দূর দেশের লোক গল্প—২৫৫
কোরিয়া (এশিয়া)
মোড়লের হুকুম
চিন্ময় দাশ
অনেক অনেক বছর আগের কথা। তখন কোরিয়া এতো উন্নত হয়নি। সিওলও গড়ে ওঠেনি কোরিয়ার রাজধানী হিসাবে। তখন সিওল বলতে ছোট্ট একটা গঞ্জ। চারদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা। ঘন জঙ্গল আর নানান জীবজন্তুর বাস সেই পাহাড়ে।
সূর্য যেই পশ্চিমে ঢলে পড়ল, বাড়ি থেকে বেরোতেই ভয় পেতে মানুষজন। বেরোনো মানেই বাঘের পেটে যাওয়া। কে সাহস করে বাইরে যাবে? কিন্তু বাইরে না গেলেও তো নয়। সংসার চলে কী করে? হাজারো রকম কাজ থাকে সংসারের। যেকারণে দূপুরের পরেও বাইরে বের হতে হয়। কিন্তু এমন অবস্থা, বেরোলে যে ঘরে ফিরবে, তার কোন ঠিকঠিকানা নাই।
সেই ভয়ে কেউই বাড়ি থেকে বেরোয় না। কিন্তু এভাবে কতদিন চালানো যায়? হাজার রকমের সমস্যা হতে থাকলো। কত কাজ করা যায় না।
কেউ কেউ বললো, আমরা যদি অনেক জন মিলে দল বেঁধে বেরোই, তাহলে নিশ্চয় বাঘ ভালুক কেউ আর সাহস করবে না আমাদের দিকে এগোতে। অনেকের মনে ধরল কথাটা।
একজন বলল-- কিন্তু ভায়া, এটা কি সম্ভব? সবসময় দল বেঁধে ঘর থেকে বেরোবো, তা কিন্তু অত সহজ নয়।
আবার আলোচনা। একজন বলল-- আচ্ছা যদি আমরা ঢাকঢোল নিয়ে বের হই। তাতে তো কাজ হবে মনে হয়। ঢাকঢোলের শব্দে নিশ্চয়ই বাঘ ভালুক ভয় পাবে। তারা নিশ্চয় এগোবে না।
এটাও খুব একটা মনঃপুত হলো না অনেকের। তখন ঠিক হোল—চলো, মোড়লের সাথে গিয়ে কথা বলা যাক। সে নিশ্চয়ই কিছু একটা উপায় করবেই।
মোড়লের কাছে যাওয়া হলো। মোড়ল বলল-- আমিও ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছি হে। ঠিক আছে। আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। পাহাড়ের মাথায় একজন সাধু থাকে। দুজন যুবক ছেলে চিঠিটা নিয়ে তার কাছে যাক। চিঠিটা সাধুর হাতে দিয়ে এসো। আমার বিশ্বাস, সাধু মহারাজ নিশ্চয়ই কিছু একটা বিহিত করে দেবেন।
দুটো ছেলের হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হলো। তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে রওনা হয়ে গেল। কিছু দূর গিয়ে তাদের মাথায় এলো, পাহাড়ের উপর পর্যন্ত পৌঁছাতে গেলে, সেই তো বনের ভিতর দিয়েই যেতে হবে। আর বন মানেই বাঘের ভয়। বাঘের মুখে পড়লে, তখন তো কেউ বাঁচাতে আসবে না আমাদের। উপায় কি হবে? ছেলে দুটো দোনামনা করতে লাগলো। কী করা যায়, কী করা যায়? ফিরেও যাওয়া যায় না। আবার, বাঘ আছে জেনে, এই রাস্তায় এগুলোও যায় না।
একজন বলল-- কিন্তু ভাই, মোড়ল যদি ভাবতো বাঘের পেটে যাওয়ার ভয় আছে, তাহলে কি আমাদের পাঠাতো? কিছুতেই পাঠাতো না। কিন্তু পাঠিয়েছে যখন, মনে হয় আমরা যতটা ভাবছি অতটা ভয়ের কিছু হবে না। চলো, যাওয়া যাক।
দুজনে মনে মনে এটাই ভেবে নিল, বাঘের ভয় থাকলে মোড়ল নিশ্চয়ই আমাদের পাঠাতো না। এই ভেবে তারা এগোতে লাগল। বুক দুরু দুরু। এই যদি বাঘের সামনে পড়ে যায়। কিন্তু চলা তাদের থামল না। দেখতে দেখতে এক সময় পাহাড়ের মাথাতেই পৌঁছে গেল দুজন। দেখল কুড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে রোদে চুল শুকাচ্ছে সাধু মহারাজ।
দুজনে গিয়ে পেন্নাম করল সাধুকে। সাধু অবাক হয়ে তাকাতে, হাতের চিঠিটা ধরিয়ে দিল তারা। সাধু মহারাজ চিঠি খুলে পড়তে চোখ বুলিয়েছেন। অমনি ছেলে দুটোর দৌড। দৌড়তে দৌড়তে সোজা গ্রামে এসে থামলো দুজন।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন। বেঁচে আছি দুজনে। বাঘের পেটে যেতে হয়নি, এটাই কত কপাল। মোড়লকে খবরটা দিতে হবে। এবার ধীরে সুস্থে মোড়লের ঘরে গিয়ে হাজির হলো তারা। মোড়লের ঘরের দরজা ভেজানো। বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ বুলিয়ে, দুজনে তো অবাক!
ভোজবাজি না কি? যে সাধুর সাথে এইমাত্র পাহাড়ের মাথায় দেখা করে এলো দুজনে, সেই সাধু কী করে মোড়লের ঘরে বসে আছে? এত তাড়াতাড়ি একজন বুড়ো মানুষ কী করে পৌঁছে গেল এখানে? এলই বা কোন রাস্তা ধরে? আমাদের সঙ্গে তো দেখা হয়নি কই? দুজনেই ভারি অবাক।
ভেতরে দুজনের কী আলোচনা হচ্ছিল, সেটা তো বোঝা যাচ্ছে না। এখন শোনা গেল মোড়ল গলা উঁচিয়ে বলছে-- তোমার ওই ছদ্মবেশের ভেক ছাড়ো এই মুহূর্তে। তারপরে অন্য কথা।
দেখতে না দেখতে, চোখের পলক পড়তে পেল না। সাধু মহারাজ ছিটকে উঠল মেঝে থেকে। বাতাসে এক পাক ডিগবাজি খেয়ে, নীচে নামলো যখন, বিশাল এক বাঘ।
ছেলে দুটো চমকে উঠেছে। তাহলে এই সেই সাধু? এই বাঘের সাথেই তারা দেখা করে এসেছে পাহাড়ের উপরে! আর, বলিহারি সাহস মোড়লের। বাঘের সঙ্গে বসে কথা বলছে। আবার সেই সাথে ধমকাচ্ছেও বাঘকে!
এবার শোনা গেল, মোড়ল হুকুম করছে-- তুমি হতে পারো বনের রাজা। থাকতেও পারো অনেকে দলে বেঁধে। কিন্তু মনে রেখো, এখন তোমরা আছো মানুষের মধ্যে। আমার ধারণা, মাথায় বুদ্ধি আছে তোমার। ভালো-মন্দ বুঝবার মতো ক্ষমতাও হবে। মানুষ তো তোমাদের সঙ্গে কোনো বিবাদ করেনি। তাহলে, তোমরা কেন শত্রুতা করছ? মানুষকে হত্যা করা একেবারেই সঠিক কাজ নয়। এটা আমি মানবো না।
বাঘের মুখে কথা নাই। রা-টিও কাড়ছে না সে। মোড়ল আবার বলল-- আমি এখনই তোমাকে এখানেই মেরে ফেলতে পারি। চাইলে গাঁয়ের লোকজন দিয়ে জঙ্গল ঘিরে ফেলতেও পারি। তাতে একটা বাঘও রেহাই পাবে না আমাদের হাত থেকে। বাঘের বংশ ধ্বংস করে দিতে পারি আমরা। কিন্তু এখনও সময় আছে। তোমরা যদি নিজেদের শুধরে নাও, যদি আমার কথা শোন, আমরা কোন ক্ষতিই করব না তোমাদের।
এবারেও কোন উত্তর দিল না বাঘ। চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। মোড়ল বলল-- আমার কথা শোন। এই মুহূর্তে সাত দিন সময় দিলাম তোমাদের। দল গুটিয়ে অন্য পাহাড়ে চলে যাও। গুনে গুনে সাত দিন কিন্তু। ভুলে যেও না। যদি আমার কথা না শোনো, নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনবে তোমরা। তখন আমাকে দোষ দিও না। যে পাহাড়ে মানুষ জনের বাস নেই। হাজার রকম জীবজন্তু আছে। তোমাদের পেট চালাতে কোন অসুবিধা হবে না, সেখানে যাও।
একটু থেমে মোড়ল বলল—বলো, তোমার কি মত। উত্তর দাও। এখনই এই ব্যাপারের ফয়সালা হয়ে যাক।
আবার লাফ দিল বাঘ। মাটিতে নামলো যখন ডিগবাজি খেয়ে, আবার সেই সাধু। বাঘের কোন চিহ্ন নাই। সাধু বলল-- ঠিক আছে। আমি সব বুঝেছি, মোড়ল। তোমার যেমন হুকুম, তেমনটাই আমি করব।
মোড়লের মুখে হাসি। বলল-- এইতো মাথা খুলেছে তোমার। আমার কথা যদি শোনো, যদি মেনে নাও, ভালোই হবে তোমাদের। আর একটা কথা। এতদিন এই পাহাড়ে ছিলে তোমরা। এখন চলে যাচ্ছো। যাওয়ার আগে তোমাদের বড় একটা ভোজ দিতে চাই আমি। যেদিন যাবে, সবাই দল বেঁধে এখানে এসে হাজির হয়ে যেও। পাহাড়তলীতে ফাঁকা জায়গাটা তুমি নিশ্চয়ই চে্নো। সেখানে এসে জমায়েত হবে তোমরা সবাই। সকলের ভোজের ব্যবস্থা করে রাখা হবে। ভোজ খেয়েই চলে যাবে চিরদিনের মত।
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। বনের যত বাঘ পাহাড়তলীতে এসে হাজির হয়েছে সেদিন। সে এক দেখবার মত দৃশ্য। বুনো শুকর মেরে, এলাহী ভোজের ব্যবস্থা করেছে মোড়ল। হাপুস-হুপুস করে পেট ভরে খেল সবাই।
এবার রওনা দেওয়ার পালা। সেই বাঘটা মোড়লকে বলল-- আমার একটা নিবেদন আছে তোমার কাছে।
মোড়ল বলল—বলো, তোমার কী নিবেদন?
বাঘ বলল-- একটা বাঘিনী আছে আমাদের দলে। খুব শিগগিরই বাচ্চা হবে তার। এই ভারী শরীরে অতটা দূরের পথ তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। কষ্টকর হবে খুব। তাকে ক’টা দিন এখানে রেখে যেতে চাই। দেখো, তার যেন কোন বিপদ না হয়।
মোড়ল বলল-- কথা দিলাম। কোন বিপদ হবে না বাঘিনীর। চাইলে সে তার বাচ্চাদের নিয়ে এখানে থেকে যেতেও পারে। তার নিরাপদে থাকবার ব্যবস্থা আমরা করে দেবো। যদি বিশ্বাস করো, তাকে এখানে আমাদের হেফাজতে রেখে যাও।
মোড়লের কথা শুনে বাঘ ভারি খুশি। দলের অন্য বাঘেরাও খুশি হল সে কথায়। তারাও রাজি হয়ে গেল। বাঘের পুরো দলটা পাহাড় গঞ্জ ছেড়ে চলে গেল চিরকালের মতো। কেবল একটা বাঘিনী রয়ে গেল মোড়লের কাছে।
আজও কোরিয়া জুড়ে যে সকল বাঘ দেখা যায়, তারা সেই বাঘিনীরই বংশধর সবাই। ফিরে যায়নি তারা। এখানেই রয়ে গিয়েছে।
0 Comments