জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২৪৫চীন (এশিয়া)ছয় মাথা ঈগল /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প— ২৪৫

চীন (এশিয়া)


ছয় মাথা ঈগল

চিন্ময় দাশ

( ছবি – ১)

এক ছিল রাজা, আর একজন রানি। ছিল আরও একজন। সে হোল রাজকুমারি। রাজা রানির বড় আদরের মেয়ে, নয়নের মণি। দেখতে যেমন সুন্দর, গলার স্বরটিও তেমনি মিষ্টি। বাগানে বসে কখনো কখনো গান করে সেই মেয়ে। বাতাস থমকে যায় তার গানের সুরে। 

এক ঢাল কালো চুল রাজকুমারি্র মাথায়। মাথায় জুঁইফুল গোঁজা রাজকুমারির সখ। প্রায়ই বাগানে চলে যায়। সেরকম একদিন ফুল তুলতে বাগানে এসেছে। রোদ ঝলমলে বাগান। সবুজ মখমলের মতো ঘাসের বিছানা পাতা বাগান জুড়ে। 

নিজের রেশমি রুমালটি ঘাসের উপর পেতে দিয়েছে মেয়ে। একটি-দুটি করে জুঁই তুলছে। রেখে দিচ্ছে রুমালে। ফুলের গন্ধে ম’-ম’ করেছে গোটা বাগান। প্রজাপতিটির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজকুমারি।

সোনা ঝরা রোদ সূর্যের। চারদিক আলোয় ঝলমল। হঠাৎ এক দুর্বিপাক। রুমাল তুলে গিঁট দিতে যাচ্ছে রাজকুমারি। এক ঝোড়ো বাতাস ধেয়ে এলো কোথা থেকে। বাগান থেকে উড়িয়ে গেল মেয়েটিকে। রুমালের কোণাটাই কেবল হাতে ধরা। শ্বেত বলাকার মতো বাতাসে উড়ে যাচ্ছে রাজকুমারি। এতো বেগ বাতাসের, এতো বেগ-- চোখ দুটো খুলে রাখা যাচ্ছে না। 

যেখানে এসে নামল মেয়ে, সেটা একটা গুহা। এদিক ওদিক চোখ ফিরিয়ে, একটা বিশাল পাখি দেখতে পেলো। রক্ত ঝরছে পাখিটার গা থেকে। রাজকুমারি বলল—কী হয়েছে তোমার? এতো রক্ত কেন? 

--স্বর্গের কুকুরগুলোর খপ্পরে পড়েছিলাম। ছ’খানা মাথা আমার। কেটেই নিয়েছে একটা। কোন রকমে বেরিয়ে এসেছি।

রাজকুমারিকে বন্দী করে রেখে দিল পাখি। বের হতে দেয় না কোথাও। 

এদিকে রাজা রানি চিন্তায় আকুল। বাগান থেকে মেয়ে ফিরল না কেন? লোকজনকে চারদিকে পাঠিয়েও, কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। নিশ্চয় কোন বিপদে পড়েছে মেয়েটা!

রাজামশাই ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলেন— যে কেউ রাজকুমারিকে খুঁজে এনে দিতে পারবে, তার সাথেই বিয়ে দেব মেয়ের।

এমন ঘোষণায় সাড়া পড়ে গেল রাজ্যে। রাজকুমারির সাথে বিয়ে! সেই লোভে, যুবক ছেলের দল বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। 

কিন্তু ঐ বেরিয়ে পড়া পর্যন্তই। একদিন যায়, দু’দিন যায়। বেশ কয়েক দিনও চল্র গেল কোনও সংবাদই নাই।

একদিন এক যুবক এসে হাজির। রাজামশাই বললেন— কে তুমি?

যুবক বলল—আমার নাম গুয়াং। রাজকুমারিকে খুঁজতে যাবো। অনুমতি দিন আমাকে। 

রাজা বললেন-- পারবে তুমি? 

--দেখি চেষ্টা করে।

--কিন্তু চারদিক তো খোঁজা হয়ে গেছে। কোথাও পাত্তা নেই মেয়েটার। কোথায় খুঁজবে তুমি?

--হাল ছেড়ে দিতে নাই কোনও কাজে। চেষ্টা করে যেতে হবে। 

রাজা বললেন—সে তো জানি। কিন্তু কোত্থাও তো বাকি নাই খুঁজতে। নতুন কোথায় আর যাবে তুমি?

মাথা ঝুঁকিয়ে গুয়াং বলল—ছোটবেলায় এক ছয়মাথা পাখির গল্প শুনেছি ঠাকুরমার মুখে। আমার মন বলছে এ সেই শয়তানটার কাজ আর কারও নয়। 

চমকে উ্ঠলেন রাজামশাই। ভরা দরবার চলছে তখন। মন্ত্রী ছিল রাজার পাশেই। বলল—ঠিকই বলছে যুবকটি। অনুমতি দিন একে।

রাজাও জানেন এ পাখির কথা। তবে, ভাবনাটা এতদূর যায়নি তাঁর। রাজার সম্মতি, রানিমার আশীর্বাদ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল গুয়াং।

মাইলের পর মাইল হাঁটল। দিন গেল। দিনের পর দিন গেল। একদিন এক পাহাড়ি এলাকায় এসে হাজির হোল গুয়াং। যে দিকে চোখ যায়, শুধু পাহাড় আর পাহাড়। উঁচু উঁচু সব পাহাড়। আর পাহাড় জুড়ে ঘন বন। সেই বনের ভিতর এক কাঠুরিয়ার সাথে দেখা। দূরদেশী এচেনা এক যুবককে দেখে সে অবাক। কাঠুরিয়ারা ছাড়া, আর কেউ তো এই এলাকায় আসে না। এই দুর্গম বনে, এ আবার কোথা থেকে উদয় হোল!

লোকটা জানতে চাইল—বনের মধ্যে কোথায় চলেছ তুমি? 

গুয়াং তাকে সব খুলে বলল—রাজকুমারির খোঁজে বেরিয়েছি আমি। 

--তোমার অনুমান সঠিক। এখানের সবচেয়ে উঁচু যে পাহাড়, তারই গুহায় থাকে পাখিটা। কিন্তু ডানা কোথায় তোমার? পৌঁছাবে কী করে সেখানে? দক্ষ কাঠুরিয়া, কিংবা আর কোনও পাখি—এই দুজন ছাড়া, দুনিয়ার কেউ সেখানে পৌছাঁতে পারবে না। পথই খুঁজে পাবে না সেখানে পৌঁছুবার।

গুয়াং এবার কাঠুরিয়াকে ধরে পড়ল--কিছু একটা ব্যবস্থা করো তুমি। তুমি তো কাঠুরিয়া। তুমি চলো আমাকে নিয়ে। রাজামশাই অনেক পুরষ্কার দেবেন তোমাকে। 

নাছোড়বান্দা গুয়াংয়ের দিকে তাকিয়ে রইল কাঠুরিয়া। যেন জরীপ করছে। ছেলেটা বলল—আমাকে কী দেখছ অমন করে?

 কাঠুরিয়া হেসে বলল—তোমার ছোটখাটো চেহারাটা মেপে নিলাম। একটা ফন্দি এসেছে মাথায়। ঠিক আছে। তুমি বসো এখানে।

সারাদিন বসে বাঁশের ছিলকা তুলে, একটা বাক্স বানাল কাঠুরিয়া। বাক্স আর কিছু দড়ি নিয়ে পাহাড়ে চড়ল দুজনে। পাহাড় বড় হলে কী হবে, সব খাঁজ-খোঁজ হাতের তালুর মতো চেনা কাঠুরিয়ার। 

ঈগলের গুহাটার মুখ একটা খাড়া পাহাড়ের গায়ে। পাহাড়টার মাথায় গিয়ে হাজির হয়েছে দুজনে। বাক্সটার মধ্যে গুয়াংকে চেপেচুপে ঢুকিয়ে, দড়ি ধরে ঝুলিয়ে দিল কাঠুরিয়া। গুহার মুখটায় পৌঁছে, এক লাফে ভেতরে ঢুকে পড়ল গুয়াং।

ভেতরটা অন্ধকার। চোখ সয়ে গেলে দেখল, বিশাল আকারের ঈগলটা মাটিতে শুয়ে আছে। তার পাঁচখানা মাথা মাটিতে এলানো। একটা মাথা কাটা। রাজকুমারি ক্ষত যায়গাটা পরিষ্কার করে দিচ্ছে। পাথরের আড়ালে বসে রইল গুয়াং। 

কতক্ষণ বাদে ঘুমিয়ে পড়ল পাখি। গুয়াং বেরিয়ে রাজকুমারির সামনে হাজির হোল—আমি তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি। রাজামশাই আর রানিমা পাঠিয়েছেন। তাড়াতাড়ি চলো এখান থেকে। 

রাজকুমারি তো ভাবতেই পারছে না, কোন্ব দিন ফিরে যাওয়া যাবে। রেহাই পাবে এই অন্ধকার গুহা থেকে। আবার নিজের প্রাসাদে ফিরে যেতে পারবে সে। 

রাজকুমারি বলল—কিন্তু এই পাখি বেঁচে থাকতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। জেগে উঠেই, মাঝপথ থেকে ধরে নিয়ে আসবে আবার। 

পাখি তো ঘুমিয়ে কাদা। ধারালো কুঠার দিয়েছিল কাঠুরিয়া। কচ-কচ করে ঈগলের পাঁচটা মাথাই কেটে দিল গুয়াং। রাজকুমারির হাত ধরে গুহার মুখে এনে বলল—এই বাক্সটায় চেপে বসো। এক কাঠুরিয়া আছে ওপরে। সে তুলে নেবে তোমাকে।

--আর তুমি? তুমি যাবে কী করে? রাজকুমারি অবাক। 

--তুমি ওপরে পৌঁছুবার পর, আবার বাক্স ঝুলিয়ে দেবে। আমি তখন উঠে যাব। 

এবার আর আপত্তি করল না রাজকুমারি। সোনার কাঁটা ছিল মাথার খোঁপায়। কাঁটাটা খুলে গুয়াংয়ের হাতে ধরিয়ে দিল। সিল্কের সেই রুমালটা ছিল সাথে। রুমাল বের করে, সেটাকে ছিঁড়ে দু’-টুকরো করে ফেলল। এক্টুকরো গুয়াংকে দিয়ে বলল—আবার দেখা না হওয়া পর্যন্ত, এগুলো রেখো যত্ন করে।

রাজকুমারিকে ঝুড়িতে চাপিয়ে দিতেই, তাকে ওপরে তুলে নিল কাঠুরিয়া। তখনই শুরু হোল বিপদ। রাজকুমারি উঠে এসেছে দেখে, লোভ পেয়ে বসল লোকটাকে। আলো জ্বলে উঠল দু’চোখে। রইল পড়ে ঝুড়ি। তুললই না সে গুয়াংকে। 

রাজকুমারিকে নিয়ে পাহাড় থেকে নামতে লাগল কাঠুরিয়া। কুঠার উঁচিয়ে বলল—বাড়ি পৌঁছে টুঁ শব্দটি করেছ, তো এক কোপে মুণ্ডু কেটে ফেলব। 

রাজকুমারিকে নিয়ে রাজবাড়িতে হাজির হয়েছে কাঠুরিয়া। খুশির বন্যা বয়ে গেল রাজবাড়িতে। হারাণো মেয়েকে ফিরে পাওয়া গেছে, আনন্দ ধরে না রাজা-রানির। বিয়ের আয়োজন শুরু করে দিলেন রাজামশাই। জামাই আদর করে একটা মহলে রাখা হয়েছে কাঠুরিয়াকে। 

এদিকে ঝুড়ি নামল না দেখে, গুয়াংয়ের বুঝতে কিছু বাকি রইল না। ধুরন্ধর কাঠুরিয়া চালাকি করেছে তার সাথে। কিন্তু কোন খাদ্য নাই এখানে। নাই জলও। ধুঁকে ধুঁকে এই অন্ধকার গুহায় মরে পড়ে থাকতে হবে তাকে। মানুষ কতো লোভি হতে পারে!

এখান থেকে বেরুবার অন্য কোন গোপন রাস্তা আছে কি না, খুঁজে দেখতে শুরু করল গুয়াং। পাখিটাকে ডিঙিয়ে খানিক ভেতরে গিয়েছে, পায়ে কাপড় জড়িয়ে গেল তার। তুলে দেখে তো অবাক। মেয়েদের ওড়না। একটা নয়, দুটো নয়, অনেকগুলো ওড়না। 

বুঝতে অসুবিধা হোল না। এইভাবে মেয়েদের তুলে আনে পাখিটা। আর, ছটা মুখ দিয়ে খুবলে খুবলে খায়। ওড়নাগুলো সেই হতভাগ্য মেয়েদের।

মাথায় বুদ্ধি এসে গেল। ওড়নাগুলোকে গিঁট বেঁধে বেঁধে জুড়ে ফেলল। তার পর? একটা মাথা পাথরে বেঁধে, ঝুলে ঝুলে নিচে নেমে আসতে অসুবিধা হোল না। 

পাহাড় থেকে নেমে, ক’দিন পথ হেঁটে হেঁটে রাজবাড়িতে এসে হাজির হোল গুয়াং। সেখানে তখন বিয়ের তোড়জোড় চলছে। লোকলস্করের ছোটাছুটি। সবাই ব্যস্ত। 

🍂

একটা লোককে পাকড়াও করে বলল—কীসের আয়োজন চলছে গো?

লোকটা বলল—আচ্ছা উজবুক তো। কোন আকাশ থেকে উদয় হলে তুমি? কাল আমাদের রাজকুমারির বিয়ে, জানো না?

--রাজকুমারির বিয়ে! কার সাথে?

লোকটা চলে যেতে যেতে বলেগেল—কার সাথে আবার? যে মানুষ খুঁজে ফিরিয়ে এনেছে মেয়েকে, তার সাথে।  

মন খারাপ হয়ে গেল গুয়াংয়ের। তবে চুপ করে রইল। কী ঘটে দেখা যাক।

পরের দিন। রাজুমারিকে স্নান করানো হবে। ডেকে আনা হয়েছে তাকে। কিন্তু সে মেয়ে গায়ে জল ঢালতেই রাজি নয়। রাজা ছুটে এলেন, রানিমা ছুটে এলেন। বলে কী, মেয়ে? 

সবাই জড়ো হয়েছে ভীড় করে। সবাই অবাক। বিয়ে করবে না কেন? রাজকুমারি বলল—ওকে কেন বিয়ে করব আমি? ও তো একটা কাঠুরিয়া। ও কি আমাকে উদ্ধার করেছে না কি? 

রাজামশাই তো আকাশ থেকে পড়লেন—তাহলে, কে তোমাকে উদ্ধার করেছে, মা?

--সে কি আমি জানি না কি? চিনিও না তাকে। দেখিওনি আগে কোন দিন। মাত্র এক মূহুর্তের জন্য দেখা।

--আগে এসব বলোনি কেন তুমি?

--কী করে বলবো? কুঠারের এক কোপে মুণ্ডু কেটে নেবে বলেছে আমার। মুণ্ডুর মায়া কার না হয়?

মহা মুশকিলে পড়ে গেলেন রাজামশাই। বিয়ের আয়োজন সারা। কী করা যায় এখন? মেয়েকে বললেন— পাবো কী করে তাকে? চিনব কী করে সে ছেলেকে? 

--চেনার অসুবিধা নাই। নিশান দিয়ে এসেছি তাকে। 

গুয়াং তো ঢুকে পড়েছিল ভীড়ের ভিতর। কার সাথে রাজকুমারির বিয়ে হয়, দেখবে বলে। নিজের কানে সব শুনে, বেশ সাহস হোল মনে।

ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়েছে। নিশান দুটো বের করল পকেট থেকে। এক হাতে সোনার কাঁটা, অন্য হাতে আধখানা রুমাল তুলে, বলল—নিশান তো এগুলোই, তাই না? রাজ়কুমারির মুখে হাসি। আলো জ্বলে উঠেছে চোখে মুখে।ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছে ছেলেটাকে। 

রাজামশাই হাসলেন। রানিমা হাসলেন। জমায়েত শুদ্ধ সবাই আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠল। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল দুজনের। 

এবার রাজামশাই বললেন-- বিয়েবাড়ি তো মিটে গেল। বিচারের কাজটা সেরে নেওয়া যাক এবার। মিথ্যেবাদি কাঠুরিয়াটাকে বের করে আনো। ওর কুঠারের কোপে ওরই মুণ্ডু কাটব আমি।

গুয়াং বাধা দিয়ে বলল—না, রাজামশাই! তা হতে পারে না। ওর সাহায্য না পেলে, আমি গুহাটার ধারেকাছেও পৌঁছোতে পারতাম না। ও না থাকলে, রাজকুমারিকেও উদ্ধার করা যেত না। ক্ষমা করে দিন ওকে।

--বলো কী তুমি? আমার মেয়েকে কেটে ফেলবে বলেছে হতভাগাটা। রাজামশাই গর্জন করে উঠলেন।

গুয়াং বলল—ওকে এখানে মেরে ফেললে, ঘরে বউ-বাচ্চাগুলো যে না খেয়ে মরবে ওর। তারা কিন্তু কোন দোষ করেনি। তারা তো আপনারই প্রজা, রাজামশাই। 

সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল গুয়াংয়ের।

Post a Comment

0 Comments