মার্কেজের খোঁজে
বিংশ পর্ব
মলয় সরকার
আসলে আমার খোঁজা শুরু হয়েছিল ল্যাটিন আমেরিকার এই ছোট একটি দেশের প্রান্তে প্রান্তে, যেখানে পড়েছিল সেই বিখ্যাত সাহিত্যিকের চরণচিহ্ন, তাঁর জন্ম, বড় হওয়া বেড়ে ওঠা, কর্মের পরিসর বা পরিবেশ, তাঁর শেষ আশ্রয় সবটুকু।চেষ্টা করেছিলাম আমি আমার মত করে সেই মহান মানুষটিকে ছুঁয়ে দেখতে।তবে,সব তো আর যাওয়া সম্ভব নয়, তাই প্রধান জায়গাগুলোতেই গিয়ে চেষ্টা করেছি, তাঁকে জানতে।আমরা রবীন্দ্রনাথের উপরে এত দিন ধরে এত গবেষণা করেও কি তাঁর সম্বন্ধে সব জানতে পেরেছি বা সব জানা গেছে? আজও নিরন্তর চলছে তাঁকে নিয়ে নিরন্তর কাটা ছেঁড়া। তবে আমি তো কোন বড় গবেষক, নামজাদা সাহিত্যিক, সমালোচক বা ইতিহাসবিদ নই, নিছকই আপনাদের মতই এক অখ্যাত অনামী বাউণ্ডুলে পথিক মানুষ। তার হঠাৎ খেয়ালের বা পাগলামির বশে চলে আসা, অতি সাধারণ মানুষের চোখে দেখার উপলব্ধির আর অনুভূতির বর্ণনা দিতে চেষ্টা করার ফলশুতি এই লেখা। এ লেখায় অবশ্যই খামতি থাকবে, ভুল থাকবে অপূর্ণতা থাকবে, থাকবে উপলব্ধির অক্ষমতা। তবু এটা ঠিক যা দেখেছি, বুঝেছি, তাই বলেছি গল্পের বা বর্ণনার আকারে। এর মধ্যে যা আছে তা হল, অকপটতা আর নিছক সত্যি। যা নেই তা হল, অতিকথন, মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত কষ্টকল্পিত বর্ণনা। এবার বাকীটা আপনাদের মত সহৃদয় পাঠকের আমাকে সহ্য করে নেওয়ার মত ক্ষমতার উপর নির্ভর।তাই যা জেনেছি এতদিন ঘুরে, পড়াশোনা করে, লোকমুখে শুনে তাই কিছু তুলে আনব আপনাদের জন্য।যা পেয়েছি রাস্তায়, তুলে আনার আর আপনাদের সামনে পরিবেশনের দায়িত্ব নিয়েছি যে।ভুল হলে, পাঠক, নিজ গুণে মার্জনা করে সংশোধন করে দিলে বাধিত হব।
এবার বলি মার্কেজের ব্যাপারে দু একটি কথা। যদিও মায়ের কাছে মাসীর গল্পের মতই লাগবে বাঙালী পাঠকের কাছে মার্কেজের কথা, তবুও আমার মত লেখকদের এই এক দোষ, বকবক করা। যাক, আসলে মার্কেজের গল্পের কিছু আশ্চর্যময়তা আমাকে মুগ্ধ করেছিল, যা আমি বন্ধুদের কাছে বলে হাল্কা হতে চাই।
মার্কেজের স্ত্রী মার্সিডিজ বার্চা
স্প্যানিশ ভাষার লেখক হলেও যে যাদুমন্ত্রের গুণে তিনি সারা পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রাজত্ব করেন, তা হল তাঁর উপন্যাস ও ছোট গল্পের যাদু বাস্তবতা।তাঁর গল্প কোথাও প্রকাশ হলেই তা অনুদিত হত ও ছড়িয়ে যেত সারা পৃথিবীতে।এরকম সচরাচর দেখা যায় না।তাঁর কল্পনা বাস্তব জগতের গভীরে প্রোথিত, কিন্তু তা হল প্রায়শঃই যাদু বাস্তবতা।তিনি বলেন, ‘মেক্সিকোর রাস্তায় রাস্তায় যাদু বাস্তবতা ছুটে বেড়ায়। যাদু বাস্তবতা এসেছে মূলতঃ ল্যাটিন আমেরিকা থেকে।’
আসলে মার্কেজ বিশ্বাস করতেন যে, প্রত্যেকের জীবনেই এই যাদু বাস্তবতা ঘটে এবং এটি বাস্তব অথচ তা আমরা অনেক সময় বিশ্বাস করি না। তাঁর গল্পগুলি উঠে এসেছে বাস্তবের মাটি থেকেই। তাঁর গ্রাম আরাকাতাকার উপর ভিত্তি করেই সৃষ্টি হয়েছিল মাকোন্দো। তাঁর চরিত্র হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার পিছনের মানুষটি তাঁর নিজের দাদু। কলাম্বিয়া শিল্পরীতি হিসাবে জাদুবাস্তবতাকে বেছে নিলেও তিনি আজীবন রহস্যাবৃত স্বদেশ ও ল্যাটিন আমেরিকার বিশিষ্ট বাস্তবতাকে, তার pastoral simplicity কে তুলে ধরেছেন এক শিল্পীসংগ্রামীর প্রোজ্জ্বল ও মহৎ অনুপ্রেরণায়।
🍂
এ ছাড়া তাঁর কলা ব্যবসায়ীরা ও তাদের কথা তো এসেছে আসলে আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি United fruits company (United Brands Company) , যারা কলা ও অন্যান্য ফল ল্যাটিন আমেরিকা থেকে সংগ্রহ করে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাত, তাদের কথা থেকেই। ১৯২৮ সালে এই কোম্পানীর শ্রমিকরা যে তাদের কাজের বিনিময়ে বেতনের চুক্তি নিয়ে বিদ্রোহ করে এবং তাতে প্রায় ৩০০০ মানুষ মারা যান, তাদের গল্পই প্রচ্ছন্ন ভাবে লুকিয়ে আছে গল্পের মধ্যে।
তাঁর গল্পে অনায়াসে বর্ণিত হয় সমস্ত আশ্চর্য ঘটনা, যেমন অনিদ্রা রোগের মহামারী হয়, ভূতেরাও বৃদ্ধ হয়, এক গ্লাস গরম চকোলেট খেয়ে যাজক বিশেষ আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করেন, চারবছর এগার সপ্তাহ ও দুই দিন ব্যাপী একটানা বৃষ্টি হয় ইত্যাদি। কিন্তু গল্পের মধ্যে ঢুকে পাঠকও যেন এগুলো বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে।
তাঁর বাল্যকালের এক বন্ধুর হত্যার ভয়াবহ বিবরণ থেকেই “ Chronicles of a Death Foretold” প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে।
আবার ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত Love in the time of Cholera আসলে তাঁর বাবা মায়ের প্রেমের উপর ভিত্তি করে তৈরী।
তিনি নিজেই বলেছেন, আমি সব সময়েই এটা দেখে মজা পাই যে, আমার কাজের বড় প্রশংসাগুলো আসে কল্পনার জন্য অথচ আসলে আমার লেখালিখির মধ্যে এমন একটি লাইনও নেই যার বাস্তব ভিত্তি নেই।
আসলে যাদু আর বাস্তব দুটি আলাদা সত্বা, এবং তাদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য হওয়া সত্বেও মার্কেজ দুটো বিষয়কে এমন ভাবে মিশিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত করেন যে, দুটি সত্বা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
আসলে তিনি এই ম্যাজিক রিয়ালিজম কে নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, একে আত্মস্থ করেছেন। তিনি বলেছেন সায়েন্স ফিক্সন বা অলৌকিক ঘটনা কিন্তু ম্যাজিক রিয়েলিজম নয়।এটি পাঠককে একটা ব্যাখ্যাতীত ঘটনার সম্মুখীন করবে না, অথচ একটা ঘটনার সাথে অন্য একটি গভীর অনুভবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে।
এইখানেই তাঁর বিশেষত্ব।
আমি মার্কেজের খোঁজে এসেছি অনেক দূরে ,সত্যি কথাই। তাঁর দেশকে দেখলাম অনেক কাছ থেকেই। ছুঁয়ে এলাম তাঁর স্পর্শিত বা স্মৃতি বিজড়িত জায়গাও। এর ফলে কি পেলাম, সেটা তো আর পাঠকের সঙ্গে ভাগ বসাতে পারব না। সেটুকুই আমার নিজস্ব অনুভূতি, সেটাই থাক আমার নিজের সঙ্গে।
এবার বলি সেই বিখ্যাত লেখকের সম্বন্ধে কিছু কথা, যা জেনেছি, যা হয়ত অনেকেই জানেন। তবু যাঁরা খুব বেশি জানেন না বা পড়াশোনা করেন নি তাঁকে নিয়ে, তাঁদের জন্যই আমার এই লেখা।
মার্কেজের আসল নাম গাব্রিয়েল হোসে দে লা কনকর্ডিয়া গার্সিয়া মার্কেজ। তাঁর জন্ম হয় কার্তাহেনা থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে কলম্বিয়ার আরাকাতাকা শহরে ১৯২৭ সালের ৬ই মার্চ। গাব্রিয়েল মার্কেজ বেশি পরিচিত ছিলেন ‘গ্যাবো’ নামে। তাঁরা ছিলেন এগারো ভাই বোন।তার মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।তাঁর বাবার নাম Gabriel Eligio।মায়ের নাম লুইসা( Luisa)।
বলিভার প্লাজায় ঘুরে বেড়াচ্ছে লামারা
বাবা গাব্রিয়েল গ্যাবোকে নিয়ে যখন বারানকুইলাতে একটা ফার্মাসী খোলার জন্য যান, তখন তাঁর বয়স মাত্র এগার বছর।এই বারাঙ্কুইলা ম্যাগডালেনা নদীর ধারে, যেখানে এটি ক্যারিবিয়ান উপসাগরে পড়েছে। এই বারাঙ্কুইলা তখন এক বিরাট বাণিজ্যিক ও ব্যবসাকেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠছে। অনেক ফ্যাক্টরি, ওয়ার্কশপ, এয়ারলাইন, ডাচ কোম্পানী, ইটালিয়ান ফুড, আরবিয়ান দোকান ইত্যাদি এখানে এসে হাজির হয়।
১৯৩৮ সালে যখন তিনি আরাকাতকার যৌথ পরিবারের সকলকে ছেড়ে ছোট্ট পরিবারের মধ্যে বারাঙ্কুইলায় হাজির হন, সেই প্রথম একাকীত্ব ব্যাপারটা বুঝতে পারেন।অসুস্থ দিদাকে ছেড়ে আসাটা তাঁর মন কিছুতেই মেনে নিতে চায় না।তাঁর মা এবং প্রত্যেকেই এই মনঃকষ্ট পেয়েছেন, তবু ফেরা আর হয় নি।
এখানেই তৈরি হয় বাবার নতুন ফার্মাসী।কিন্তু এটা লাভের মুখ দেখতে পায় নি।ফলে তাঁর বাবা আবার নিজের ভাগ্য পরীক্ষায় ,আসন্নপ্রসবা মাকে ছেড়ে দূরে চলে যান। আর তখন থেকেই আসে দুঃখের দিন।তিনি এখানে ওখানে টুকটাক রোগী দেখা, অস্থায়ী কোন ছোট কাজ করা এইসব করতে লাগলেন।
যে বইয়ের জন্য মার্কেজের বিশ্বজোড়া খ্যাতি
তাঁদের সপ্তম সন্তান Rita জন্মায় জুলাই ১৯৩৯ এ।এরপর তাঁদের আরও চারটি সন্তান জন্মায়, যারা প্রত্যেকেই পুত্রসন্তান।মা, লুইসা ছিলেন আত্মমুখী শান্ত ভদ্রস্বভাবের। কিছুটা শিশুসুলভ সারল্যও খেলা করত তাঁর মধ্যে। তিনি, দারিদ্র্য সত্বেও চেষ্টা করতেন এগারোটি সন্তানকে ভাল ভাবে বড় করতে।গ্যাবো তাঁর মায়ের এই চরিত্রটিরই ছবি ধরে রেখেছেন, তাঁর অনেক উপন্যাসে। বিশেষ করে ‘নিঃশব্দতার একশ বছর’ উপন্যাসের অবিস্মরণীয় চরিত্র Ursula Iguaran এর আদলটা এখান থেকেই এসেছে।
ক্রমশঃ-
0 Comments