জ্বলদর্চি

বাবলা /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৮৭
বাবলা

ভাস্করব্রত পতি

'বাবলা গাছে বাঘ বসেছে' -- ছোটবেলায় এই tonguetwister বাক্যটা অন্য বন্ধুদের দ্রুত বলতে বলতাম। কিন্তু তা বলা সহজ ছিল না। একবার দুবার বলার পরেই বলতে শোনা যেত 'বাবলা গাছে বাপ বসেছে'! তখন 'হো হো' করে হেসে গড়িয়ে পড়তাম সকলে। সে এক মজার ব্যাপার ছিল। আর সেসময় খেলতে খেলতে যখন ক্ষীরাই নদীর পাড়ে যেতাম, তখন আমাদের কাজ ছিল মুখ ভরে বাবলা গাছের কুসি পাতা নেওয়া। ওখানে নদীর পাড়ে প্রচুর বাবলা গাছ ছিল। ভালো করে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে আঁচলা ভরা জল মুখে দিলেই মুখ মিস্টি! সে অনুভূতি বোঝানো অসম্ভব। 
বন্যার জলের তোড়ে ক্ষীরাইয়ের বাঁধ ভেঙেছে। কোনও রকমে টিকে আছে বাবলা গাছ।

সাদা রঙের কাঁটায় ভরা এই গাছ। হাতে ফুটলেই অসহ্য যন্ত্রনা। তাতে কি? আমাদের শৈশবের 'মিস্টি গাছ' হল এই বাবলা। আজ হয়তো সংখ্যায় কমেছে অনেক। তবে তার চেয়েও কষ্টকর বিষয়, আজকের প্রজন্ম জানেইনা বাবলা নিয়ে নস্টালজিয়ার কথা। কোনও কারণে নিজেদের অসাবধানতার দরুন হঠাৎ যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যায় আমাদের জীবনে, তখন বলতে শোনা যায় 'বাইচান্স বাই বাবলা কাঁটা'। অর্থাৎ, বাবলার পাতা তোলার সময় একটু অসাবধানতাবশত বাবলা গাছের কাঁটা হাতে ফুটে যেতে পারে। তাই এহেন কথার সৃষ্টি। এই বাবলা গাছের কাঁটা নিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মানুষদের বলতে শোনা যায় 'কেঁটকী রে কেঁটকী, দুই ভারে এক পুঁটকী'। 
বাবলার কাঁটা

একসময় বাবলা কাঠের ঢেঁকি খুব প্রচলিত ছিল। এই কাঠ এতই শক্ত যে গরুর গাড়ির চাকা, লাঙল তৈরিতেও বাবলা কাঠ দরকার পড়তো। তবে আসবাবপত্র তৈরির জন্য যে সুন্দর ফিনিশিং কাঠের দরকার হয়, সেই বৈশিষ্ট্য বাবলার নেই। মূলত জ্বালানি হিসেবেই কাজে লাগে। প্রবাদে রয়েছে -- 'তাল তেঁতুল বাবলা / কি করবে দুধুমুখী একলা' এবং 'কতকের ঢেঁকি / না, বাবলা কাঠ'। স্থাননামের এড়াতে বাবলার উপস্থিতি দেখা যায়। মুড়োগাছা এলাকা নিয়ে ছড়ায় পাই -- 'তাল বাবলা ছুঁচো বোঁচা / এই চার নিয়ে মুড়োগাছা'। আবার লোকগানের মধ্যেও বাবলাকে খুঁজে পাওয়া যায় --
'মনে বাবলা পাতার কষ লেগেছে, 
উঠে না দাগ সাবানে...
গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে...'! 
'মনে বাবলা পাতার কষ লেগেছে, / উঠে না দাগ সাবানে... / গুরু আমার মনের ময়লা যাবে কেমনে...'!

বাবলাকে সংস্কৃতে বন্ধুর, হিন্দিতে বাবুর, বাবুল, কিকর, বাবলা, তেলুগুতে নাল্ল তুম্মা, তামিলে কারুভেলম, মারাঠীতে বাবুল, গুজরাটিতে বাডল, সাঁওতালীতে গরুর, ইংরেজিতে Indian Gum Arabic Tree, Babul, Egyptian acacia, Thorn Mimosa, Thorny Acacia বলে। বাবলা পরিচিত তীক্ষকণ্টক, কন্টালু, গোশৃঙ্গ, কফান্তক, পংক্তিবীজ, দৃঢ়বীজ, বধূর, যুগলাক্ষ, অভাভক্ষ্য নামেও। বিজ্ঞানসম্মত নাম Acacia nilotica। এটি Fabaceae পরিবারের অন্তর্গত। এছাড়াও আরও যেসব প্রজাতির সন্ধান মেলে --
Acacia arabica
Acacia nilotica 
Acacia scorpioides 
Mimosa arabica
Mimosa nilotica 
Mimosa scorpioides 
তবে গুয়ে বাবলা বা গুয়া বাবলা নামে আরেকটি গাছ রয়েছে। এটি অবশ্য আলাদা। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Vachellia farnesiana (আগে Acacia farnesia নামে পরিচিত ছিল)। Mimosaceae পরিবারের অন্তর্গত। এই গাছের কাছে গেলে কিংবা এই গাছ থেকে প্রাপ্ত বিট খদির (খয়ের) খেলে বিষ্ঠার গন্ধ পাওয়া যায়। তাই এর নাম গুয়ে বাবলা।

বাবলা গাছের ফুল উভয়লিঙ্গ। এতে কোনও পাঁপড়ি নেই। মার্বেলের মতো গোলাকার। সোনালী হলুদ রঙের ফুলগুলি একটি বোঁটায় একটিই থাকে। প্রতিটি কাঁটার গোড়ায় দুটি করে ফুল জন্মায়। সাধারণত বর্ষার শেষেই গাছে ফুল আসে। আর বর্ষার বিকেলবেলায় বৃষ্টি হলে মনে হবে বাবলার গাছ জুড়ে অসংখ্য জোনাকি যেন আলো জ্বেলে ঘিরে রয়েছে। আসলে এগুলি বাবলার ফুলের রূপ। তাই বোধহয় বাবলা ফুলকে বলে দিনের বেলার জোনাকি। কেউ কেউ এই ফুলকে মেয়েদের নাক ফুলের সাথে তুলনা করে থাকে। এটি মোটামুটি ছোট ধরনের গাছ। তেঁতুলের মতো পাতা। কাঁটাযুক্ত। বাবলা কাঁচা ফল সাদা রঙের। আর পেকে গেলে কালো রঙের। গলার নেকলেসের মতো ফলগুলি ৩-৬ ইঞ্চি লম্বা। খুব দাহ্য জ্বালানি এগুলো। 

বাবলা গাছেরই সুপ্রাচীন নাম 'বর্বর'। কথায় বলে, 'বর্ব'রাণাং ধনক্ষয়ঃ'। অর্থাৎ অজ্ঞব্যক্তির ধন কেবল ক্ষয় করার জন্য। যাইহোক বিনা সেচনেই এই গাছটি বেঁচে থাকতে পারে। নানা বিপর্যয়ের মধ্যেও নিজের জীবনকে রক্ষা করে। রূঢ় মরুপ্রান্তরেও বহাল তবিয়তে টিকে থাকার ক্ষমতা রয়েছে এর। বিভিন্ন রোগ প্রতিকারে বাবলা পাতার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। মামস বা কর্ণমূল, হাজা, পাতলা দাস্ত, দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়া, স্ত্রীদের প্রদর রোগ, রক্তস্রাব, গনোরিয়া, পিত্তের প্রদাহ, ঘন ঘন কাশি, পা মচকে যাওয়া বা ফুলে যাওয়া ইত্যাদি উপশমে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই। 

ক্রমশঃ কমছে বাবলা গাছের সংখ্যা। খড়গপুর হাওড়া রেললাইন স্থাপনের সময় BNR আধিকারিকরা প্রচুর বাবলা গাছের বীজ ছড়িয়ে ছিলেন বলে শোনা যায়। যদিও এখন সেইসব গাছের অস্তিত্ব দেখা যায় না। নদীর পাড় থেকেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে আদরের বাবলা। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর 'জলের কল্লোলে' কবিতায় যেন সেই হাহাকার তুলে ধরেছেন --
"জলের কল্লোলে যেন কারও কান্না শোনা গেল, 
অরণ্যের মর্মরে কারও দীর্ঘনিশ্বাস। 
চকিত হয়ে ফিরে তাকাতেই দেখা গেল
নির্বান্ধব সেই বাবলা গাছটাকে।
আর আর তাকে গাছ বলে মনে হল না; 
মনে হল,
সংসারের সমস্ত রহস্য জেনে নিয়ে 
কেউ যেন জলের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে।"
🍂

Post a Comment

0 Comments