বৌদি ও বোতলের দৈত্য
শুভশ্রী রায়
কয়েক দিন ধরেই ভাবছি একটা গল্প লিখব। আজ লিখতে বসে গেলাম। অবশ্য এটা ঠিক গল্প নয়। একদম সত্যি ঘটনা।
ব্যাপার হল, আমাদের চন্দ্রলোক হাউজিং এর বি-টুকটুক ব্লকের একতলায় তেজী বৌদি থাকেন। আমাদের ব্লকটাকে আমি আদর করে বি-টুকটুক বলি। যাই হোক, বৌদিদের ফ্ল্যাট একতলায় বলে অনেক সুবিধা। সিঁড়ি ভাঙতে হয় না। তেমনি কিছু অসুবিধাও আছে। দুষ্টু ছেলেপিলে ঢিল ছুঁড়ে জানলার কাচ ভেঙে দেয়। বাড়ির সামনে লোকজন অনেক সময় চিপসের প্যাকেট, চকোলেটের মোড়ক বা নরম পানীয়'র বোতল ফেলে যায়। এক দিন আমাদেরই চারতলার সুজিত সাহার বৌ বুলবুল ওপর থেকে ফলের রসের চ্যাপ্টা বোতল ছুঁড়েছিল। তখন সকাল ন'টা। বৌদি তো ভীষণ রেগে নিচ থেকে চিৎকার শুরু করলেন।চারতলার দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু বলতে শুরু করলেন। বুলবুলকে বললেন-"প্রায় তোমরা এই সব করো। কিছু বলি না বলে যা খুশি তাই করবে?"
বুলবুল কি স্বীকার করে? ধুন্ধুমার কান্ড লেগে গেল। লোক জমে গিয়েছিল। ঝগড়া দেখে লোকজন যত মজা পায়, অন্য কিছুতে তত মজা পায় কিনা সন্দেহ।
🍂
সুজিত তখন বাড়ি ছিল না। উত্তেজিত বুলবুলের ফোন পেয়ে সুজিতের বাবা-মা চলে এলেন। তাঁদের বাড়ি চন্দ্রলোক থেকে রিক্সায় দশ মিনিট। চন্দ্রলোকের দু' চারটে লোকজন বেরিয়ে মধ্যস্থতা করায় সে দিন ঝগড়া থেমেছিল। তেজী বৌদির পাশের ফ্ল্যাটে ঠান্ডা মাথার মাস্টারমশাই বিল্টু থাকে। পাড়ায় কোচিং সেন্টার আছে তার। ঝগড়া থামাতে গিয়ে তার কোচিং এ যেতে দেরি হয়ে গেল। এ রকম কখনো কখনো হয় এখানে তবে বৌদিকে এতটা চেঁচাতে কমই দেখেছি। আমিও এই ফ্ল্যাটে থাকি কিনা!
তেজী বৌদির ভালো নাম নবঝর্ণা। অত্যন্ত বাস্তববাদী এবং খাটিয়ে মহিলা, গল্পটল্প করেন পরে, আগে কাজ। চিরকাল তিনি এই নীতি নিয়ে চলেছেন। তাঁর মেধাবী ছেলে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি করে, মুম্বাইতে কর্মরত। বৌদির বোন ও বোনপো বেশিরভাগ সময় বৌদির সঙ্গে এখানে থাকে। বৌদির বাপের বাড়ি বাহাসাত। বাপের বাড়িটা বিরাট এবং স্বচ্ছল পরিবার। সম্প্রতি বাবার বাড়ির পাশের জমিটা ওঁরা বিক্রি করেছেন। বিক্রি করার আগে কোনো প্রতিবেশী বাগড়া দিচ্ছিল।
সেটা নিয়ে বৌদি একটু চিন্তায় ছিলেন।
এক দিন ভোর পাঁচটারও আগে বৌদি ফুল তুলতে বেরিয়েছিলেন। সামনের ফাঁকা জায়গাটায় দু' তিনটে ফুলগাছ তিনি লাগিয়েছেন। ভোরবেলায় উঠে তুলে না নিলে বেশিরভাগ ফুল চুরি হয়ে যায়। নিরাপত্তা রক্ষীরা কি সব সময় সব কিছু দেখতে পায়? ফুল তুলে বাড়ির সামনে বৌদি একটু হাঁটাহাঁটি করছেন, দেখলেন বারান্দার সামনে একটা অদ্ভুত নীল বোতল পড়ে আছে। নিশ্চয় বুলবুলের কাজ! বিরক্ত হতে গিয়েও সামলে নিলেন তিনি। তারপর কি মনে হওয়ায় নিচু হয়ে বোতলটা তুলে নিলেন।
ঘরে এসে চা খেতে খেতে বোতলটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন তিনি। বোন আর বোনপো তখনো ওঠেনি।
জিনিসটা সত্যিই সুন্দর, কাচের নয় এবং গায়ে কিছু লেখা নেই। সরু মুখটায় একটা ফুটোফুটো পলকা ঢাকনা। বোতলের গায়ে একটু মাটি লেগে ছিল। তুলে ফেললে বোধহয় বোঝা যাবে কিসের তৈরি, ভেবে বৌদি একটা শুকনো কাপড় দিয়ে বোতলের গা-টা আলতো করে ঘষতে লাগলেন। অমনি এক কান্ড! বোতল থেকে ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল এবং সেই ধোঁয়া জমাট বেঁধে একটা অদ্ভুত লোক তৈরি হয়ে গেল। তেজী বৌদি সহজে ভয় পাওয়ার মানুষ নন তবু তাঁর সাংঘাতিক ভয় লাগছিল। স্বপ্ন নয় তো? জেগে আছেন কিনা বোঝার জন্য হাতে চিমটি কেটে দেখেও নিলেন। নাঃ জেগেই তো আছেন।
এ কি কান্ড রে বাবা! লোকটার চেহারা অদ্ভুত, অনেকটা লম্বা, গায়ের রং গাঢ় হলুদ আর মাথায় অল্প চুল এবং কানে বড় বড় দুটো লোহা বা অন্য কোনো ধাতুর দুল। ছোটবেলায় রূপকথার বইতে এমন চেহারা তিনি দেখেছেন। দৈত্যটেত্য এরকমই হয়।
"পেন্নাম হই মা-ঠাকরুন।"
লোকটা নিচু হয়ে বিনীত ভঙ্গীতে তাঁকে নমস্কার করছে।
ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটিয়ে বৌদি জিজ্ঞাসা করলেন- "আপনি কে?"
লোকটা বলল- "নাম তো আমার অনেক। আপনি যে নামে খুশি ডাকবেন। তবে আমি লোকের ভালো ছাড়া মন্দ করি না। আমাকে অকারণে ভয় পাবেন না মা-ঠাকরুন। কোনো অসুবিধায় পড়লে আমাকে ডাকবেন। কোনো কিছু চাইলে আমাকে স্মরণ করবেন। আমি বোতল থেকে বেরিয়ে আসি বা না আসি সব ঠিক করে দেব। অসুবিধা দূর করে দেবই। ঠিকঠাক ব্যবস্থা করতে আমার জুড়ি নেই। আর আমাকে আপনি বলবেন না মা-ঠাকরুন, তুমি বলবেন।"
চেহারাটা উৎকট হলেও লোকটার কথা বলার ভঙ্গীটা ভারি মোলায়েম। অনেকটা আশ্বস্ত হয়ে বৌদি বললেন, "আচ্ছা এখন এসো। দরকার হ'লে ডাকব কিন্তু।"
তাঁকে একটা প্রণাম ঠুকে লোকটা ফের ধোঁয়া হয়ে বোতলে ঢুকে গেল। আসলে লোক নয় অবশ্য, দৈত্য। আর বৌদি সারা দিন অন্যমনস্ক হয়ে রইলেন।
তেজী বৌদি জানেন এসব কথা কাউকে বলতে নেই। এমন কি ছেলেকেও বলেননি। বোতলটাকে সাবধানে আলমারির ভেতর দিকে চাপাচুপি দিয়ে রেখে দিয়েছেন।
জীবন স্বাভাবিকভাবেই চলছে। এমন সময় খবর এল বাহাসাতে জমি বিক্রি নিয়ে কুচুটে প্রতিবেশী কানাই হালদার খুব বাগড়া দিচ্ছে। এর ওর কাজে বাগড়া দেওয়া তার কাজ। লোকে তাকে গেরো কানাই বলে।
তেজী বৌদির মনে হ'ল, বোতলের দৈত্যটাকে ডাকা যেতে পারে। বাড়িতে কেউ নেই। বোন গেছে বাহাসাত, বোনপো অফিসে। দুপুরে বোতলটাকে বার করলেন তিনি। পরিষ্কার রুমাল দিয়ে একটু ঘষতেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে সে হাসিমুখে বেরিয়ে এল। প্রণাম করে বলল- "বলুন মাঠাকরুন।" জমি বিক্রির সমস্যার কথাটা তাকে বললেন তিনি। দৈত্য শুনেটুনে বলল- "ও হয়ে যাবে।" বলেই প্রণাম ঠুকে আবার বোতলের ভেতরে ঢুকে গেল।
ঠিক তিন দিন পরে বাহাসাত থেকে সুখবরটা এল। কানাই বাবু জমি নিয়ে বাগড়া দেবেন না বলে কথা দিয়েছেন। এমন কি তেজীবৌদির বড়দার কাছে এসে ক্ষমাও চেয়ে গিয়েছেন। তাঁর এ হেন পরিবর্তনের কারণটা কি তা নিয়ে দু' রকম কথা শোনা যাচ্ছে। এক দল বলছে- সন্ধ্যাবেলায় নিজেদের বাড়ির ছাদে পায়চারি করছিলেন কানাইবাবু। এমন সময় কিছু একটা দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছেন। আরেক দল বলছে, এক রাতে বাজার থেকে ফেরার সময় বিক্রির জমির ওপর দিয়ে শর্টকাট করার সময় কিছু দেখেছেন তিনি। কী দেখেছেন তা ভেঙে বলেননি তবে অবশ্যই ভয় পাওয়ার মতো কিছু। মোট কথা জমি বিক্রিতে আর বাধা নেই।
দিন পনেরো পরে তেজী বৌদি আবিষ্কার করলেন শাশুড়ি মায়ের রেখে যাওয়া গয়নাগুলোর ভেতর থেকে এক জোড়া ভারি সোনার দুল পাচ্ছেন না। সঙ্গে প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকাও খুঁজে পাচ্ছেন না। ফের সময় মতো বোতলের দৈত্যকে ডাকলেন তিনি। শুনে নিয়ে পেন্নাম করে সুট করে বোতলে ঢুকে গেল সে। কখনোই বেশি ক্ষণ বাইরে থাকে না।
পরের দিন সকালে খাটের তলা থেকে হারানো দুল জোড়া পেয়ে গেলেন তেজীবৌদি। আর সাড়ে চার হাজার টাকাটা পেলেন রান্নাঘরের তাকে এক কেজি চিনির প্যাকেটের তলায়। মুদীর দোকান থেকে এনে ওখানে রেখে মনে ছিল না। তার ঠিক একুশ দিন পরে বাহাসাত থেকে ষোলো লাখের চেক নিয়ে মেজদা এসে হাজির। তাঁদের পরিবারে মেয়েদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার রেওয়াজ নেই।
এর পর এক দিন পত্রিকার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ম্যাঙ্গো কেকের ছবি দেখে সেটা খেতে ইচ্ছা হল তেজী বৌদির। সে দিন অবশ্য বোতল ঘষেননি। শুধু সেই আজ্ঞাবহ বিনয়ী দৈত্যটিকে মনে মনে ডেকেছিলেন। পরের দিন প্রতিবেশিনী পৌষালি চাটুজ্জে হাসিমুখে মস্ত বড় ম্যাঙ্গো কেক নিয়ে হাজির। কি উপলক্ষ্য? ছেলে ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে গেছে।
এই দৈত্যের কথা তেজী বৌদি শুধু আমাকে বলেছেন। আমি অবশ্য দৈত্যের সাহায্য নেওয়ার জন্য কখনোই বৌদির দ্বারস্থ হব না। তবে হ্যাঁ! সম্পাদক মশাই যদি এই গল্প মনোনীত না করেন তখন কিছু একটা ব্যবস্থা করার জন্য তেজী বৌদির মাধ্যমে ইচ্ছা - দৈত্যকে জানাব বলে ঠিক করে রেখেছি।
0 Comments