জ্বলদর্চি

শ্যামানন্দ দাস (বৈষ্ণবসাধক, গোপীবল্লভপুর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৭১
শ্যামানন্দ দাস (বৈষ্ণবসাধক, গোপীবল্লভপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

'শ্রীনিবাস নরোত্তম শ্যামানন্দ আর। 
চৈতন্য নিত্যানন্দ দ্বৈত্বের আবেশ অবতার।। 
শ্রীচৈতন্যের অংশকলা শ্রীনিবাস হয়। 
নিত্যানন্দের অংশকলা নরোত্তমে কয়।। 
অদ্বৈতের অংশকলা হয় শ্যামানন্দে। 
যে কৈলা উৎকল ধর্মধন্য সংকীর্ত্তনানন্দে।।'
    -- শ্রীপ্রেমবিলাস, ২০ বিলাস
মেদিনীপুরের দণ্ডেশ্বর গ্রামে ষোড়শ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন প্রভু শ্যামানন্দ। বৈষ্ণবদের কাছে তিনি 'শ্যামানন্দ' ও 'দুঃখী কৃষ্ণদাস' নামেও পরিচিত। শ্যামানন্দের বাবার নাম কৃষ্ণ মণ্ডল। তিনি জাতিতে সদগোপ ছিলেন। মায়ের নাম দুরিকা এবং ছোট ভাইয়ের নাম বলরাম। ধারেন্দা বাহাদুরপুরে তাঁদের আদি বাসস্থান ছিল বলে জানা যায়। পরবর্তীতে তাঁরা সেখান হতে উঠে এসে দণ্ডেশ্বর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। 
শ্যামানন্দ দীক্ষাগ্রহণ করেন হৃদয়ানন্দ বা হৃদয়চৈতন্যের কাছে এবং ভক্তিশাস্ত্র পাঠ করেন শ্রীজীব গোস্বামীর কাছে। আসলে যৌবনকালেই তিনি বিবাগী হয়ে ওঠেন। তখন তিনি নরোত্তম ঠাকুর ও শ্রীনিবাস আচার্যের সাথে বৃন্দাবনে চলে যান। 
সেখানেই শ্রীজীব গোস্বামীর কাছে ভক্তিশাস্ত্র পাঠ করেন। এই বৃন্দাবন থেকেই এই তিনজন একসাথে প্রীতিবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। যাবতীয় ভক্তিশাস্ত্র পাঠের পর শ্রীজীব গোস্বামী তাঁদের তিন জনকে উৎকলভূমি ও গৌড়ভূমিতে বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের জন্য পাঠান। সেই আদেশ মতো শ্যামানন্দ মেদিনীপুরে এসে ধর্মপ্রচারে নিয়োজিত হন। 
'একদিন শ্রীগোস্বামী করিছে শয়ন। 
রাধাকৃষ্ণ তারে আসি দিল দরশন।। 
বলে শুন শ্যামানন্দ আমার বচন। 
কাশীপুরে চল তুমি লয়ে ভক্তগণ।। 
সুবর্ণরেখা নদী তীরে আছে শ্রেষ্ঠ স্থান। 
শ্রীগোপীবল্লভপুর দিবে তার নাম।। 
গুপ্ত বৃন্দাবনে যেও বড় পুণ্যস্থান। 
এখানে সেখানে আমার পূজা পধারিবে। 
মহোৎসব আদি সব সেখানে করিবে।।'
   -- শ্রীশ্রীশ্যামানন্দ প্রকাশ, সপ্তম দশা
উল্লেখ্য উপরোক্ত 'কাশীপুর' হল আজকের গোপীবল্লভপুর। শ্যামানন্দ রোহিণীতে সুবর্ণরেখা নদীর পাড়ে নয়াবসান গ্রামের পূর্ব প্রান্তে কাশপুর বা কাশীপুর গ্রামে আসেন। রসিকমঙ্গল কাব্যে এই কাশীপুরের বিবরণে পাই --
'সুবর্ণরেখার কুল অতি সুশোভিত। 
আম্র কাঁঠালের বন শোভে চারিভিত।। 
পুলিন সুন্দর নদী দেখিতে সুন্দর। 
যমুনার জল যেন দেখি পরিমল।।'
এছাড়াও প্রচলিত রয়েছে, রোহিণীর রাজা অচ্যুতের জ্যেষ্ঠ পুত্র কাশীনাথ মাঝে মধ্যে এখানে এসে বসবাস করতেন। কাশীনাথের বাসস্থান বা পুরী হিসেবে এই গ্রামের নাম হয়ে ওঠে কাশীপুর। আবার কেউ কেউ বলেন, এতদঞ্চলে প্রচুর কাশফুল ফুটতো। তাই নাম হয়েছে কাশপুর বা কাশীপুর। এই কাশীপুরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন শ্যামানন্দ। এরপর এই কৃষ্ণ বা শ্রীগোপীবল্লভ রায়ের নামে এলাকার নামকরণ করেন শ্রীগোপীবল্লভপুর। শ্যামানন্দ বললেন --
'অনেক আনন্দ হবে এ গ্রামের ভিতরে। 
বৃন্দাবন সম এই হবে পরচারে।। 
এ গ্রাম মহিমা কিছু কহিতে না জানি। 
প্রকাশ হবেন এথ গোবিন্দ আপনি।। 
যেইরূপ ধ্যানেতে করিয়ে নিরীক্ষণ। 
বিদ্যমান সেইরূপ দেখিবে সর্বজন।।'
উল্লেখ্য, এই রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের দক্ষিণে কাপাসিয়া গ্রামে কাশীনাথ শিব, পশ্চিমে রঙ্কিনী মন্দির, নয়াবসান গ্রামে শীতলা মন্দির প্রতিষ্ঠিত রয়েছে পারস্পরিক সহাবস্থানের উদাহরণ হিসেবে। আর গোপীবল্লভপুর পরিচিত হয়ে ওঠে 'গুপ্ত বৃন্দাবন' নামে। 
শ্যামানন্দের ভাবশিষ্য ছিলেন রসিকানন্দ। এছাড়াও শিষ্য ছিলেন রসিকানন্দের বাবা রসময় দাসও। শ্যামানন্দ প্রভুর পঞ্চাশের বেশি শিষ্য ছিল। তবে প্রভাবশালী ছিলেন বারো জন। তাঁদের মধ্যে গোপীবল্লভপুরের রসিকানন্দ ও রাধানন্দ, কেশিয়াড়ীর শ্রীদামোদর, পুরুষোত্তম, উদ্ধব, কিশোর, সাঁকোয়ার মধুসূদন, হরিহরপুরের জগতেশ্বর, রাজগ্রামের বলভদ্র এবং ভোগরাইয়ের আনন্দানন্দের নাম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
'কিশোর, উদ্ধব, আর    পুরুষোত্তম দামোদর
কাশিয়াড়ীতে এই চারি ঘর।
রসিক মুরারী আর    রোহিণীতে বাস যাঁর, 
ধারেন্দাতে দরিয়া দামোদর।।
চিন্তামণি নাম যাঁর     বড়গ্রামে বাস তাঁর, 
বলভদ্র রহে রাজগ্রাম।
হরিহরপুরে ঘর      নাম শ্রীজগতেশ্বর;
শাঁকোয়াতে শ্রীমধুসূদন।। 
শ্রীগোপীবল্লভপুর     রাধানন্দের কুটীর, 
শ্রীআনন্দানন্দ ভোগরাই।
দ্বাদশ শাখার বাস     বন্দনায় করি আশ
পাঁচালীতে রচিল সবাই।'
ড. তপন কুমার দে উল্লেখ করেছেন, "চৈতন্যদেবের ঝাড়খণ্ডে পদার্পণের পর জঙ্গলমহলে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম প্রচারে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন শ্যামানন্দ।" নরহরি চক্রবর্তীর লেখা 'ভক্তি রত্নাকর' গ্রন্থের পঞ্চদশ তরঙ্গে উৎকল দেশে শ্যামানন্দ বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেছিলেন বলে বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। 
শ্যামানন্দ মেদিনীপুরের মধ্যে গোবিন্দপুর এবং শ্যামানন্দপুর গ্রামে বেশিরভাগ সময় বসবাস করতেন। সেসময়কার বাণপুর (বেনাপুর), পঞ্চটী (পঁচেট), নারায়ণগড়, মোহনগড় (মোহনপুর) ইত্যাদি স্থানে তিনি বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন। হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে যান তিনি। তাঁরা শ্যামানন্দের কাছে বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। এমনকি সেসময়কার অনেক দস্যু ডাকাত লোকজন ও তাঁর আশ্রয়ে এসে নতুন জীবনের খোঁজ পেয়েছিলেন। জনৈক শের খাঁ নামের এক ভয়ঙ্কর মুসলিম দস্যুকে তিনি তাঁর দক্ষতায় বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করেন। ড. মধুপ দে লিখেছেন, "সপ্তদশ শতক থেকে নয়াবসান পরগনায় গোপীবল্লভপুরে স্থাপিত হয়েছিল বৈষ্ণব তীর্থপীঠ ঠাকুরবাড়ি। কলাইকুণ্ডার নিকটবর্তী ধারেন্দা গ্রামের শ্যামানন্দ বৃন্দাবনে শ্রীজীব গোস্বামীর কাছে দীক্ষা নিয়ে উৎকলে বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তিনি রোহিনীর জমিদার শাক্ত ধর্মাবলম্বী অচ্যুত পট্টনায়কের পুত্র রসিকানন্দকে শিষ্য করে নয়াবসান পরগনায় সুবর্ণরেখা নদীর তীরে কাশীপুর নামক স্থানে গোপীবল্লভ রায় তথা কৃষ্ণ এবং রাধার যুগল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে।" 
শ্যামানন্দের লেখা 'অদ্বৈত তত্ত্ব'তে অদ্বৈতপ্রভুর প্রতি মাধবেন্দ্র পুরীর যাবতীয় উপদেশের বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও 'উপাসনা সার সংগ্রহ' ও 'বৃন্দাবন পরিক্রমা' নামে আরও দুটি কাব্য লেখেন। শ্যামানন্দ আরও অনেক পদ রচনা করেছেন। যোগেশচন্দ্র বসুর মতে, "বৈষ্ণবসমাজে কৃষ্ণদাস ও শ্যামদাস নাম দুইটি এত বহুল প্রচলিত যে কোনটি শ্যামানন্দের রচনা, তাহা নির্ণয় করা দুরূহ। তাঁহার রচিত পদাপেক্ষা তাঁহার ভক্তিরসময় জীবন বেশী সুরভিময়। এই জন্য তাঁহার ক্ষুদ্র বৃহৎ যাবতীয় গ্রন্থ প্রত্যেক বৈষ্ণব নরনারীর আদরের বস্তু।" ১৫৫২ শকাব্দে তথা ১৬৩০ সালে শ্যামানন্দের জীবনাবসান ঘটে। এরপর গোবিন্দপুর গ্রামে গুরু শ্যামানন্দের মহোৎসব করেছিলেন রসিকানন্দ।
চিত্রঋণ : উইকিপিডিয়া
🍂

Post a Comment

0 Comments