জ্বলদর্চি

ছেলেধরা বুড়ি ও নাপিতের ছেলে /সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস কথক- সীমা দাস, গ্ৰাম- ডুমুরিয়া, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম


ছেলেধরা বুড়ি ও নাপিতের ছেলে

সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস 

কথক- সীমা দাস, গ্ৰাম- ডুমুরিয়া, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম 


কৃষ্ণপুর নামে একটি গ্ৰামে বাস করত এক নাপিত। নাপিত তার বউ ও একমাত্র ছেলেকে নিয়ে সুখে শান্তিতেই বসবাস করত। নাপিত সারাদিনে যা রোজগার করত তাতে তাদের তিনজনের ঠিক চলে যেত। কোনোদিন ভালো রোজগার না হলেও তাদের কোনো দুঃখ থাকত না। কারণ পাশের গ্ৰামের পলাশ নামে এক বুড়ো তাদের নানাভাবে সাহায্য করত। কখনো তরি-তরকারি, পুকুরের মাছ আবার কখনো কখনো টাকা পয়সা এইসব দিত। এই পলাশ বুড়ো নাপিতকে তার নিজের ছেলের মতো ভালোবাসত। তাই এইসব জিনিস দিয়ে তাদের সাহায্য করত। এমনকি নাপিতের পরিবারও পলাশ বুড়োকে খুব ভালোবাসত। তাই তাদের বাড়িতে কিছু হলে পলাশ বুড়োকে গিয়ে দিয়ে আসত। এইভাবে ভালো-মন্দ দুই মিশিয়ে নাপিতের সংসার ভালো ভাবেই চলত।

এমনই একদিন নাপিত তার রোজগার ভালো হওয়ার জন্য বাড়ির জন্য বাজার থেকে একটা বড়ো দেখে কাতলা মাছ নিয়ে আসে। আর রান্না হয়ে যাওয়ার পর নাপিতের বউ তার ছেলেকে ওই মাছের তরকারি দিয়ে পাঠিয়ে দেয় পলাশ বুড়োর বাড়ি। কারণ নাপিতের ছেলেও পলাশ বুড়োকে খুবই ভালোবাসত। তাই মায়ের কথামতো সে মাছের তরকারি নিয়ে পলাশ বুড়োর বাড়িতে যায়।

রাস্তায় যেতে যেতে সে ভাবতে থাকে-“যাই তাড়াতাড়ি যাই। পলাশ দাদুকে গিয়ে এই তরকারিটা দিয়ে আসি। দাদুও তো আমাদের কত কিছু দেয়। তাই আমাদের উচিত পলাশ দাদুকে কিছু দেওয়া।”

🍂

এইসব ভাবতে ভাবতে সে যেতে থাকে। রাস্তায় যেতে যেতে তার অনেক জল তেষ্টা পায়। কিন্তু সে কোথাও জল দেখতে পায় না।

তাই সে বলে-“উফঃ কোথাও তো জল পেলাম না। আমি যে আর হাঁটতেও পারছি। তাই ওই গাছের তলায় গিয়ে একটু বিশ্রাম করি। তা না হলে আর হাঁটতে পারবে না।”

এই বলে সে একটি গাছের তলায় গিয়ে বসে। তখন ওই পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে পৌঁছায় এক ছেলেধরা বুড়ি। এমন ফাঁকা জায়গায় নাপিতের ছেলেকে দেখে বুড়ি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়।

আর বুড়ি বলে-“ওলে বাবা লে, এ যে কচি খোকা।            নিশ্চয়ই হবে একটু বোকা। হা হা হা। তাহলেই তো আমার সুবিধা হবে কাজ সারতে। একটুখানি বুদ্ধি লাগবে ওকে ধরতে। অনেকদিন পর আমার হাতে অনেক টাকা আসবে। আঃ কী সুন্দর একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। মনে হচ্ছে মাছের গন্ধ। কতদিন মাছ খাইনি। আজকে যে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম কে জানে। একদিকে কচি খোকা, আর একদিকে মাছ। উফঃ কী যে আনন্দ হচ্ছে।”

এরপর বুড়ি নাপিতের ছেলের কাছে আসে আর জিজ্ঞাসা করে-“কে তুমি খোকা, এই ভরদুপুরে এই নির্জন রাস্তায় একা একা কী করছ? বাড়ি কোথায় তোমার? তুমি কী হারিয়ে গেছে?”

তখন নাপিতের ছেলে বলে-“না গো বুড়িমা, আমি হারাইনি। আমি তো পাশের গ্ৰামেই থাকি। আসলে অনেকটা পথ হেঁটে হেঁটে আমার খুব জল তেষ্টা পেয়েছিল। কিন্তু কোথাও জল না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে আমি এখানেই বসে পড়েছি।”

বুড়ি তখন বলে-“ও আচ্ছা, এই কথা। খুব জল তেষ্টা পেয়েছে বুঝি। দাঁড়াও, আমি তোমাকে জল দিচ্ছি।”

এইবলে বুড়ি নিজের বস্তা থেকে একটা জলের কুঁজো বের করে। আর বলে-“এই নাও খোকা জল খাও।”

নাপিতের ছেলে বলে-“তোমার কাছে জল আছে বুড়িমা! অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।”

এরপর নাপিতের ছেলে জল খায়। কিন্তু জল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নাপিতের ছেলে অজ্ঞান হয়ে যায়। কারণ বুড়ি ওই জলের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল। 

তারপর বুড়ি নাপিতের ছেলেকে বস্তার মধ্যে ভরে নিয়ে যেতে লাগল। অনেকটা পথ হাঁটার পর বুড়ি আর হাঁটতে পারছিল না। কারণ তার বয়স হয়েছে। তাই পিঠে করে বস্তাটাও ঠিকমতো বইতে পারছিল না।

তাই বুড়ি বলে-“আঃ কী ভারী বস্তাটা। এই বয়সে কী আর পারা যায়। এখানে একটু দাঁড়াই। আর এবার আমারও খুব জল তেষ্টা পেয়েছে। তাই আশেপাশে কোথাও জল পাওয়া যায় কিনা দেখি।”

এইবলে বুড়ি বস্তাটা একটি গাছের নিচে রেখে জল আনতে যায়। বুড়ি যাওয়ার পর নাপিতের ছেলে বস্তার ভিতরে ছটফট করতে থাকে। ছটফট করতে করতে হঠাৎ সে বস্তার বাঁধা মুখটা খুলে ফেলে।

বস্তা থেকে বেরিয়ে নাপিতের ছেলে বলে-“যাইহোক বাবা, বস্তা থেকে বেরোতে পেরেছি। এই বুড়ি তাহলে ছেলেধরা। ভগবানের অশেষ কৃপা আমি ওই বুড়ির হাত থেকে রেহাই পেয়েছি।”

এরপর নাপিতের ছেলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে বুড়ি নেই। এই ফাঁকে সে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। 

কিছুক্ষণ পর বুড়ি এসে দেখে বস্তা খোলা। তার মানে ছেলেটি পালিয়েছে। তখন বুড়ি বলে-“বেটা পালিয়ে যাবে কোথায়। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি। ওই ছোঁড়া নিশ্চয়ই এই পথ দিয়েই যাবে।”

এরপর বুড়ি একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। আর বুড়ির অনুমান মতো নাপিতের ছেলেও এই রাস্তায় আসতে থাকে। তাকে আসতে দেখে বুড়ি ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে। 

নাপিতের ছেলে তার কাছে আসতেই বুড়ি তাকে বলে-“কী গো খোকা, জিলিপি খাবে নাকি?”

তখন নাপিতের ছেলে বলে-“তুমি কে গো বুড়িমা?”

বুড়ি বলে-“আমি পুঁটির পিসি। তোমাদের পাড়াতেই থাকি। আমি তো তোমাকে চিনি। তুমি তো অমল নাপিতের ছেলে, তাই না?”

তখন নাপিতের ছেলে বলে-“হ্যাঁ।”

বুড়ি বলে-“আসলে আমি অনেক দিন বাড়িতে ছিলাম না। তাই হয়তো তুমি আমাকে চিনতে পারছ না।”

নাপিতের ছেলে বলে-“হবে হয়তো।”

বুড়ি বলে-“আমি পুঁটির জন্য জিলিপি নিয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তায় তোমাকে দেখলাম তাই ভাবলাম তোমাকেও দুটো দি। তুমি তো আমার নাতির মতো। তুমি খাবে বাছা?”

নাপিতের ছেলে বলে-“এত করে যখন বলছ তাহলে দুটো দাও।”

এরপর নাপিতের ছেলে ওই জিলিপি খায়। কিন্তু জিলিপি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। কারণ বুড়ি ওই জিলিপির মধ্যে অজ্ঞান হওয়ার ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল। এরপর বুড়ি আবার নাপিতের ছেলেকে বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়। 

আর বুড়ি বলতে থাকে-“এবার আর কোথাও দাঁড়াব না সোজা বাড়ি যাব।” 

এই বলে বুড়ি বাড়ির পথে রওনা হয়। 

বাড়ি পৌঁছে বস্তাটি রেখে বুড়ি বলে-“যাই এবার কিছু কাঠ নিয়ে আসি। দুটো ভাত ফুটিয়ে নিই। আর তার সঙ্গে নাপিতের ছেলের কাছে যে মাছ ছিল ওই মাছ দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে নিই। তারপর রাত হলেই বেরিয়ে পড়ব শহরের উদ্দেশ্যে। আর বাচ্চাটিকে বেচে অনেক অনেক টাকা পাব।”

এই বলে বুড়ি কাঠ আনতে চলে যায়। আর এদিকে নাপিতের ছেলে আবার বস্তার ভিতরে ছটফট করতে করতে আগের মতো এবারেও বস্তার মুখ খুলে ফেলে। বস্তা থেকে বেরিয়ে নাপিতের ছেলে দেখে সে একটা ঘরের মধ্যে আছে। 

তখন নাপিতের ছেলে বলে-“নিশ্চয়ই ওই ছেলেধরা বুড়ি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমি এখান থেকে বের হব কী করে?”

এইসব বলে সে ঘরের চারিদিকে দেখতে থাকে। হঠাৎ সে দেখে ঘরের একটা জানালার একটা দুটো শিক ভাঙা আছে। তখন নাপিতের ছেলে জানালার বাকি শিকগুলো কোনোমতে ভেঙে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। 

আর এদিকে বুড়ি কাঠ নিয়ে যখন ঘরে আসে, তখন সে দেখে ছেলেটি নেই। আর ঘরের সামনে জানালার শিকগুলো ভাঙা। 

তখন বুড়ি বলে-“বেটা আবার পালিয়েছে। একে আমি কিছুতেই ছাড়বে না।” 

বুড়ির রাগ আগের থেকে আরও দ্বিগুন বেড়ে যায়। আর এদিকে নাপিতের ছেলে দু-দুবার বুড়ির হাত থেকে বেঁচে যাওয়ায় তার সাহস আগের থেকে আরও বেড়ে যায়।

এইভাবে কিছুদিন কেটে যায়। একদিন নাপিতের ছেলে দুপুরবেলা তার বাবার কাছে চুল কাটার সরঞ্জাম পৌঁছে দিতে যায়।

তখন নাপিতের ছেলে বলে-“বাবাও না, চুল কাটতে যাবে আর চুরি, কাঁচি, খুর এগুলো নিতেই ভুলে যাবে। বাবা কী জানে না, এগুলো ছাড়া চুল কাটতে পারবে না। আর মায়ের ফরমাশ আমাকেই এগুলো বাবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। মা তো আর জানে না একটা পাগলি বুড়ি আমার পেছনে পড়েছে।”

এইসব ভাবতে ভাবতে সে পথ চলতে থাকে। যেতে যেতে হঠাৎ সে দেখে ওই বুড়ি এদিকে আসছে। বুড়িকে আসতে দেখে নাপিতের ছেলে ভাবে-“এই যে বুড়ি আবার এদিকে আসছে। মনে হয় আবার কাউকে ধরবে। এই বুড়িকে এবার একটা শিক্ষা দিতে হবে। বাচ্চা বিক্রি করা এবার তোর লোভ আমি ঘোচাব রে বুড়ি।”

এই ভেবে নাপিতের ছেলে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে সামনে একটা গাছের নিচে কতগুলো গরু চরছে। তখন সে ওই গাছের তলায় যায়। আর সেখানে পড়ে থাকা গরুর গোবরগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। আর গোবরের ভিতরে খুর, চুরি, কাঁচি এগুলো ঢুকিয়ে দেয়। তারপর সে ওই গাছের তলায় বসে পড়ে আর ঘুমানোর ভান করে। 

এদিকে বুড়ি হঠাৎ নাপিতের ছেলেকে দেখতে পেয়ে বলে-“ওরে বাবা, এ তো সেই বদমাইস ছোঁড়াটা। দু-দুবার আমার হাত থেকে ফসকে গেছিস। এবার তোকে নাগালে পেয়েছি আর ছাড়ব না। এবারে হাত পা বেঁধে নিয়ে যাব।”

এই কথা বলে বুড়ি আনন্দে দৌঁড়ে ছেলেটির কাছে আসে। কিন্তু হঠাৎ গোবরে পা পিছলে বুড়ি পড়ে যায়। আর গোবরের মধ্যে থাকা খুর, কাঁচি, চুরিতে বুড়ি সারা শরীর কেটে যায়। যারফলে বুড়ির গা থেকে অঝোরে রক্ত পড়তে থাকে। আর বুড়ি যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। 

তখন নাপিতের ছেলে বলে-“ঠিক হয়েছে বুড়ি। বাচ্চা বিক্রি করবি, তাই না। এবার বোধ ঠেলা। এটাই তোর শাস্তি। আমিও নাপিতের ছেলে এত সহজে আমাকে ধরতে পারবি না।”

এই বলে নাপিতের ছেলে সেখান থেকে চলে যায়। এদিকে বুড়ি যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে আর নিজের ভুল বুঝতে পেরে কাঁদতে থাকে।

Post a Comment

0 Comments