মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৭৪
রসিকানন্দ
ভাস্করব্রত পতি
১৫১২ শকাব্দতে তথা ১৫৯০ সালে দীপান্বিতার রাতে রসিকানন্দের জন্ম হয় শাঁকরাইল থানার ডুলুং নদীর ধারে রোহিনী গ্রামে অতি প্রাচীন রোহিনী রাজবংশে। তাঁর বাবা ছিলেন পরহিতকারী ধার্মিক পুরুষ অচ্যুত পট্টনায়ক। আর মা হরিনাম পরায়না ভবানীদেবী। আসল নাম শ্রীরসিকচন্দ্র হলেও বাবা নাম দিলেন মুরারী। স্ত্রীর নাম ইচ্ছাদেবী। এই ইচ্ছাদেবীর বাবা শ্রীবলভদ্র মহাপাত্র ছিলেন কাঁথির বাহিরীর বিভীষণ মহাপাত্রের ভ্রাতুষ্পুত্র। বৈষ্ণবকুলতিলক প্রভু শ্যামানন্দের শিষ্যদের মধ্যে সমধিক জনপ্রিয় ছিলেন রসিকানন্দ।
একসময় গোপীবল্লভপুর এলাকায় একক গুরুর পাঠশালা ছিল। সেখানে গিয়ে ছাত্ররা পড়াশোনা করত। গ্রামের এরকমই এক পাঠশালায় গিয়ে রসিকানন্দ পড়াশোনা করতেন। সেই কাহিনি মেলে গোপীজনবল্লভ দাসের 'রসিকমঙ্গল' কাব্যে --
'উত্তম সে পাঠশালা করিয়া রচন।
বাসুদেব পড়ায়েন অচ্যুত নন্দন।।'
ধীরে ধীরে বড় হতে হতে ব্যাকরণ, কাব্যনাটক, ষড়দর্শন, শ্রীমদ্ভাগবত আত্মীকরণ করলেন অনায়াসে। 'রসিকমঙ্গল' কাব্যে রয়েছে --
'কখন পড়েন পুঁথি বসিয়া নিগমে।
কখন করেন পূজা করিয়া বিধানে।।
কখন করেন গীত নানা ভাষা মতে।
কখন করেন শ্লোক নানা কাব্য অর্থে।।'
১৬১১ সালে তিনি শ্রীশ্রী রসিকানন্দ বৃন্দাবনে যান। সেখানে ব্রজমণ্ডলের দ্বাদশ বন, উপবন, দর্শন করে শ্রীশ্রীগোবর্ধনে যান। কিন্তু সেখানে কখনও চরণ স্পর্শ করেননি। বৃন্দাবন থেকে রোহিণীতে ফিরে দেখেন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়েছে। অচ্যুতানন্দের মৃত্যুর পর রসিকানন্দ সর্বেসর্বা হন। কিন্তু তাঁর মনে তো কেবল রাজ্যাধিকার ছিলনা, তিনি বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের তাড়নায় বিভোর। তাঁর মোট ২০৯ জন শিষ্য ছিল। এছাড়াও বহু শিষ্যা ছিল। তাঁদের নিয়ে তিনি মাতলেন বৈষ্ণবধর্মের প্রচারে। নিজ কুলদেবতাকে নিয়ে স্বপত্নী কাশীপুরে আসেন। ১৬১৪ সালে শ্রীশ্রী শ্যামানন্দ কাশীপুরে এসে যার নামকরণ করেন গোপীবল্লভপুর। এই গোপীবল্লভপুরে প্রতিষ্ঠিত করলেন গোপীবল্লভ রায়কে। ধীরে ধীরে গোপীবল্লভপুর হয়ে ওঠে বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের প্রধানকেন্দ্র। তিনি লিখেছেন 'শ্রীশ্যামানন্দ শতক', 'শ্রীমদ্ভাগবতাষ্টক' সহ আরও অনেক স্তব ও গীত। এই 'শ্যামানন্দশতক' গ্রন্থটি সংস্কৃত সাহিত্য ভাণ্ডারের অন্যতম উজ্জ্বল রত্ন বিশেষ। ব্রজবুলিতে তাঁর লেখা ত্রয়োদশ পদ ভাবসম্পদে সমৃদ্ধ। রসিকানন্দের লেখা পদগুলি বেশ উল্লেখযোগ্য। সন্ন্যাসগ্রহণের সময় শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মস্তকমুণ্ডন নিয়ে তিনি লিখেছেন --
'কহে মধুশীল আমি কি দুঃশীল
কি কর্ম করিনু আমি।
মস্তক ধরিনু পদ না সেবিনু
পাইয়া গোলকস্বামী।।'
রসিকানন্দের মৃত্যু হয় ১৬৫২ সালে। বালেশ্বর জেলার রেমুনা গ্রামে রসিকানন্দের দেহ কবরস্থ করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন --
'রেমুনাতে শ্রীগোপাল চরণে।
আসন করিবে মোর নিশ্চে সেই স্থানে।।
অহর্নিশি সংকীর্ত্তন রঙ্গে নিরন্তর।
বেড়ি সদা নাম গায় সব সহচর।।'
এখানেই রয়েছে ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মন্দির। এখানে পুরী যাওয়ার পথে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু একদিন কাটিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে গোপীনাথের তেরো দিন ধরে মেলা বসে।
তাঁর মৃত্যুর পর এই রাজবংশের নাম পরিবর্তিত হয়ে গোপীবল্লভপুর গোস্বামীবংশ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। রসিকানন্দের মোট তিন ছেলে -- রাধানন্দ, কৃষ্ণগতি এবং রাধাকৃষ্ণ এবং এক কন্যা দেবকী। এই রাধানন্দের লেখা 'রাধাগোবিন্দ কাব্যম' জয়দেবের অনুসরণে লেখা একটি শ্রেষ্ঠ গীতিকাব্য। তিনি শ্রীপাট গোপীবল্লভপুরের গোস্বামী পদে আসীন হন। আর কৃষ্ণগতি বসবাস করেন শ্যামসুন্দরপুরে এবং রাধাকৃষ্ণ যান নিউসেনী গ্রামে।
🍂
0 Comments