জ্বলদর্চি

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি (নবম পর্ব) /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি  
(নবম পর্ব) চিত্রা ভট্টাচার্য্য

প্রেমের পূজারী নজরুল 

‘সে কোন দূরের মেয়ে আমার কবি মানসবধূ
বুক পোড়া আর মুখ ভরা তাঁর পিছলে পড়ে ব্যথার মধু।
নিশীথ রাতের স্বপন হেন
পেয়েও তারে পাইনে যেন
মিলন মোদের স্বপন কুলে কাঁদন চুমোয় চুমোয়।’

চিরপথিক কবি কবিতার অন্তহীন চলার পথে পাড়ি দিয়ে এলেন কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার নিভৃত এক অজপাড়াগ্রাম দৌলতপুরে।  শুৱু হলো নজরুলের জীবনের এক বিচিত্র অধ্যায়। তাঁর স্বভাব সুলভ অট্টহাসিতে পাড়া মাতিয়ে  বাঁশি বাজিয়ে হাসি গানে আনন্দে নিজেকে মশগুল রেখে জয় করলেন খান পরিবারের ছোট-বড় সবার মন। ছোটদের ভালবেসে লিখলেন  ‘হার মানা হার’ কবিতা:
‘তোরা কোথা হ’তে কেমনে এসে
 মণি-মালার মত আমার কণ্ঠে জড়ালি!
আমার পথিক-জীবন এমন ক’রে
ঘরের মায়ায় মুগ্ধ ক’রে বাঁধন পরালি॥
   
দৌলতপুরে বন্ধুর সাথে তার আত্মীয়ের  বিয়ের নিমন্ত্রণে যোগ দিতে এসে কবি নজরুল  নিজেই প্রেমে পড়ে গেলেন জীবন্তএক মানসী কবিতার। ভাবী কালের স্বপ্ন সুন্দরীর খোঁজ পেলেন কবি।'কেমন ক’রে ছোট্ট বুকের একটু ভালবাসায় প্লাবিত হয়ে ঐ কচি বাহুর রেশমী ডোরে বাঁধা পড়লেন ' গড়ে উঠলো কবি জীবনের অমর প্রেমের কাব্যগাথা ! 

হয়তো সেদিন 'প্রহর শেষের আলোয় রাঙা '  চৈত্র গোধূলির কোনেদেখা আলোয় উন্মুক্ত নীলাম্বরীর তলে খান বাড়ির ছাদের আলসের ধারে পটে আঁকা ছবির মত অপরূপ সুন্দর খোলা চুলের সৈয়দা খাতুন ছিলেন আনমনে তার স্বপ্নের রাজপুত্রের প্রতীক্ষায়। 
দূরে ঝিলপাড়ে আম্রবীথিকার  নিবিড় ছায়া তলে মোহন বাঁশিতে সুর তুলতে বিভোর ছিলেন কবি। 
' হঠাৎ আলোর ঝলকানি 'লেগেছিল চোখে কবি চিত্তে। মন্ত্র মুগ্ধের মত প্রথম দেখেছিলেন ষোড়শী কন্যা অবগুন্ঠনহীনা সৈয়দা খাতুন কে। প্রথম দেখাতেই কবির জীবনমরুতে  প্রেমের বারি  সিঞ্চিত করেছিল কুমিল্লার সেই সাধারণ পল্লী কিশোরী। কবি তার শুভ্র অতুল সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার প্রথম প্রেম কুসুমের নাম রেখেছিলেন নার্গিস। ফরাসি ভাষায় অতি সুগন্ধ যুক্ত সাদা ফুল ফোঁটা বাহারি গুল্মের নাম নার্গিস। ইরানের কবিদের ভারী প্রিয় এ গুল্ম ও ফুল। কবি তার প্রেয়সীকে শুধালেন , 'এমন ফুলের মত যাঁর সৌন্দর্য  তার  সৈয়দা নাম রাখলো কে ?  আজ থেকে তোমার নাম হলো নার্গিস। ' (মুজাফ্ফর আহমেদ / কাজী নজরুল স্মৃতি কথা )
🍂

তাঁর মন পাগল করা বাঁশির সুর সদ্যযৌবনার কিশোরী মনে তোলে প্রেমের হিল্লোল। 'দক্ষিণ সাগরের সমীরণ ' সব আবরণ-বন্ধন ছিন্ন করে উড়িয়ে দেয় নার্গিসের উতলা আঁচল। নজরুলের সঙ্গে নার্গিসের পরিচয় প্রগাঢ়তর হয়ে প্রেমের বাঁধনে দোঁহে ভেসে যায়। তাজা শিউলির সুগন্ধর মোহাচ্ছন্নতায় আবিষ্ট  ,তরুণ কবির প্রেমের স্বপ্নে জাগায় স্বর্গীয় সুখের মোহমায়া । নার্গিসের নজরুল ময় জগৎ। মেঘের ফাঁক থেকে উঁকি দেওয়া মেঘলা দিনের সূর্যের মতো একটি হাসির ঝিলিক ফুটে ওঠে প্রিয়দর্শনে প্রিয়ার রক্তিম অধরে। হৃদয়ের গোপন অন্তঃপুরে অনুরাগের স্পর্শে প্রেম পদ্মটি ঘোমটা খুলে বিকশিত হয় তাদের বাস্তবের মানস সরোবরে।  দীঘির পাড়ে গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসে গান লেখেন নজরুল। বাঁশিতে সুর তোলেন। কণ্ঠের অনুচ্চারিত যত সুর বারেবারে ধ্বনিত হয়ে এলোমেলো প্রকাশ পায় একবার মিলনের প্রত্যাশায়। 

নার্গিসের ও বড় ইচ্ছে হয় যেন তাকে নিয়েও গান লেখেন কবি। কিন্তু এই সুদৃঢ় উচ্চতার সুপুরুষ বলিষ্ঠ মানুষটির সংস্পর্শে এলেই তার সবকিছু এলোমেলো, গোলমাল হয়ে যায়, সব কাজে ভুল হয় বারেবারে। নিজেকে অচেনা লাগে। বিক্ষিপ্ত ভাবনার দল তাকে দিগ্বিদিকে জ্ঞানশূন্য করে ঘুরিয়ে মারে। সব বোঝেন কবি, স্মিত হেসে বাঁশিতে ঠোঁট রাখেন। নির্জন বাগানের ছায়া সুনিবিড় গাছেদের আড়ালে মিশে গিয়ে লজ্জা রাঙা নার্গিস দৌড়ে আত্মগোপন করলেও পোড়া বাঁশরীর সে সুর হৃদয়ের তন্ত্রীতে মিশে গিয়ে তাকে ঘরছাড়া উদাসিনী করে তোলে। একবার টি চোখের দেখা,মিলনের আশায় শুধুই সুযোগ খোঁজেন।

 কাঁচা সোনারাঙ্গা ঝিঙেফুল নিয়ে কবিতা লেখেন নজরুল , কবির মানসী নার্গিস তখন বুঝি সাজেন হলুদ শাড়িতে, খোঁপাটিতে গুঁজেছিলেন হলুদরাঙা ফুল? সবুজ পাতার আড়ালে,মুখ তুলে হেসেছিলেন ঝিঙে ফুলের মতো সরল মিষ্টি হাসি ?  কিম্বা হয়তো স্নান সেরে খোঁপাটি বন্ধনমুক্ত করলে দীঘল কালো কেশরাশি পিঠের ওপর লুটিয়ে পরে ঢেউ খেলে যায় ।  কাঁচা সোনার বরণ শরীরে জড়ানো বাসন্তী  রাঙা শাড়ি টি যেন সোনালী রোদ্দুর হয়ে খেলা করে প্রিয়ার সর্বাঙ্গে। হয়তো তখন ই নার্গিসের কানের পাশে ভেসে আসে আবার সেই পোড়া বাঁশির সুর মন ব্যাকুল হয়, ' 'উতলা করে সারা বেলা '। তিনি বুঝি পথ হারালেন। মুন্সিবাড়ির দক্ষিণ উঠোনের বিশাল বাড়িটি ছেড়ে  চলে যাচ্ছেন খানেদের পুকুরপাড় ধরে বাগান পেরিয়ে।  

বিরহী বাঁশির সুরে , বিরহিনী প্রিয়া বিচলিত হয়ে আনমনে পথ হারালেন। তারমনে অজস্র প্রশ্নের ঝড় ওঠে , ভাবনারা বিক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে বেড়ায় কুলকিনারা পায়না। দীর্ঘদেহী সুপুরুষ নজরুলের এগিয়ে আসার ছায়া মাটিতে পড়ে। লজ্জাবনতা নার্গিস আঁড়চোখে চান সে ছায়ার দিকে। পরক্ষণেই অধোমুখী হয়ে মাটিতে মিশে যেতে চান । নজরুল স্মিত হেসে বাঁশিতে ঠোঁট রাখেন। বাগানের গাছের আড়ালে লুকিয়ে নার্গিস আত্মগোপন করলেও  তার সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকে কবির নতুন গানের সুর। 

 প্রেয়সী ধরা দেয়না, কবিতা বিস্মৃত হয়ে যান খেয়ালী কবি। মনে তখনই কবিতা শূন্য।  ভাবহারা কবিকে কাব্য হীনতা থেকে মুক্তি দিতে ছুটে আসেন মানসী প্রিয়তমা।কবি প্রাণিত হন নতুন উদ্যোমে সৃষ্টির নেশায়। 
নার্গিস খুশিতে ঝলমল করে ওঠেন, হলুদ রাঙা গুলবাগিচায় তারার সুরভি নিয়ে ফুটে থাকা ঝিঙে ফুলের সাথে। এমনি করে দুটি নবযৌবনের তৃষায় এগিয়ে যাওয়া হৃদয়ের প্রণয় পরিণত হয় পরিণীতায়। বাঁধন-হারা কবি বাঁধা পড়েন নার্গিসের প্রেমের গভীরতায় --মায়ার জালে। তাঁরই আভাস ফুটে উঠলো কবির ‘মানসবধূ’ কবিতায়। 
 ‘কার বাঁশি বাজিল
নদী-পাড়ে আজি লো?
নীপে নীপে শিহরণ কম্পন রাজিল
কার বাঁশী বাজিল?
বনে বনে দূরে দূরে
ছল ক’রে সুরে সুরে
এত ক’রে ঝুরে’ ঝুরে’
কে আমায় যাচিল?নাহি দিয়ে যা ছিল!
 
অবশেষে ১৯২১ সালের ২০ জুন  নজরুল-নার্গিসের বিয়ের তারিখ ঠিক হলো। ধুমধামের সঙ্গে আয়োজন চলে ছাপা হয় বিয়ের দাওয়াতপত্র। লেখা হয় কাবিননামা। কবির মানস বধূ নার্গিসকে জীবন-সঙ্গিনী হিসেবে পাবার মুহূর্তে বেজে ওঠে এক অশনি সংকেত। কাবিননামায় লেখা হয়েছিল বিয়ের পর নার্গিসকে নজরুল দৌলতপুর থেকে অন্যকোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। নজরুলকে ‘ঘর জামাই’ হয়ে চিরদিনই থাকতে হবে শ্বশুরবাড়ি দৌলতপুরে।  
 
দুখুমিয়া তখনও নজরুল হয়ে ওঠেননি। দুখু মিয়ার দুঃখের অমানিশার ছদ্মাবরণেঢাকা নজরুল। ছন্নছাড়া, বাঁধন-হারা দুঃখ ভরা জীবনতরীর এক দুর্দিনের যাত্রী। তবে নজরুল দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হলেও তাঁর আভিজাত্যকে বিন্দুমাত্র বিসর্জন দিতে পারেননি। তাঁকে ঢেকে দিতে পারেনি অভাবের দুঃখের কালোছায়া । ‘ঘরজামাই’ হয়ে থাকার প্রস্তাবে অপমানে কবি দুঃখে ক্ষোভে, ক্রোধে ফেটে পড়লেন।  নার্গিসকে দৌলতপুর থেকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন কলকাতায়।  কিন্তু ছিন্নমূল বাউন্ডুলে কবিকে বুঝে উঠতে পারেননি প্রেমিকা নার্গিস। নাম ঠিকানা বিহীন বাঁধনহারা এক কবির সঙ্গে ঘর বাঁধলেও অজানা-অচেনা অনিশ্চিত পথে সেদিন পা বাড়াতে তিনি একটুও সাহসী ছিলেন না। নববধূর অনাহত উন্মাসিকতা কবি কে চরম আঘাত করেছিল। 

অসামান্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন কবি সদ্য ২১ বর্ষীয় যুবক ‘ঘর জামাই’ হয়ে চিরকাল ধনী শ্বশুরবাড়ি দৌলতপুরে থাকার প্রস্তাবে চরম অসম্মানিত বোধকরেন এবং নার্গিসের প্রত্যাখ্যানে আঘাত প্রাপ্ত্য হন। তাঁর সহজাত প্রবৃত্তিতে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।  তিনি সে রাতেই এক চিঠি লিখে বিয়ে বাড়ি থেকে চলে যান। 

নার্গিসের বাসর রাত সমাপ্ত হলো না। ঝরে পড়লো নিশি ভোরের নার্গিস। মুছে গেল কোনের হাতের মেহেদী। বিধ্বস্ত হলো তার বধুর সাজ। খসে পড়লো তার  নাকের বেসর-নাকফুল। একবুক বেদনা নিয়ে  শবরীর প্রতিক্ষায় চলে চোখের জলে মালা গাঁথা। জীবনে কখনো আর কোথাও দেখাও হয়নি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কবির সাথে তার। এই বিচ্ছেদ ব্যথা নজরুলের মনে অসহনীয় মর্মান্তিক ভাবে বেজেছিল। নার্গিস কে সহজে ভুলতে পারেননি কবি ,তাঁর গানে কবিতায় এই বিরহ প্রকাশ পেয়েছে। কবি লিখলেন
 আমি গান গাই আপনার দুঃখে 
তুমি কেন আসি দাঁড়াও সম্মুখে 
আলেয়ার মত ডাকি ও না আর নিশিথ অন্ধকারে। '' 
                                                                                              এ যেন ছিল পরম প্রিয় কে পেয়েও না পাওয়ার জ্বালা। প্রিয়াকে ভুলতে চেয়েও কবি ভুলতে পারেনা।  নার্গিসের ভালবাসায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে ব্যর্থ প্রেমিক নজরুল লিখেছিলেন ১৫৭টি গান ও ১২০টি কবিতা। ব্যর্থ কবির লেখা বিখ্যাত সেই গান আজো হৃদয়েরতন্ত্রীতে গভীর নাড়া দিয়েযায়। অলক্ষ্যে মন ব্যথাতুর করে তোলে।  
                            ‘পথ চলিতে যদি চকিতে,
                             কভু দেখা হয় পরান প্রিয়’। 
                               চাহিতে যেমন আগের দিনে 
                                তেমিন মদির চোখে চাহিও  
                             যদি গো সেদিন চোখে আসে জল,
                               লুকাতে সে জল করিও না ছল,
                                    যে-প্রিয় নামে ডাকিতে
                             মোরে সে-নাম ধরে বারেক ডাকিও॥ ' 
নার্গিস অর্থাৎ সৈয়দা খাতুন পরবর্তীতে কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাঁর সন্তানরা সবাই সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন । ’নজরুলও নার্গিসের বিরহে ধূপের অনলে পুড়েপুড়ে হয়েছেন অঙ্গার। দুজনের মাঝে মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ, বিরহ-বেদনায় লেখা হয়েছে ব্যর্থপ্রেমের অশ্রুলিপি। 

কবি তাঁর ‘নিশীথ প্রীতম’ কবিতায় লিখেছেন:
‘মোদের দু’জনারেই জীবন ভরে কাঁদতে হবে গো-
মোরা কে যে কত ভালবাসি কোন দিনই হবে না বলা।
কভু সাহস করে চিঠির বুকেও আঁকবোনা সে কথা।'
   সত্য সুন্দরের কবি আজীবন ছিলেন প্রেমের কাঙাল। তার জীবনে প্রেম এসেছিল একাধিক বার, তবে তা বিরহই রচনা করেছে অধিক। তাই কবির সুরে বিরহের বেহাগ বাজে। একমাত্র প্রমীলা দেবী কবির প্রণয় কুসুমকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন চিরকাল। 
‘' আমি গান গাহি আপনার দূঃখে
তুমি কেন আসি দাঁড়াও সন্মুখে
আলেয়ার মতো ডাকিওনা আর নিশিথ অন্ধকারে।'' 

কাজীকবির সাথে নার্গিসের বিয়ে নিয়ে যথেষ্ট দ্বিমত প্রচলিত আছে। নজরুল জীবনীকার অনেকেই সে কথা স্বীকার করতে চান নি। কিন্তু আসল সত্য তাদের বিয়ে শুরুর আগেই ভেঙে গিয়েছিল। তিনি বিয়ের চুক্তিপত্র সই না করে বিয়ের আসর থেকে উঠে পড়েন এবং সেই নির্ধারিত দিন,টি ছিল  ১৯২১ সালের ১৮ জুন। ঝড়-জলের রাতেই নজরুল আলী আকবরের বাড়ি ছেড়ে কুমিল্লায় কান্দিরপাড়ে, বিরজা সুন্দরী দেবীদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন। সঙ্গে ছিলেন তার পুত্র কবির বন্ধু বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত।
বিরজা সুন্দরী দেবী ঐ বিয়ের আসরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ''বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মতন ঝুলতে লাগল মধ্যপথেই, এখন আমাদের বিদায়ের পালা।' বিয়ের ব্যাপার নিয়ে পরের বছরই, ১৩২৯ বঙ্গাব্দের বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকায় শ্রাবণ সংখ্যায় বিরজা সুন্দরী দেবীর 'নৌকা পথে' নামে একখানা লেখা প্রকাশিত হয়। তাতেই তিনি ঐ বিয়ে সুসম্পন্ন না হওয়ার কথা স্পষ্ট করে লিখেছেন।' 
 শূন্য বাসর শয্যা...! 
বাসর ভাঙা রাতের দুঃস্বপ্নে চোখের জলে ভেসে যায় বুক। গোমতীর উথাল পাথাল ঢেউয়ের দোলায় নার্গিসের বিরহ-ব্যথার চোখের জল বয়ে চলে অশ্রুমতির দেশে। কবি নিজেই লিখেছেন বিরহ বেদনার কথা:‘রূপের দেশের স্বপন কুমার স্বপনে আসিয়াছিনু
বন্দিনী! মম সোনার ছোঁয়ায় তব ঘুম ভাঙ্গায়িনু।
দেখ মোরে পাছে ঘুম ভাঙ্গিয়াই
ঘুম না টুটিতে তাই চলে যাই।’
কবি আরও লিখলেন বেদনার কাব্যমালা:
‘আমি এদেশ হ’তে বিদায় যেদিন নেবো প্রিয়তম,
আর কাঁদবে এ-বুক সঙ্গীহারা কপোতিনী সম,

এমন প্রতক্ষ্য দর্শী সাক্ষী থাকা সত্বেও দুই ' বাংলার কিছু লেখক দাবী করেছিলেন,' "নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে সুসম্পন্ন হয়েছিল। তাঁদের লেখায় বিয়ের চুক্তিপত্র বা অন্য কোনও সাক্ষ-প্রমান তাঁরা দাখিল করতে পারেননি। নার্গিস ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন এবং বিচ্ছেদের সাত ,আট মাসের মাথায়  নার্গিস বিয়ে করেন আজিজুল হাকিম নামে তখনকার পুর্ব বাংলার এক নজরুল ভক্তকে। এতগুলো বছরের মধ্যে নার্গিসকে দিয়ে কোনও লেখক বলাতে পারেননি যে ১৯২১ সালে নজরুলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে সুসম্পন্ন হয়েছিল কি না?। 

নার্গিসের বাড়ি থেকে চলে এসে কবি উঠেছিলেন কান্দিরপাড়ে সেনগুপ্ত হিন্দুবাড়িতে। সেখানে এসে নতুন করে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল  দুলির সঙ্গে। এই দুলির পুরো নাম দোলনচাঁপা। দোলনচাঁপার ভালবাসায় আড়াল হলো সদ্য নার্গিসের সঙ্গে বিচ্ছেদ বেদনার। কবি দোলনচাঁপার নাম দিলেন ‘প্রমীলা’। এ অসম প্রেম সেনগুপ্ত পরিবার মানতে নারাজ। প্রমীলার মা পরিবার থেকে বের হয়ে মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় গিয়ে বিয়ে দিলেন নজরুলের সঙ্গে। ১৯২১ সালের মার্চ মাসে প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের প্রথম পরিচয় ঘটে এবং ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল কবি তার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।                                                         
                                                                                                                                      ক্রমশঃ

Post a Comment

1 Comments

  1. বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের জীবনী সম্বন্ধে যতই জানতে পারছি ততই মুগ্ধ ও ঋদ্ধ হচ্ছি। ধন্যবাদ দিই লেখিকাকে এত সুন্দর বিস্তারিত ভাবে সবকিছু তুলে ধরার জন্য।

    ReplyDelete