জ্বলদর্চি

আমার ভাবনায় সুকুমার রায় /অর্হণ জানা


আমার ভাবনায় সুকুমার রায়

অর্হণ জানা

সুকুমার রায়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় তিন বছর বয়েসে। তাঁর মৃত্যুর ৮৬ বছর পরে। ব্যক্তিগত পরিচয় ঠিক বলব না। তা তখন সম্ভবও ছিল না। কারণ, ততদিনে তিনি গত। একটি ছড়ার বইয়ের সুবাদে হয় সেই পরিচয়— ‘ছড়ার ঝরনা’। ওই বইটিতেই প্রথম সুকুমার রায় এবং তাঁর ছড়ার সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমার। সুকুমার রায়ের বেশ কয়েকটি ছড়া ছিল ওই বইয়ে। ‘বাবুরাম সাপুড়ে’-র সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ওই বইতেই। ওই বইটি ঘিরে আমার অনেক স্মৃতি আজও অমলিন। ওই বইটি না থাকলে হয়তো অত ছোট বয়েসে সুকুমার রায়ের মত একজন গুণী মানুষের সঙ্গে আমার চেনাশোনাই হত না! 

আরও একটু বড় হতেই কাঠ-বুড়ো, কাতুকুতু বুড়ো-র সঙ্গে আমার আলাপ। ওই সময় থেকেই সুকুমার ঢুকে গেলেন আমার অস্তিত্বে, মজ্জায়, রক্তে। বিরাজ করতে শুরু করলেন আমার শয়নে, স্বপনে, জাগরণে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে। বয়েস আরও একটু বাড়তেই খোঁজ পড়ল রামগড়ুরের ছানাদের। বলা বাহুল্য, ‘আবোল তাবোল’ প্রথম ওই সময়েই পড়ি আমি। তখন যেমন আনন্দ দিত ওই ছড়াগুলি, আজও তেমনি দেয়। 

আমার না-দেখা গুরু, বন্ধু এবং অবশ্যই পথপ্রদর্শক সুকুমার রায়। তাঁর দেখানো পথেই আমি একটু-আধটু এগিয়ে চলার চেষ্টা করে চলেছি আমার লেখায়, আমার ভাবনায়, চিন্তায়। তাই আমি সাহস করে তাঁর মত লেখার ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছি আমার অকিঞ্চিৎকর কিছু রচনায়। তাঁর কাছে মার্জনা চেয়েই এখানে দুটি কিশোর বয়েসের লেখা (লেখা-ই, কারণ ছড়া বলতে যা বোঝায়, তা আমি লিখতে পারি না) তুলে দিলাম: 

চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে
                    আকাশ থেকে মট্ ক’রে,
ওরে ভোলা, আন না গিয়ে
                    ময়দা আঠা চট্ ক’রে!

কী বললি! পারবি নে তুই?
                    তোর তো ব্যাটা ভীষণ তেজ!
পিটিয়ে তোকে করব বাঁদর,
                    লাগিয়ে দেব লম্বা লেজ!

দাঁত ক’খানা উপড়ে নেব―
                    যেমন তোলে পালং পুঁই,
ঠ্যাং নাচিয়ে দেখব আমি
                    ধড়্‌ফড়িয়ে নাচবি তুই!


🍂

তিন্তিড়ী খেতে কেন
              টক টক গন্ধ?
লঙ্কায় ঝাল কেন?
              মনে বড়ো ধন্ধ!

আকাশটা নীল কেন?
              বলো দেখি বাপুরে—
সাপ নিয়ে কেন খেলে
              বাবুরাম সাপুড়ে?

আঙুরের রং কেন 
              সবুজ বা বেগুনী?
কেউ যদি জানো, তবে
              বলে যাও এখুনি!

সুকুমার রায়ের জন্ম হয় ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দের ৩০ অক্টোবর, কলকাতায়। স্বনামধন্য শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও বিধুমুখী দেবীর ছয় সন্তানের এক সন্তান, সুকুমার কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক হবার পাঁচ বছর পর ১৯১১ সালে বিলেত চলে যান মুদ্রণশিল্পে উচ্চশিক্ষার জন্য। কলেজ ছাড়ার কিছুদিনের মধ্যেই সুকুমার তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে সৃষ্টি করেন বিচিত্র এক সংঘ, যার নাম— ‘ননসেন্স ক্লাব’। কী হত এই ননসেন্স ক্লাবে? তার চাইতে বলা যাক— কী হত না সেখানে। সেখানেই অভিনয়ের জন্য সুকুমার লিখলেন দুটি নাটক— ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ এবং ‘ঝালাপালা’। ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ নামে একটি হাতে-লেখা পত্রিকারও জন্ম হল সেখানেই। আর সেখানেই পাওয়া গেল সুকুমারের পরিশীলিত এক হাস্যরসের পরিচয়।— যখন ‘ঝালাপালা’ রচনায় পাঠশালার ছাত্র কেষ্টা তার পণ্ডিতমশাইকে জিগ্যেস করে— ‘আই গো আপ, উই গো ডাউন’-এর মানে কী, এবং তার পরে পরেই ইংরেজি, সংস্কৃত, বাংলা— সব ঘেঁটে গিয়ে একেবারে হযবরল অবস্থা তৈরি হয়, যা আমাদের পেটে খিল-ধরানো হাসির উদ্রেক ঘটায়—

‘আই’—  ‘আই’ কিনা চক্ষুঃ, ‘গো’— গয়ে ওকারে গো গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ ‘আপ্’ কিনা আপঃ সলিলং বারি অর্থাৎ‌ জল। গোরুর চক্ষে জল,  অর্থাৎ‌ কিনা গোরু কাঁদিতেছে। কেন কাঁদিতেছে? না ‘উই গো ডাউন’, কিনা ‘উই’ অর্থাৎ‌ যাকে বলে উইপোকা— ‘গো ডাউন’, অর্থাৎ‌ গুদোমখানা। গুদোমঘরে উই ধরে আর কিছু রাখলে না— তাই না দেখে, ‘আই গো আপ্‌‌’— গরু কেবলি কান্দিতেছে—’। 

এমন-কি, একবার ক্লাব সম্পাদকের অনুপস্থিতিতে সদস্যদের কাছে চিঠি গেল, যার বয়ান ছিল: “সম্পাদক বেয়াকুব / কোথা যে দিয়েছে ডুব— / এদিকেতে হায় হায় / ক্লাবটি তো যায় যায়। / তাই বলি, সোমবারে / মদগৃহে গড়পারে / দিলে সবে পদধূলি / ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।” ইত্যাদি, ইত্যাদি। এইসব ‘তথাকথিত’ পাগলামি মিশ্রিত হাস্যরস সুকুমারের লেখায় বারেবারেই এসেছে, যাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন— ‘খেয়াল রস’। ননসেন্স কথাটির বাংলা তর্জমা বোধহয় এর চাইতে ভাল কিছুই আর হয় না। এ ছাড়াও ছিল— মান্ডে ক্লাব বা মন্ডা ক্লাব— যার অধিবেশন ডাকা হত সোমবারে-সোমবারেই।

আবোল তাবোল শ্রেণির লেখায় সুকুমারের প্রথম কবিতাটিই আমাদের চম্‌কে দেয়। যখন তিনি লেখেন— “হাঁস ছিল, সজারু (ব্যাকরণ মানি না), / হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না।” মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়— এ কেমন জানোয়ার রে বাবা! ‘বকচ্ছপ’-ই বা কী? কোথায় গেলে দেখা মিলবে ‘হাতিমি’-র? এইরকম আরও নানাবিধ মিশ্র জন্তু রয়েছে সুকুমারের এই মজার দেশে। সুকুমারের আগে ল্যুইস ক্যারল বা এডওয়ার্ড লিয়র এ-ধরণের কিছু উদ্ভট রকমের মিশ্র জানোয়ারের সৃষ্টি করেছেন ঠিকই, কিন্তু তারা ছিল অচেনা জগতের কিছু প্রাণী, যাদের এ-জগতের সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই।আর সুকুমারের প্রাণীগুলি আমাদের চেনা-জানা জগতের খুব কাছের। এইটিই তাঁর স্বাতন্ত্র্য। 

তাঁর ‘কাঠ-বুড়ো’ কবিতায় হাঁড়ি নিয়ে দাঁড়িমুখো বৃদ্ধের ভিজে কাঠ সিদ্ধ খাওয়া, কিম্বা হেড অফিসের বড়বাবুর গোঁফ চুরির বৃত্তান্ত যেমন উদ্ভট, তেমনই বিস্ময়কর বোম্বাগড়ের রাজার ছবির ফ্রেমে আমসত্ত্ব ভাজা বাঁধিয়ে রাখা কিম্বা কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে গন্ধ বিচার করবার মত বিচিত্র সব পরিকল্পনা। সুকুমারের বহুমুখী প্রতিভা নিশ্চিন্তে বিচরণ করেছে ছড়া, কবিতা থেকে বিজ্ঞানভিত্তিক ও জন্তুজানোয়ার সংক্রান্ত প্রবন্ধে, নাটক থেকে জীবনী, গল্প ও বিভিন্ন রম্যরচনায়। পাগলা দাশুর পাগলামিও যেমন মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়, তেমনি হ য ব র ল-র বিচিত্র জ্ঞানী বেড়ালটির সেই বিখ্যাত উক্তি, “চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ্য, রুমালের মা—হল চশমা। কেমন,  হল তো?”— আমাদের চোখ দুটিকে বিস্ময়ে বিস্ফারিত করে দেয়। 

শুধু একটিই আফশোস থেকে গেছে সুকুমারের জীবনে। প্রথমে পিতা উপেন্দ্রকিশোর ও তাঁর মৃত্যুর পর সুকুমার সম্পাদিত সন্দেশ পত্রিকায় ও অন্যত্র তাঁর বেশ কিছু কালজয়ী লেখা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু অঙ্কণে ও সাহিত্যে সমান পারদর্শী সুকুমারের নিজস্ব কোনও মুদ্রিত পুস্তক তিনি তাঁর জীবদ্দশায় করে যেতে পারেন নি। তাঁরই তৈয়ার করা তিনরঙা মলাট, অঙ্গসজ্জা, পাদটীকা ও অন্যান্য টীকাটিপ্পনী-সহ সুকুমারের প্রথম ‘খেয়াল রসের বই’ আবোল তাবোল প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর মাত্র নয় দিন পরে— ১৯২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। যখন দুরারোগ্য লিশম্যানিয়াসিস রোগে ক্ষণজন্মা এই কবি ১৯২৩-এর ১০ সেপ্টেম্বর মাত্র ৩৬ বছর বয়েসে মৃত্যুর সামান্য আগে আবোল তাবোল কবিতার শেষ ছত্রে অবলীলায় লিখতে পারেন— “ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর, গানের পালা সাঙ্গ মোর”, তখন মৃত্যুর ব্যাপারে তাঁর দূরদর্শিতা আমাদের চোখ দুটিকে ভিজিয়ে দেয়, হৃদয়কে নিঃস্ব করে দেয়। আমরা নিথর হয়ে যাই।

Post a Comment

0 Comments