চিত্র-শুভম দাস
দূর দ্বীপবাসিনী
পুলককান্তি কর
-- হ্যালো। আচ্ছা আমি কি ন্যায়ব্রত চক্রবর্তীর সাথে কথা বলছি?
-- হ্যাঁ নমস্কার। কে বলছেন আপনি?
-- আমি অলঙ্কৃতা সেন বলছি।
অলঙ্কৃতা নামটা শুনেই চমকে উঠল ন্যায়ব্রত। একটু সন্দিগ্ধতা নিয়েই বলল 'আই.এস.ডি কল দেখছি, কোথা থেকে কথা বলছেন?
--নিউ ইয়র্ক।
-- নিউ ইয়র্ক? কী দরকার বলুন তো?
-- গলাটাও কি চেনা যাচ্ছে না? হেঁয়ালি করল অলঙ্কৃতা।
একটু থেমে বলল, ‘কতগুলো অলঙ্কৃতাকে চেনো ব্রতদা?’
-- তুমি কি 'অলকা'? কোচবিহারের?
-- দিব্যি ভুলে গ্যাছো দেখছি।
-- তোমাকে কি ভোলা যায়? দীর্ঘশ্বাস গোপন করল ন্যায়।
-- গলার স্বর তো বাদই দিলাম, আমাকে 'তুই' করে ডাকতে সেটাও তো মনে রাখোনি।
-- কালের দূরত্ব অনেক অধিকার খর্ব করে দেয় অলকা।
-- হেঁয়ালি করে কথা বলাটা এখনও আছে দেখছি।
-- ওটাই তো বেচে খাই গো।
-- লেখক হিসাবে তোমার অনেক নাম হয়েছে শুনি।
-- ও দেশেও শোনা যায়? তাহলে বুঝতে হবে সত্যি নাম হয়েছে।
-- আজকাল বাংলার কোন জিনিসটা এদেশে পাওয়া যায় না ব্রত দা? নেটের দৌলতে তোমাদের আগেই পত্রিকা ফত্রিকা গুলোর লেখা আমরা এখানে বসে পেয়ে যাই। তবে তোমার নাম তো সত্যি সত্যি হয়েছে। শুনেছিলাম এবার বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনে নাকি তুমি এখানে আসতে রাজী হয়েছ?
-- দেখি। অফিসে ছুটি পাওয়াও তো জরুরী। নইলে যাওয়া হবে না। তবে তুমি ওখানে আছো যখন যাওয়ার আকর্ষণ অনেক গুণ বেড়ে গেল সন্দেহ নেই।
-- এখনও তুমি আকর্ষণ অনুভব কর ব্রতদা? দুষ্টুমির হাসি শোনা গেল ফোনের ওপারে।
চুপ করে রইল ন্যায়ব্রত। একটা সময় সত্যি সত্যি অলঙ্কৃতার প্রেমেও মগ্ন ছিল। ওরা দুর্গাপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ত। ন্যায়ব্রত অলঙ্কৃতার দু'বছরের সিনিয়ার। মনে আছে যেদিন ফ্রেশার'স ওয়েলকাম সেদিন এক নজরেই চোখে পড়ে গিয়েছিল মেয়েটি। বিশাল বড় বড় চোখ, হালকা কাজলে সন্ধ্যার অন্ধকারকে মনে করিয়ে দেয়। তেমনি বড় চোখের পাতা। ঠিক যেন 'ভ্রূ পল্লবে ডাক দিত চন্দনের গন্ধে'। খুব সুন্দর তাঁতের সালোয়ার স্যুট পরে এসেছিল সেদিন। ওদের কলেজের ফ্রেশারস এ তিন মিনিট করে কোনোও এক টপিকের উপর এক্সটেম্পোর আয়োজন থাকত প্রতিবছর। নতুন মুরগীদের চাটার জন্য যতটা সম্ভব ননভেজ বিষয় রাখা হ'ত। অলঙ্কৃতার বিষয় ছিল 'আমি যদি দ্রৌপদী হতাম।' কী ভয়ংকর উইটি এবং বাচনিক পারদর্শিতা ছিল মেয়েটির, ন্যায়ব্রত এখনও অবাক হয়ে ভাবে। সেদিন মোটামুটি সারা দুর্গাপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সমস্ত পুরুষ ছাত্র নির্ঘাত ফিদা হয়ে গেয়েছিল অলঙ্কৃতার উপস্থাপনায়। ন্যায়ব্রত স্বভাব লাজুক, গ্রামের ছেলে। উচ্ছাস তার ছিল না ঠিকই, কিন্তু মুগ্ধতা তাকেও না ছুঁয়ে যেতে পারে নি।
অলঙ্কৃতা নিজেকে একটু 'স্নবি' টাইপের প্রকাশ করতে ভালোবাসতো। হয়তো ঈশ্বর সুন্দরীদের এমন একটি বর্ম পরিয়ে দেন যাতে অন্তত অপেক্ষাকৃত হাবা গোবারা কাছে কম ঘেঁষতে পারে। যে সব ছেলেরা উন্নাসিক তারাও মনে মনে শত ইচ্ছে থাকলেও আগবাড়িয়ে কাছে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা বেশী একটা করে না। আর কিছু ওভার স্মার্ট ছেলেপুলে সব ক্লাশেই থাকে যারা মেয়ে পটানোটাকেই অ্যাডভেঞ্চার হিসাবে ভাবে। তাদের কাছে এটা তেমন কোনও ইস্যু না। ওরা এটাকেই বাহানা করে নারকেলের খোল ভেঙে ঢুকে পড়তে পারে ভেতরে। অলঙ্কৃতার এরকম খান পাঁচেক পুরুষ বন্ধু ছিল আর ছিল এক প্রাণের বান্ধবী। ঠিক বান্ধবী না, দিদি যে ন্যায়ব্রতের সাথে একই স্ট্রিমে পড়তো। ওর নাম ছিল সুছন্দা। বহুদিন হয়ে গেল ওর সাথেও যোগাযোগ নেই।
-- কী গো? উত্তর দিলে না যে? আবার প্রশ্ন করল অলঙ্কৃতা।
-- চাঁদ দূরে থাকলে কি জোয়ার ভাটা বন্ধ হয়ে যায় অলকা? সমুদ্র ঠিক টান বোঝে। চাঁদই মনে রাখতে পারে না কোথায় জোয়ার আর কোথায়ই বা ভাটা?
-- এ তো কবিতা হয়ে গেল গো।
-- কবির কথা তো কবিতাই। সাজিয়ে বললে কাব্য, না বললে গদ্য।
-- ঠিকই বলেছ ব্রতদা। তুমি নিজেকে মূলতঃ কী মনে কর?
-- 'কী মনে করি' মানে?
-- মানে কবি, না গল্পকার?
-- আমার কবিতাও তো গল্পই। জানো তো আমি কুঁড়ে মানুষ! যে গল্প ছোট করে বলতে চাই, তা হয়ে যায় কবিতা, যা একটু ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে বলি তা হয়ে যায় গল্প।
🍂
-- তাহলে বেসিক্যালি কি দাঁড়াল? তুমি মনে মনে বেশী গল্পকার?
-- না, আমি মনে হয় বেসিক্যালি কবি। তবে পাবলিক তো গল্পটা খায় বেশি, তাই আমাকে লেখক হিসাবেই বেশী লোক চেনে।
-- আমি তো তোমাকে কবি হিসাবেই ভাবতে ভালোবাসি ব্রতদা,
-- বা, বা। আমার সৌভাগ্য। তুমি আমাকে কিছু একটা ভাবো, এতেই আমি কৃতার্থ। 'কবি' তো উপরি পাওনা।
-- এভাবে বলছ কেন ব্রতদা?
-- কী ভাবে বলব? তুমি আমাকে ভাবো কোনও দিনের কোনও এক সময় - এটাই তো আমি ভাবতে পারি না; ইনফ্যাক্ট বিশ্বাসও করি না।
-- তাহলে এত কষ্ট করে তোমার ফোন নম্বর জোগাড় করলামই বা কেন, ফোনই বা করলাম কেন?
-- আমিও তো তাই ভাবছি অলকা।
-- কই তুমি তো আমায় কখনো ফোন করনি?
চুপ করে রইল ন্যায়ব্রত। কীইবা বলতো সে ফোন করে? কোনও বিবাহিত মহিলাকে কলেজের সিনিয়র দাদা কি যখন তখন ফোন করতে পারে? আর তাছাড়া ফোন নম্বরটাই বা কোথায় ছিল ওর কাছে? কিছু বলার জন্যই বলল – ‘আমার নম্বরটা কোথায় পেলে?’
-- তুমি বিখ্যাত লেখক। তোমার নম্বর চাইলে জোগাড় করা যায়।
-- যায় বুঝি? পাবলিশার্সদের তো স্ট্রিক্টলি বলা আছে আমার পার্সোন্যাল নাম্বার কাউকে না দিতে?
-- 'কেন, পাঠিকারা জ্বালাতন করে বুঝি?' মিষ্টি হাসির শব্দ এলো সাথে। 'আর তাছাড়া পাবলিশার্স' থেকে নম্বর নিয়েছি এমনটা মনে হল কেন তোমার? তুমি না লেখক?
-- না, মানে ওটাই সহজ অপশন। তবে কার কাছে পেলে শুনি?
-- কল্পনা কর। কল্পনার জাল বুনে বুনে যেমন এক একটা ছোট ঘটনাকে এক একটা গল্পে এনে ফেল, সেরকম কিছু একটা কর।
-- আমি তো সত্যিটা জানতে চাইছি অলকা, গল্প লিখতে তো চাইছি না।
-- আচ্ছা, এইটা নিয়ে গল্প লিখলে কী করতে? সুছন্দাদির আগমন ঘটতো এরপর? কহানি মে টুইস্ট?
-- গল্প তো আমার চেয়ে তুমি ভালো বানাতে পারো অলকা?
-- তোমার এত এত গল্প পড়ি কবিতা পড়ি - তোমাকে চিনবো না?
-- পাঠিকা যদি লেখককে বুঝে যায় তবে তো লেখক শেষ।
-- আমি তো পাঠিকা শুধু নই ব্রত দা। তুমি তো জানোই আমি তোমার প্রতিটি গল্পের বা কবিতার অন্যতম কুশীলব! তুমি কি সেটা স্বীকার কর?
-- অলকা, এভাবে দেখো না। লেখকরা জীবন থেকেই ঘটনা নেয়। কোনও একটা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত ভেবে কল্পনার জাল বনে। সম্ভবনার অনেক দিক থাকে। যে সম্ভবনা সেই মুহূর্তে লেখককে আকৃষ্ট করে সে তাই লেখে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত কিছু কল্পনা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
-- আমি তোমাকে যতটুকু চিনি ব্রতদা, তুমি তো ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে লেখো না। তুমি নিজেই একদিন বলেছিলে ঈশ্বর নাকি তোমায় দিয়ে লিখিয়ে নেন। এখন নাম হয়েছে, অর্ডারি লেখা ফেকাও লিখতে হয়নি নিশ্চই। তোমার কি সেরকম পরিবর্তন কিছু হয়েছে?
-- না, তা নয়। তবে ঈশ্বরের দয়ায় হয়তো ঘাটতি পড়েছে এখন।
-- ঘাটতি কিছুই পড়েনি ব্রতদা। বরং তোমার লেখা এখন আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছে। খুব ছোট ছোট ঘটনাকে নিয়ে এমন এক জায়গায় আজকাল পৌঁছে যাও তুমি, মনে হয় যেন বড় একটা কবিতা লেখা হয়ে গেল। হয়তো কাহিনী নেই তেমন কিছুই - কিছুটা রহস্য, কিছুটা আবেগ সব মিলিয়ে বেশ টানটান। আমার তো খুবই ভালো লাগে ব্রতদা।
-- তবে সমস্যাটা কী?
-- আজকাল তোমার যাই লেখা পড়ি সব কটাতেই মনে হয় ওতে আমি আছি কোনও একটা চরিত্র হয়ে। আমাদের জীবনের কোনও না কোনও ঘটনা আছে ওখানে।
-- তোমার আমার মিলিত জীবন আর কতদিন অলকা? আড়াই বছর। কত ঘটনাই বা ঘটেছে?
-- তা ও। প্রতিটি লেখায় কোথাও যেন তুমি আমাকেই লিখতে চাও। একটু পরেই যদিও আমি নিজেই আর খুঁজে পাই না নিজেকে। অন্য কেউ এসে আমার চরিত্রটা দখল করে নেয় তখন।
-- এটাই তো লেখকের সফলতা অলকা। পাঠক পাঠিকা যদি নিজেদের সাথে রিলেট করতে পারে তবেই না লেখাটা সার্থক।
-- তুমি কি বলতে চাও ব্রতদা, তুমি আমার কথা ভেবে এখন আর লেখো না?
-- এভাবে কেন ভাবছ অলকা? আজ সাতাশ-আঠাশ বছর বাদে এই নিয়ে আলোচনায় কোনও লাভ আছে কি?
-- নেই। এটা তবুও আমারই জিজ্ঞাসা। আমি সত্যিটুকু জানতে চাই। তুমি 'হ্যাঁ' বা 'না' স্পষ্ট করে বলো।
-- সব কথার স্পষ্ট জবাব হয় না অলকা। আমি হ্যাঁ বললেও কথাটার সত্যতা থাকবে না, 'না' বললেও না।
-- তুমি তো পেপার-ওয়ালাদের সাক্ষাৎকার দিচ্ছ না ব্রতদা, পরিষ্কার করে বলতেই বা দোষ কি? ধরা পড়ে যাওয়া?
-- কার কাছে ধরা পড়ার ভয় অলকা? ধরা তো তোমায় আমি দিতেই চেয়েছিলাম; তুমি স্বীকার করো নি। আমার দিক থেকে কোনও লুকোচুরি তো ছিল না কখনও।
চুপ করে রইল অলঙ্কৃতা। ন্যায়ব্রত তখন থার্ড ইয়ারে পড়ে। ও, সুছন্দা, আবির, টুম্পা ওর সব বন্ধুরা ক্যান্টিনে যখন যেত অলকা প্রায় দিনই ওদের সাথে এসে বসতো। সুছন্দা ওর রুমমেট ছিল বলেই ওর বেশী আনাগোনা ছিল। বাকীদের ও বিশেষ পাত্তা দিত বলে মনেও হ'ত না। তবে অকারণ কারোর সাথে কর্কশ ব্যবহারও করত না সে। ওর সাথে হাই-হ্যালোর বেশী ঘনিষ্ঠতা তাই ভাবতো না কেউই। ন্যায়ব্রত যদিও ভাবতো, কিন্তু মুখে বলে নি কোনওদিন। বছর খানেক বাদে কানাঘুষোয় শুনল ফাইন্যাল ইয়ারের মনতোষ বলে এক দাদা ছিপ ফেলে মাছ তুলে নিয়েছে। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। একদিন সুছন্দা কে ফাঁকা পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
-- হ্যাঁ রে তোর বোনটি নাকি ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে?
-- কেন রে? তোর পুকুর হওয়ার বাসনা ছিল নাকি?
-- কী যা তা বলছিস? আসলে অত ডাঁটে থাকে তো, তাই ভাবলাম কার অত বুকের পাটা হল।
-- অত মিউ মিউ করলে চলে না সখা; মাঝে মাঝে বুকের পাটায় থাবড়াতে হয়। মজা করল সুছন্দা।
-- তোকে নিজের মুখে স্বীকার করেছে অলঙ্কৃতা?
-- হ্যাঁ। কেন বল তো? নইলে কি তুই অন্য কোনও আশার আলো দেখতিস?
-- চুপ করে রইল ন্যায়ব্রত। ওকে দেখে কপট দুঃখের সুরে সুছন্দা বলল 'আহারে। এত দুঃখ প্রাণে? আগে থেকে মনটা খুলে ধরলে না হয় ঘটকালি করার পুণ্য করতাম। এখন তো সবই গেল। আহা রে! - ন্যায়ব্রতের চোখে আলতো হাত বুলিয়ে চোখের জল মোছাবার ভান করল সুছন্দা।
-- 'ইয়ার্কি মারিস না ছন্দা।' ধমকে উঠল সে। বলল 'জিজ্ঞাসা করলাম বলে, কী শুরু করলি?'
-- মেয়েদের চোখকে ফাঁকি দিও না গুরু। আমি সব বুঝেছি।
-- হাতি বুঝেছিস।
-- দাঁড়া, আজই অলুকে বলব তোর কথা। সুছন্দা অলঙ্কৃতাকে ছোট করে অলু বলতো।
-- 'না,না'। আর্ত্তনাদ করে উঠল ন্যায়ব্রত- 'বলবি না কিছু, আমার দিব্যি'?
-- কেন রে?
-- কী ভাববে বল দেখি!
-- কী ভাববে? মেয়েরা দু চারটে এরকম রাখাল বালক থাকলে খুশি হয় হতভাগা। এরা স্তাবকের মতো স্ত্ততি করবে, ভক্তের মতো চাইবে কিন্তু পাবে না কিছু।
-- তুই আমাকে সেই দলে ফেলতে চাস?
-- না রে। রাখালদেরও ক্যাটেগোরি আছে। কেউ কেউ 'আম রাখাল'। স্ত্ততি অঁবেদারি ছাড়া ওরা কিছু পারে না। পেলেও সুযোগ নিতে পারে না। দ্বিতীয় ক্যাটেগোরি হল তোর মতো আঁতেল রাখাল। এদের মনে ষোল আনার জায়গায় বিশ আনা ইচ্ছে - কিন্তু মুখ ফুটে বলবে না কখনও। মেয়েদের কাছে এই রাখালদের আলাদা কদর। এরা মেয়েদের গৌরব বাড়ায়।
-- আর গৌরব বাড়িয়ে কাজ নেই ছন্দা। তুই প্লিজ এই নিয়ে মজার ছলেও কিছু বলিস না।
-- বলব তো আমি বটেই, আজ সন্ধেটা কাটাবার এত ভালো খোরাক পেয়েছি, ছেড়ে দেব?
-- আমি তোর বন্ধু না? আমাকে নিয়ে খিল্লি করতে খারাপ লাগবে না তোর?
-- আরে বন্ধু বলেই তো বলব। আরে একটা ফর্ম ফিলাপ করেই রাখ না। কবে কোথায় কার জন্য কোন ভ্যাকেন্সি খুলে যায় - বোঝাই যায় না। এই মনতোষদা একটা আস্ত বাচাল। চপলমতি ছেলে। দ্যাখ না কদ্দিন এক ফুলে থাকে।
-- যা ছন্দা এরকম বলিস না। সেটা হলে কি ভালো হবে?
-- তুই তো দেখছিস শরৎ চাটুর্জের নায়ক টাইপ। তুই নিজের স্বার্থ দেখবি না অলুর? এত ভালোবেসে ফেলেছিস পাগল কোথাকার! আলতো করে ন্যায়ব্রতের চুলে বিলি কেটে দিল সুছন্দা। বলল মনতোষদার সাথে অলুর রিলেশন না টিকলেই তো ভালো রে হাঁদা। তোর চান্স খুলবে।
-- আমি এভাবে চান্স নিতে চাই না।
-- তুই কি মনে করিস মনোতোষদা অলুর মতো এমন সুন্দর মেয়ের যোগ্য? তোরা তো ওর বাইরেরটা দেখিস, আমি তো ওর সাথে থাকি, ও খুবই সফ্ট এবং সুন্দর মনের মেয়ে। আমার মনে হয় মনোতোষদার মতো প্রগলভ কেউ না হয়ে তোর মতো স্হিতধী কোনও পুরুষ যদি ওর জীবনে আসে, তবে ও সুখী হবে।
-- ও এতেই সুখী হোক ছন্দা।
-- আর তুই রবি 'নিষ্ফলের হতাশের দলে?' সত্যি তুই খুব ভালো রে! আমাকে প্রোপোজ কর না! মজা করল ছন্দা।
-- করলে বুঝি তুই রাজি হবি?
-- করেই তো দ্যাখ। আমি এক কথায় রাজি হয়ে যাব।
-- হ্যাঁ, আর আবির এসে আমার থোবনাটা তুবড়ে দিক আর কি!
সেদিন বোধহয় সুছন্দা অলঙ্কৃতাকে ওর ব্যাপারে কিছু বলেছিল। তারপর অলঙ্কৃতা তার সাথে দেখা হলে নিছক হাই-হ্যালো করে বিদায় নিত না। বরং ওর সাথে দাঁড়িয়ে কিছু না কিছু কথা বলত। ওর নতুন লেখা কবিতা বা গল্প চেয়ে পড়তো, সেই নিয়ে নিজের মতামত দিত। কখন যেন ওদের মধ্যে আলাদা একটা সম্পর্ক তৈরী হয়ে গেল। অত বড় নাম নিতে অসুবিধা হয় বলে অলঙ্কৃতা ওকে 'ব্রতদা' বলে ডাকত। আর ন্যায় ওকে 'অলকা' বলত। ওরা আরো কাছাকাছি এল যখন ওরা কলেজের এক্সকারসানে সবাই মিলে পুরী গেল বেড়াতে। তখন ন্যায় ফাইন্যাল ইয়ারে। মনোতোষ ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ তে সিলেক্টেড হয়ে দিল্লীতে ট্রেনিং নিচ্ছে। বিদেশী কোম্পানি, কয়েক মাস পরেই হয়তো অ্যাব্রডে চলে যাবে। একদিন বিকেলে ওদের অধিকাংশ ছেলে মেয়েরাই পুরীতে কোন এক সিনেমা হলে ফিল্ম দেখতে গেছে। সুছন্দা আবির সবাই। ন্যায়ব্রত বেড়াতে গিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়াটাকে নিছক আদেখলপনা ছাড়া অন্য কিছু মনে করে না। অলঙ্কৃতাও যায় নি সেদিন। দুজনে মিলে সন্ধ্যায় সি বিচে গিয়ে বসেছিল অনেকক্ষণ। ঢেউ এর উপর ঢেউ লাগাতার আছড়ে পড়ছে ঠিক যেন বেলাভূমিকে কোনও কিছুর জন্য সম্মত করার এক নিরন্তর প্রয়াস তার মধ্যে। সেই ঢেউ এর মধ্যে ফসফরাসের কণা এমন ভাবে জ্বলে উঠেছে যেন জলের মধ্যে একরাশ জোনাকির ঝিকিমিকি। ওরা খানিকক্ষণ চুপ করে বসে বিরামহীন ঢেউ গুনলো কিছুক্ষণ। একটু পরে ন্যায়ব্রত বলল 'তোর বাঁ হাতটা দিবি?'
চুপচাপ বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিল অলঙ্কৃতা। বুক পকেট থেকে পেনটা নিয়ে সেই হাতের তালুতে লিখে দিল – ‘ইচ্ছে করে তোমার কাছে/ ছন্দ হারাই ছন্দ খুঁজি/ তোমার সাথে বোঝাপড়া/ সবই তবে সোজাসুজি’।
নিজের বাঁ হাতটায় লেখাটা অনেকবার করে পড়ল অলঙ্কৃতা। গভীর এক দীর্ঘশ্বাস এসে পড়ল তার বুক চিরে। এর উত্তরে কিই বা বলবে সে। শুধু বলল, 'জানোই তো সব। কী বলেই বা ফিরে আসবো?
-- ফিরে আসতে তো বলিনি অলকা। আমার ইচ্ছেটুকু জানিয়েছি শুধু। আমার মনে হ'ল ইচ্ছের কেন্দ্রবিন্দু যখন তুই, তোকে জানানো উচিৎ। তুই যেমন আছিস থাক, আমার জন্য কিছু তোকে বদলাতে হবে না।
-- তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো ব্রতদা। তুমি তবে কষ্ট পাবে না।
-- দূর পাগলি! চাইলেই কি কাউকে ভালোবাসা যায়? তুই এসব নিয়ে চাপ নিস না। আমি তো জানিই তুই অন্য কাউকে ভালোবাসিস। তুই ভাবিস না আমি সেখান থেকে তোকে বিচ্ছিন্ন করতে চাই। এমনটা ভাবছিস না তো?
-- না না।
-- তবে আমার তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুই কিছু বলতে চাস?
-- না, না। তেমন কিছু নয়।
-- আরে বলই না। আমি মুখ দেখে বুঝতে পারি।
-- আমার মনে একটা প্রশ্ন এসেছে, জাস্ট কোয়ারি। তুমি আমাকে জানো, আমার অ্যাফেয়ারটাও তোমার অজানা নয়। তুমি এতদিন আমাকে কখনোই কোনও দুর্বলতা দেখাওনি। আজ তবে জেনে শুনে কেন এই চারটে লাইন আমাকে লিখে দিলে ব্রতদা?
-- দ্যাখ অলকা, আমি তোর প্রতি সৎ থাকতে চাই। আমার লেখায় কোথাও না কোথাও তুই থাকিস, তাই আমার মনে হয় এই জানানোটা আমার কর্তব্য।
আজ বোধহয় অলকা সেটাই জানতে চায়। এখনও সে এইসব লেখায় কোথাও আছে নাকি স্থান বদল হয়ে গ্যাছে তারও, অন্য কারও ছায়ায়। এই কথার কোনও জবাব দিল না সে। শুধু বলল- 'বিয়ে করলে না কেন ব্রতদা?'
-- তেমন মেয়ে পাইনি।
-- তেমন মানে?
-- মানে যেমন আমি চাই।
-- সেটা কেমন? আমার মতো?
আজ কী হয়েছে অলকার? সে তো এত প্রগলভা নয়। সে তো কখনও নিজের হৃদয়ের কথা বলে না এমন সোচ্চারে, সশব্দে। বিয়ের পর চরিত্র বদলে গেছে তার? কেনই বা এমন অধিকার বোধ কাজ করছে তার আজ এত বছর পর? কোনও উত্তরই ঠিক সুরে বাজলো না ন্যায়ব্রত'র মনে। বলল 'আসলে বেরিয়েই চাকরি পেয়ে গেলাম - তারপর লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ততা। কখন বয়স পেরিয়ে গেল টেরই পেলাম না।'
-- ছেলেদের আবার বিয়ের বয়স কি? বিশেষ করে তোমাদের মতো সেলেব দের? পঞ্চাশও হয়নি ভালো করে।
-- এতদিন যখন পার হয়ে গেল, মিছিমিছি আর মায়া বাড়াতে বলো কেন? এখন আর মনের জোরও নেই, হাঙ্গামা পোয়াবার সামর্থ্যও নেই।
-- বিয়ে না করেই বুঝে গেলে এতে হাঙ্গামা অনেক?
-- এটা বোঝার জন্য মস্ত বড় বিজ্ঞানী হতে হয় না অলকা। আর তাছাড়া লেখক মানুষ, নানান লোকের উপর একটা আলতো নজরদারি তো রাখি। কোনটা কখন কাজে লেগে যায়।
-- কিন্তু একটা অনুযোগ আছে তোমার প্রতি। তুমি কলেজ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আমার কোনও খোঁজ রাখো নি।
-- কী লাভ ছিল ওতে?
-- তা নয়। তোমার সাথে একটা বন্ধুতা তো ছিলই। সেটাও কি রাখাটা বাড়তি হয়ে যেত?
-- অলকা, আমি যবে থেকে তোমার কাছে ধরা দিয়েছি, তারপর আমরা কথাবার্তা বললেই এই সংক্রান্ত কথা কোনও না কোনও ভাবেই আসতোই। সেটা কি তোমার দাম্পত্যে প্রভাব ফেলত না? আর তাছাড়া শুনেছি বিয়ের কয়েক বছর পর তোমার বরের সাথে তোমার ডিভোর্স হয়ে যায়। ও আমেরিকান কোনও এক মহিলাকে বিয়ে করে নেয়। তোমার মেয়েকে নিয়ে তুমি আলাদা থাকতে শুরু কর। তখন আমি ফোন করলে তার অন্য অর্থ হতে পারতো।
-- তুমি সব খবর জানো আমার?
-- সব জানি না, প্রথম কিছু বছর রাখতাম। তারপর না রাখাটাই অভ্যাস হয়ে গেছে।
-- যখন ডিভোর্স হয়, তখন ফোন করনি কেন? এটা কি বন্ধুর মতো কাজ হয়েছিল ব্রতদা? বিপদের সময়ই তো বন্ধুরা পাশে দাঁড়ায়।
-- তুমি বোঝো নি মনে মনে আমিও তোমার পাশে ছিলাম? সামনাসামনি পাশে থাকলে হয়তো তুমি ভাবতে আমি চান্স নিচ্ছি।
-- এমন কেন ভাবতাম ব্রতদা? আমি তোমায় চিনি না?
-- হয়তো ভাবতে না। কিন্তু যদি ভাবতে, তাহলে সেটা আমার পক্ষে অসম্মান জনক হত।
-- আমি তোমার ‘কখনও নক্ষত্র’ উপন্যাসটা পড়ে বুঝেছিলাম তুমি আমার ডিভোর্সের বিষয়টা জানো।
-- তখন তুমিই বা ফোন করোনি কেন?
-- ভাবছিলাম যদি তোমার ফোন আসে। তবে 'যে টেলিফোন আসার কথা সচরাচর আসে না।' এতদিন অপেক্ষা তো করলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেললো অলঙ্কৃতা।
-- আচ্ছা অলকা, সে সময় তোমার টাকা পয়সার ব্যাপার কিভাবে সামলালে? শুনেছি তুমি নাকি মনোতোষদার থেকে অ্যালিমনি দাবিই করোনি?
-- না। সে আমার সাথে সম্পর্কই রাখেনি, তার থেকে টাকা নেব কেন? তবে তোমার 'ফাগুনের পর' গল্পটায় তুমি এমন এক নারীর জীবন নিয়ে লিখেছো তো! ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রিটা ছিল। একটা চাকরী জুটিয়ে নিলাম। মেয়ে তো এদেশেই বড় হয়েছে। বাপের ধারাটা পেয়েছে। বিয়ে করে নিয়েছে এ দেশেরই এক ত্র্যাফ্রো- আমেরিকানকে। 'বিয়ে' কথাটা ভুল বললাম। লিভ টুগেদার করছে। মাকে মনেও পড়ে না। আমিও ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছি ওই পর্বটাকে।
-- দেশে আসো না?
-- কী করব আর গিয়ে? বাবা-মা দুজনেই গত। ভাই এর বিয়েতে গিয়েছিলাম। ভাই তো বিয়ের পর থেকেই বাবা মা'র সাথে থাকতো না, কাজেই আমার সাথেও বিশেষ সম্পর্ক নেই। দু-তিন বছর আগে একবার গিয়েছিলাম সুছন্দাদির মেয়ের বিয়েতে। ভেবেছিলাম ওখানে তোমার সাথে দেখা হবে। শুনলাম ওদের সাথেও নাকি তুমি যোগাযোগ রাখো না।
-- যোগাযোগ রাখি না - এটা একপ্রকার ব্লেম দেওয়া অলকা। এটা ঠিক আমি নিজের থেকে খুব একটা আলাপী নই। কেউ ফোন করলে কথা বলি, নিজে থেকে খোঁজখবর নেওয়া হয়ে ওঠে না।
-- কেন? ব্যস্ততা?
-- না, না ব্যস্ততাকে দোষ দেব না। জীবনে খ্যাতি তো ব্যস্ততা দেবেই। তার জন্য প্রিয়জনের খোঁজখবর নেব না সেটা ঠিক কথা নয়। এটা আমার স্বভাব অলকা।
-- লোকে সে কথা মানবে কেন? তারা তো তোমাকেই দায়ী করবে।
-- আমি লোকেরও দোষ দেখি না। ইনফ্যাক্ট এসব আজকাল আমি আর ভাবি না। মা বেঁচে থাকতে নিয়ম করে ফোন না করলে গালাগালি দিত, এখন সে পাটও চুকে গেছে।
-- এখন কি তুমি দার্শনিক হয়ে যাচ্ছো ধীরে ধীরে? নাকি বিগতস্পৃহ?
-- সে যা বলো।
-- সুছন্দা দি, আবিরদা দুজনেই তো তোমার ভালো বন্ধু ছিল ব্রতদা। সম্পর্কটা থাকলেই ভালো লাগত।
-- সম্পর্ক কি এভাবে নষ্ট হয় অলকা? সবকিছুই আছে, ফলগুধরার মতো আমরা শুধু দেখতে পাচ্ছি না বাইরের থেকে। দেখা হলে দেখবে আবার সেই যৌবনের চপলতা লাগবে সম্পর্কে।
-- সুছন্দাদি কিন্তু বেশ অভিমানই করল তোমার উপর।
-- দ্যাখো অলকা, আমাকে ওরা মেয়ের বিয়েতে নেমন্তন্নই করেনি। অবশ্য নেমন্তন্নের প্রয়োজনও ছিল না। কোনওভাবে যদি আমি জানতে পারতাম, ঠিক চলে যেতাম।
-- ব্রতদা তুমি জানো ওরা এখন কোথায় থাকে?
-- বছর চারেক আগে শুনেছিলাম আবির দুবাই এ থাকে, সুছন্দা কলকাতাতেই চাকরি করে। লেটেস্ট খবর জানি না। কোথায় থাকে তুমি জানো?
-- হ্যাঁ। ওরা দুজনেই এখন কলকাতায় থাকে। আমি তোমাকে ঠিকানা দিতে পারি। অবশ্য যদি চাও।
-- থাক অলকা। ওরা যদি হারিয়েই থাকতে চায় তাদের তাই থাকতে দাও। ওদের খোঁজার দরকার নেই।
-- এমনও তো হতে পারে ব্রতদা, ওরা তোমার এই খোঁজারই প্রতীক্ষা করছে এতদিন।
বোঝা গেল না অলঙ্কৃতা নিজের কথাটাও এর মাঝে জুড়ে দিলে কিনা। ন্যায়ব্রতকে চুপ থাকতে দেখে অলঙ্কৃতা আবার বলল, 'ব্রতদা, তোমরা তো লেখক মানুষ, দাবী কর লোকেদের মন বোঝ। সত্যি বোঝ কি?
-- এতদিন তো ভাবতাম বুঝি বলে, এখন তুমি যখন সন্দেহ প্রকাশ করেছ, তখন বুঝি না নিশ্চই। একটু মজা করে পরিবেশটা হাল্কা করতে চাইল ন্যায়ব্রত।
-- না, বোঝো তো নিশ্চয়ই; নইলে লোকেরা লেখাগুলো নিজের বলে রিলেট করতে পারে কেন! তবে কিনা তোমাদের মনের লেভেল টা আমজনতার থেকে একটু বেশী বলেই বোধ হয় - যখন তোমরা নিজেরা এর মধ্যে জড়িয়ে পড়ো, একটা সুপার ইগো এসে তোমাদের দৃষ্টিটাকে কিছুটা ঝাপসা করে দেয়।
ন্যায়ব্রত ভেবে পেল না একথার কী জবাব দেবে। অলঙ্কৃতার ব্যাখ্যাটা হয়তো ঠিক, কিন্তু এখনই এসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করল না তার। তাই কথা ঘোরাবার জন্য বলল, 'অলকা তুমি যদি আবার কলকাতায় আসো, তবে তোমার সাথে সুছন্দাদের বাড়ী যাব। তুমি কবে আসবে?'
-- এখন তো আসার কোনও বাহানা নেই। এক কাজ কর, তুমি একটা বিয়ে করে ফেল। ওই বাহানায় আসা যাবে।
-- মেয়ে দেখবে কে? তুমি?
-- সে বললে দেখে দেবো।
-- রক্ষে করো বাবা। তোমার আসার বাহানা খুঁজতে বিয়ে করতে পারবো না। বাহানা ছাড়াই এসো।
-- যেতে তো বলছো, গেলে থাকবো কোথায়?
-- কেন? আমার এখানেই উঠবে।
-- তোমার লোক নিন্দে হবে না? ব্যাচেলার মানুষ? তার উপরে লেখক।
-- ওসব আমি পরোয়া করি না। আর তাছাড়া মানুষ যুবক-যুবতীকে একা একা থাকতে দেখলে ঈর্ষা বোধ করে। প্রৌঢ় প্রৌঢ়াদের বোধহয় সিনিয়র সিটিজেন ভেবে মাফ করে দেয়। হেসে উঠল ন্যায়। সে হাসির ছোঁয়াচ ছড়িয়ে গেল অলঙ্কৃতার মনেও। ন্যায়ব্রত বলল, 'অলকা ভিডিও কল করো না। তবে তোমায় দেখতে পাওয়া যেত।’
-- না ব্রতদা। এই বেশ। দেখতে হলে সামনাসামনি দেখো। তবেই না বুঝবে, তোমার সেই অলকা এখনও তেমনটি আছে কিনা?
-- আগের মতো তোমার সেই এক ঢাল চুল আছে আলকা?
-- না। ছোট করে দিয়েছি।
-- মোটাসোটা হয়েছো? গিন্নি বান্নি টাইপ?
-- সে তুমিই বিচার করো।
-- আচ্ছা এটাই তোমার ফোন নাম্বার তো?
-- কী করবে? সেভ করে রাখবে? কী লাভ? তুমি তো আবার নিজে থেকে ফোন কর না।
-- সবাই আর তুমি কি এক হলে?
-- এখনও কি আমি অন্যের থেকে আলাদা ব্রতদা।?
হঠাৎ একটা পুরোনো দিনের গন্ধ এসে লাগল ন্যায়ব্রতের মনে। হালকা একটা পারফিউম, নাম মনে নেই তার। অলকা খুব ব্যবহার করত। ন্যায়ব্রত কোনও উত্তর দিল না এ কথার। শুধু বলল, 'এই নম্বরটাই সেভ করে রাখব তো?'
-- না। এটা আমার কলিগের ফোন। আমার নম্বর তোমায় দেব না। যদি সত্যি তুমি আমায় ফোন করতে চাও, নম্বর খুঁজে নিও আমার। ফোনটা কেটে দিল অলঙ্কৃতা। ন্যায়ব্রত ভাবলো এই নম্বরটা তো সেভ করা থাক। এখান থেকে প্রয়োজনে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। সেভ করতে গিয়েও থমকে গেল সে। কী হবে এতে? যে তার ছিঁড়ে গেছে, তাতে কি আর সুর লাগবে আগের মতো? হঠাৎ একটা ঝটকা হাওয়ায় বারান্দার মাধবীলতার একটা ডাল এসে ঢুকে পড়ল ঘরে। ন্যায়ব্রত খুব সন্তর্পনে গ্রিলের আঁকসি থেকে মুক্ত করে দিল তাকে। তার নিজের জায়গায়; খোলা আকাশের নীচে।
0 Comments