জ্বলদর্চি

গুচ্ছকবিতা /অভিজিৎ হালদার

গুচ্ছকবিতা 
 
অভিজিৎ হালদার 


|| প্রস্থান  ||

তুমি চলে গেলে এক নিরুত্তর দুপুরে—
সেই দুপুরে কাকও ডাকেনি, ছায়ারাও স্থবির ছিলো।
আমি বসেছিলাম জানালার পাশে, হাতে ছিলো
একটি অসমাপ্ত চিঠি, যার শিরোনাম ছিলো 
 —তুমি

চোখে জমেছিলো অস্থিরতা—
আর ঠোঁটে ছিলো একটি শেষ না বলা সংলাপ,
তুমি তা বুঝলে না;
তুমি চলে গেলে, যেন কালের পৃষ্ঠায় এক শূন্য ছাপ দিয়ে।

চলে যাওয়া মানে শুধু হারিয়ে যাওয়া নয় !
তা এক নীরব কফিন
যেখানে জীবিত প্রেমেরা ঘুমায়
ভুলে যাওয়ার ছলনায়, আত্মাকে মৃত করে।

আমি এখনো প্রতিরাতে শুনি
তোমার নিঃশ্বাসের প্রতিধ্বনি—
ঘুম ভেঙে গেলে দেখি শুধু নিজেকে—
তোমাহীন, অথচ তোমায় পূর্ণ।



 ||  অনাহূত অশ্রুজল ||

প্রেমের নামে যে অশ্রু পড়ে, তা নয় অশান্তি—
তা এক অনাহূত বারিধারা
যা জন্মায় হৃদয়-বিক্ষত প্রার্থনায়
যেখানে ঈশ্বরও কাঁপেন ভালোবাসার ব্যর্থতায়।

তুমি বলেছিলে ভালোবাসি
কিন্তু শব্দগুলো ছিলো অস্থায়ী
শব্দের ঘ্রাণেই আমি বিভ্রম করেছিলাম
একে চিরন্তন বলেছিলাম— কত মূঢ় আমি!

আজও আয়নার সামনে দাঁড়ালে
দেখি আমি দুই মানুষ—
একজন আমি, অন্যজন আমি-হীন আমি
যার প্রতিচ্ছবিতে তুমি থেকে গেছো অবচেতনে।

হৃদয় এক মৃতদেহ
যার ছায়া কাঁপে প্রতিটি অতীতের ধ্বনিতে—
তুমি শুনবে না তা -  জানি !
তবু বয়ে নিয়ে চলেছি সেই নিঃশব্দ আহ্বান।



|| ব্যাকরণহীন ভালোবাসা ||

ভালোবাসা শিখিনি ব্যাকরণে
তা এসেছিলো নৈঃশব্দ্যের ব্যতিক্রম হয়ে—
যেখানে অভিব্যক্তি ছিলো অনুশাসনের বাইরে
কবিতার মতো অসংগত, অথচ অমোঘ।

তুমি ছিলে সেই প্রথম অলঙ্কার—
যার প্রতিটি অঙ্গবিন্যাসে ছিলো ভাষাহীন আকুলতা।
আমি লিখতাম চিঠি
তুমি পড়তে না; কারণ তুমি শব্দে নয়, চাহনিতে বাস করলে।

তবু আজও লিখি—
পাণ্ডুলিপি গুমরে কাঁদে, ছেঁড়া পাতায় গাঁথা থাকে
তোমার নামের অভ্রান্ত ব্যথা।
কে বলেছে ভাষা হারালে প্রেম মরে যায়?

না, সে তো আরো নিরেট হয়ে ওঠে—
শব্দবর্জিত ভালোবাসা
যা কাঁদে ব্যাকরণহীন বিরহে
যেখানে শুধু তুমি বললেই পৃথিবী থেমে যায়।



|| বর্ণনাতীত বেদনা ||

তোমাকে বলা যায় না শব্দে—
তুমি একধরনের অজানা ব্যথা,
যার উৎস খুঁজে পেলে শুধু শূন্যতা
আর চোখের কোনে ভাসমান নামহীন জল।

তুমি ছিলে না কখনো আমার
তবু হারানোর কষ্টে আমি মরেছিলাম বারবার
প্রতিবারই জীবিত হলাম শুধু
একটি সম্ভাবনার আশায়, যে তুমি একদিন ফিরবে।

বেদনার বর্ণনা নেই কোনো অভিধানে
তবু আমি লিখি, আঁকি, কাঁদি—
তোমার স্পর্শহীনতার প্রতিকৃতি এঁকে
প্রতিটি দীর্ঘ রাতে।

জানো? প্রেম এক দুর্লভ শাস্ত্র
যেখানে পাঠ্যাংশ শেষ হয় না কোনোদিন—
আর বিরহ, তারই অন্ধ অধ্যায়
যেখানে আলো নেই, তবু দৃষ্টি যায় শুধু একদিকে
— তোমার দিকে।



|| নিরুদ্দেশ সন্ধ্যা ||

সন্ধ্যাটা আজও নামে
ঠিক সেইভাবে—
যেমন নামে কোনো আত্মা পরলোকে,
নিরুদ্দেশ, অথচ অনিবার্য।

তোমার চলে যাওয়ায় দিন হারিয়েছিলো ছন্দ
আমি চেষ্টা করেছিলাম নতুন সূর্য আঁকতে—
কিন্তু রঙ গলে পড়েছিলো ক্যানভাস থেকে,
যেমন কাঁদে জলরঙ প্রেমহীন বাতাসে।

তুমি বলেছিলে, সময় সব ভুলিয়ে দেয়।
হয়তো ঠিক বলেছিলে,
কিন্তু সময় যে তোমার মতো হয়ে গেছে এখন—
নিঃশব্দ, নিরুদ্দেশ, নিরুত্তাপ।

আমি আজও সন্ধ্যার কান্নায় গন্ধ পাই—
তোমার কেশবিন্যাসে লেগে থাকা গোলাপজল,
তোমার চিবুকের তিল,
তোমার গলার স্বরে লুকিয়ে থাকা বিষাদ।

সব রয়ে গেছে—
তুমি শুধু নেই।
আর সেই অনুপস্থিতির মধ্যেই
তুমি সবচেয়ে বেশি আছো।

🍂


Post a Comment

0 Comments