অরণ্যের দিনরাত্রি : সমাজমন ও আত্মপর্যালোচনার অন্তঃস্রোত
সত্যজিৎ পড়্যা
সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি কেবলমাত্র চারজন শহুরে যুবকের গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার কাহিনি নয়; এটি আধুনিক নাগরিক সমাজের অন্তর্গত মানস-সংঘাত,অবচেতনের অন্ধকার, এবং সামাজিক সম্পর্কের নান্দনিক জটিলতার এক মননশীল প্রতিচ্ছবি। চলচ্চিত্রটি যেন এক অন্তর্মুখী আয়না, যেখানে দেখা যায় প্রগতির মোহে আবদ্ধ নগরজীবনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য ক্ষয় ও বিচ্ছিন্নতা।কলকাতার কোলাহল থেকে চার বন্ধু—আসিম, সন্দীপ, শিবনাথ ও হরি—প্রকৃতির নীরবতায় কিছুদিন কাটানোর জন্য পালিয়ে আসে বিহারের এক প্রত্যন্ত অরণ্যে। কিন্তু প্রকৃতির শ্বাস-প্রশ্বাসে মিশে যাওয়ার বদলে তারা বয়ে নিয়ে আসে শহরের ধুলো, স্বার্থপরতা, ও প্রতিযোগিতার মনোভাব। এই চরিত্রগুলো আমাদের সমাজের প্রতীক—যেখানে বন্ধুত্বও অদৃশ্য স্বার্থের গোপন দাগে আচ্ছন্ন।
🍂
আসিম, কর্পোরেট উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিমূর্তি, নিজেকে আধিপত্যশীল প্রমাণে তৎপর; সন্দীপ, নরম সুরে হলেও চালাকির লেশহীন নয়; শিবনাথ, বামপন্থী ভাবনার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জর্জরিত এক দার্শনিক মন; আর হরি, ব্যর্থ প্রেমিকের মানসিক শূন্যতা বয়ে বেড়ানো সাদাসিধে যুবক। চারজনের এই মানস-গঠন এক বহুবর্ণ শহুরে মনোজগতের প্রতিরূপ।অরণ্য এখানে নিছক ছুটির গন্তব্য নয়—এটি এক পরীক্ষাক্ষেত্র, যেখানে সভ্যতার মুখোশ খুলে পড়ে। প্রকৃতির অবিন্যস্ত অথচ সুশৃঙ্খল সৌন্দর্যের মধ্যে তাদের নগরায়িত মনোবৃত্তি ধীরে ধীরে অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। জঙ্গলের নীরবতা তাদের শোনায় নিজের ভেতরের অশ্রুত শব্দ—ঈর্ষা, লালসা, প্রতিযোগিতা।প্রকৃতির সান্নিধ্যে মানুষের সহজাত মানবিকতা জেগে ওঠার বদলে, এখানে উল্টো প্রক্রিয়া ঘটে—চার বন্ধু আরও নগ্নভাবে উপলব্ধি করে নিজেদের ক্ষুদ্রতা। এই বৈপরীত্যই চলচ্চিত্রের অন্যতম মনস্তাত্ত্বিক শক্তি।চলচ্চিত্রে নারীর উপস্থিতি সীমিত হলেও গভীর অর্থবহ। আপর্ণা ও জয়া—দুটি ভিন্ন স্বভাব ও জীবনদর্শনের নারী—শহুরে পুরুষ-মনস্তত্ত্বকে এক অনাবৃত আয়না দেখিয়ে দেয়। আসিমের প্রতিযোগিতামূলক স্বভাব সন্দীপের সঙ্গে আপর্ণার ঘনিষ্ঠতায় আরও উসকে ওঠে। বন্ধুত্ব, প্রেম ও অহমের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন এখানে অসাধারণ শৈল্পিকতায় ফুটে উঠেছে।জয়ার সঙ্গে হরির সম্পর্ক, যদিও সামান্য ও চুপচাপ, তবুও তা হারানো ও প্রাপ্তির মধ্যে এক বিষণ্ন সেতুবন্ধন রচনা করে। প্রেম এখানে কোনো রোমান্টিক পরিসর নয়—এটি শহুরে মানসিক ক্ষুধার এক ক্ষণিক তৃপ্তি, যা শেষে আরও শূন্যতা রেখে যায়।অরণ্যের রাতগুলোতে তাসের আসর ও নেশার আবেশে যে ‘গেমস পিপল প্লে’ ধরা পড়ে, তা কেবল বিনোদন নয়—এটি মানুষের অবচেতনের সামাজিক মনস্তত্ত্বের প্রতিচ্ছবি। সেখানেই প্রকাশ পায় শ্রেষ্ঠত্বের লালসা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্ধতা, এবং অন্যকে অপমান করার অন্তর্লীন প্রবণতা।রায় অসাধারণ নিপুণতায় দেখান, কীভাবে সভ্যতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আদিম প্রবৃত্তি সামান্য প্ররোচনায়ই উন্মোচিত হয়ে পড়ে।চলচ্চিত্রের শেষে বন্ধুরা শহরে ফিরে যায়, কিন্তু তারা আর আগের মতো থাকে না। অরণ্যের দিন ও রাত যেন তাদের অন্তরের এক নিভৃত দরজা খুলে দিয়েছে, যার ভেতর তারা নিজেদের প্রকৃত রূপ দেখেছে। কিন্তু সেই দর্শন কোনো মুক্তি এনে দেয় না—বরং শহরে ফিরে গিয়ে তারা আরও নিঃসঙ্গ, আরও বিভ্রান্ত হয়ে ওঠে।এই চলচ্চিত্র সমাজকে এক অনিবার্য প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়—নগরায়নের অগ্রগতি কি আমাদের সম্পর্কের গভীরতা নষ্ট করছে?প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে কি আমরা নিজেদের সত্তা হারাচ্ছি?আধুনিক শিক্ষিত যুবসমাজ কি সত্যিই মুক্তমনা, নাকি তারা কেবল আরেকটি প্রতিযোগিতার ঘেরাটোপে বন্দি?
সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাটিতে প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি সংলাপ, যেন নীরবে এই প্রশ্নগুলো ফিসফিসিয়ে বলে যায়। “অরণ্যের দিনরাত্রি” আমাদের শেখায়, সভ্যতার অলংকার যতই ঝলমলে হোক, মানুষের ভেতরের আদিম প্রবৃত্তি ও আবেগ চিরকালই বেঁচে থাকবে, শুধু আড়াল বদলাবে।এই শিল্পকর্ম শুধু চলচ্চিত্র নয়—এটি শহুরে জীবনের উপর এক দার্শনিক প্রবন্ধ, যেখানে মানবমন, সমাজ ও প্রকৃতির ত্রিমুখী সম্পর্ক এক গূঢ় অথচ হৃদয়-স্পর্শী ভাষায় রূপায়িত হয়েছে। দর্শক যখন শেষ দৃশ্যে নিঃশব্দে প্রেক্ষাগৃহ ছাড়েন, তখন মনে হয় যেন তার নিজেরই ভেতরে এক অরণ্যের দরজা খুলে গেছে—যেখানে দিনের আলো আর রাতের অন্ধকার মিলেমিশে এক অনন্ত আত্মজিজ্ঞাসার পথে নিয়ে যায়।
0 Comments