্যাঁ ওই লোকটাই তো! ওই বা হাসপাতালে এল কেন? এবার ধীরে ধীরে নিজের দিকে নজর দিল সে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, হাতে স্যালাইন। এসব ভাবতে ভাবতেই লোকটা এগিয়ে এল তার দিকে। হাসি হাসি মুখ করে বললো, এই তো চোখ খুলছেন, ভালো। যাই সিস্টারকে খবরটা দিয়ে গে।
একটু বাদে লোকটা ফিরে এসে বসল ওর বেডের সামনে রাখা একটা স্টল এ। রীমা বলল, আমি এখানে কেন?
-- আপনার মনে নেই কিছু?
রীমার মনে পড়ল সে একটা পার্কে গিয়েছিল বিকেলে বেলা। সেখান থেকে ফেরার সময় পেছন থেকে একটা কিছু ধাক্কা লাগে আর কিছু মনে নেই তার। একটু থেমে বলল, আপনি বা এখানে কী করে?
-- অদৃষ্ট।
-- মানে?
আপনাকে রাস্তার কেউ বোধ হয় হাসপাতালে দিয়েছিল; আমাকে এই হাসপাতালে থেকে ফোন করেছিল।
-- আপনার ফোন নম্বর পেল কী করে? আমার মোবাইলে তো আপনার নাম সেভ করা নেই।
-- আপনাকে আমার নাম্বারটা কাগজে লিখে দিয়েছিলাম তো। হয়তো সেইটাই আপনার হাতে ছিল, ওরা সেটাই প্রথমে ট্রাই করেছে।
-- আপনি আমাকে চেনেন না, জানেন না – আপনি মিছিমিছি ঝামেলায় জড়াতে গেলেন কেন?
-- আপনাকে তো আগেই বলেছি ম্যাডাম, আমি বেশী কিছু ভেবে কাজ করি না। আমাকে যখন ফোন করেছিল, আমি এই চত্বরেই ছিলাম। এসে দেখলাম আপনি সদ্য মুখ চেনা, অস্বীকারই বা করি কী করে?
-- ভালো। আপনার নাম।
-- অনিন্দ্য।
-- বাঙালি? কোথায় বাড়ি?
-- মুর্শিদাবাদ। আপনার?
-- আমি রীমা, মেদিনীপুরে বাড়ী।
-- এখানে আপনি কী করেন?
-- আমি পি এইচ ডি করছি তিরুপতি ইউনিভার্সিটিতে।
-- ওঃ। তা আপনার বাড়ীর লোককে তো খবর দেওয়ার দরকার?
-- থাক, দরকার নেই। অকারণ চিন্তা করবে সব।
-- কে কে আছেন বাড়ীতে?
-- বাবা, মা আর ছোট ভাই। আচ্ছা এখানে আমাকে তার কতদিন রাখবে?
-- বলেছে তো বাহাত্তর ঘন্টা আবজর্ভেশনে রাখবে। স্ক্যানট্যানও করবে আজ।
-- ওসব না করলে হয় না?
-- আসলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন তো। এরা রিস্ক নেবে না।
-- এটা কি খুব বড় হাসপাতাল? মানে কষ্টলি খুব?
-- তাইতো মনে হয়।
-- আপনি আমার বাবাকে এক বার ফোন করে দিন তাহলে।
-- এই তো বলছিলেন অকারণ ওঁদের বিব্রত করবেন না।
-- এত টাকা কী করে ব্যবস্থা হবে? আমার কাছে তো অত টাকা নেই।
🍂
-- বাবা কী করেন?
-- ছোট খাটো একটা দোকান আছে। গ্রামের দোকান, ধারই বেশী।
-- ঠিক আছে, এত চিন্তা করার কিছু নেই।
-- কী চিন্তা করবো না! টাকার ব্যবস্থা কী হবে?
-- ওই তো - আপনার কাছে আমার নম্বর দেওয়া আছে। ধীরে সুস্থ পে করে দেবেন।
-- আপনি দেখুন না ছুটি করে দেয় কি না! এখন তো আমি ভালো আছি।
-- চুপটি করে শুয়ে থাকুন। যেটুকু দরকার সেটুকু তো করতে হবে। রীমা চোখ বন্ধ করে চুপ করে শুয়ে রইল। মনে ভেসে এলো নানা ছেঁড়া ছেঁড়া কথা।
একটা বাচ্চা মেয়ে ওর সামনে এসে ইনিয়ে বিনিয়ে নানান অঙ্গভঙ্গি করে কিছু খাওয়ানোর আব্দার করতে রীমা ভালো করে চেয়ে দেখল। এগারো বারো বছরের মেয়ে, শতচ্ছিন্ন জামাকাপড় নোংরা, নাকে সর্দি অথচ উজ্জ্বল টলটলে চোখ – রীমা বিকেলের দিকে প্রায়ই এই পার্কে এসে বসে, কই আগে দেখেনি তো কোনওদিন? ও তাড়াহুড়ো করে মানিপার্সটা বের করতে গিয়ে দেখে সবই একশো দুশোর নোট। মেয়েটি এদিকে একটানা কী যেন বলেই চলেছে। ভারী অস্বস্তিকর অবস্থা। প্রথম থেকে কাটিয়ে দিলেই হত, কিন্তু এখন মেয়েটি বুঝতে পেরেছে ও কিছু দিতে চায়। এখন কী বলে ওকে নিরস্ত করবে ভাবতে ভাবতে পাশ থেকে একজন বলল, আপনি ওকে কত টাকা দিতে চান বলুন, আমি দিয়ে দিচ্ছি।
রীমা তাকিয়ে দেখল বছর পঁয়ত্রিশ সাঁইত্রিশের এক যুবক অগোছালো চেহারা – তার দিকে চেয়ে আছে। হাতে পার্স। রীমা ভ্রু কুঁচকে একঝলক তাকাতেই লোকটি আবার বলল, 'কত দিতে চান বলুন, দিয়ে দিচ্ছি।'
রীমা বেশ রাগত স্বরে বলল, 'আপনার নিজের দিতে ইচ্ছে হয় দিন না! কে বারণ করছে?'
-- আমার নিজের থেকে দেওয়ার প্রবৃত্তি নেই। ইনফ্যাক্ট এইসব বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়ের ভিক্ষে চাওয়াটা আমি ঘৃণাই করি। ফলে নিজের দেওয়ার প্রশ্নই নেই।
-- তাহলে নিজের ম্যারালিটির এগেনষ্টে গিয়ে আপনি আমাকে হেল্প করতে এসেছেন আমি মহিলা বলে?
-- দেখুন ম্যাডাম, এত শত ভেবে আমি কোনও কাজ করি না। আপনাকে দেখে মনে হল আপনি এমব্যারাসড হচ্ছেন, তাই দিতে চেয়েছি। ছাড়ুন। বলেই উল্টোদিকের পথ ধরলো সে।
ভিখারী মেয়েটি এতক্ষন এদের বাকবিতন্ডা শুনছিল। লোকটিকে চলে যেতে দেখে সে গিয়ে তার পথ আগলাল। সে আর বাক্যবায় না করে একটা দশটাকার নোট ধরিয়ে দিল মেয়েটিকে। এবার রীমা উঠে গিয়ে বলল, 'আপনি ওকে টাকা দিলেন কেন?'
লোকটি এবার বেশ তেরিয়া হয়ে বলল, ‘এতে আপনার কী সমস্যা? আমার ইচ্ছে হয়েছে, দিয়েছি।’
-- মোটেও আপনি নিজের ইচ্ছেতে দেননি। আমার জন্যই আপনাকে এটা দিতে হয়েছে। এই টাকা আপনাকে আমার থেকে নিতে হবে।
-- বেশ তো! দিন তবে! একটু থেমে লোকটি আবার বলল, ‘এত কান্ড তো এই নিয়েই। আপনার কাছে খুচরো নেই আমি তো সেই কারণেই...’
-- আপনার ফোন পে বা জি পে কিছু নেই?
-- এই দশটাকার জন্য?
-- আপনি আপনার নম্বারটা দিন।
লোকটি একটি কাগজে ওর নাম আর ফোন নম্বর লিখে ওর হাতে ধরিয়ে বলল, 'নিন। তবে এই সামান্য বিষয় নিয়ে এত সিরিয়াসলি না ভাবলেও পারতেন’।
বিকেল গড়িয়ে গেছে।বাসায় ফিরে যাওয়াও দরকার। কিছু লেখা রেডি করে গাইডকে দেখাতে হবে দু-একদিনের মধ্যে। কিছুটা তাড়াহুড়ো করে পার্ক থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। হঠাৎ রাস্তায় কিছু একটা ধাক্কা দিল তাকে, আর মনে নেই কিছু তার।
২
অনিন্দ্য বেশ জমিয়েই ফোনটা শুরু করলো। বেশ সিরিয়াস গলায় কথাটা বলতে হবে। রেড্ডি অলরেডি টোপটা দিয়ে রেখেছে। মনে হয় লোকটা রাজী হয়ে যাবে। এবার শুধু ধীরে ধীরে লাটাইটা গোটাতে হবে। এমন সময় কলিংবেলটা বাজতে কিছুটা বিরক্তই হল সে। ওর বাড়ীতে কাজের লোক ছাড়া বিশেষ কেউ তো আসে না। ঘরে বারমুডা পরে ছিল। কী হোল দিয়ে দেখল, রীমা। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে একদিন ফোন করেছিল বটে, সে যে ঠিকানা খুঁজে এখানে চলে আসবে, আশা করেনি সে। কোনরকম একটা ট্রাউজার গলিয়ে দরজা খুললো সে, 'আরে আপনি'?
-- কেন এসে কি আপনাকে সমস্যায় ফেললাম?
-- না, না তা কেন?
-- তবে আপনার মুখে খুশী দেখছি না কেন? অনাকাঙ্ক্ষিত বলে?
-- আপনি এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলেন কেন? সোজাসুজি কিছু বলতে পারেন না? বড্ড জটিল আপনি!
রীমা হাসল। বলল, ‘জটিল না, বলুন কুটিল।’ ঘরে ঢুকে বলল ‘বউদি কই?’
-- বউদি সাথে থাকে না।
-- ওঃ স্যরি। আমি বুঝতে পারিনি। আমার জিজ্ঞাসা করে আসা উচিৎ ছিল। আসলে আপনি বলেন তো, আপনি ভেবেচিন্তে কিছু করেন না সেটা ভেবেই...
-- বেশ করেছেন এসেছেন। এমনি ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বৌদি না থাকলেও আপনার কিছু অসুবিধে হবে না।
-- অসুবিধে তো হবেই। আজ আমাদের হোষ্টেল বন্ধ। আমি ভাবলাম বৌদির হাতে আমাদের দেশের মতো মাছ ভাত খাব। এখনকার খাওয়া আমার একদম ভালো লাগে না।
-- বেশ তো। আপনি বসুন, আমি একটু বাজার থেকে মাছ কিনে আনি। আমি খারাপ রাঁধি না। আপনি বরং ততক্ষণ রান্নাঘরে গিয়ে যা যা খাবেন সেই মতো আনাজপাতি কেটে বেটে রাখুন, তাহলে বেশ পিকনিক পিকনিক ফিলিং হবে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাজারে বেরিয়ে গেল অনিন্দ্য। রীমা ঘরের এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দেখলো একদম ছন্নছাড়ার সংসার। ফ্রীজে জলের বোতল আর দুই একটা বিয়ারের বোতল ছাড়া কিছু নেই। বাটার কাটা হয়ে পড়ে আছে গ্যাসের স্ল্যাবে। পাউরুটি টোস্টারটায় পুরোনো পোড়া রুটি, চারদিকে শুধু নোংরা আর নোংরা। অথচ ঘরটায় সব আছে। বাথরুমে গীজার, মাইক্রোওভেন, এসি, ইনভার্টার, ইন্ডাকশন, টোস্টার, রুটি মেকার – স - ব। ঘরে একফোঁটাও দুধ নেই, একটু চা খেলে ভালো লাগতো। অনিন্দ্যকে ফোন লাগালো সে 'এক প্যাকেট দুধও আনবেন কিন্তু, ঘরে দুধ নেই। চা আছে কি?
-- মনে নেই। নিয়ে আসছি না হয়। ভালোই হবে, দোকানের চা খেয়ে খেয়ে মুখে ছ্যাদা পড়ে গেছে।
সারাদিন রান্না খাওয়ার বেশ কেটে গেল দিন। খাওয়ার সময় রীমা বলল, ‘আমার হাসপাতালের বিলটা তো এখনও বললেন না, আমি মাসে মাসে কিছু কিছু করে শোধ করে দেব।’
-- ও বলব পরে 'খন।
-- এই করে করে তো প্রায় দুমাস হতে চলল – আমার স্টাইপেণ্ড থেকে কিছুটা কিছুটা করে শোধ করলেও বছর ঘুরে যাবে মনে হয়। আমি ফিরে যাওয়ার আগে তো শোধ করে যাবো?
-- ক'দিন আছি আপনার টেনিওর?
-- আজ থেকে ঠিক এক'বছর দু মাস।
-- ঠিক আছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, সময় শোধ করতে পারবেন, এমন সময়েই বলবো। আপনি রাতের খাওয়াটা তো খেয়ে যেতে পারতেন।
-- থাক, কিছু কাজকর্ম করতে হবে রাতে। এখন বেরিয়ে গেলে টাইমে পৌঁছাতে পারবো।
-- রাতে কী খাবেন?
-- দেখি কিছু একটা জোম্যাটোতে অর্ডার করে দেব।
-- আপনার পছন্দ কী? মোগলাই, চাইনিস?
-- দুই ই।
-- বেশ বেরিয়ে যান, আমিও বেরোবো একটু পরেই।
হোষ্টেলে ফিরে কিছুক্ষণের মধ্যে একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন এল রীমার। জোম্যাটো বয় এর ফোন। ওর ঠিকানায় বিরিয়ানির অর্ডার করে দিয়েছে অনিন্দ্য। লোকটার কাছে বড্ড ঋণ বেড়ে যাচ্ছে তার।
মনটা খিঁচড়ে আছে অনিন্দ্যর। টোপটা ফস্কে গেল বোধ হয়। জ্যোতি নির্ঘাৎ এত বেশী লেকচার মেরেছে, লোকটার সন্দেহ হয়েছে। কাজটা বেশ গুছিয়ে করতে হয়। প্রথমে জ্যোতি ফোনটা করে টার্গেটকে, বলে ওর গচ্ছিত টাকাটা ঠিক মতো জমা পড়ছে না। একটা নম্বর দিয়ে বলে পলিসিটা লক করে দিন। আর ফোন করে বলে একটা নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করতে। সেই ফোনটা রেড্ডি তোলে। সেই নিয়ম কানুন বোঝায়। আরও তিনজন আছে দলে। তারা কেউ এজেন্ট সেজে বা অফিসার সেজে ফোন করে। এই সব কথার প্যাঁচ এমন বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয় যাতে টার্গেটেড লোকটি বোকা বনে যায়। এক একটা দাঁও মারতে পারলে সত্তর আশি হাজার টাকা পাওয়া যায়। এই লোকটা সকাল থেকে ফোনই তুলছে না। মানে কেটে গেল। নতুন মক্কেল ধরতে হবে। অনিন্দ্য এই টার্গেট ধরার কাজটা করে। বেশ বিরক্তির মুডেই বাইরে গিয়ে চা খাবে ভাবছিল, রিমার ফোন।
-- হ্যালো, কোথায় আছেন?
-- বাড়ীতে।
-- বিকেলে একটা শো দেখতে যাবেন নাকি? কলকাতা থেকেই ইয়ুথ কয়ারের ট্রুপ আসছে।
-- গেলেই হয়।
-- এখন কী করছেন?
-- এই একটু চা খেতে যাবো ভাবছি।
-- এইটুকু বানিয়ে নিন না, এর জন্য বাইরে যেতে হবে কেন?
-- দূর। চা করে খেতে আমার একদম ভালো লাগে না?
-- আমি আসব?
-- আপনি এইটুকুর জন্য মিছিমিছি আসবেন কেন?
-- আজ আমার তেমন কাজ নেই। আমি গিয়ে খিচুড়ী রাঁধবো – খিচুড়ী আর ডিম ভাজা, বেগুন ভাজা। জিনিসপত্র কী আছে বাড়ীতে?
-- না বোধহয়। তার জন্য ভাবনা নেই, আমি নিয়ে আসবো।
-- দরকার নেই। আমি তো বেরোচ্ছিই। যাবার সময় নিয়েই ঢুকবো।
চা খেতে খেতে অনিন্দ্য বেশ আন্তরিক ভাবেই বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
-- কেন?
-- এই এলেন বলে। সকাল থেকে মুডটা ঠিক নেই।
-- কেন কী হয়েছে?
-- আপনাকে বলার মতো বিষয় না। মাথাটা ধরে আছে – একটু যে চা খাবো, বাইরে বেরুতেও ইচ্ছে করছিল না।
-- ডাকলেন না কেন?
-- এই কারণে কি ডাকা যায়?
-- বিষয়টা ব্যক্তিগত, আমার এক্তিয়ারও নেই, তবু এতদিনের পরিচয়ের সূত্র থেকে জানতে চাইছি একটা বিষয়ে...
-- বলুন না।
-- আপনি একবার বলেছিলেন, 'বউদি সাথে থাকে না' – আসলে ব্যাপারটা কি ইয়ারকি? আপনি কি আদৌ বিবাহিত?
-- হ্যাঁ। বউ ছেড়ে চলে গেছে।
-- ও মা! ফিরবে না আর?
-- না। কারণটা জানতে চান না?
-- থাক।
-- আমার বলতে অসুবিধা নেই। ইনফ্যাক্ট আপনারও জানা দরকার। আপনি দেশের লোক।
-- কী লাভ জেনে?
-- আমার সাথে আপনার মিশতে সুবিধা হবে।
-- বেশ, বলুন।
-- আমার স্ত্রী যখন আমাকে ছেড়ে যায়, তখন আমার চাকরী ছিল না। ছাঁটাই করে দিয়েছিল।
-- ও মা। আপনি কিসের চাকরী করতেন?
-- ব্যাঙ্কে এ। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের ইন্সিওরেন্স পলিসি থাকে না – সেরকম একটা অফিসে কাজ করতাম।
-- তা এখন আপনি কিছু চাকরী বাকরী করেন না?
-- না।
-- ওমা আপনি আমার পেছনে এতগুলো টাকা দিলেন এই অবস্থায়– সেটা তো একদম ঠিক হয়নি। আপনি অ্যামাউন্টটাও আমায় বলেছেন না, ওটা বলুন আমি ইমিডিয়েটলি ওটা দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।
-- আমি আপনাকে বলেছি আমি চাকরি করি না। তাই বলে আমি খুব আর্থিক সঙ্কটে আছি – এটা তো বলিনি কখনও।
-- তাহলে বৌদি ছেড়ে গেল কেন? আপনি যদি অন্য কোনভাবেই রোজগার করে নিতে পারেন, তাতে তো আপত্তির কিছু থাকতে পারে না!
-- আমার রোজকার সোজা পথে নয় রিমা। আমি আমার স্ত্রী কে দোষ দিই না।
-- সোজা পথে নয় – মানে কী। আপনি ভালো মানুষ, সোজা পথেই থাকুন। স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনুন।
-- তা আর হয় না।
-- কেন?
-- ও বিয়ে করে নিয়েছে। ওর প্রাক্তন এক প্রেমিক ছিল, তাকে।
-- আপনি সিত্তর?
-- হ্যাঁ।
-- বেশ তো। তিনি না ফিরলে আপনি বাঁকা পথে পড়ে থাকবেন, এ তো কাজের কথা নয়।
-- আর জীবনটা তো কেটে গেল। নতুন করে চেষ্টা করে লাভ কী?
-- জীবন কোথায় কাটলো আপনার? এখন আপনার বয়স কত?
-- আটত্রিশ।
-- মোটে? অর্ধেক হয়নি জীবনের। আপনি কী করেন আমি জানি না; কিন্তু আমি চাই আপনার স্বাভাবিক জীবনে ফিরুন।
-- আমি হলাম একজন ফ্রড, আপনারা যাকে বলেন ফোর টুয়েন্টি! আমি মানুষকে প্রতারণা করি।
-- এটা হতেই পারে না, অনিন্দ্যবাবু। আর যদি কোনও কারণে করে থাকেন, সেটা দুর্ঘটনা মাত্র।
-- দুর্ঘটনাই বটে। যখন করোনা এল, আমাদের ব্যাঙ্ক অনেক কর্মচারীকেই ছাঁটাই করলো। আমি ছিলাম ব্যাক সাপোর্ট স্টাফ। আমাদের গ্রুপের ছ' জন একদিন গিয়ে শুনলাম কারোর চাকরী নেই। কিন্তু ব্যাঙ্ক এর গ্রাহকদের অনেক ডাটা আমাদের কাছে ছিল। আমরা সেই সব গ্রাহকদের ট্রেস করে এই কাজটা করি।
-- যা করতেন করতেন, এবার ছেড়ে দিন।
অনিন্দ্য চুপ করে বসে রইল। রিমা বললো, 'ঠিক আছে, এতে এত মন খারাপের কিছু নেই। আপনি তো এই নিয়ে এতদিন দিব্যি আছেন। এসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে, আপনি আপাতত আমায় একটু হেল্প করুন, রান্না চড়াবো।
খাওয়া দাওয়ার পর অনিন্দ্য বললো, 'জানেন তো, কথাগুলো বলে আমার নিজের কিছুটা ভালো লাগছে। আপনি এতদিন নিজের মনে করে আমার বাড়ী আসতেন, আমার সাথে ভালো ভালো কথা বলতেন, আমার খুব খারাপ লাগতো। আমি ভাবতাম, আপনি যদি সত্যি কথাটা জানতেন, তবে কখনওই আমার কাছে আসতেন না।’
-- আপনি আমার জন্য যা করেছেন, তা একজন মহান আত্মা লোকই করতে পারে অনিন্দ্য বাবু। আপনি কখনওই খারাপ হতে পারেন না। আপনি বাঁকা পথ ছেড়ে দিন প্লীজ।
-- সে আর হয় না রীমা!
-- কেন?
-- অভ্যেস। আজ তিন চার বছর এসব করে করে এতেই অভ্যাস হয়ে গেছে। নতুন কিছু করার কথা সাহসে কুলোয় না।
-- এ পথে ভয় নেই?
-- আছে। তবে কি জানেন এটা আমার বেশ স্পোর্টিংলি নিই। খেলার মতো হারজিত আছে, মজা আছে।
-- ঠিক আছে। কিন্তু চিটিং করা তো ভালো কাজ নয়। আপনি এমন ধারা কাজ করবেন কেন?
-- আপনার কথা শুনে মনে হয়, আপনার কথা মেনে নিই। কিন্তু আপনিই বা আর কতদিন থাকবেন? আপনারও তো যাওয়ার সময় হল!
-- সে ঠিক কথা। কিন্তু আপনার ভালো হওয়া না হওয়াটা তো আপনার উপর নির্ভর করছে না। আপনি নিজের জন্য ভালো হবেন। নিজের কাজে ভালো হবেন।
-- আপনি এখান থেকে গিয়ে কী করবেন? চাকরীর চেষ্টা?
-- সে তো করবোই। তবে আর আগে বোধহয় বিয়ে হয়ে যাবে।
-- বিয়ে ঠিক হয়ে আছে নাকি?
-- একপ্রকার। কথাবার্তা হয়ে আছে। আমি পি এইচ ডির জন্য সময় চেয়েছিলাম, ওরা মঞ্জুর করেছে।
-- ভালো কথা। সম্বন্ধ করে বিয়ে?
-- হ্যাঁ।
-- তাহলে আর কী? আপনি আর মিছিমিছি আমাকে বদলাতে তৎপর হবেন না।
-- মানেটা কি অনিন্দ্যবাবু? আমি এখানে থাকলে নিজেকে বদলাবেন, নইলে বদলাবেন না?
-- আসলে আপনি সামনা সামনি থাকলে তাও একটা আপনাকে খুশী করার তাগিদ বোধ করতাম, না থাকলে সেটা কতটা হবে, আমি সিত্তর না।
-- সে ঠিক আছে, আমি নিয়ম করে আপনাকে ফোন করে মনে করাবো। তাতে হবে তো?
-- হাসলো অনিন্দ্য। বললো, ‘আমাদের কি নির্দিষ্ট সিমকার্ড বেশী দিন থাকে? ক'দিন বাদে বাদেই বদলাতে হয়।’
-- আপনি আমাকে সেই নম্বর পাঠাবেন। কী, পাঠাবেন না?
চুপ করে রইল অনিন্দ্য। কিছুটা নীরবতা দরকারও ছিল। এই পরিস্থিতিতে কী কথা বলবে, কোন দিকে চাইবে – ভেবে পাচ্ছিল না সে। কিছুটা কথা ঘোরানোর জন্য রীমা বললো, 'আপনি টাকাটার কথা কিছু বললেন না।'
-- ও আপনার বিয়েতে আমার গিফ্ট হিসেবে ধরুন না। ওটা ফেরৎ দেওয়ার দরকার নেই।
-- দেখুন এমনিতে আমার আপনার কাছে ঋণের শেষ নেই। দয়া করে সেটা আর নাই বা বাড়ালেন! আপনি প্লীজ বলুন।
-- ও ঠিক আছে। বলবো কখনও। এখনও তো কিছুদিন আছেন। বলে দেবো এক ফাঁকে।
-- এই করে করে বছর গেল। বলার সময় আর এলো না আপনার। ঠিক আছে যাওয়ার আগে এককালীন যা পারবো, কিছু দিয়ে যাবো।
-- যে দেখা যাবে। নিন চলুন, এবার এভাবে কথাবার্তা চলতে থাকলে দুপুরের খাওয়াও হবে না, আপনার শোটা ও মিস হবে।
বাড়ীতে এসে বেশ চিন্তায় পড়ল রীমা। সারাটা দিন এতটা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে যে মাথা পুরো ঘেঁটে আছে। আজ অনেকদিন পরে নিজের ভেতরটা ভালো করে দেখতে চাইছে সে। ওর কি অনিন্দ্যর প্রতি কোনও দুর্বলতা জমেছে? বা অনিন্দ্যের ওর প্রতি? যে সময়টুকু ওরা এতদিন কাটিয়েছে, সুন্দর একটা আন্তরিকতার সম্পর্ক বাদ দিয়ে অন্য কিছু মাথা চাড়া দিয়েছে কি? অনিন্দ্য কি ওর বিয়ের খবর শুনে হতাশবাচক কিছু অভিব্যক্তি দিয়েছিল? অনেক ভেবেও তো তেমন কিছু মনে পড়লো না। তবে দু একটা কথায় ওর মনে হচ্ছিল ও রীমার সান্নিধ্যটা হারাতে চায় না। মানুষটা তো ভালোই, ও এখানে থাকলে যদি অনিন্দ্য পুরোনো কাজ থেকে বেরোতে পারে ওর সেই চেষ্টা কি করা উচিত নয়? বিকাশ বলে যে ছেলেটির সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে, মাঝে মাঝে কথা হয় তার সাথে। তাকেই বা কী বলবে? এসব কথা কি বলার?
সারারাত ঘুম হলো না রীমার। ও উঠে এসে একটা কাগজ নিয়ে বসল।
'আনিন্দ্যবাবু!
সারারাত অনেক ভাবলাম। কালের কী নির্দেশ বুঝি না। কিন্তু আমার মনে হল আমি যদি আপনার জীবনের একসাথে পথ চলি, আপনি হয়তো ভালো পথে ফিরে আসবেন। আপনি অত্যন্ত ভালো মানুষ, সাময়িক পথভ্রষ্ট হয়েছেন মাত্র। এটা ভাবার নয় যে আমি কেবল আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা বশত এমন কাজ করছি। আপনার ঋণ শোধ হওয়ার নয়, সে চেষ্টা আমি করি না। আপনি হয়তো আমার বিয়ে স্থির হওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারেন। সেটা অন্যায়ও নয়। তবে ভেবে দেখলাম বিয়েটা ভেঙে দিলে হয়ত সাময়িক একটা আলোড়ন হবে, বাবা-মা কষ্ট পাবেন – তবে একদিন নিশ্চিত কালের নিয়মে তার থিতু হবে। আমি যুক্তির চেয়ে হৃদয়কেই প্রাধান্য দিলাম। আমার এই বিবেচনায় আপনি সহমত হলে ফোন করবেন
রীমা।
চিঠিটা খামে ভরে পরের দিনই পোস্ট করে দিল রীমা। দুদিন গেল, তিনদিন গেল, ফোন এল না। যখন সপ্তাহ পেরোল, চিঠি ফিরে এল। রীমা ফোন করল, কেউ ফোন ধরল না। অনিন্দ্যের বাড়ী গিয়ে শুনলো একদিনের নোটিসেই বাড়ী ছেড়ে কোথাও চলে গেছে সে। কেউ জানেনা তার এখানকার ঠিকানা। পুলিশও নাকি একবার এসেছিল খোঁজে। রীমা এসে সেই পার্কটায় বসলো যেখানে অনিন্দ্যর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল তার। চোখের কোনটা ভিজে এল, কিন্তু চোখ মোছার ইচ্ছেটাও এখন আর বেঁচে নেই। যে মানুষ নিজে থেকে হারিয়ে যায় তাকে কে কোথায় খুঁজবে? বড় বেশী ঋণী করে গেল অনিন্দ্য – যার শেষ হবে না কোনওদিন।
0 Comments