জ্বলদর্চি

মার্কেজের খোঁজে(দ্বাবিংশ পর্ব)/মলয় সরকার

মিউজিয়ামে জেনুদের তৈরী সোনার পাতের গহনা

মার্কেজের খোঁজে
(দ্বাবিংশ পর্ব)

মলয় সরকার

এর মধ্যে গ্যাবিটোর উঠতি বয়সে, এক বন্ধু জোটে, যার নাম, Jose Palencia।  গ্যাবিটোর ভাই,  Luis Enrique এর মত, সেও ছিল বেশ ভাল  গাইয়ে, বাজিয়ে এবং নাচিয়েও। সে বোগোটায় থাকাকালীন তাঁর খুব ভাল বন্ধু ছিল। গ্যাবিটো যদিও ভাল গান করতে পারতেন, কিন্তু নৃত্যবিদ্যাটি তাঁর জানা ছিল না।ফলে তাঁর Palenciaকে পেয়ে সেই জায়গাটা সমৃদ্ধ হল। কিন্তু এই অশেষ গুণসম্পন্ন বন্ধুর অকালমৃত্যু তাঁকে একটা বড় ধাক্কা দিয়েছিল।

এরপর বিশেষ একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আর সুক্রে বা বারাঙ্কুইলার কোন স্কুলে যেতে রাজী হন নি। তখন তাঁকে ১৯৪৩ সালের জানুয়ারীতে রাজধানী বোগোটায় যেতে হয়,যদিও এখানে থাকা খাওয়া ও পড়াশোনা করা যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ ছিল।তাঁর বাড়ী থেকে সবাইকে ছেড়ে এই সুদীর্ঘ যাত্রাপথের অনেকখানিই জাহাজ, নৌকা পালটে, শেষে রেলে চড়ে একা গ্যাবিটোকে আসতে হয়েছিল।এই কষ্টকর নিঃসঙ্গ নিরুদ্দেশ যাত্রার কথা তিনি কখনও ভোলেন নি।যখন নিঃসঙ্গ অবস্থায় বোগোটা স্টেশনে বিশাল এক ট্রাঙ্ক নিয়ে  নামলেন, তখন কিছুই চেনেন না, জানেন না, এক অসহায় অবস্থা। কান্নায় ভেঙে পড়লেন কিশোর গ্যাবিটো।এক নিরাপদ সুন্দর জগত ছেড়ে এই অনিশ্চিত অন্ধকার শহরে আসাটা মেনে নেওয়া বড় সহজ ছিল না তাঁর কাছে।
সামনে কলম্বিয়ান সুন্দরী পিছনে পল সান্তান্দর প্লাজা

শেষে একজন পরিচিত দূর সম্পর্কের আত্মীয় এসে তাঁকে স্টেশন থেকে নিয়ে যান।
এখানে এসে কিছুটা তাঁর সৌভাগ্য এবং কিছুটা তাঁর নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও গুণের জোরে এক স্কুল কর্তৃপক্ষের নজরে আসেন। ফলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান,বিশেষ উচ্চশ্রেণীর, কলম্বিয়াবাসীদের জন্য নির্দিষ্ট ত্রিশ মাইল দূরে Zipaquira তে National College for boys এ।এই জিপাকুরাই তাঁকে ভবিষ্যতের প্রসিদ্ধির পথের প্রকৃত সূচনার আলো জ্বেলে দেয়।

তখন তাঁর কাছে পয়সা বা সময় দুটোই ছিল না, যে এই এই রকম একটা স্কুলে ভর্তির আনন্দের খবর বাড়িতে দিয়ে , আনন্দের সঙ্গে পালন করবেন।৮ ই মার্চ ১৯৪৩ এ তিনি ট্রেনে করে জিপাকিরাতে পৌঁছান, যে জায়গার নাম তিনি জীবনে শোনেন নি।তখন তাঁর বয়স মাত্র ষোল। তবে আমরা জানতে পারব যে, এই জিপাকিরাই তাঁর জীবনের মোড় ঘোরানোর প্রথম মাইলস্টোন।

এই জিপাকিরাতেই রয়েছে সেই লবণের খনি, যার গুঁড়ো আর গন্ধ ভেসে বেড়ায় আকাশে বাতাসে। প্রসঙ্গত বলি, এই জিপাকুরার লবণের খনি ভ্রমণের গল্পই পাঠককে শুনিয়েছি আগে।
🍂

 এর চার ধারে ছোট ছোট ওয়ার্কশপ, তার কালো কালো ধোঁয়া ওড়া চিমনি আর নুনের কারখানা এই নিয়েই তখনকার জিপাকিরা। এই পরিবেশ তখন তাঁর কাছে এক দমবন্ধ করা পরিবেশ।স্কুলে ছিল প্রায় ৮০ জন ছাত্রের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা। এখানে লাইব্রেরীটিও খুব ভাল ছিল।স্কুলটি যদিও একটি পুরানো পরিত্যক্ত বাড়িতে নতুন করে করা হয়েছিল, স্কুলটি বেশ ভাল সমস্ত ব্যবস্থা সমেত ছিল।এই স্কুলে কিন্তু সারা দেশ থেকে বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেদের পড়তে পাঠানো হত। এখানে শিক্ষকরা ভীষণ ভাল ছিলেন।তাঁরা প্রত্যেকেই আধুনিকপন্থী ও নিজের বিষয়ে যথেষ্ট দক্ষ।
সেখানে ভোর ছ'টায় ঘুম থেকে উঠে সাড়ে ছ'টার মধ্যে ঠাণ্ডা জলে স্নান করে, পোষাক পরে, জুতো পরিষ্কার করে পরে, নখ পরিষ্কার করে তৈরী হতে হত।তাঁর তো অন্যদের মত দামী জামাকাপড় ছিল না, তবু তাই দিয়েই তাঁকে চালাতে হত।রাত ন'টায় স্কুলের হোমওয়ার্ক ও পড়া করে শুতে যেতে হত। তখন একজন শিক্ষক রোজ বিভিন্ন বড় বড় সাহিত্যিকের লেখা গল্প বলতেন, যতক্ষণ না তারা ঘুমিয়ে পড়ে।এখানে তাঁর খুব ভাল লাগত মার্ক টোয়েনের গল্প।রাত্রে তিনি ভয়ের স্বপ্ন দেখে অনেক সময় জেগে রাত কাটাতেন।
শনিবার অর্ধবেলা ক্লাশের পর থেকে পুরো রবিবার ছুটি থাকত। তখন ছাত্ররা ইচ্ছামত খেলাধূলা নাচগান,  সিনেমা দেখা ইত্যাদি করত। চার্চে যাওয়াও বাধ্যতামূলক ছিল না।স্কুলটির প্রকৃত নাম ছিল Liceo Nacional de Varones in Zipaquirá.
মিউজিয়ামে জেনুদের হাতের পোড়া মাটির কাজ

এই স্কুলটির বর্তমান নাম “Centro Cultural Casa del Nobel Gabriel Garcia Marquez” । এখানে বর্তমানে শিক্ষা ছাড়াও একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও তাঁর নামে একটি মিউজিয়াম করা হয়েছে।

এখানে তিনি প্রচুর বই পড়তেন। বারাঙ্কুইলাতে তিনি জুল ভের্ণ,  এমিলো সালগারীর বই ছাড়াও স্প্যানিশ বই অনেক পড়েছেন।এখানে ক্রমশঃ প্রায় গোটা লাইব্রেরীর সমস্ত সাহিত্যের বই শেষ করে ফেললেন।তারপর হাত বাড়ালেন ইতিহাস, মনস্তত্ব, মার্ক্সিজমের বইয়ের দিকে। এ ছাড়া ফ্রয়েড এবং নস্ত্রাদামুসের বই ও তাঁর পাঠ্যতালিকায় ছিল।তাঁর এই বই পড়ায় এত আগ্রহ হয়েছিল যে পাঠ্যবই পড়ায় মন ছিল না। ফলে পরীক্ষায় ফলাফল খারাপ হওয়ায় তাঁর বৃত্তি বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল।তখন তিনি সেটি বুঝতে পেরে মাত্র কয়েক দিনের চেষ্টায় আবার সমস্ত সতীর্থদের চমকে দিয়ে ক্লাশের সেরা ছাত্রের শিরোপা অর্জন করেন।

১৯৪৩ এর শেষদিকে তিনি সুক্রেতে ফিরলেন। এর পর তিনি সেই নদীঘেরা সুক্রেতে বারবারই ফিরে এসেছেন, যতদিন না, তাঁর পরিবার পুরোপুরি কার্তাহেনাতে চলে আসেন। এখানেই তিনি তাঁর উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রদের খুঁজে বেরিয়েছেন।এখানেই খুঁজে পান Chronicle of Death বইয়ের Maria Alexandrina Cervantes নামের পতিতার চরিত্রটিকে।

এখানে তাঁর নবম ভাই Hernando জন্মাবার পর তাঁর বাবা আবার এক অবৈধ সন্তানের জন্মানোয় নতুন কেচ্ছায় জড়িয়ে পড়েন। এবারে স্ত্রী লুইসা ও বড় মেয়ে মার্গট রেগে আগুন হয়ে যান।
এই সময়ে গার্সিয়া মার্কেজও এক অবৈধ  যৌন অভিজ্ঞতা লাভ করেন, যা প্রতিফলিত হয়েছে,  প্রায় অপরিবর্তিত ভাবে ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ উপন্যাসে। এই ব্যাপারে তিনি মহিলার স্বামীর হাতে ধরা পড়েও বেঁচে যান, কেবলমাত্র তাঁর বাবা ওই ভদ্রলোককে কঠিন দুরারোগ্য রোগ থেকে বাঁচিয়েছিলেন, এই সুবাদে।

গ্যাবিটো ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠল। তার স্কুলের সহপাঠীরা স্মরণ করতেন, যে ছেলেটি ছিল রোগা- পাতলা, বড় বড় চোখ, সব সময় শীতে কাঁপত আর ঠাণ্ডার জন্য শিক্ষকদের কাছে প্রতিবাদ জানাত, তার চুল হয়ে উঠল ঘন মখমলের মত, তার পোষাক সব সময় ছিল পরিচ্ছন্ন, চুল ক্রীম দেওয়া ও আঁচড়ানো।তার এক সুন্দর মোটা গোঁফ গজিয়ে উঠল সুন্দর ভরাট মুখমণ্ডলে।

স্কুলে থাকাকালীন তিনি Javier Garces এই ছদ্মনামে লিখতেন।তিনি  লোরকা, দারিও বা নেরুদার মত লিখতে চেষ্টা করতেন।তিনি জিপাকিরাতে যতদিন ছিলেন,  Berenice Martinez নামে একটি মেয়ের প্রেমে পড়েন।  তাঁর এবং মেয়েটির জন্ম একই মাসে। এ ছাড়া Cecilia Gonzalez Pizano নামে আর একটি মেয়ের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন,  তবে তাঁর সঙ্গে কবিতা নিয়ে আলোচনাই বেশি হত। জিপাকিরাতে পুরানো পাড়াতে তিনি আরও এক বয়স্কা মহিলার সাথেও জড়িয়ে পড়েন, যিনি ছিলেন এক ডাক্তারের স্ত্রী। ভদ্রমহিলার স্বামীর অনুপস্থিতিতে তিনি রাত্রে লুকিয়ে তাঁর বাড়িতে যেতেন।এঁর ছবিও তিনি তুলে এনেছেন, “নিঃসঙ্গতার একশ’ বছর “ উপন্যাসে,  জোসে আর্কাদিওর মধ্যে।

এ ছাড়াও অবশ্য আর একটি ঘটনার কথা জানা যায়, যেখানে তিনি মেক্সিকোর লেখিকা সুসানা ক্যাটো (Susana Cato) নামে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়ান এবং এর ফলে ১৯৯০ সালে তাঁদের একটি কন্যা সন্তান হয়। তার নাম ভারতের প্রয়াতা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে রাখা হয়, ইন্দিরা। তার পুরো নাম ইন্দিরা ক্যাটো (Indira Cato) ।একে তিনি খুবই ভাল বাসতেন। আসলে তাঁর সঙ্গে ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর খুবইও ভাল সম্পর্ক ছিল। শোনা যায়, ১৯৮২ সালে তিনি নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর প্রথম অভিনন্দন নাকি গিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকেই।এই ইন্দিরা ক্যাটো বর্তমানে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি ২০১৪ সালে অনেক পুরস্কারে ভূষিতও হন।

ক্রমশঃ- 
সঙ্গে থাকুন বন্ধুরা–

Post a Comment

0 Comments