জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /শ্যামাশিস জানা

গুচ্ছ কবিতা

শ্যামাশিস জানা

গাছ


পাতায় পাতায় নিঃশ্বাসের শব্দ
ছায়ার ভিতরে লুকিয়ে কত স্বপ্নের শরীর
তাদের চোখের কোণে অন্ধকার নয়—
সেখানে সোনালী পোকারা নাচে মৌন বিষাদে 

বাকলের নীচে লুকানো কত কোটর 
সেইসব গহ্বরে আঁকা আছে সময়ের আলপনা,
তারই ভেতরে কান্নাহীন অশ্রুজন্মের বীজ—  
বুনতে বুনতে তুমি শুষে নিচ্ছো সমস্ত কসমিক ধুলো

গাছেরা নিঃশব্দ, তাদের মুখে গাঢ় ছায়া
তারা বহুযুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে তোমার বুকে
অথচ গোপনে ডুবে যাচ্ছে জলছবির মতো 
চারিদিকে ছোপ ছোপ মৃত্যুচিত্র
তার মধ্যে আমি উঠে দাঁড়াই, হাঁটি,
নিজেকেই খুঁজে বেড়াই—
এক ভার্চুয়াল বনভূমির মধ্যে,
যেখানে দাবানলরা প্রতিবার
নতুন করে তোমার নাম রাখে 


একটি বর্শাবিদ্ধ স্বপ্ন 

এক নারী— অর্ধেক ঘোড়া, অর্ধেক আগুন
তার হাতের বর্শা চিরে দেয় আকাশের অস্থি
বর্শার ডগায় ঝুলে আছে সময়ের চিৎকার,
রক্ত নয়, সেখানে ঝরে পড়ে আলোর কান্না

বর্শা হল সেই সেতু — 
যার গায়ে এখনো লেগে আছে ক্ষোভ আর করুণা,
তার চোখে নেই এতটুকু লজ্জা, প্রেম কিংবা অনুরাগ 
আছে বজ্রপাতের মতো অনেক গুপ্ত ইচ্ছার ক্ষতচিহ্ন,
চোখের ভেতর লুকানো গোপন আর্তনাদ
যা শুনতে শুনতে চোখের পাতা পুড়ে যায়

সেই নারী ভবিষ্যতের কল্পদ্রষ্টা, ছিন্ন গীতিকারী
আগুনে আগুনে ঠোকা লেগে জ্বলে ওঠে কত পাথর
নিজেরই ভেতরের অন্ধকারে সে পুড়ছে ক্রমাগত


ছায়ানারী 

নরম ছায়াটির ডানার কোনো শব্দ নেই
সে বসে থাকে এক কঙ্কালপিশাচ ভঙ্গিমায়
তারপর অনন্ত মহাকাশে উড়ে বেড়ায়
মুখ নেই, দৃষ্টি নেই, তবুও তার পবিত্র ছায়া— 
আমাদের অলস স্বপ্নগুলোকে গিলে ফেলে 

উদাসী নারীটি জানালার দিকে চেয়ে আছে অপলক
তার মুখে বিষাদের তন্দ্রা, চোখে আপাত নৈরাজ্য
ঘরের বাতাসে জমেছে অপেক্ষার কুয়াশা,
সে কি কারো অপেক্ষায়?
নাকি শুধু নিজেকেই খুঁজে পেতে চায়

ছায়া ও নারী— দুটি চরিত্র, দুটি বিবর্তিত সময়
আর মাঝে থমকে আছে এক দীর্ঘশ্বাসের দোলনা
একজন বাইরে, একজন ভেতরে, অথচ উভয়েই বন্দী
দু’জনেই খুঁজে চলে একটি শব্দ
যা উচ্চারিত হয় না
শূন্যতার হৃদয়ে জন্ম নেয় এক গুপ্ত বিপ্লব

এই দুঃসময়ের ভারে ছায়ানারীটির শরীর বেঁকে গেছে 
মহাকালখণ্ডের নীচে সে খুঁজছে নিজের অস্তিত্ব
সে কি আমাদের যৌথ অবচেতন? 
নাকি হারিয়ে যাওয়া এক ঈশ্বরী?

🍂


বাঘ

দুটি বাঘ ঘুরে বেড়ায় ভাঙা আয়নার ভেতর
তাদের কোনো গর্জন নেই,
চোখে নেই আগুনের দ্যুতি
তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে
বাস্তব আর মায়ার মাঝখানে,
বারবার আঁচড় টেনে যায় আকাশে
সেইসব থাবার দাগ যেন এক ভূতুড়ে মানচিত্র,
যেখানে জল-স্থল-অরণ্য-জনপথ কিছুই নেই
কেবলই অনেক প্রশ্নচিহ্ন

দুটি বাঘ একই স্বপ্নের দুই অভিমুখ
একটি লাফিয়ে ওঠে আকাশের সিঁড়িতে,
অন্যটি নেমে আসে জীবন-জঙ্গলের দিকে
তারা জানে তাদের কোনো শিকার নেই
শিকার মানে সেই অপ্রকাশিত স্বপ্ন
যা কখনও লেখা হয়নি
যেন ছোটগল্পের কোনো ভাঙা বাক্য
যেখানে অরণ্যের অনুপস্থিতিতে
ভয়ের তেমন কোনো অভ্যাস নেই 
বরং এক হারানো ভাষার লিপিমালা

এইসব বাঘ আসলে কে?
শুধুই কি কল্পনার পুনর্জন্ম
দুজনেই একে-অপরকে চেনে না,
অথচ এক অদৃশ্য কোয়ান্টাম অনুবাদে বাঁধা 


চিত্রকল্প 

দেওয়ালে আঁকা এক দেবতা
দশহাতে ধরেছেন দশ দিগন্ত,
মাথায় দুটি শিং, চোখ-মুখ নেই
শুধু রক্তে মোড়া নীরব প্রতিধ্বনি
তাঁর পায়ের নীচে লুটিয়ে পড়েছে অগণিত মানুষ
বামদিকে সূর্য, ডানদিকে ছায়া-সূর্য
এই দুটি চক্র ঘুরছে একই কক্ষে বিপরীতমুখী বিশ্বাসে

পুরো দেওয়াল জুড়ে যেন এক রূপক পুরাণ,
যেখানে ঈশ্বর ও জনতা মিশে যায় ধুলোর মোজাইক-নাটকে
কেউ চায় সুখ, কেউ চায় শান্তি , কেউ কেউ কৈবল্য 
কেউ কেবল দাঁড়িয়ে থাকে, মনে হয় কিছুই চায় না 
এরা কেউ কাউকে ছুঁতে পারে না

Post a Comment

2 Comments

  1. কমলিকা ভট্টাচার্যAugust 31, 2025

    ভালো লাগলো কবিতাগুলি,বেশ কিছুকিছু পংক্তি।

    ReplyDelete
  2. ShyamashisAugust 31, 2025

    অনেক ধন্যবাদ

    ReplyDelete