জ্বলদর্চি

উত্তরাখন্ডের উত্তরে : ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার'স/সোনালী জানা

উত্তরাখন্ডের উত্তরে : ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার'স

সোনালী জানা


"আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে
          দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে,
          ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে। "
এমনই এক ভরা শ্রাবণদিনে , বৃষ্টিতে ভিজে চেপে বসলাম ট্রেনে। যাবো উত্তরাখন্ডের অন্যতম আকর্ষণ - 'ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার'স'। জেনেছি ওখানকার ফুলেরাও বড়ো বৃষ্টি ভালোবাসে।
   দুর্গাপুর থেকে যেদিন হরিদ্বার পৌঁছালাম,সেদিন শ্রাবণের সোমবার। ভারত সেবাশ্রমে ব্যাগ রেখে আমি ও আমার বান্ধবী চলে গেলাম গঙ্গার ঘাটে। ইচ্ছে ছিলো শিবের মাথায় জল ঢেলে এই দীর্ঘযাত্রা শুরু করব। লক্ষ লোকের সমাগমে,এক পুণ্যদিনের সাক্ষী থেকে পরেরদিন খুব ভোরে রওনা দিলাম গোবিন্দঘাটের উদ্দেশ্যে।

 পাহাড়ের কোলে এঁকেবেঁকে বাস চলছে।ঠান্ডা বাতাসে হয়তো একটু ঝিমুনি এসেছিল। চোখ খুলে দেখি বাস থেমেছে। এখন চা-পানের বিরতি। আর সামনে কী? অবাক চোখে তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, দাঁড়িয়ে আছি পঞ্চপ্রয়াগের প্রথম প্রয়াগ-'দেবপ্রয়াগে '! ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি " ইহা কীতনা দের রুকেগা ভাইয়া? "
আসলে এখন আমরা চাইছি বাস আরও একটু থেমে থাক। ছুটে গিয়ে একবার দুহাত দিয়ে ছুঁয়ে আসি সেই পবিত্রধারাকে।

 তারপর ফিরে এসে আর চোখ বন্ধ করিনি। রুদ্র প্রয়াগ,কর্ণপ্রয়াগের, নন্দ প্রয়াগ, বিষ্ণুপ্রয়াগের শোভা দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলাম প্রায় দশ ঘন্টার পথ। সূর্য অস্ত যেতে বাসও তার যাত্রা শেষ করলো যোশীমঠে। আমরা দুই যাত্রী খুঁজে পেতে আবারও পৌঁছে গেলাম ভারত সেবাশ্রমের দরজায়। ঈশ্বরের করুণা আর ওনাদের উষ্ণ আপ্যায়ন, লিখতে বসে আজও কেমন যেন অনুভব করতে পারি।

পরেরদিন সকাল সকাল শেয়ার গাড়িতে চেপে পৌঁছে গেলাম চামোলী জেলার গোবিন্দঘাট। সেখান থেকে পুলনা। এবার গাড়ির পথ শেষ। শুরু হলো হাঁটার পরীক্ষা। ব্যাগপত্র মালবাহকের ঝুড়িতে ভালো করে বেঁধে রেডি হলাম পরীক্ষার জন্য। হাতে তুলে নিলাম একটা মজবুত লাঠি। সঙ্গে ছোটো ব্যাগে রাখলাম জলের বোতল, চকোলেট, বিস্কুট, রেইনকোট আর টুকিটাকি জিনিস। প্রায় আট ন'ঘন্টার পরীক্ষা বলে কথা!

 "আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো -
তাই তো তোমার বাণী বাজে ঝর্ণা-ঝরানো..."
-পুলনা থেকে গোবিন্দধাম বা ঘাঙরিয়া।পেরোতে হবে দশ কিমি চড়াই রাস্তা। চাইলে ঘোড়া নেওয়া যায়। কিন্তু আমরা ঠিক করেছি হেঁটেই উঠবো।
 পথ চলতে চলতে বুঝলাম কী বিচিত্র এই দশ কিমি! কেউ চলেছেন নাঙ্গা পায়ে হেমকুন্ডে সাহিবে মাথা ঠেকাতে। কেউ আপাদমস্তক দামি পোশাক, নামি জুতোয় সুসজ্জিত হয়ে ট্রেক করে। এখানে সকলের গন্তব্য এক কিন্তু উদ্দেশ্য আলাদা।
🍂

 কিছুটা পথ কিংবা কয়েকটা বাঁক,এখানে এমনভাবেই হয় পথসঙ্গী। দেখা হল তেমনই এক বয়স্ক ভদ্রমহিলার সাথে। জিজ্ঞাসা করলাম- "কোথা থেকে আসছেন?"
- "দিল্লি।"
-"কী করেন?"
"আর্কিটেকচারের কাজ করি ।"
বলেই ওনার পাল্টা প্রশ্ন "এবার নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবে আমার বয়স কত?" আমরা দুই অনভিজ্ঞ মৃদু হেসে আর জিজ্ঞাসা করিনি। শুধু বুঝলাম এই রাস্তায় বয়স জিজ্ঞাসা করা মানা। ইচ্ছেটাই আসল এবং একমাত্র।

গোবিন্দধামের এই পথে দেখা হল এক শিখসাধকের সাথে। ডান দিকের চোখ, গাল, ঘাড় অ্যাক্সিডেন্টে ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। জিজ্ঞাসা করলাম "কী করে এমন হল?"
জানালেন, দুদিন আগে এখানে আসার সময় তার উপরে গাছ পড়ে গিয়েছিল! ফার্স্ট এইড করে, একদিন বিশ্রাম নিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে আবারও বেরিয়ে পড়েছেন। ক্ষত কিন্তু তখনও কাঁচা। গরমে ঘামে কুটকুট করছে বলেই ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছেন। আর সেই সঙ্গে হয়তো খুলে ফেলেছিলেন সমস্ত ভয়ও।

অনেকটা পথ পার হয়ে গেছি। রাস্তায় দেখা হলো সাধারণ একজন বাবার সাথে, সঙ্গে অসুস্থ সন্তান। হাত ধরে নিয়ে চলেছেন। দুজনের বয়স আনুমানিক সত্তর ও চল্লিশ।চোখে অদ্ভুত আলোর তৃষ্ণা। পথে যার সাথেই দেখা হচ্ছে, হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন একটা চকলেট! হয়তো নীরবে চেয়ে নিচ্ছেন অসুস্থ ছেলেটার জন্য একটু দোয়া। 

 ঈশ্বরের এই দোয়া কিংবা করুনাকে পাথেয় করেই আমরাও পৌঁছে গেলাম ঘাঙরিয়া। রাতে হোটেলে বিশ্রাম। পরেরদিন সকালে উঠে  যাত্রা শুরু বহুকাঙ্ক্ষিত 'ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সে'র দিকে। ঠিক উল্টোদিকের পথটি চলে গেছে হেমকুন্ড সাহিব। 

 আমরা চললাম বারো হাজার ফুট উচ্চতায় 'ফুলো কা ঘাঁটি'র দিকে। UNESCO ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। অদ্ভুত সুন্দর এক নৈসর্গিক পথ। একপাশে ঘনজঙ্গল, অন্যপাশে পুষ্পবতীর উদ্দামস্রোত। একেবারে নির্জন, নেটওয়ার্কহীন এই দুর্গমপথে আমাদের সঙ্গী রবীন্দ্রসংগীত। গুনগুন করতে করতে পেরিয়ে যাচ্ছি দীর্ঘ পাথুরে পথ। 
 ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে ঝিঁঝিপোকা, পাখির ডাক। নিজের শারীরিক সক্ষমতাকে ছাপিয়ে শুনতে পাচ্ছি  হার্টবিট। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠছি। একটু দম নিতে বসে পড়ি গভীর জঙ্গলের বাঁকে রাখা ছোটো ছোটো পাথরে। সামনে-পেছনে তাকিয়ে খুঁজতে থাকি, "আর কি কেউ আছে ?"
  না,কেউ নেই! ঘিরে ধরে কী অদ্ভুত নির্জনতা! আর তখনই বারবার মনে পড়ছিল স্বামীজীর কথা, "সাহস আছে?" 

নিজেকে এই প্রশ্ন করতে করতেই হয়তো ১৯৩১ সালে একদিন পৌঁছে গিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক এস. স্মিথ সাহেব। আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন এই ফুলের উপত্যকাটি। জার্নি শুরু করার সময় পারমিট অফিসে দেখেছিলাম বেশ কয়েকজনকে। কমবয়সী ছেলেমেয়েদের দুটো দলও এসেছে। তখনও জানিনা পাহাড়ে এই চড়াইতে আমার গতি ঠিক কতখানি? আমার সঙ্গীর সাথে তা মেলে কিনা? চলতে গিয়ে বুঝলাম, আমি ধীরগতির! একে একে এগিয়ে গেছে সবাই। আমি থমকে দাঁড়িয়েছি যেখানে সেখানে। মাথা নত করেছি অলৌকিক সৌন্দর্য্যের কাছে। ক্যামেরাবন্দি করেছি মুহূর্ত। স্বাভাবিকভাবেই পিছিয়ে পড়েছি আরও। তারপর একসময় জনমানবহীন পথে মনে হয়েছে "এর শেষ কোথায়? এগিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে দেখতে পাবো তো ? নাকি জনকথিত কোনো বন্যজন্তু আমার পথরোধ করে দাঁড়াবে, আর আমি...!"

চার কিমি পথের শেষ অংশ আরও খাড়াই, আরও পাথুরে। তারপর হঠাৎ করেই কোন এক বাঁকে যেন বদলে গেল সব। অজানা অসংখ্য ফুল দুহাত মেলে ডাকতে থাকল -"সুস্বাগতম! তুমি এখন ফ্লাওয়ারসের ভ্যালিতে। পৃথিবীর নন্দন কাননে...।"
 
আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে জানালাম উচ্ছসিত অভিবাদন, "তাহলে, শেষ পর্যন্ত আমরা পৌঁছে গেছি...!" তারপর মুগ্ধ চোখে শুধু চেয়ে থাকা। আট কিমি দীর্ঘ, দু কিমি প্রস্থে বিস্তীর্ণ এই বাগিচা জুড়ে কতো চেনা রং, কতো অচেনা ফুল। জুলাই থেকে অক্টোবর এই চারমাসে বদলে বদলে যায় রঙের প্রাধান্য। এখন লাল আর গোলাপি বেশি। রোদ,মেঘ,বৃষ্টির পরম মমতায় নন্দাদেবীর কোলে দুলে উঠছে তারা। এতটাই বিহ্বল যে, পথের কষ্ট ভুলে অজান্তেই চোখে এসে গেছে আনন্দাশ্রু।

দুপুরের পরে মেঘ ঘিরে ফেলেছে সমগ্র ভ্যালি। তাদের বিদায় জানিয়ে নেমে এলাম ঘাঙরিয়াতে। পরেরদিন আরও কতো গল্প কাহিনি সঙ্গে নিয়ে সেই একই পথ ধরে নেমে এলাম গোবিন্দঘাট। দেখা হয়েছিলো সোদপুর থেকে আসা এক জীবনসংগ্রামী মহিলার সাথে। শুধুমাত্র ORS খেয়ে "ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার'স " ট্রেক সম্পূর্ণ করে নিচে নেমে এসেছেন। না, এটা বড় কথা নয়! কথাটা হলো, তারও বছরখানেক আগে ব্রেস্ট ক্যান্সারে কেমো নিয়ে জীবনের অনেক বড়ো চূড়া স্পর্শ করে ফেলেছিলেন। সুতরাং এই পথটুকু তো ওনার কাছে  যেন,
"আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি...!"

  আসলে ভ্যালির এই ফুলেরাও তো পথে দেখা হওয়া, নাম না জানা মানুষগুলোর মতোই। জীবনের চড়াই- উৎরাইতে তাদের সৌন্দর্য্য কিংবা সৌরভ মনে থেকে যায় বহুকাল। ঠিক যেমন মনের এক কোণে চিরস্থায়ী হয়ে আছে স্নিগ্ধ সুশোভিত ব্লু পপি অথবা বিকশিত ব্রহ্মকমলের দল।

Post a Comment

0 Comments