সাহিত্যিক কিন্নর রায়-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
রাজীব কুমার ঘোষ
রাজীব ঘোষ: ঠিক কোন সময়ে আপনি বুঝলেন যে আপনাকে মৌলিক লেখা লিখেই যেতে হবে। লেখা ছাড়া আর আপনার কোনও উপায় নেই?
কিন্নর রায়: আমি কোনোদিন লেখক হবো ভাবিনি। আমি স্কুল ম্যাগাজিনে কোনও গল্প লিখিনি। কলেজ ম্যাগাজিনে কোনও গল্প লিখিনি। আমি আমার বন্ধুদের, যারা প্রেম করতেন তখন, তাদের প্রেমপত্রের ড্রাফট্ করে দিতাম। হাতের লেখা ভালো ছিল বলে আর ল্যাংগুয়েজটা ছোটবেলা থেকেই — বাংলা — লোকে বলত মোটামুটি ভালো, ফলে ড্রাফট্ করে দিতাম এবং সেইসব প্রেমপত্র যখন তারা দিত প্রেমিকাদের তারা গদগদ হয়ে যেত। পরে যখন তারা জেনেছিল এসব প্রেমপত্র আমি লিখে দিতাম, তখন তারা আমায় বলেছিল, তাহলে তোর সঙ্গে প্রেম করাটাই আমাদের উচিত ছিল। তাছাড়া পার্টির ইস্তেহার সেইটা আমাদের সময় — যাকে আমরা চলিত ভাষায় জেরক্স বলি — কথাটা ভুল আসলে ফটোকপিয়ার, তখন তো ছিল না — তখন সাইক্লোস্টাইল মেশিন ছিল এবং সেই সাইক্লোস্টাইল মেশিনের মোম কাগজের ওপর একটা মোটামুটি ধারালো কলম যার নিবটা সরু তা দিয়ে তোমার ঐ ড্রাফট্ করা হত। সেইটা সাইক্লোস্টাইলে ছেপে পঞ্চাশটা, একশোটা বের করা যেত। একটা সাইক্লোস্টাইল মেশিন আমাদের বিদ্যালয়ে ছিল আমরা সেটা উঠিয়ে নিয়ে আসি পার্টির কাজের জন্য, পরে পুলিশ সেটি সিজ করে। সেটা অন্য কাহিনি। সাতাত্তরে জেল থেকে বেরিয়ে মনে হল আমার অনেক কথা বলার আছে এবং সেই বলাটা আমাকেই বলতে হবে। কেউ বলবে না। তখন আমি গল্প লেখার দিকে নজর দিলাম। সেটা কী হয়েছে আমি জানি না, এতদূর আসার পর। কিন্তু এটা এমন সময় যখন আর কোনও গত্যন্তর নেই পিঠে দেওয়াল ঠেকে গেছে। জেল থেকে বেরোনোর পর মা আমাকে আলাপ করিয়ে দিতেন যে, আমার বিধবা মেয়ে — তা অপমান করার জন্য নয়। বাবা রিয়ারমেন্টের মুখে, এট দ্য ভার্জ অফ রিটায়ারমেন্ট, তো মা চাইছেন যে আমি দাঁড়িয়ে যাই, বাবা চাইছেন দাঁড়িয়ে যাই। আর আমি ভাবছি যে আমি পুরো পার্টির হোলটাইমার হয়ে সোলঝিনিৎসিন বা গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে চলে যাব। কিন্তু পার্টি তখন ছিন্নভিন্ন, পার্টির নেতৃত্ব একে অপরকে সন্দেহ করে যারা বেঁচে আছেন। অধিকাংশই নিহত, যারা খানিকটা বসে গেছেন তাদের রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে নানা ফারাক। চিন, চিনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন, দেশের শাসকগোষ্ঠীকে নিয়ে প্রশ্ন — এই সমস্ত দোলাচলের মধ্যে আমি নানারকম কথা, বিভিন্নরকম ভাবতে থাকি এবং সাজাতে থাকি। তখনি মনে হয় যে খবরের কাগজে যাবার। কারণ আমি দেখেছিলাম পুলিশ একমাত্র ভয় পায় খবরের কাগজকে, সাংবাদিককেও ফলে আমি সাংবাদিকতার কাজটা করব এমন একটা ভাবনা এবং সেইসঙ্গে মানুষের কথা বলার। আমাকে প্রশান্ত সরকার অনেক পরে শিখিয়েছিলে যে দ্যাখো সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যম হচ্ছে ব্রিজ বিটউইন দ্য পাবলিক অ্যান্ড এডমিনিস্ট্রেশন। তুমি তোমার কথা, এডমিনিস্ট্রেশনের কানে পৌঁছে দিতে গেলে তুমি ব্রিজের কাজ করবে পাবলিকের হয়ে। এবং এটা কখনই একদেশদর্শী হবে না।
রাজীব: কিন্তু কোন গল্প বা কোন গল্পের বই বা কোন উপন্যাস লেখার সময় আপনি ভেতর থেকে বুঝতে পারলেন যে আপনার আর ফিরে যাওয়ার ব্যাপার নেই মানে এই লেখাই আপনার সারাজীবনে সঙ্গী হয়ে যাবে?
কিন্নর: তুমি বলতে পারো লেখাটা আমার কাছে একটা আত্মমোচন, আত্মমোক্ষণ। আমি আমার ভেতরের যন্ত্রণাগুলোকে লেখার মধ্যে বলতে চাই। নিজের সঙ্গেই কথা, এটা আমার সলিলকি বলতে পারো। আত্মকথন, আত্মকথোপকথন এইটা আমার লেখার মধ্যে খানিকটা এসেছে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, লেখাটা হচ্ছে একটা উন্মোচন।
রাজীব: আপনার লেখায় খুব বিশদভাবে সবকিছু উঠে আসে — স্থান-বস্তু-ব্যক্তি এবং বাস্তব যে তথ্য, বাস্তব যে নাম, সমকালীন রাজনীতি —আপনার লেখায় উঠে আসে। সাধারণত আমরা দেখি লেখকরা একটু আড়াল রাখেন। আপনার লেখায় এই আড়ালটা নেই। এই যে একটা সাহসী শৈলী এটা আপনি কীভাবে নিলেন?
কিন্নর: এই যে নাম দেওয়া, এই যে নাম রেখে দেওয়া, সাহিত্যিকরা কেন রাখেন না আমি জানি না কিন্তু আমার মনে হয় ঔপন্যাসিক হচ্ছেন একজন সোশাল রিপোর্টার। আমার লেখা নিয়ে যদি আদৌ কোনও গবেষণা হয়, হয়েছে, অনেক পি এইচ ডি হয়েছে, আরো হবে, তারাও আমাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করেছেন। আমি বলেছি হ্যাঁ তুমি যদি ওই জায়গায় যাও তাহলে এই লোকগুলোর পরবর্তী বংশতালিকা পাবে, তারা বেঁচে আছে এবং আমার বাবা, আমার মা, আমার দাদামশাই, ঠাকুর্দা, আমার ঠাকুমা এদের কথাও আমি — আমি তুলনা করছি না যেমন মার্কেজ মাকান্দো তৈরি করেছিলেন, আমি মাকান্দো তৈরি করিনি। বালি-র কথা যখন লিখি তখন একেবারে সবার কথা লিখি এবং সেই কথাগুলো আমার মনে হয় যে, আমি তো থাকব না, আমার লেখায় থাকবে। একটা সোশাল, সামাজিক দায়বদ্ধতা তার থেকে আমি লিখি যাতে এই যে সামাজিক ইতিহাস, সমাজের হারিয়ে যাওয়া, মুছে যাওয়া ইতিহাস তাকে বারবার করে চিহ্নিত করে রাখা, তাকে বারবার করে নথিবদ্ধ করা এবং এটা আমার সামাজিক দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।
রাজীব: আপনি জনপ্রিয় লেখক। আপানর নিজস্ব পাঠক আছে, আপনি সেভাবে বিগ হাউসে নেই কিন্তু এই পাঠক আপানার লেখার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এর কারণ কি এটাই মনে হয়, সমসাময়িকতাকে তুলে আনা স্পষ্টভাবে একটা স্পষ্ট উচ্চারণের জন্য?
কিন্নর: রাজীব, অনেকে আমার ভাষাটিকে বড় গুরুত্ব দেন। বলেন আমার ভাষা নাকি খুব ভালো। আমি মনে করি যে ভাষা ছাড়া কোনও লেখা দাঁড়াতে পারে না। রবীন্দ্রনাথকে যদি ছেড়েও দি, তাহলে বঙ্কিমচন্দ্র, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ — গদ্যের কথা বলছি; এরা সবাই কিন্তু অদ্ভুত ভাষাশিল্পী। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পরবর্তী সময়ে আমাকে মুগ্ধ করে রাখেন। জাদুকরের মতো মুগ্ধ করে রাখেন শ্যামল। সন্দীপন-ও খানিকটা। সন্দীপনের ভাষায় আবার চালাকি আছে যেটা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায় নেই। আমি ভাষাশিল্পী হিসাবে মনে করি যে, লেখকের ভাষাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার থেকে বড় কথা তুমি একটা নতুন কথা শোনালে, আমি খুব পপুলার লেখক। আমি তা নই রাজীব। আমি নিজে জানি। সেই অর্থে পপুলার হওয়া কোনও অন্যায় নয় কিন্তু পপুলার হওয়ার যে ছক সেদিকে আমি এগোইনি। আমি বরং ছক ভাঙতে চেয়েছি আমার মতো করে, নিজের মতো করে। এই পশ্চিমবাংলায় সবচাইতে বড় যে পুঁজিতাড়িত এবং পুঁজি পরিচালিত প্রতিষ্ঠান তাতে আমি লিখিনি। লিখিনি মানে এই নয় যে লেখা জমা দিয়েছি তারা রিফিউজ করেছে, আই রিফিউজ দেম। তারা আমায় লিখতে বলেছে যখন আমার পঁতাল্লিশ বছর বয়স। আজকে আমি বাহাত্তর। (আমি মনে করি না, আমি মনে করি এখনও সতেরো।) তাদের ছোটোদের পুজো সংখ্যায় লিখতে বলেন, ছোটোদের কাগজে লিখতে বলেন। যারা বলেছিলেন তারা তিনজনেই এখনো বেঁচে আছেন — অনির্বান চট্টোপাধ্যায়, অনিল বিশ্বাস এবং রতনতনু ঘাঁটি। তারা আমাকে কতবার অনুরোধ করেছেন লেখার জন্য কিন্তু আই রিফিউজ টু রাইট। আমার খুব ছোটো পাঠক মণ্ডলী একটা আছে হয়তো। তারা কিন্নর রায়কে বড় লেখক বলে মনে করে। তুমি আমার অন্যতম পাঠক, কেননা তুমি আমার লেখা খুব মন দিয়ে পড় আমি জানি। ফলে সেটা আমার কাছে খুব সম্মানের বিষয়। এই কথাগুলো কিন্তু রাখবে। তোমার মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ গদ্যকার যখন আমার লেখা পড়ে তখন...ঘোষ স্যার, তোমার গল্পের একটি অন্যতম চরিত্র, অসামান্য চরিত্র, তখন আমি নিজে গর্বিত বোধ করি, মনে হয় যে আমি এখনো ফুরিয়ে যাইনি। এক নবীন গল্পকার তার চোখ দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করেন এইটা আমার কাছে সম্মানের বিষয়।
রাজীব: আপনার লেখার মধ্য থেকে যদি দুটি আপনার নিজের খুব প্রিয় গল্প এবং উপন্যাস বেছে নিতে হয় কোন দুটি গল্প বা উপন্যাস বেছে নেবেন?
কিন্নর: আমার কোনও প্রিয় গল্প নেই। আমি ভীষণ ডিস্যাটিসফ্যাকশন মানে বড় মাছকে অল্প জলের মধ্যে বাজারে রাখলে সে ক্রমাগত খাবি খায়। আমি ওরকম একজন মানুষ। আমার মনে হয় যে আমার কোনও লেখাই আসলে হয়নি। আমি আসলে লিখতে চাই গলা ডুবিয়ে, মুখ ডুবিয়ে, বুক ডুবিয়ে — সেটা আমার হয়নি হয়ত। আমি পারিনি।
রাজীব: যারা লিখতে চাইছেন বা যারা লিখছেন নবীন প্রজন্ম তাদের উদ্দেশ্যে যদি আপনাকে কিছু বলতে হয় কী বলবেন?
কিন্নর: আমি বাণী দেবার লোক নই। আমি তোমাদের মতো তরুণরা যখন লেখে আমি তাদের আমার বন্ধু মনে করি। দুটো কথা বলব, ইন্টারনেট দেখে বা গুগুল করে লেখা হয় না। একজন খুব নামকরা কলমচি লেখক বলেছিলেন যে, ‘আমার তো অভিজ্ঞতার দরকার নেই আমার তো ইন্টারনেট আছে। আমি পড়ব, পড়ে কল্পনার রং মেশাব।’ দ্যাখো সবাই তো বিভূতিভূষণ নয় যে ঘরে বসে চাঁদের পাহাড়...আর বিভূতিভূষণ অসম্ভব পড়াশুনো করতেন, স্ট্রান্ড ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে ন্যাশন্যাল জিওগ্রাফিক পড়তেন ফলে উনি মোটেই হ্যাকা-ক্যাবলা লেখক ছিলেন না। আমার যেটা মনে হয় যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া উচিত। নিজেকে সংঘর্ষে জড়ানো উচিত। জীবনের নানা সংঘর্ষে নানা পরিস্থিতি তার সঙ্গে কল্পনা, স্বপ্ন — নিজের অধীত পঠন-পাঠন, প্রভূত গান শোনা, প্রচুর সিনেমা দেখা, প্রভূত সৎ সাহিত্য দেশে বিদেশের পাঠ করা; অ্যাস্ট্রোনমি, পথ-ঘাট, জঙ্গল সমস্ত জানা আর যদি না জানতে পারেন একজন লেখক তার পক্ষে তার বই হয়ত বিক্রি হবে কিন্তু তিনি দাঁড়াবেন না। দাঁড়াতে পারেন না। কারণ হয় তারাশঙ্কর ঠিক, বিভূতিবাবু ঠিক নয় বাকিরা ঠিক। বাকিরা তো ঠিক না, বাকিরা মুছে গেছেন কিন্তু বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, জগদীশ গুপ্ত এরা কিন্তু টিকে আছেন নিজের জোরে। রবীন্দ্রনাথ পাশে থাকা সত্ত্বেও, ওই হিমালয় কাছে আছে তা সত্ত্বেও জীবনানন্দের গদ্য পড়ে, কবিতা তো ছেড়েই দাও, গদ্য যখন পড়ি আমি বিমুগ্ধ হয়ে যাই রাজীব। কী করে ‘জলপাইহাটি’ লিখলেন! কী করে ‘সুতীর্থ’ লিখলেন! কী করে ‘মাল্যবান’ লিখলেন! আমি বিস্মিত হই। এই বিস্ময়টা আমার কাটে না যখন আমি অভিজ্ঞতার কথা বলি এবং ক্রমাগত সংঘর্ষ ও জটিলতার মধ্য দিয়ে...দেখলে তুমি বুঝতে পারবে না যে এই লেখক সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেখানোর কিছু নেই, কৃত্তিবাসী মদ খেয়ে রাস্তায় পড়ে যেতাম না। রবীন্দ্রনাথের মতন বোহেমিয়ান কে ছিলেন বল তো? কে ছিলেন? এই রবীন্দ্রনাথ আমার আদর্শ, জীবনকে নানাভাবে তিনি ভেঙেছেন এবং যা বিশ্বাস করেছেন সেটাই করেছেন তার থেকে সরে আসেননি। মহাত্মা গান্ধীও তাই রাজনৈতিকভাবে। এই আরকি, এইটুকুই বলা। অভিজ্ঞতা দরকার। অভিজ্ঞতা ছাড়া লেখা যায় না।
রাজীব: কথা অনন্ত কিন্তু আমাদের থামতে হবে আজ। জ্বলদর্চির পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ এই সাক্ষাৎকারের জন্য।
0 Comments