জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২৫২/বুদ্ধিমানের তিন কথা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ (ইউরোপ)/চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প— ২৫২

বুদ্ধিমানের তিন কথা 

ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ (ইউরোপ)

চিন্ময় দাশ


কথা এক 

লোকটার বাড়ি গোথান দেশে। হাতে একটা কাপড়ের থলি নিয়ে একদিন সে বাজারে যাচ্ছে। থলির ভেতর রয়েছে পুর দেওয়া কতগুলো পিঠে। হাটে গিয়ে সেগুলো বিক্রি করবে লোকটা। একটা পাহাড়ের গা দিয়ে চলেছে। আর খানিকটা গেলেই নটিংহাম ব্রিজ। হঠাৎ কি করে একটা পিঠে থলি থেকে নিচে পড়ে গেল। আর দেখাই গেল না পিঠেটাকে। 

--যাচ্চলে। লোকটা বলে উঠলো—আরে, হতচ্ছাড়া। এই যে বেরিয়ে গেলি, তুই একলা হাটে পৌঁছাতে পারবি কখনো? ঠিক আছে, কী আর করা যাবে? বাকিগুলোকেও আমি তোর পেছন পেছন পাঠাচ্ছি। 

বলতে বলতে রাস্তার উপরেই বসে পড়ল লোকটা। থলি খুলে একটা একটা করে পিঠা বের করে, আর পাহাড়ের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে থাকে। কোনটা এই ঝোপে ঢুকে গেল, কোনটা অন্য ঝোপে । সেসব সে গ্রাহ্যই করল না। চিৎকার করে বলল-- তাহলে ঐ কথাই রইল। সবাই হাটে পৌঁছে আমার সাথে দেখা করবি।

কথা দুই 


এক সময় বারো জন লোক বাস করত গথামের এক গ্রামে। তাদের কাজ ছিল মাছ ধরা। খালে বিলে নদীতে জলায় মাছ ধরে বেড়াত তারা। একদিন তারা গেছে নদীতে মাছ ধরতে। কেউ জলে নেমেছে। কেউ আছে উপরে ডাঙ্গায়। দূপুর গড়িয়ে তাদের কাজ শেষ হল। হাটে গিয়ে সেসব বিক্রিও করে ফেলল সবাই। 

বাড়ি রওনা হওয়ার সময় একজন বলল-- ভগবানের ইচ্ছেয় আমরা সবাই বাড়ি ফিরছি। নিশ্চয়ই কেউ ডুবেটুবে রয়ে যায়নি তো!

অন্য একজন বলল--গুনে দেখলেই হয়। আমরা তো ১২ জন কাজে এসেছিলাম।

🍂

তখন সবাই নিজেদের গুনে দেখার কাজে লেগে পড়লো। আর, গোনা শেষ হলে, সবাই বলে যে সংখ্যাটা ১১ই হচ্ছে। প্রত্যেকেই তারা প্রত্যেককে বলতে লাগলো-- নিশ্চয়ই আমাদের মধ্যে কেউ একজন ডুবে গেছে। 

তাড়াহুড়ো করে তারা আবার যেখানে মাছ ধরছিল, সেই নদীর ধারে ফিরে গেল। 

উপর নিচ আশপাশ চারদিক খুঁজে বেড়ালো। কিন্তু ডুবে যাওয়া লোকটার কোনো খোঁজই তার পাওয়া গেল না। 

কথা তিন 


একদিন গথামের কয়েকজন লোক বেড়াতে বেরিয়েছে নদীর ধারে ধরে। জায়গাটা নটিংহাম থেকে মাইল দেড়েক দূর। সেখানে নদীর মাঝে একটা ঘুর্ণি। বিপরীতমুখী স্রোতের ধাক্কায় জল যেন সেখানে টগবগ করে ফুটছে। লোকগুলো বেড়ানো থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তা দেখে। 

একজন বলল—দেখো, দেখো। জলটা কেমন ফুটছে। আরেকজন বলল-- আমাদের কাছে যদি খানিকটা আটা থাকতো, পরিজ বানিয়ে খাওয়া যেত।

একজন বলল-- চাই কি যথেষ্ট আটা থাকলে, গোটা গ্রামকে খাওয়ানো যেত এক মাস ধরে।

একজন বলে উঠল—আরে, এ আর এমন কী কথা? নিয়ে চলে এলেই হল। 

সবাই মিলে আলোচনা করে, সেটাই সিদ্ধান্ত হলো। তাদের মধ্যে কয়েকজন সোজা বাড়ি চলে গেল। যার বাড়িতে যত আটা ছিল, তাই নিয়ে আসতে। তারপর আটা এসে গেলে,  সেগুলো সব ঢেলে দিল নদীর জলে। এবার একটা প্রশ্ন উঠল জলে তো সব ফেলা হলো। ফুটতেও শুরু করে দিয়েছে নিশ্চয়ই এতক্ষণে। কিন্তু কখন পরিজগুলো ঠিক মতো তৈরি হয়ে যাবে, সেটা বোঝা যাবে কি করে? 

দেরি লাগলো না। অচিরেই এই প্রশ্নের সমাধান করে দিল তাদেরই একজন-- এটা আর এমন কি কথা? আমি নদীতে নেমে দেখে দেবো পরিজগুলো তৈরি হল কি না। 

--কিন্তু সেটা আমাদের জানাবে কি করে?

-- ঠিক আছে। আমি যখন দেখব যে ওগুলো তৈরি হয়ে গেছে, আমি একটা হাত ওপরে তুলে নেড়ে দেখাবো। তাতেই তোমরা বুঝতে পারবে। 

সবারই বেশ মনে ধরল কথাটা। তখন লোকটা ঝাঁপ দিয়ে জলে নেমে গেল। আর নেমেই বুঝতে পারল সে যা ভেবেছিল জল তার চেয়ে অনেক বেশি একবার দুবার তিনবার লোকটা জলের ওপর ভেসে উঠলো। কিন্তু কিছু বলতে পারল না। একবার করে ভেসে উঠছে, আর সাথেসাথেই ডুবে যাচ্ছে জলের টানে। 

এদিকে পাড়ের উপর লোকগুলো অধৈর্য হয়ে উঠেছে। এমন সময় হঠাৎই একবার লোকটাকে দেখা গেল। দু’ ঠোঁটে কেমন চুপচুপ শব্দ করে, একটা হাত ওপরে তুলল একবার। তারপর আবার ডুবে গেল জলের তলায়। 

পাড়ের লোকগুলো বুঝতে আর কিছু বাকি রইল না। পরিজ ঠিকঠাক তৈরি হয়ে গেছে। তারা পড়ি কি মরি করে সবাই জোরে ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। নিজের নিজের ভাগটা বুঝে নিতে হবে না? দেরি করলেই তো ঠকে যাওয়ার ভয় আছে। 

কেউ কিন্তু তারা আর ডাঙায় ওঠেনি। মনে হয়, ভাগবাঁটোয়ার কাজ এখনো শেষ হয়নি তাদের।


Post a Comment

0 Comments