তনুশ্রী ভট্টাচার্য
সেলুলয়েডে বন্দি করা একজন মানুষ ও একটি যাত্রীবাহী মোটর গাড়ির জীবনালেখ্য ঋত্বিক ঘটকের অযান্ত্রিক সিনেমাটি। মূল গল্প সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের। একটি প্রাণহীন গতিশীল পনেরো বছরের বেশী বয়স্ক নড়বড়ে গাড়ি চলচ্চিত্রটিতে মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠেছে। সত্যিই কি প্রাণহীন? না, তাকে প্রাণহীন বলা যাবে না। এখানেই পরিচালকের চিন্তায় মৌলিকতার ছাপ, সিনেমার ট্রিটমেন্টে অভিনবত্ব। যেভাবে ঐ গাড়িটিকে পর্দায় দেখানো হয়েছে সেখানে গাড়িটিকে প্রাণবন্ত ই দেখানো হয়েছে। জীবনের প্রায় শেষ লগ্নে উপস্থিত একটি গাড়ি কেমন করে তার মালিকের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে একমাত্র রোজগারের পথ হিসাবে, কেমন করে তার কলকব্জা বিকল হতে হতেও সে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে, এবং অবশেষে তাকে বারবার সারাই করেও ফল পাওয়া যাচ্ছে না শেষপর্যন্ত তাকে ওজন দরে লোহালক্কড়ের সঙ্গে টুকরো টুকরো করে ভেঙে ভেঙে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে, যেন তার অন্তর্জলী যাত্রা ঘটছে ----তারই মর্মস্পর্শী আখ্যান অযান্ত্রিক।এ্যানথ্রোপোমরফিজমের সেলুলয়েডীয় ভাষ্য --- যন্ত্রে নরত্বারোপ।
🍂
পটভূমি বাংলার পশ্চিম সীমান্ত পুরুলিয়া। বাংলা ভাষার সঙ্গে স্থানীয় ডায়েলেক্টে হিন্দি উচ্চারণ। লোকজনের হাঁটাচলা পোষাক,কথাবলার ধরন, এমনকি শরীরের গঠন,এবং প্রকৃতির গঠন ---সব মিলিয়ে পুরুলিয়া বিহার সীমান্ত এলাকার একটি ছোট্ট গাড়ি স্ট্যান্ডের একটি গাড়ি ও তার মালিকের জীবন ছবি। রেলযোগাযোগ আছে। ট্রেন থেকে নেমে যাত্রীরা তার গাড়িতে ওঠে। কলকাতার প্যাসেঞ্জার ট্রেনের যাত্রী মাস্টারমশাইকে এই জগদ্দল প্রাণপন ছুটে ট্রেন ধরিয়ে দেয়। এক মামা তার পাগল ভাগ্নাকে নিয়ে বিয়ের আসরে যথা সময়ে পৌঁছতে পারে এই গাট্টা গোট্টা জগদ্দলের দুরন্ত গতির দাক্ষিণ্যে। যখন অন্য গাড়ির ড্রাইভার বর্ষার পাহাড়ী ঝোরা উপচে বিপদের আশঙ্কায় পিছিয়ে যায় তখন এই জগদ্দলের ভরসায় বিমল সেই ফিরিয়ে দেওয়া প্যাসেঞ্জার কে গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়িও বাঘের বাচ্ছার মতো ছোটে। বিমল খুশি হয় জগদ্দলের ওপর। পরের একটি দৃশ্যে বিমল গাড়ির তলায় শুয়ে সারাইয়ের কাজ করছে আর একটি বাচ্চা ছেলে অনবরত যাওয়া আসা করছে, তার পা দুটো শুধু দেখানো হচ্ছে, এটি চূড়ান্ত সিম্বলিক কারণ ছবির শেষে আবার আমরা দেখব পুরনো গাড়ি ওজন দরে বেচা হয়ে গেল এবং একটি শিশু পরিত্যক্ত পুরোনো হর্ণ বাজিয়ে যেন নতুন দিন ডাকছে। শিশুর মাধ্যমে একটি কোমল দিক এবং আগত ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করা হয়েছে। এই সব সিম্বলিজম ব্যবহারে ঋত্বিক অন্যন্য।
একই ফ্লেভারে ঋত্বিক নতুন পুরোনো দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন বা নতুন এলে পুরোনোকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে এমন বার্তা দিয়েছেন সিনেমাটির পরতে পরতে। নতুন গাড়ি স্ট্যান্ডে দাঁড়াচ্ছে শুধু নয় একটি দৃশ্যে খুব কৌশলে একটি বাস দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ পাবলিক ট্রান্সপোর্টের একটি সমূহ পরিবর্তন আসছে আধুনিকতার হাত ধরে, প্রয়োজনীয়তার হাত ধরে। প্রথম দিকের দৃশ্যে বিমলের শোওয়া আর শিশুর হাঁটা একটি প্রস্তাবনা তৈরী করেছে শেষ দৃশ্যের উপসংহারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। একটি দ্যোতনা তৈরী করেছে আগামী ভবিষ্যতের। এইরকম অজস্র মুহূর্ত আছে ছবিতে। বা এমনটাও মনে হচ্ছে যেন বিমল গাড়িটির পায়ের কাছে অর্ঘ্য সাজাচ্ছে। কারণ তার আগেই বিমল গানটি গাইছে --কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা রে আলোর নাচন।একটি বহুশ্রুত শ্যামা সঙ্গীতকে ব্যবহার করে তার মানেটা পাল্টেদিলেন পরিচালক। হয় এটাই বিমলের দেবতা নয়তো এটাই তার কালো মেয়ে। বিমল গাড়িটিকে আদর করে নাম রেখেছে জগদ্দল। বেঙ্গলী ক্লাবের লোকেরা বলে বিমল একটা যন্ত্র আর তার উত্তরে বিমল মনে মনে আওড়ায় --ওরা জানেনা জগদ্দলও একটা মানুষ। এই সরল স্বীকারোক্তিটি দ্বান্দ্বিকতার তীব্রতা মুছে দেয়। লংশটে গতিশীল গাড়ির প্রতিচ্ছবি পড়ছে জলাশয়ে । নয়ন মনোহর আউটডোর শুটিং পুরুলিয়ার নিসর্গকে প্রাণভরে দেখানো হয়েছে। বিদেশী ছবিতে আমরা যেমনটি দেখে মুগ্ধ হই এখানেও একই মুগ্ধতা। বর্ষার ভিজে রাস্তায় সারিসারি গাছের দীর্ঘ বনবীথির মধ্য দিয়ে গাড়িটা ছুটছে আর ব্যাকগ্রাউন্ডে উস্তাদ আলি আকবর খানের সেতারের স্বর্গীয় মূর্চ্ছনার ব্যবহারে পরিচালকের মেধা ও মুন্সিয়ানায় অভিভূত হতে হয়। নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ এই দৃশ্যগুলি। ক্যামেরার কৌনিক ব্যবহার অসাধারণ। গোরুর পালের মধ্যে একটি বাছুর তার মায়ের দুধ খাচ্ছে এমন দৃশ্য দেখেই বিমল এতজোরে ছোটা গাড়িটারও তেষ্টা পেয়েছে অনুভব করল।গাড়ি গরম হয়ে গেলে বিমল বলে তোর তেষ্টা পেয়েছে না রে? সত্যিই তার প্রাণ আছে কারণ জল ঢালার সময় খুব তেষ্টায় মানুষের যেমন জল খাওয়ার ঢকঢক আওয়াজ বেরোয় গলা দিয়ে ঠিক সেরকম আওয়াজটি পরিচালক দিয়েছেন। এটাকেই বলা যায় এ্যানথ্রোমরফিজম ---নরত্বারোপ। বন্ধু প্রীতি, সন্তান প্রীতি, মাতৃস্নেহ বা একান্ত স্বজন প্রীতির মতো শোনায় ডায়ালগটি। সিনেমার পরিভাষায় depth of thought and idea. বিমল স্বীকারোক্তি করে যে জগদ্দল তেল কম খায়, কত সাশ্রয় করে, বিমল যে গরীব সেটা জগদ্দল বোঝে একজন রক্তমাংসের সংবেদনশীল মানুষের মতই। এখানেই যন্ত্রের সঙ্গে আত্মার মিলন ঘটিয়ে একটি উচ্চ জীবনদর্শন স্থাপন করেছেন পরিচালক । এরকমটি সংসারেও হয় বৈকি। যন্ত্র সভ্যতার কুফল থাকতে পারে কিন্তু ভারতবর্ষের মতো দেশে স্বাধীনতার পরে পরেই যখন ভারতবর্ষ কোন পথে এগোবে -- যান্ত্রিক যুগে প্রবেশ করবে কি না সে নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব আবার যন্ত্র ভিত্তিক আগামী দিনগুলোকে কেমন করে সাজাবে সেই নিয়েও দ্বিধাবিভক্ত সেই সময়ে এরকম একটি যন্ত্র-মানব দ্বৈরথ সরিয়ে রেখে যন্ত্র-মানব সখ্যতা দেখিয়ে পরতে পরতে মানবিকতার ছোঁয়া দিয়ে দিয়ে ছবিটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ঋত্বিক। এরকম আরো উদাহরণ আছে। কালো মেয়ের পায়ের তলায় গানটি গাইবার সময় যেন গাড়িটিও অভিমান করছে। তার হেডলাইটের পজিশন বদল করে বোঝায় নিজের অভিমান। গানটির প্রয়োগ অর্থবহ কারণ BRO 117 কালো গাড়িটি ছুটলে যেন আলোর নাচন ই হয় । দুর্দান্ত তার মাইলেজ। বিমল বলে জগদ্দল বাঘের বাচ্চা। এই ডিটেইলস গুলোতে ঋত্বিকের আলাদা মুন্সিয়ানা। গানটির প্লেব্যাক করা হয় নি । বিমলের নিজস্ব ভঙ্গিমায় গাওয়া গানটি একাত্ম বোধের তাৎপর্য বোঝায়। একটু রুক্ষ্ম ব্যবহারে অভ্যস্ত বিমল খুব আবেগ তাড়িত হয়ে সুন্দর পোষাক পরে জগদ্দলকে নিয়ে ফটো তোলার আবদার করে ক্যামেরাম্যানের কাছে যায়। এই মুহূর্তটি একেবারে মানবিক আবেদনে ভরপুর। বিমলের ভালোবাসার চলমান ছবি এই টুকরো মুহূর্ত গুলি। স্ট্যান্ডে নতুন পুরোনো গাড়ির দ্বন্দ্ব । নতুন গাড়ি বেশী ভাড়া পায়, বিমল ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে। আবার কোনো সময় নতুন গাড়িতে চার জন যাত্রী যায় আর বিমলের জগদ্দলে দশজন ঢুকে যায়। 'যেন ক্যাঙ্গারুর পেট' বলে মেকানিক্স।
আপাত রুক্ষতার মধ্যে পুরো সিনেমাটিতে এক সমান্তরাল সূক্ষ্ম প্রেমের পেলব স্পর্শ ছড়িয়ে আছে। একদিকে পুরুলিয়ার রুক্ষ্ম পাহাড় এবড়ো খেবড়ো চড়াই উতরাই আবার তার পাশেই সুদীর্ঘ শালপলাশের বনভূমি, জলাশয় আর চওড়া মসৃণ রাস্তায় জগদ্দলের ছোটা --বৈপরীত্যের মায়াবী মেলবন্ধনে জীবনের সুর বেজে চলে অহরহ।
পুরুলিয়ার ওঁরাও সম্প্রদায়ের মানুষের একটি বিশেষ ভূমিকা ছবিটিতে আলাদা মানে বয়ে নিয়ে গেছে। শুরু থেকেই সাঁওতালি গানের সুর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আছে পুরুলিয়ার আদি অকৃত্রিম ছৌ নৃত্য। শ্যুটিং লোকেশন হিসাবে তিনি এই বাংলা বিহারের সীমান্ত অঞ্চলকে বেছেছেন চিত্রনাট্যের দাবীতে। বর্তমানে এই এলাকা ঝাড়খন্ড। রাঁচী ঝরিয়া দেওঘরের উল্লেখ রেখেছেন সংলাপে। দেওঘরের বিখ্যাত বৈদ্যনাথধামকে এক ঝলক দেখিয়েছেন।পুরুলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী আছেন বহু মানুষ। সদ্য ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু রয়ে গেছে তাদের গোরস্থান। সেটি বেশ কয়েকবার দেখানো হয়েছে। আর এদেশের আদিম অধিবাসীদেরমধ্যে, ট্রাইবদের মধ্যে খৃষ্টান ধর্মটা রয়ে গেছে বেশ গভীরে। তাই একটি নতুন সংস্কৃতিকে পরিচালক হাইলাইট করেছেন খুব সচেতন ভাবে। সীমান্তবাসী ট্রাইবদের নিজস্ব আদি লোকসংস্কৃতিকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে মূলস্রোতের বাঙালীর দেবতা ,খৃষ্টানদের চার্চ , খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী আদিবাসীদের উৎসব এবং গাড়িকেন্দ্রিক বিমলের জীবন লড়াই -- চতুর্ভুজের মতো ছবিটি ঘিরে রাখে সচেতন দর্শককে। ছবির ডিটেইলস যে কোনো ছবির প্রাণশক্তি। ঋত্বিক এখানে সবকটি খুব ধৈর্য সহকারে দেখিয়ে ছবিটির আর্কাইভ্যাল মূল্য বাড়িয়েছেন। ঋত্বিক ছবিটি করেছেন ১৯৫৫-৫৬ সাল নাগাদ কারণ ছবিটি হল রিলিজ হয়েছে ১৯৫৮,২৩শে মে।। ঋত্বিক ঘটকের মতো পরিচালক স্থানীয় দেশজ লোকশিল্পের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা যে রাখবেন তাতে আর আশ্চর্য কি! শুধু আশ্চর্য নয় শ্রদ্ধায় অবনত হতে হয় মানুষটি কি অসাধারণ শৈল্পিক দক্ষতায় ঐ জনজাতি গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, উৎসবের মিছিল , হাট,এবং ব্যক্তিমানুষের অভিব্যক্তিকে সিনেমার অঙ্গীভূত করেছেন। বেশ কয়েকবার খ্রিষ্টান গোরস্থানের ছবি দৃশ্যে এসেছে। মৃত্যুর দ্যোতনা আছে, কিন্তু পাশাপাশি চলেছে জীবনের পতাকা ওড়ানোর কাজটিও। আদিবাসীদের সুদীর্ঘ পতাকা নিয়ে মিছিলের দৃশ্যগুলি রুক্ষ ভূমিতেও কিভাবে জীবনের জয়গান বেজে চলে তারই চলমান ভাষ্য অযান্ত্রিক।
বিকট আওয়াজ তুলে চারিদিকে ধুলো উড়িয়ে জগদ্দল স্ট্যান্ড থেকে যখন বের হয়ে তখন মানুষ বিরক্ত হয়। জগদ্দল এর উদ্দেশ্যে তারা ব্যঙ্গক্তি,বক্রোক্তি করে কিন্তু বিমল সেই সময় তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং জগদ্দলের অপমানে সে আহত হয়ে প্রতূত্ত্যর দিতে পিছপা হয় না। কাহিনীর বুননে এই ছোটো ছোট ডিটেলস গুলো পরিচালকের মুন্সিয়ানায় মানবিক আবেদনগ্রাহী হয় । জগদ্দল বারবার বিগড়ালেও প্রথমে কিন্তু বিমল একেবারেই বিরক্ত হয় না। আপ্রাণ চেষ্টা করে তাকে আবার সারিয়ে তুলতে। বিমলের একগুঁয়েমি জেদের সামনেই মনে হয়---- জগদ্দল একটা মানুষ, বিমল একটা যন্ত্র। একটি বৈপরীত্যের ম্যাজিক তৈরি হয়। এখানেই প্রশ্ন জাগে অযান্ত্রিক কথাটি আসলে কোন মানে বহন করছে। বিমল আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজের সর্বস্ব অর্থ খরচ করে এবং নিজে পরিশ্রম করে গাড়িটিকে সারিয়ে তুলতে । মেকানিক্স বারবার জগদ্দলকে বিদায় করে নতুন গাড়ি নেওয়ার পরামর্শ দেয় এবং বলে ও তো একটা লোহারতাল ওর প্রতি এত মায়া কেন ---এই কথায় বিমল অত্যন্ত আহত হয়। মেকানিক্স পরের দিন সকালে গাড়ি সারিয়ে দেবে কথা দেওয়ার পরেও সেই রাতেই বিমল সারারাত ধরে নিজেই গাড়িটিকে সারিয়ে সকালবেলা স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে দেয়। মেকানিক্স সহ সবাই অবাক হয়ে দেখে বিমল অসাধ্য সাধন করেছে। এই ভাবেই বিমল আর জগদ্দল গাড়িটার সঙ্গে একটি অচ্ছেদ্য বন্ধন তৈরি হয়েছে পুরো সিনেমাটিতে। বাচ্ছা ছেলে সুলতান মোক্ষম প্রশ্নটি করেছে ---ও সাড়া দেয়?। যন্ত্র এখানে দানব নয় মানব হয়ে ধরা পড়েছে।
যেহেতু ধাতব একটি জিনিসকে কেন্দ্র করে সিনেমাটি, ধাতব শব্দ মিউজিকের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। যখনই বিপরীত কিছু ঘটছে তখনই তীব্র কর্কশ ধাতব শব্দের ব্যবহার করেছেন পরিচালক । হাতুড়ির ঠংঠং, ইঞ্জিনের ঘসঘস, ধোঁয়া বেরোবার ভসভস, গিয়ারের ক্যাঁচক্যাচ, কড়কড় সব মিলিয়ে একটা যান্ত্রিক শব্দের কঠোরতা বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। কোলিয়ারিতে কয়লা বহনের ঝুড়ি গুলো যখন রোপওয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার একটিতে বিজোড় সংখ্যার ব্যবহার হয়েছে 579। আমরা জানি রুক্ষতার ব্যবহার করার জন্য কবি সাহিত্যিকরা ব্যঞ্জন বর্ণের আধিক্যে তৈরী শব্দ ব্যবহার করেন। ঋত্বিক সেকারনেই এখানে কনসোন্যান্ট সাউন্ডের সংখ্যা ব্যবহার করেছেন। ভাওয়েল সাউন্ডের সংখ্যায় যে পেলবতা থাকে সেটি সযত্নে পরিহার করে একটি এফেক্ট তৈরি করেছেন। মানুষ ও যন্ত্রের বিজোড় সম্পর্ককে হাইলাইট করার চুড়ান্ত সিনেম্যাটিক প্রয়োগ। সচেতন দর্শক এটি অনুধাবন করতে পারবেন। আবার ফ্রেম বদলের সঙ্গে সঙ্গে কখনো এই ধাতব শব্দের সঙ্গে সেতারের ব্যবহার আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। যখন গাড়ির কলকব্জা খারাপ হচ্ছে তখন খনখনে ধাতব শব্দ আবার যখন গাড়ি দিব্যি ছুটছে তখন সেতারের সুরেলা মূর্চ্ছনা। অত্যন্ত কৌশলী ব্যবহার। সিনেমার পরিভাষায় বলা হয় sound itself creates a world. অযান্ত্রিকে শব্দ একটি অদৃশ্য চরিত্র হয়ে উঠেছে।
সিনেমাটির কাহিনিতে বেশ কয়েকটি স্তর আছে। প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে সমান্তরালে চলেছে এবং একটা একটা করে জীবনের পরত ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে। আদিবাসীদের জীবনের আনন্দ নাচ গান যেভাবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে সেখানে মূল সুর চিরকালীন আনন্দ বিষাদ, স্পন্দন উদ্বেগ, রাগ অভিমান, বঞ্চনা প্রত্যাখ্যান। আদিবাসীদের গানের সুরে জীবনের শান্তপ্রভা আছে, উদ্বেলতা আছে আবার মৃত্যূর বিলাপ আছে। আদিবাসী যুবক যুবতীর একটি সংলাপ বাংলা না হলেও তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে পরিস্কার বোঝা যায় তাদের নতুন জীবনের ভালোবাসা, খুনশুটির মতো মরমী বিষয়গুলো ঋত্বিক অন্যন্য মেধাবী উপায়ে দেখিয়েছেন। আবার একটি দৃশ্যে দুই নরনারীর প্রত্যাখ্যান ও বঞ্চনার কিঞ্চিৎ আভাস আছে। কারণ তখন মূল স্রোতের মেয়েটিকে তার পুরুষটি ফুসলিয়ে নিয়ে এসে স্বর্ণালংকার কেড়ে নিয়ে ফেলে পালিয়েছে। তবে এখানেও ভাষা কোনো ব্যবধান তৈরী করতে পারেনি । তাদের ফেসিয়াল এক্সপ্রেসন বুঝিয়ে দিয়েছে কথোপকথনের নির্যাস। অভিনয়ের দক্ষতা না পরিচালকের শট ব্যবহার ---কোনটি হৃদয়গ্রাহী তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যায়। আদিবাসী নারী পুরুষদের কী মেধাবী ব্যবহার করে অভিনয় টেনে বের করে এনেছেন পরিচালক ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। মনে রাখতে হবে এগুলো কোনোটাই বিচ্ছিন্ন নয় বরং মূল চরিত্র বিমলের সঙ্গে এবং মূল কাহিনীর অন্য দুটি চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সিনেমার ব্যাকরণে এগুলো ইন্টিরিয়র আর এক্সটিরিয়র--- অন্তর্গত ও বহির্গত দৃশ্যের সম্মিলন।
ছবিটির প্রথম কনফ্লিক্ট বা দ্বন্দ্ব তৈরী হয়েছে এক রমণী ও পুরুষ তার গাড়িতে উঠল কোনো এক অনির্দিষ্ট জায়গার উদ্দেশ্যে। রমণীটির আচরণ কিঞ্চিৎ অন্যরকম। সে হঠাৎ ড্রাইভার বিমলের কাঁধে ছুঁয়ে 'ও গাড়িওলা দাঁড়াও' বলে উঠলো আর তখনই জগদ্দল ঈর্ষাজনিত প্রতিক্রিয়া দেখালো। এ যেন প্রেমের অধিকারবোধ। বিমলের ওপর গাড়িটির অধিকারবোধের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। বিমলের গায়ে সে অন্য মেয়ের স্পর্শ সহ্য করবে না। এমনকি বিমল মেয়েটির উপস্থিতিতে অপ্রতিভ হলেও মেয়েটির উপস্থিতিটাই গাড়ি সহ্য করতে পারছে না, সে ধোঁয়া ছেড়ে বোঝাচ্ছে তার গোঁসা হচ্ছে।গাড়িটিতে নারীসত্তা আরোপিত হয়েছে এইক্ষেত্রে। সারা ছবিতে অন্যান্য মানবিক টাচের পরেও এই প্রেম সম্পর্কটিকে পরিচালক জোরালো করেছেন পরের দৃশ্যগুলোতে। মেয়েটি খুশি হয়েছে ফুটো রেক্সিন দিয়ে সুন্দর আকাশ দেখা যাচ্ছে বলে, হেসেছে। বলছে--- আরো ছিঁড়ে দিতে ইচ্ছে করছে । ইঙ্গিতবাহী ডায়ালগ। যেন খোলা আকাশের নিচে থাকাতেই মানুষের পরম আনন্দ। মানুষ বুঝি সেই আনন্দেই থাকতে চায়। আদিবাসীদের দলে ও দীর্ঘ পতাকা ধ্বজা এই মুক্তির স্বাদ নিয়ে আসে। অন্য সময় বিমল গাড়ির নিন্দা সহ্য করে নি। কিন্তু এক্ষেত্রে বিমল খুশিমনে মেনে নিয়েছে শুধু তাই নয় মেয়েটির কথা রাখার জন্য ফুটো রেক্সিন সারাই করিয়েছে। অন্ত:সলিলা ধারার মতো একটি অনুচ্চারিত নামহীন সম্পর্ক বয়ে গেছে অগোচরে। সিনেমার ব্যকরণ মেনে এগিয়েছে প্রত্যেকটি সিন ,প্রত্যেকটি সিন শেষ হয়েছে একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। মেয়েটি সর্বসান্ত হয়ে আবার সেই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েছে ফিরতি পথে । বিমল তাকে গাড়িতে তুলে নিয়েছে। যে দৃশ্যে মেয়েটিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো বিমল তার কাছে যেতে চাইলে গাড়িটি স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। অন্য নারীর কাছে যেতে বাধা দিচ্ছে জগদ্দল? জগদ্দল কি তবে বিমলের প্রেমিকা? উত্তরবিলীন এমন প্রশ্ন সিনেমাটি দেখার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। গাড়ি থেকে নেমে বিমল দেখল একটা বড় পাথর পড়ে আছে চাকার কাছে। টিলার ওপর মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। বিমল ওপরে উঠতে গিয়ে সজোরে হোঁচট খেল। একটি প্রতীকী ব্যঞ্জনা। সিনেমাটোগ্রাফির পরিভাষায় এটি Depth of a Picture. স্টোরি লাইনকে গভীরতা দিতে এই ছোট্ট ছোট্ট কৌশল অবলম্বন করেন পরিচালকরা। ঋত্বিক এইসব ক্ষেত্রে অদ্বিতীয়। গাড়িটি চাইছে না বিমল মেয়েটির কাছে যাক বা মেয়েটিকে গাড়িতে ওঠাক। যেন সে ঈর্ষাকাতর হচ্ছে আর তারপর থেকেই গাড়িটা একেবারে অচল হয়ে বিগড়াতে শুরু করল। তবুও বিমল মেয়েটিকে স্টেশনে পৌঁছিয়ে মেয়েটিকে টিকিট কেটে কলকাতায় ফেরত পাঠালো। লক্ষণীয়, তার পুঁটলি গাড়িতে রয়ে গেল আর সেই হাটে কেনা চিরুনীটাও রয়ে গেল। যে চিরুনী মেয়েটি হারাবে না বলেছিল আজ মেয়েটি নিজেই সব দামী অলঙ্কার হারিয়ে জীবনের বাঁকে হারিয়ে গেল। এগুলো দক্ষ পরিচালকের স্ক্রীপ্ট রাইটিংএর অভিনবত্ব। ঋত্বিক এখানে অনন্য।
মেয়েটি ট্রেনে করে চেলে গেল। বিমল যেন একটু বিমর্ষ হলো। পুঁটুলি ফেরত দিতে যাবার চেষ্টা ব্যহত হলো গাড়ির অসহযোগিতায় এবং ঈর্ষায় । এর পরেই তার গাড়ি আর মন দুটোই বিগড়াতে লাগল। ঘনঘন। এরপর বিমল গাড়িটার ওপরও বিরক্ত হতে লাগলো। প্রথমদিকের মায়া যেন একটু একটু করে বিতৃষ্ণায় পাল্টাচ্ছে। আবার মেলায় ছেলেরা যখন কাদা ছুঁড়ছে তার গাড়ির ওপর তখন সে আবার নিজের শরীর দিয়ে তাকে আগলাচ্ছে। নিজের গায়ে আঘাত নিচ্ছে তবুও গাড়িটাকে বাঁচাচ্ছে।
যেন অবশেষে আর গাড়ি টা চলল না সে ঠেলতে ঠেলতে স্ট্যান্ডে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। সবাই বিদ্রুপের নিষ্ঠুর হাসিতে আঘাত করল তাকে। শুধু তার সহকারী বাচ্ছা ছেলেটি সুলতান কাঁদতে লাগল আর মেকানিক্স শান্তভাবে পরিস্থিতিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। গাড়িটা বিমলের কাছে মায়ের মতো, প্রেমিকার মতো, স্ত্রীর মতো। বিমল সব সহ্য করেও নতুন উদ্যমে গাড়ি সারাই করে চালাবে মনস্থ করল। কিন্তু গাড়ি নিজে আর সায় দিল না। যেমন মৃত্যূপথযাত্রী রোগীও অনেকসময় ইচ্ছাশক্তি দিয়ে বেঁচে যায় বেশ কয়েক বছর এখানেও তাই ,জগদ্দলের আর বাঁচার ইচ্ছেটাই নেই। কেন নেই? বিমল ঐ মেয়েটির প্রতি একটু দুর্বল হয়েছে বলে ? তাই বিমলের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে একটু একটু করে গাড়ি তার অন্তর্জলী যাত্রা ঘটিয়েছে ? মেধাবী পরিচালক দর্শককে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছেন। সেই ফেজ পার হয়েছে বটে তবে অবশেষে মেকানিক্সের পরামর্শ মতো সেটিকে ওজন দরে বেচে দিতে বাধ্য হয়েছে। চারচক্রযানটি টুকরো টুকরো হয়ে গোরুর গাড়ির সওয়ারী হয়ে বিদায় নিয়েছে। মেয়েটিও হারিয়ে গেল আর জগদ্দল ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। তার অন্তিম যাত্রাপথের দিকে চেয়ে বিমলের চোখে জল আর সেই পথেই গাড়ির হর্ণটি অসতর্ক ভাবে পড়ে গেছে আর একটি শিশু সেই হর্ণ বাজিয়ে নতুন দিনকে যেন ডাকছে। বিমল ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি, চোখে টলটলে জল নিয়ে পুরানো কে বিদায় দিয়ে নতুনকে স্বাগত জানাচ্ছে।
সভ্যতার অনিবার্য পরিণতি পুরোনোর স্থলে নতুনকে স্থান দিতেই হবে, যুগে যুগে। পুরো সিনেমায় যন্ত্র প্রেমিক বিমল শেষ দৃশ্যে তার মনের জগদ্দল ভালোবাসাকে নতুন দিনের কাছে সমর্পণ করতে পারল-- এখানেই বিমলের চরিত্রের উত্তরণ।
মহৎ শিল্পের অনেকগুলি স্তর থাকে। এখানেও আছে।নতুনকে গ্রহণ করা সব সময় সহজ হয় না, বিমলের চরিত্রে তাই দেখানো হয়েছে। স্ট্যান্ডের অন্য গাড়িচালকদের সঙ্গে তার পার্থক্য এটাই যে ওরা প্রফেশনাল ,বিমল ইমোশনাল। গাড়ি নড়বড়ে হলে ওরা বেচে দেয়,নতুন কেনে। বিমল আঁকড়ে রাখতে চায় পুরোনো কেই।এখানেই জগদ্দল কথাটার অন্য ব্যঞ্জনা। আসলে বিমলের ইমোশনটাই জগদ্দলের মতো চেপে বসেছে তার জীবনে। অন্য একটি দৃশ্যে সবাই হাঁটছে আর জগদ্দল স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জগৎ গতিশীল। বারবার এটাই দেখানো হয়েছে। একটি বিশেষ মুহূর্তে র কথা বলা জরুরী। যখন স্ট্যান্ডে পুলিশ অফিসার সেই নারী পুরুষটির ছবি বিমলকে দেখালো যারা পালিয়ে গেছিলো এবং ওরা বিমলের গাড়িতেই চড়েছিল ।বিমল সেটা পুলিশের কাছে বেমালুম অস্বীকার করল। সুলতান ছেলেটি অবাক হয়ে বিমলকে দেখল-- :কেন সে চেপে গেল '--এই ছিল তাঁর চোখের ভাষা । সব রহস্যের সমাধান কাম্য নয়, তাতে স্টোরি লাইনের ধার কমে যায়। একটা চোরাস্রোতের টান তৈরীতে ঋত্বিক সিদ্ধহস্ত। ঋত্বিক সযত্নে এই মেকানিজম গ্রহণ করেছেন।আবার মেয়েটিকে টিকিট কেটে দিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে এসে যখন দেখল পুঁটুলি ও চিরুণী পড়ে আছে তার গাড়িতে তখন সে তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে যেতে চাইল আর এইবার গাড়ি বিগড়ালো। একটি মেয়ের প্রতি তাঁর এই তড়িৎ প্রতিক্রিয়া জগদ্দল মেনে নিতে পারে নি।সেইবার প্রথম বিমল মাঝরাস্তায় গাড়ি খারাপ হওয়ার বিপদে পড়ল। এখানে স্টোরি লাইনের বিভিন্ন পরত সিলভার লাইনের মতো ঝকঝকে করে সিনেমাকে আন্তর্জাতিক মাত্রা দিয়েছে। গাড়ি আর মেয়েটির মধ্যে একটা টানাপোড়েন তৈরী হয়েছে। আরো একটি বিজোড় সম্পর্কের আবেদন সৃষ্টি করেছেন পরিচালক।
ক্যামেরার লংশটে, ডিপ লংশটে, মিড ক্লোজ আপের দৃশ্যায়ন ছবিটির গভীরতা বৃদ্ধি করেছে। একমাস ধরে জগদ্দল খারাপ হয়ে পড়ে আছে। বিমল হাজার চেষ্টা করেও পারছে না তাকে সুস্থ করতে। শেষ পর্যন্ত তার স্বীকারোক্তি ---'জগদ্দলের ভেতরে একটা কিছু হয়েছে।' Depth of a cinema ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক ছোট্ট এই সংলাপে । দর্শক জানবেন যে মেয়েটার প্রতি একটু বেশী মনোযোগ দেওয়াতে গাড়িটি অভিমানে বিগড়ালো। গাড়ির মনের ব্যথায় সে অকেজো হয়ে পড়ল। অসাধারণ গল্পের লেয়ার তৈরী করেছেন পরিচালক। জগদ্দলের মৃত্যু ঘন্টা বাজার সময় আসন্ন আর তখনই পরিচালক এক গোরস্থানের সামনে বিষাদ সুরে আদিবাসী গানের প্রয়োগ করেছেন নান্দনিকতার চুড়ান্ত পরিচয়ে।গভীর রাত্রে মেয়েটি মৃতের প্রতি বিলাপ করছে আর বিমল গ্যারাজে গিয়ে মৃত্যু পথযাত্রী জগদ্দলকে সান্ত্বনা দিচ্ছে যে আমি আছি জগদ্দল। কী করুণ বৈপরীত্যের সহাবস্থান পরিচালক সৃষ্টি করেছেন! আসলে হয়তো বিমল নিজেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছে। একটি ঘন্টাকে দুলতে দেখা গেছে সিনেমার প্রথম দৃশ্য থেকে বেশ কয়েকবার। জগদ্দলের মৃত্যু ঘন্টা? সিনেমার শেষ দৃশ্যের কথা মুখ ? সিম্বলিজম যে কোনো মহৎ সৃষ্টির উপাদান। এখানেও তেমনটিই আছে।
বুলকি একটি পাগল দরিদ্র চরিত্র। তার পুরোনো গামলা ট্যাক্সির চাকায় তুবড়িয়ে গেলে ব্যথা পায় কিন্তু নতুন গামলা পেয়ে পুরোনোকে ভুলে যায়। চিরন্তন সেই কথা ---'খালি আসা আর যাওয়া, তবে এলে কেন?' বুলকি বলে। তবু তো আসতে হয়, এটাই যে নিয়ম। এই চিরসত্য শুধু সিনেম্যাটিক ট্রুথ নয়, জীবন সত্য। পুরোনো গাড়ি বেচে নতুন আনতেই হবে -- পুরোনো জায়গা ছেড়ে দেবে নতুনকে তবেই জীবন এগোবে।ক্লোজ আপে বিমলের মুখের এক্সপ্রেশনে ধরা পড়েছে তার হৃদয়ের বেদনা। নিজেই হাতে করে গাড়ির সামনের কাঁচটা ভাঙার পর কান্নায় ভেঙে পড়লে প্রকৃতির দিকে ক্যামেরা প্যান করে বিমলের বেদনাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন পরিচালক।দিগন্ত ছোঁয়া গাছগাছালি আর রুক্ষ্ম পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে যেন বিমলের কান্না আছড়ে পড়ছে। সিনেম্যাটিক ব্যাকরণ মেনেই এগুলো করা হয়েছে। চার্চের ঘন্টা যেন জগদ্দলের বিদায় ঘন্টা বাজাচ্ছে। শেষবেলায় গাড়ি চলে যাচ্ছে টুকরো টুকরো হয়ে আর খৃষ্টান সমাধিক্ষেত্রের ক্রশ চিহ্নটি বোঝাচ্ছে মৃত্যুর ব্যঞ্জনা। অনেক সার্ভিস দিয়েছে জগদ্দল আর কতই বা দেবে! বিমল বেদনা বিদ্ধ হয়েও জীবনের রুঢ় সত্যটি উপলব্ধি করল।
ঋত্বিক ঘটকের প্রথম ছবি নাগরিক মুক্তি পায়নি তখনো। স্বভাবতই দ্বিতীয় নির্মাণ অযান্ত্রিক (১৯৫৮) মুক্তি পাক এই বিশ্বাসে তিনি ছিন্নমূল মানুষের বিক্ষুব্ধ হৃদয়ের কথা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন বিমলের মধ্যে ? গাড়িটাকে আর কর্মক্ষম রাখা যাবে না জেনেও মরিয়া চেষ্টায় রাতভোর সারাই করে দিনের আলোয় স্ট্যান্ডে দাঁড় করানোর মধ্যে একটা জয়ের ভাষা দিতে চেয়েছিলেন? কারণ ঋত্বিক তখন উদ্বাস্তু হয়ে এ বাংলায় এসেছেন ওপার বাংলা থেকে। বেঁচে থাকার লড়াই তিনি জানেন। দেখছেন রোজ। বিমলের বেঁচে থাকার রসদ ঐ জগদ্দল। সুতরাং জগদ্দল চলে গেলে তার বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। যেমন নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসা মানুষগুলোর বেঁচে থাকা কঠিন হয়েছে। সময়কে ধরতে চেয়েছেন। কেউ কেউ তাঁকে বলেছিল আপনি বড্ড দেশভাগের ইমোশনে ভোগেন। তিনি বললেন --'তবে কি ? বিক্ষুব্ধ সময়ে মুজরো করব?' জগদ্দলের অন্তিম পরিণতি মানতে কষ্ট হলেও অবশ্য বিমল মেনে নিয়েছিল। 'আছে দু:খ আছে মৃত্যু '-- ঋত্বিক দেখিয়েছেন । দেখিয়েছেন 'তবুও অনন্ত জাগে' -- হাসি মুখ শিশুর হাতের চাপে গাড়ির টুকরো হিসাবে পড়ে থাকা হর্ণ টার আওয়াজ সৃষ্টিতে। ঋত্বিকের সৃষ্টির ঘরাণা এটাই।
0 Comments