জ্বলদর্চি

বিছুটি / ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৮৩
বিছুটি

ভাস্করব্রত পতি

“তোমার নাম বনফুল কে দিয়েছিল? 
তোমার নাম হওয়া উচিত ছিল ‘বিছুটি’। 
যা দু এক ঘা দিয়েছ, তার জ্বলুনি এখনও কমেনি।”
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার এভাবেই বনফুল তথা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়কে বিছুটির সাথে তুলনা করে বলেছিলেন! আর এই বিছুটি হল উদ্ভিদজগতের সবচেয়ে নচ্ছার এবং জ্বালাময়ী উদ্ভিদ। প্রবাদে রয়েছে -- 'কলির জাগ্রত তিন দেবতা / আগুন বিছুটি কীল গুঁতা।'

আমরা কথায় কথায় বলি, 'বিছুটি ঝাড়ের আম গোপীনাথের।' অর্থাৎ যে আম বিছুটির ঝোপেঝাড়ে পড়ে, তা কুড়োনো যায়না। তখন তা মনে মনে দেবতাকেই অর্পণ করা হয়। অনেকটা ঠিক 'উড়ো খই গোবিন্দায় নম' সুলভের। আসলে এই বিছুটি গাছের পাতা গায়ে লাগলেই বেদম জ্বালা জ্বালা করে। চুলকোয়। চামড়ায় থোড়া থোড়া হয়ে ফুলে যায়। সহজে কেউ এর কাছে ঘেঁষে না। বরং সবাই এড়িয়ে চলে গাছটিকে। দুই চব্বিশ পরগনায় এই গাছটির এহেন চরিত্র নিয়ে ধাঁধা রয়েছে --
'তিন বর্ণে নাম তার শুন শিশুগণ। 
বন মাঝে হেরি তার সদাই জনম।।
পত্রে তার বিষ থাকে একথা জানিয়া। 
জীবগণ চলে সদা তারে এড়াইয়া।।
মস্তক কাটিলে তার যাহা পড়ি রয়।
ছাত্রগণ লভি তাহা পুলকিত হয়৷৷'
আবার বাংলাদেশের ঢাকাতে বিছুটি গাছ সম্পর্কে শোনা যায় --
'অরণ্যেতে জন্ম তার অরণ্যেতে রয়, 
ভুলেও তার কাছে কেহ নাহি যায়।
স্পর্শ মাত্র তার অঙ্গ সর্ব অঙ্গ জ্বলে, 
দ্বিগুণ আগুন হয় তাতে জল পেলে।।'
এই বিছুটি গাছের কাণ্ডে অতি সূক্ষ্ম লোমের মত 'ট্রাইকোম' রয়েছে। গাছের গায়ে স্পর্শ করলেই ঐ ট্রাইকোমগুলির সামনের অংশ ভেঙে যায়। তখন ট্রাইকোমের মধ্যে থাকা হিস্টামিন, অ্যাসিটাইল কোলিন, সেরোটোনিন সহ অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থগুলি বেরিয়ে আসে। যার ফলে দেহের চামড়ায় জ্বলুনি শুরু হয়। 

বিছুটিকে সংস্কৃতে বৃশ্চিকালী, বিষণী, হিন্দিতে পিত পারানি, বারান্ত, বহরটা, মালয়ালমে কডিতুম্বা, ছেরিকোটিতোবা, চরিয়ানাম, তামিলে কান্চরী, সেনতাত্তী, কন্নড়ে তুর্কি বাল্লি, নেপালিতে উট কেটারী, তেলুগুতে তেলোকন্দিকেত্ত, মারাঠিতে বৃশ্চিকালী, আগ্য, লাঘুমেদশিঙ্গি, আগ পান, কল্লভি, ওড়িয়ায় কাসালাক্কু নামে পরিচিত। এছাড়াও এর পরিচিতি ক্ষীরবিষণিকা, স্বর্ণপুষ্পা, বিষয়ী, নেত্ররোগহা, থলিপণী, দক্ষিণবর্তকী, বিষাণী, উস্ট্রিকা, ভাসুরপুষ্পা নামেও। চুলচুইল্লা গাছ নামেও কোথাও কোথাও পরিচিত। ইংরেজিতে বলে Climbing Nettle, Indian Stinging Nettle, Canchorie Root Plant। মেদিনীপুরের লোকেরা বলে বিছাতি গাছ। আসাম এবং ময়মনসিংহের লোকেরা একে 'চোতরা' বলে। আসামে একে 'শিরনাথ'ও বলে। কামাখ্যা অঞ্চলে এর নাম 'ডোমাসরাত'। এই চোতরার বিজ্ঞানসম্মত নাম Laportea crenulata। এটি Urticaceae পরিবারের। তবে বিছুটির বিজ্ঞানসম্মত নাম Tragia involucrata। যা Euphorbiaceae পরিবারের অন্তর্গত। 

গুল্ম জাতীয় বিছুটি সর্বত্র পাওয়া যায়। প্রায় ৪ - ৫ ফুট লম্বা। রাস্তার পাশে, বেড়ার ধারে, জমির আলে, পতিত জমিতে জন্মাতে দেখা যায়। চরকের বিমানস্থানের অষ্টম অধ্যায়ের ১৭৩ গুচ্ছে রয়েছে 'বৃশ্চিকালী অতিবিষা মূলানি'। উল্লেখ্য, প্রতি বছর বিছুটি পাতা খাওয়ার অভিনব প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ডের ডরসেটে। এটি কিন্তু একটি ভেষজ উদ্ভিদ। গাঁটে বাত, কোষ্ঠবদ্ধতা, হাঁপানি, বুক ধড়পড়ানি, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, ওজন কমে যাওয়া, মামস রোগ, বায়ু জনিত কাশির নিরাময়ে বিছুটি গাছ ব্যবহৃত হয়।

🍂

Post a Comment

0 Comments