জ্বলদর্চি

নির্জন ভূষণে বিভূতি/প্রসূন কাঞ্জিলাল

নির্জন ভূষণে বিভূতি
প্রসূন কাঞ্জিলাল


অনেক পুরোনো দিনের কথা | বি এ পাশ করে হরিণাভির একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেলেন এক তরুণ | একদিন ক্লাসের ফাঁকে স্টাফরুমে বসে আছেন, হঠাৎ একটি অল্পবয়সি ছেলে এসে বলল, চলুন,আমরা দু’জনে মিলে একটা বই লিখি।

সেই তরুণ শিক্ষক মনে মনে হাসলেন | ভাবলেন বই তো দূর অস্ত, কোনও দিন কোনও গল্প, প্রবন্ধ লেখার কথাও তাঁর মাথায় আসেনি | এই ভেবে ওই অল্পবয়সি ছেলেটিকে বারণ করে দিলেন তিনি |

সেই ছেলেটিও ছাড়ার পাত্র নয় | পরের দিন স্কুলে পৌঁছে সেই শিক্ষক দেখেন, যেখানে-সেখানে সাঁটা বিজ্ঞাপন |‘‘শীঘ্র প্রকাশিত হইতেছে....শীঘ্র প্রকাশিত হইতেছে উপন্যাস।’’ সেই শিক্ষকের বুঝতে বাকি রইল না এটা কার কাজ ! মনে মনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি | একবার হাতে পেলে হয় সেই ছেলেকে | অন্যদিকে সহকর্মীদেরও চোখে পড়ল সেই বিজ্ঞাপন | অনেকেই তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, বাঃ, মশাই! আপনি তো বেশ গোপন রসিক দেখছি। তা কবে বেরোচ্ছে উপন্যাস?

কিছুক্ষণ পরেই সেই শিক্ষকের সাথে হঠাৎ দেখা সেই ছেলেটির | ছেলেটাকে কার্যত কলার চেপে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে এইসব রসিকতার মানে কি ? কোন প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছেয় সে এ সব করল ! তাতে ছেলেটি একটুও উত্তেজিত না হয়ে বলেছিল, ভেবেছিলাম দু’জনে মিলে লিখে ফেলব, আর উপন্যাসের নামও ঠিক করে ফেলেছি - ‘চঞ্চলা’ | তার এই ভাবলেশহীন উত্তরে আর কিছু বলতে পারেননি শিক্ষক মশাই |

এদিকে রোজই রাস্তায়, বাজারে, স্কুলে, সকলের একই প্রশ্ন— কবে বেরোচ্ছে উপন্যাস ? কাউকে বলতে পারছেন না যে উপন্যাস তো দূর অস্ত, এমনকী তিনি যে আদৌ লেখক নন, বিজ্ঞাপনটা পুরো মিথ্যে |

একদিন ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল শিক্ষকের | রাতে রাগের চোটে কাগজ-কলম নিয়ে বসে একটি ছোট গল্প লিখলেন। পাঠিয়ে দিলেন কলকাতার একটি মাসিক পত্রিকায় | পত্রিকার নিয়ম অনুযায়ী সঙ্গে একটি ঠিকানা লেখা খাম স্ট্যাম্প সেঁটে পাঠালেন |

তিন দিন পর থেকেই অপেক্ষা। দুরু দুরু বুকে স্কুলে বসে ভাবছেন এই বুঝি খাম ভর্তি অমনোনীত গল্প ফেরত এল | প্রায় সপ্তাহ তিনেক পর সেই খাম এল | দেখামাত্র তিনি খামটা পকেটে চালান করে দিলেন | রাতে বাড়ি ফিরে খুললেন সেই খাম | পেলেন একটি চিঠি | সম্পাদক মশাই লিখেছেন, “আপনার রচনা মনোনীত হয়েছে, শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।”
🍂

১৩২৮, মাঘ মাসের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সেই গল্প | সেটি ছিল তাঁর প্রথম গল্প | নাম  ‘উপেক্ষিতা’। এই গল্পটি সেই বছর শ্রেষ্ঠ গল্পের পুরস্কারও ছিনিয়ে নেয়।

পরবর্তীকালে সেই শিক্ষক তাঁর এক বন্ধুকে বলেছিলেন, ছেলেটি ( সেই ছেলেটির আসল নাম ছিল যতীন্দ্রমোহন রায় ) বোধহয় ঈশ্বরের দূত হয়ে সে দিন তাঁর কাছে এসেছিল। ওই বিজ্ঞাপন কাণ্ডটি না ঘটলে তিনি কোনও দিন লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন না | 
চিনতে পারলেন সেই শিক্ষককে ? 

পরবর্তীতে তিনিই লিখেছিলেন পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ‍্যক, ইছামতী, অশনি সংকেত, চাঁদের পাহাড়, সুন্দরবনে সাতবছর, মেঘমল্লার প্রভৃতি বিভিন্ন কালজয়ী গ্রন্থ |

তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় | বাংলার সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক |

প্রতিদিনের ছোট্ট পৃথিবীটির পান্থশালায়  সাজানো সাহিত‍্যের বাগানে বিকশিত হাজার  ফুলের সুগন্ধময় অফুরন্ত সম্ভারের ভান্ডারে এক অন‍্যতম প্রিয় সাহিত্যিক তথা প্রকৃতি প্রেমিক লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। তাঁরই অতুলনীয় সৃষ্টির ডালি থেকে কিছু  ফুলচয়ন করে বসেছি মালা গেঁথে স্মরণ সভায় সাজিয়ে এই অপরাজেয় ঔপন্যাসিক কে শ্রদ্ধা জানাতে ।   মানব দরদী সুদক্ষ গদ‍্যকার কথাশিল্পীর প্রকৃতি প্রেম এবং প্রকৃতির সাথে সুগভীর অভিন্ন হৃদয়ের সখ্যতার সম্পর্ক আমাকে বারে বারে মুগ্ধ করেছে। তিনি যেন এক সুদক্ষ গদ‍্য লেখক হয়েও প্রকৃতির স্নেহধন্য রূপমোহোজালে আবিষ্ট এক নীরব প্রকৃতির ই প্রেমিক কবি। তাঁর রচনায় সর্বত্র নিখুঁত তুলির টানে প্রতি মূহুর্তে জীবন্ত হয়ে প্রাণ পেয়েছে পল্লীর সমাজ জীবন। সেখানে দারিদ্রের নিষ্ঠুর কষাঘাতে অবহেলিত নারীদের জীবন যুদ্ধের কঠিন সংগ্রামের নিখুঁত প্রতিবাদী ছবি যেমন এঁকেছেন তেমনি তাঁর লেখনীতে স্পষ্ট হয়ে আছে আবহমান কালের চালচিত্রের সাথে নিসর্গের অপরূপ  নিবিড় চিত্র। তাঁর অনুভবের দৃষ্টি তে সূক্ষ্ম বর্ণনায় বার বার ধরা পরেছে বাংলার নদ নদী নালা জল মাটি গাছ পালা ধান ক্ষেত, বন বাদার আকাশ বাতাস সবুজে সবুজ বিস্তৃত মাঠ যেখানে আকাশ মিশেছে নীল সবুজের দীগন্ত রেখার অদৃশ‍্য বন্ধনে।   

তাঁর রচনায় প্রকৃতিদেবী কেবল তার সহজ সরল রূপ টি নিয়েই আবির্ভূতা হন নি বরং প্রকৃতি ও মানব জীবনের সাথে একাকার হয়ে এক অভিনব রসের ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। গাছ ফুল পাখি কীট পতঙ্গের মত মানুষ ও যে প্রকতির ই সন্তান এ সত‍্য তাঁর বিভিন্ন রচনায় বহুবার বলেছেন। পথের পাঁচালী, অপরাজিত তে নিশ্চিন্দপুরের গ্রাম‍্য জীবন বার বার হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে চলে অজানা কোন সুদূরের স্বর্গলোকে। তাঁর মায়াবী চোখে অপরূপ হয়ে দেখা দিয়েছে শ‍্যামল সবুজ প্রান্তর  থেকে রুক্ষমাটির বুক ফাঁটা বেদনা। বাংলার ঋতু বৈচিত্র‍্য। বৈশাখে কালবৈশাখীর ঝড়ে আম কুড়োবার ধুম, আষাঢ় শ্রাবণের বৃষ্টিধারায় জল থৈথৈ মাটির দাওয়া, কুড়ে ঘরে খড়ের চালের ফুটো দিয়ে বিছানা ভিজে যাওয়া। জল পড়ার টপ টপ শব্দ। সর্বজয়ার নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে হরিহরের উদাসীনতা সত্বেও মাতৃ হৃদয়ে সন্তান কে একটু যত্নের সুখের ছায়ায় নিশ্চিন্ত আশ্রয় দেওয়ার অপরিসীম প্রয়াস।ছবির মত চোখে ভাসে আমাদের ই খুব পরিচিত ঘরের অবুঝ শিশু সম বৃদ্ধা মানুষ ইন্দির ঠাকুরুনের অভিমানী মুখ খানি। তার  সাথে জড়িয়ে আছে গাছে দের কথা, ফুলের হাসির নিঃশব্দ ভাষা, পাখির কাকলি,পাহাড়ের নিস্তব্ধতা ঝর্ণার উচ্ছল বয়ে যাওয়ার শব্দে সচকিত প্রাণময় প্রকৃতি প্রেমিক কবি মন। ঘাটশিলায় সুবর্নরেখা নদীর পাথরের ওপর শুয়ে থেকে নদীর অন্তবিহীন ছলছল বয়ে যাওয়ার শব্দ তরঙ্গে বিলীন হতে চেয়েছেন।প্রকৃতির তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তু ও রোমান্টিক লেখকের বর্ননায় চির ভাস্বর হয়ে উঠে অনুভবী মন স্পর্শ করে যায়। 

অনবরত বর্ষার প্রকোপের সাথে ভাদুরে ভরা ইছামতী নদীতে জোয়ারের তীব্রতায় বান্ ডেকেছে  ভাঙন ধরেছে নিশ্চিন্ত পর্ণকুটিরের শান্ত জীবনে।। পুকুরের জলে ফুটে থাকা শালুক ফুল,  আশ্বিনের কাশ ফুলে দোলা লাগা মাঠ প্রান্তর পূজোর গন্ধে মেতে ওঠা বাস্তব জগতে কিছুই না পাওয়া  পল্লীজীবনের চাল চিত্র। সব কিছু পেরিয়ে অপু দুর্গার মত মন ছুটে যায় ছুটন্ত রেলের গাড়ির চাকার আওয়াজে। হেমন্তের মাঠে সোনাল ফসল পাকে। অঘ্রাণ পৌষে ঘরে ঘরে নতুন গুড়, নবান্নে পিঠে পুলির গন্ধ পল্লী গাঁয়ের অপরূপ এক নিপুণ ছবি চোখের পাতা ভিজিয়ে তোলে। আজো মন স্পর্শ করে যায় আরণ‍্যকের একাকী বনচারীর বনভূমিতে ঘুরে বেড়ানো। ভুলতে পারিনা লব টুলিয়ার জ‍্যোৎস্না প্লাবিত বনভূমি। 

অভিভূত হয়ে যাই দেবযান, মেঘমল্লার,বা চাঁদের পাহাড়ের কল্পনার স্বর্গরাজ‍্যে বিচরণ করে । ভুলতে পারিনা হিঙের কচুরির বাস্তব দৃশ্য বা আদর্শ হিন্দু হোটেলের পদ্মরানী কে। তাঁর রচনায় হত দরিদ্র পল্লীবালা থেকে নিম্ন মধ‍্যবিত্ত বাঙালির জীবন চিত্র ও সমকালের আর্থসামাজিক বাস্তবতা ও সমভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা কথা সাহিত‍্যে  বিভূতিভূষণের আসন আজও সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মর্যাদায় ভূষিত হয়ে আছে। পথের পাঁচালির অপু দুর্গার শৈশব-কৈশোর আজও মনকে অনুপ্রাণিত করে। যেমন কৈশোর  থেকে সদ্য যৌবনের দোর গোড়ায় পা দেওয়া অপরাজিতর সুপ্ত জীবনের সৌন্দর্য  মনকে স্পর্শ করে যায়।  

এই নিভৃতচারী প্রকৃতি প্রেমিক লেখককে জানাই আমার প্রাণের সশ্রদ্ধ প্রণাম। খুব খারাপ লাগে ভাবতে  আমাদের  আধুনিক প্রজন্ম নিত্য নতুন আধুনিকতার হাওয়ায় ভেসে হয়তো আগামীতে কখোনো ও জানতে চাইবেনা বা পারবেনা বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যময় এমন মণি মানিক্যের রত্ন ভান্ডারে পরিপূর্ণ ধন সম্পদের হদিশ।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের  "আরণ্যক" উপন্যাসে জঙ্গলবন্ধু যুগলপ্রসাদকে দেখেছি জঙ্গলের মধ্যেই সে বনস্পতির চারা লাগায়; জঙ্গলেই বনসৃজন করে । এ যে তেলা মাথায় তেল দেওয়া নয় ! জঙ্গল কেটে ক্রমাগত বসতি স্থাপন করে, চাষাবাদ করে আমরা বনের ঢাকা-মাটি নগ্ন করে দিয়েছি । বাদাবন কেটে ঝড়-ঝঞ্ঝার অবারিত দ্বার খুলে দিয়েছি । অরণ্য কেবল কেটে ফেলার জিনিস নয়, লুটপাটের জমিদারি নয় -- তা বোধে এবং সংস্কৃতিতে চিরকালই বলে এসেছে সনাতনী সংস্কৃতি । কলোনিয়াল-লুঠেরা-শক্তি ভারতবাসীকে অরণ্য লুঠপাট করতে শিখিয়েছে। কিন্তু প্রাচীন সাহিত্য শিখিয়েছিল অরণ্য ‘দেবতার কাব্য :  " পশ্য দেবস্য কাব্যম্ " । সামীপ্যে সান্নিধ্যে এসেছিল তপোবনের শান্তিনিকেতনে । 

'অরণ্য ষষ্ঠী' তে অরণ্যের উপান্তে গড়ে উঠেছিল এক যুগবাহিত জীবনবোধ । জানপদিক( বিশেষ্য জনপদ-এর বিশেষণ জানপদ পাচ্ছি। কিন্তু অভিধানে জানপদিক শব্দটি পাওয়া যাচ্ছে না)-সংস্কৃতির এক অমূল্য সাধনা । শেষে অরণ্যেই ছড়িয়ে পড়বে ফলের বীজ; তারপরেই আসবে বর্ষা, বীজের সুপ্তি কেটে চারাগাছ বেড়ে উঠবে, অরণ্যের প্রভূত বিস্তার হবে । অরণ্যের মাঝে ফলাহারের এ এক দারুণ উৎসব।

যদিও ‘নির্জন’ শব্দটি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গেই বেশি করে জড়িয়ে রয়েছে এবং অন্তত বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই ‘নির্জন’ শব্দটি দেখলে তাঁর কথাই প্রথমে মনে পড়ে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিভূতিভূষণ তাঁর সময়কার বাংলা সাহিত্যের নির্জনতম ঔপন্যাসিক ছিলেন বললে ভুল কিছুই বলা হয় না। কারণ —বিভূতিভূষণের সমসাময়িক ঔপন্যাসিকেরা যখন মানব জীবনের কোলাহলে মুখর ছিলেন, তখন তিনি সেই সাহিত্যসভার একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে একটি স্নিগ্ধ নিভৃত সুরের আলাপ করতে ব্যস্ত ছিলেন।

বিভূতিভূষণ তাঁর সময়কার গ্রাম-বাংলাকে নিজের দেহ-মনের যুক্ত অঞ্জলিতে গ্রহণ কবেছিলেন। শুধু সেটাই নয়, নিজের ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে তিনি সেই গ্রাম-বাংলার রূপ দেখেছিলেন, সেই রূপকে বরণ করে নিজের মনের ঘরে তুলে নিয়েছিলেন এবং বিশ্বসাহিত্যের সভায় সেই রূপেরই গান গেয়েছিলেন। আর একইসাথে সম্ভবত এখানেই তাঁর দেশপ্রেমিকতার সন্ধান পাওয়া যায়। যদিও দেশকে তিনি কখনোই ‘মা, মা’ বলে উচ্চকণ্ঠে ডেকে ওঠেননি, কিন্তু তবুও তার সঙ্গে সর্বক্ষণ মিশে ছিলেন। নিজের দেশের প্রতি তাঁর এই প্রেমিকতা কখনো সরবে ঘোষিত হয়নি বা কর্মে সক্রিয় হয়নি, বরং সেটা শুধুমাত্র তাঁর অনুভূতিতে সজীব ছিল। মৃদু কলভাষে বাংলার মাটির এমন জয়গান—তাঁর সময়ে বা তাঁর পরেও অন্য কোন বাঙালি ঔপন্যাসিক করতে পারেননি।

গ্রাম-বাংলার লতাপাতা, গাছপালা, মাটির সোঁদা গন্ধ—এসবের কোনোটাই তাঁর কাছে কখনোই অপাঙ্ক্তেয় বা অবান্তর ছিল না। বরং গ্রাম-বাংলার ধুলোমাটি নিজের গায়ে মেখেই তিনি তৃপ্ত হয়েছিলেন, এবং সেই কারণেই তাঁর সাহিত্যের পাতায় পাতায় সেই ধুলোমাটির শ্যামলতা ও তৃপ্তির রোমন্থন খুঁজে পাওয়া যায়। তবে শুধু গ্রাম-বাংলা নয়, বিভূতিভূষণের ‘অপরাজিত’ ,‘আরণ্যক’ প্রভৃতিতে এই পটভূমি আরো বিস্তৃত হয়েছে বলে দেখা যায়। আরো ভালো করে বললে অরণ্য-ভারত এগুলির পরিধিভুক্ত। এভাবেই বিভূতিভূষণের হাতে পড়ে বাংলার সাহিত্য একটি নতুন দিগন্ত লাভ করেছিল। এমনকি তাঁর শেষ গ্রন্থ ‘কুশল পাহাড়ি’ পর্যন্ত তাঁর সাহিত্যে অগণ্য অরণ্যের পদধ্বনি  পাওয়া যায়।
আর এই বিস্তার আসলে তাঁর হৃদয়ের প্রসারের স্বাক্ষরতাকেই বহন করে। শিক্ষিত-সুলভ অভিমানে তিনি এগুলির পিঠ চাপড়াননি বা উপদেশ-বৃষ্টি করেননি; বরং নিজের মধ্যে থাকা আন্তরিক প্রীতি দিয়ে তিনি এগুলির অন্তরের ঐশ্বর্যকে আবিষ্কার করবার চেষ্টা করেছিলেন, এবং অত্যন্ত সৌভাগ্যের কথা যে, এবিষয়ে তিনি ব্যর্থ হননি। 

অরণ্যের সৌন্দর্য ও অরণ্যমানবের সৌন্দর্য তাঁর অনুসন্ধেয় বিষয় এবং তাঁর আনন্দ ছিল। বর্তমান সভ্যতার থাবা যেখানেই এই সৌন্দর্যকে ক্ষত-লাঞ্ছিত করেছিল, সেখানেই তিনি আর্ত হাহাকারে—‘ন হন্তব্যো, ন হন্তবঃ’— বলে উঠেছিলেন। এছাড়া এই আঘাত তাঁকে সময়ে সময়ে এতটাই বিচলিত করে তুলেছিল যে তিনি সমগ্র সভ্যতার দিক থেকেই — বিশেষত শিল্প-সভ্যতার দিক থেকে নিজের মুখ ফিরিয়ে নিতে চেয়েছেন। 

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য-কলা মানুষকে যে-সভ্যতা দান করেছে—সেটাকে তিনি অবশ্যই চেয়েছিলেন, কিন্তু যে সভ্যতা মাটিকে নোংরা ঘিঞ্জি বস্তি দিয়েছে, আকাশকে চিমনির ধোঁয়ায় কালো করেছে, আর মানুষকে অন্তর-বাহিরের সবল সৎ সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত করে কুরূপ দিয়েছে—সে সবের প্রতি তাঁর সীমাহীন
মানসিক বিরূপতা ছিল। আর তাঁর মধ্যে সেই বিরূপতা এতটাই বেশি ছিল যে তিনি আশা করেছিলেন — অরণ্য একদিন সভ্যতার ওপরে নিজের এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবে। এই কারণেই ‘অপরাজিত’ গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন —

“মানুষ প্রকৃতির এই মুক্ত সৌন্দর্যকে ধ্বংস করিতেছে সত্য, গাছপালাকে দূর করিয়া দিতেছে বটে, কিন্তু প্রকৃতি একদিন প্রতিশোধ লইবে। ট্রপিক –এর অরণ্য আবার জাগিবে, মানুষকে তাহারা তাড়াইবে, আদিম অরণ্যানী আবার ফিরিবে। ধরা-বিদ্রাবণকারী সভ্যতাদর্পী মানুষ যে স্থানে সাম্রাজ্য স্থাপন করিয়াছে, পর্বতমালার নাম দিয়াছে নিজের দেশের রাজার নামে, হ্রদের নাম দিয়াছে রাজমন্ত্রীর নামে; ওর শুশুক, পাখি , শিল, বগলা হরিণ, ভালুককে খুন করিয়াছে তেল, বসা, চামড়ার লোভে, ওর মহিমময় পাইন অরণ্য ধূলিসাৎ করিয়া কাঠের কারখানা খুলিয়াছে, এ সবের প্রতিশোধ একদিন আসিবে।”

মানুষের অতিরিক্ত লোভ নিশ্চয়ই অকাম্য, কিন্তু মানব সভ্যতার রথ তেল- বসা -চামড়া-কাঠ ছাড়া কী করে চলবে! বিভূতিভূষণ কিন্তু সে চিন্তা কখনোই করতে চাননি, সভ্যতাকে তার সৌন্দর্যগ্রাসী ভয়াবহতা থেকে মুক্ত করে সৌন্দর্য্যের সঙ্গে কীভাবে পরিণীত করা যায় — সে সম্পর্কে তিনি কখনোই মাথা ঘামাতে চাননি। বাস্তবে যে কোন সৌন্দর্য্যপ্রাণ লেখকই সৌন্দর্যের বিন্দুমাত্র লোকসান দেখলেই ভাবাবেগে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েন যে, তখন কোন ধরণের যুক্তিচালিত চিন্তা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই শুধু ওই বিশেষ মুহূর্তগুলিতেই নয়, বরং কোন সময়েই তিনি এসবের মনন-বিশ্লেষণে কোনও ধরণের আগ্রহ দেখাননি। কারণ — ‘অপরাজিত’ অনুসারে — তাঁর মতে বিস্ময়টা ‘mother of philosophy’ ছিল না, বরং বিস্ময়ই তাঁর কাছে 'ফিলোসফি' এবং বাকিটা সেটার অর্থসঙ্গতিমাত্র ছিল। তাই নিজের চিন্তাজগতে তিনি কোন ঘটনারই অর্থসঙ্গতি করতে চাননি, বরং তিনি শুধু বিস্ময়রসকে আকণ্ঠ পান করতে চেয়েছিলেন। আর সেই পান-উপভোগে বাধা পড়লেই তিনি একটি শিশুর মতোই অযৌক্তিক বিক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। এছাড়া বিভূতিভূষণের অভিশাপ-বাণী উচ্চারণ করবার ভঙ্গি দেখে এ কথাই মনে হয় যে আগামী সভ্যতা-অরণ্য সংঘর্ষে অরণ্য সভ্যতাকে সমুচিত শাস্তি দিলেও বিভূতিভূষণকে সে যেন রেহাই দেবে বলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন, তিনি কল্পনা করে নিয়েছিলেন যে—সে জানে যে বিভূতিভূষণ অরণ্যকে কত ভালবাসেন। তবে অরণ্যের প্রতি তাঁর যত অনুরাগই থাকুক না কেন, উক্ত সংঘাতে তিনি যে মানব-সভ্যতার স্বপক্ষে নিয়তি - নির্দিষ্ট, বিভূতিভূষণ সে কথা কখনোই ভুলে যাননি। আর সৌন্দর্যগ্রাসী মানবসভ্যতাকে একথা বলে শাসিয়েছিলেন যে, অরণ্যের শক্তি —

" বিপুল, বিশাল, বিরাট । অসীম ধৈর্যের ও গাম্ভীর্যের সহিত সে সংহত শক্তিতে চুপ করিয়া অপেক্ষা করিতেছে, কারণ সে জানে তাহার নিজ শক্তির বিপুলতা। ওই শক্তিটা ধীরভাবে শুধু সুযোগ প্রতীক্ষা করিতেছে মাত্র।” (অপরাজিত)

অবশ্য এই উক্তি থেকে এমন কোন সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয় যে, তাঁর মধ্যে মানবপ্রীতি ছিল না। তিনি সভ্যতার বলদর্পী নিষ্ঠুর, লোভী, সৌন্দর্য-সংহারক মূর্তিকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। মানুষের জটিলতা, লোভ, উচ্চাশা, নির্মমতার প্রতি তাঁর আন্তরিক বিরাগ ছিল। তিনি গ্রামীণ ও আরণ্য মানুষদের ভালোবাসতেন, যাঁরা মনে-মুখে এক, জীবন-আচরণে সৎ ও সরল, এবং মনোজীবনে ভাবুক ছিলেন। আর এই কারণেই তাঁর সাহিত্যে এঁদেরই জয়গান দেখতে পাওয়া যায়।

 বিভূতিভূষণের প্রকৃতিজগৎ শুধু গাছ-পাখি-মাটি নিয়ে ছিল না, এসব মানুষেরাও সেটার একটা অংশ ছিল। মানুষ তাঁর প্রকৃতি জগৎ থেকে নির্বাসিত ছিল না, বরং জৈব-সূত্রে যুক্ত ছিল, সাহিত্যে তাঁর সৃষ্ট মানুষগুলি শ্যামল-সুন্দর প্রকৃতি-পরিবারের অন্যতম সদস্য ছিল। নিজের দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি এই প্রীতির জন্যই অতীতের অনেক সাহিত্য সমালোচক তাঁর জন্য ‘দেশপ্রেমিক’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। যদিও বর্তমান সময়ে এই শব্দটি অতি ব্যবহৃত, কিন্তু বিভূতিভূষণের ক্ষেত্রে এই ব্যবহারটা যে কোন ধরা-বাঁধা অর্থে করা হয়নি, সেকথা একটু আগের আলোচনা থেকেই স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। কিন্তু তবুও তাঁর ক্ষেত্রে এই শব্দটি গ্রহণ করবার পিছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে বলেও দেখতে পাওয়া যায়।
অতীতের কেউ কেউ এই অভিমত পোষণ করেছিলেন যে — তাঁর রাজনৈতিক সাহিত্যের অভাব রয়েছে বলে বিভূতিভূষণের মধ্যে দেশপ্রেম অনুপস্থিত ছিল। তাঁর ভালোবাসা ছিল ভাবুকের ভালোবাসা, সেটা কোন কর্মবীর বা চিন্তাবীরের ভালবাসা ছিল না। তাঁর প্রেম ছিল নিস্ক্রিয় , সেটা সক্রিয়তায় উদ্বুদ্ধ ছিল না। তাঁদের এই অভিযোগের উত্তরে বলা চলে যে, একথা সত্যি যে, তিনি সমকালীন দেশের সমস্যা নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাননি ; আর ভালো করে বললে সমকালীন দেশের কোন সমস্যা নিয়েই তিনি বিশেষ মাথা ঘামাতেন না। তিনি কখনো প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেননি, দেশ-সমস্যার আলোচনা করে কোন উপন্যাসও লেখেননি। কিন্তু তবুও একথা ভুলে যাওয়ার নয় যে, তখন আশেপাশে যেসব সাধারণ মানুষরা ছিলেন অথচ তাঁরা অন্যদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, এই দেশেরই অতি-সাধারণ সৌন্দর্য— যেটা তখন মানুষের দাওয়ার পাশে অবহেলিত অবস্থায় ছিল, তিনিই কিন্তু সে সবকে নিজের সাহিত্যের মাধ্যমে স্বীকৃতি দান করেছিলেন। আর তাই সমকালীন মানুষের জীবনসংগ্রামের সক্রিয় রূপ হয়তো তাঁর চোখে পড়েনি। বরং তিনি মানুষের সততা ও সরলতা দেখতে পেয়েছিলেন, সেগুলিই তাঁর মনের তারে সুর তুলেছিল, আর সেগুলিকেই তিনি বেশি করে বাজিয়েছিলেন।

 আরো ভালো করে বললে— তাঁর মনে কখনোই কোন রকমের রুদ্র  সুর বেজে উঠত না। তাঁর সাহিত্যে শিব ধ্যানস্থ ও তন্ময় ছিলেন, সেখানে কখনোই তাঁকে প্রলয়-নৃত্যশিল্পীরূপে দেখা যায়নি। আর এখানেই সম্ভবত তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল। তাঁর জগৎ তাঁর মনের সঙ্গে সুর-মেলানো ছিল। সেখানে বহু সুর থাকলেও বৈচিত্র্য ছিল না। বৈচিত্র‍্যের অসম সুরের সাধনা তাঁর ছিল না, বরং বহু সুরের সাম্যতাই তাঁর কাম্য ও আয়ত্তাধীন ছিল; আর তাই সুরের এই একাত্মতায় তিনি আত্মহারা এবং সীমিত, আত্মস্থ ও নির্জন ছিলেন।

 এই নির্জনতাকে তিনি— ‘as a bride’ —চেয়েছিলেন। এই কারণেই  ‘তৃণাঙ্কুর’ গ্রন্থে  তিনি লিখেছিলেন —

“এমার্সন বলেচেন, ‘Every literary man should embrace solitude as a bride’। এ সম্বন্ধে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক হিউ ওয়ালপোল বড় চমৎকার একটা প্রবন্ধ লিখেচেন। নির্বাসিত দান্তে বলেছিলেন, ‘কী গ্রাহ্য করি আমি, যতক্ষণ আমার মাথার ওপর আছে নীল আকাশ আর অগণ্য তারকালোক।’ জার্মান মিষ্টির একহার্ট (Meister Eckhart) কখনো লোকের ভিড়ে বা শহরের মধ্যে থাকতে ভালবাসতেন না।”

যদিও ‘স্মৃতির রেখা’ গ্রন্থে তিনি বলেছিলেন —

“এই যুগে জন্মে আমি সকল রকম বিচিত্র জীবন-ধারার অভিজ্ঞতা চয়ন করে তার কাহিনি লিখে রেখে যাব।”

কিন্তু তাঁর সাহিত্যের দিকে তাকিয়ে এ কথা  নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, যুগের বিচিত্র জীবনধারার সাধনা তিনি কখনোই করেন নি। এ ছাড়া উক্ত গ্রন্থে তিনি এও বলেছিলেন —

“আমি সেই জগতে ডুবে থাকতে চাই—সেটা আমারই কল্পনায় গড়া আমারই নিজস্ব জগৎ, আমার চিন্তা, শিক্ষা, কল্পনা, স্মৃতি সব উপকরণে গড়া।”

সাহিত্য সমালোচকদের মতে — বাস্তবেব বিচিত্র জীবন ধারা ও কল্পনার নিজস্ব জগৎ— এই দু’য়ের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে তিনি বিশেষ কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এই কারণেই নিজের কাহিনির কাঠামো তিনি নিখুঁত বাস্তব থেকে আহরণ করে সেটার ওপরেই নিজের স্বপ্নজগৎ গড়ে তুলেছিলেন। তিনি নিজের চোখে নিয়ত দেখা অতি-পরিচিত জগৎ-সংসারের ভিত্তি-ভূমিতে রূপকথার সৌধ রচনা করেছিলেন। আর এই কারণেই তাঁর বাস্তব ঘরে খেলাঘরের স্বাদ পাওয়া যায়।

বিভূতিভূষণের দ্বন্দ্ব-ভীরু মন প্রায় সর্বত্রই দ্বন্দ্বকে এড়িয়ে চলেছিল। শুধু একটিমাত্র গ্রন্থ—আরণ্যকে তাঁর স্বপ্ন ও বাস্তব এক অনিবার্য সংঘাতের বেদনায় ট্র্যাজিক মহিমা লাভ করেছিল বলে দেখা যায়। কিন্তু এটি ছাড়া অন্য কোন জায়গাতেই তিনি ট্র্যাজেডির লেখক হয়ে ওঠেননি, বরং লিরিকের কবি হয়েছিলেন। শুধুমাত্র তাঁর আরণ্যকেই লিরিক প্রবণতার অন্তরালে এক সূক্ষ্ম ট্র্যাজিক ক্রন্দনের প্রবাহ দেখতে পাওয়া যায় ।।

Post a Comment

0 Comments