অক্ষয়কুমার দত্ত ও বিদ্যাসাগর -- এক অটুট বন্ধুত্বের স্মৃতিকথা
প্রসূন কাঞ্জিলাল
অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন মনন ও আচরণে বিদ্যাসাগরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। উনিশ শতকের বাঙালি জীবনে এই দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র গভীর ও স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। বাঙালিআত্মবিস্মৃত জাতি। বিদ্যাসাগরকে ভুলে না গেলেও তাঁর আদর্শ আমরা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছি, আর অক্ষয়কুমার দত্তকে মনেই রাখিনি।
তিনি ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও লেখক৷ পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনায় মগ্ন থেকে অক্ষয়কুমার বুদ্ধিজীবী বাঙালী মানসে এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের চর্চা এবং স্কুলপাঠ্য বইয়ে অতি সহজ-সরল ভাষায় বিজ্ঞানের ধারণা প্রদানের প্রয়াসে তিনিই ছিলেন পথপ্রদর্শক। সম্প্রতি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘লোকাল সেল্ফহুড, গ্লোবাল টার্নস : অক্ষয়কুমার দত্ত অ্যান্ড বেঙ্গলি ইন্টেলেকচুয়াল হিস্ট্রি ইন দ্য নাইন্টিনথ সেঞ্চুরি' গ্রন্থে লেখক সুমিত চক্রবর্তী প্রথমেই অভিযোগ করেছেন যে উনিশ শতকের বাংলাতে ইতিহাসচর্চায় অন্যান্য সমাজ ও ধর্মসংস্কারক,চিন্তাবিদ সাহিত্যিকদের তুলনায় অক্ষয় দত্ত অবহেলিত। অভিযোগটি একশো শতাংশের বেশি সত্যি। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, এই রকম একজন যুগপুরুষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নীরবতা। অথচ তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের দীর্ঘদিনের পরিচিত, দেবেন্দ্রনাথের তত্ত্ববোধিনী মাসিক পত্রিকার টানা বারো (১৮৪৩-১৮৫৫) বছরের সম্পাদক, দ্বিজেন্দ্রনাথ ও সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন অক্ষয়কুমারে বিমোহিত ও প্রভাবিত, সর্বোপরি অক্ষয়কুমারের দৌহিত্র কবি সত্যেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্র। তবু রবীন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমার সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব থেকেছেন। এই নীরবতার কারণস্বরূপ পিতা দেবেন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমার দত্তের মতবিরোধ তথা সম্পর্কের টানাপোড়েনই দায়ী বলে অনুমান করা হয়। অক্ষয় দত্তকে নিয়ে লিখতে গেলে উভয়ের সম্পর্ক তথা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার প্রসঙ্গ অবশ্যম্ভাবী। সেটা বর্ণনা করতে গেলেই অক্ষয় দত্তের আধুনিকতা তথা প্রগতিশীলতা, পক্ষান্তরে পিতার রক্ষণশীলতা প্রকাশ হয়ে পড়তো। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে মিথ্যাচার সম্ভব নয়। তাই নীরবতাই শ্রেয়। কিন্তু অন্যান্যদের সে দায় ছিল না। তাহলে বিনয় ঘোষ প্রমুখ বিদ্যাসাগর-গবেষকরাও অক্ষয়কুমার সম্পর্কে খুবনএকটা আলোকপাত করলেন না কেন? পরবর্তীকালে অবশ্য শ্রদ্ধেয় ডাক্তার শঙ্করকুমার নাথ, আশীষ লাহিড়ী, মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম, সুমিত চক্রবর্তী প্রমুখের চেষ্টায় এই অভাব অনেকটা দূর হয়েছে।
🍂
বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয়কুমার দত্ত— দুজনেরই জন্ম ১৮২০ সালে।।কিন্তু দুজনের ঘনিষ্ঠতার শুরু সম্ভবত ১৮৪৮ সালের মাঝামাঝি। অর্থাৎ পরিণত বয়সের বন্ধুত্ব। বিহারীলাল সরকার খুব সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন—
.... “ শোভাবাজার রাজবাটীতে অক্ষয়কুমার দত্তের সহিত বিদ্যাসাগরের আলাপ-পরিচয় হয়। তখন অক্ষয়বাবু তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
তত্ত্ববোধিনী-র সঙ্গে আনন্দকৃষ্ণ বসু প্রমুখ অন্যান্য অনেক কৃতবিদ্যের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। আনন্দকৃষ্ণবাবুর মুখে শুনিয়াছি— বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়বাবু উভয়েই রাজবাটীতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ইংরেজি, অঙ্ক ও সাহিত্য পড়িতে যাইতেন।
তাঁহারা ছাদের উপর বসিয়া খড়ি দিয়া, অঙ্ক পাতিয়া জ্যামিতির প্রতিজ্ঞা পূরণ করিতেন।
তখনও কিন্তু উভয়ের মধ্যে পরিচয় হয়নি। সেটা হল আরও কয়েকদিন পরে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার বিভিন্ন লেখা আনন্দকৃষ্ণবাবু প্রমুখরা সংশোধন করে দিতেন। একদিন বিদ্যাসাগরের উপস্থিতিতে আনন্দকৃষ্ণবাবুর কাছে অক্ষয় দত্তের একটি লেখা সংশোধনের জন্য আসে। উনি স্বভাবতই বিদ্যাসাগরকে পড়ে শোনান। শুনে বিদ্যাসাগরের মনে হল অনুবাদটি একটু আড়ষ্ট। তাই তিনি বললেন, “লেখা বেশ বটে; কিন্তু অনুবাদের স্থানে স্থানে ইংরেজি ভাব আছে।”
আনন্দকৃষ্ণবাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়কে তাহা সংশোধন করিয়া দিতে বলেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয় সংশোধন করিয়া দেন। এইরূপ তিনি বারকতক সংশোধন করিয়া দিয়াছিলেন। অক্ষয়বাবু সেই সুন্দর সংশোধন দেখিয়া বড়ই আনন্দিত হইতেন, কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয়কে জানিতেন না। আনন্দকৃষ্ণবাবুর মাধ্যমে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহিত পরে তাঁহার আলাপ-পরিচয় হয়। ইহার পর অক্ষয়বাবু যাহা কিছু লিখিতেন, তাহা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখাইয়া লইতেন।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ও সংশোধন করিয়া দিতেন। পরস্পরের প্রগাঢ় সৌহার্দ্য সংগঠিত হয়।“
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করবার পূর্বে , অক্ষয় বাবুকে ও সেই সম্বন্ধে “পেপার-কমিটী”র সভ্যদিগের মতামত নিতে হত। তার একটা প্রমাণ দেওয়া হলো ---
“কবিপন্থীদিগের বৃত্তান্ত-বিষয়ক পাণ্ডুলেখ্য প্রেরণ করিতেছি, যথাবিহিত অনুমতি করিবেন।”
তত্ত্ববোধিনী সভা,
শ্ৰী অক্ষয়কুমার দত্ত,
১৭৭০ শক, ১৪ই আষাঢ় ।
“গ্রন্থ-সম্পাদক"।
“প্রেরিত প্রস্তাব পাঠে পরিতোষ পাইলাম। ইহা অতি সহজ ও সরল ভাষায় সুচারুরূপে রচিত ও সঙ্কলিত হইয়াছে। অতএব পত্রিকায় প্রকাশ বিষয়ে আমি সন্তুষ্ট চিত্তে সম্মতি প্রদান করিলাম।
ইতি —
“শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰ শর্মা ”
“শ্ৰীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উক্ত পাণ্ডুলেখ্যর স্থানে স্থানে যে সকল পরিবর্তন করিয়াছেন, তাহা অতি উত্তম হইয়াছে।”
-'তারাচরণ মুখোপাধ্যায়'।
যদিও পত্রিকার পথ চলা শুরু হয় মূলত ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচার ও বেদান্ত সাহিত্য চর্চার উদ্দেশ্যে। কিন্তু অচিরেই এই পত্রিকায় ইতিহাস, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ নির্ভর বিভিন্ন লেখা প্রকাশ হতে থাকে।
সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তের ইচ্ছা এবং বিদ্যাসাগরের প্রেরণায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার এই পরিবর্তন সম্ভব হয়। একটা পর্যায়ে এসে সম্পাদক অক্ষয়কুমারের সাথে নিয়োগকর্তা দেবেন্দ্রনাথের নিয়মিত তর্ক-বিতর্ক ও মতান্তর ঘটেছে মূলতঃ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ নির্ভর বিভিন্ন লেখাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যাসাগরের সমর্থন ছিল অক্ষয়কুমারের পক্ষে। এই সময় বিদ্যাসাগর এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তত্ত্ববোধিনীর পথ নির্নয় এবং গুনমান নির্ধারণে। বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান প্রবন্ধ এমনকি কখনো কখনো সম্পাদকীয় ও লিখতে হতো বিদ্যাসাগরকে। ক্রমশ বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, সমাজতত্ত্বের আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশে সেই সময় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার অবদান যেমন অস্বীকার করা যাবে না, তেমনই তত্ত্ববোধিনীকে ওই উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার নেপথ্যে বিদ্যাসাগরের অবদানকেও স্বীকার না করার স্পর্ধাও করা যায় না।
যতি চিহ্ন ব্যবহারে অক্ষয় দত্ত ছিলেন পথিকৃৎ। অনেকেই বলেন, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় (১৮৪৮-র ফেব্রুয়ারি মাসের পত্রিকার ৬৭ সংখ্যা থেকে প্রকাশনা শুরু) বিদ্যাসাগরের মহাভারতের বাংলা অনুবাদের রচনাশৈলী অক্ষয় দত্তের দ্বারা প্রভাবিত। অর্থাৎ সাহিত্য ক্ষেত্রে উভয়ই পরস্পরের পরিপূরক। বিহারীলাল সরকার এটা স্বীকার করেছেন - ---
“সাহিত্য-ক্ষেত্রে অপূর্ব শুভ সংযোগ। এ শুভ সংযোগের দিন বাঙ্গালীর চিরস্মরণীয়। উভয়ে বাংলা ভাষা পুষ্টিসাধনের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।অডিসন্ স্টিলের শুভ সংযোগে ইংরেজি সাহিত্য প্রসারের শুভলক্ষণ ভাবিয়া আজিও বিলাতবাসী ইংরেজ আনন্দে উৎফুল্ল হন। হয়তো অনেক আধুনিক ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙ্গালী এই শুভসংযোগের দিনকে জাতীয় উৎসবের দিন বলিয়া মনে করিয়া থাকেন; কিন্তু বাংলার অক্ষয়কুমার ও বিদ্যাসাগরের শুভ সংযোগ, কয়জন বাঙ্গালী স্মরণ করেন ?”
না, উনিশ শতকে বাঙালি করেননি, একুশ শতকেও করেন না। বিহারীলাল কেন এই ‘শুভ-সংযোগকে বাঙালির জাতীয় উৎসবের দিন রূপে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন? মনে হয়, বাঙালি জীবনের বিচ্ছিন্নতা এবং পরস্পরের মত পার্থক্য উনিশ শতকে বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। এই ‘শুভ সংযোগ’ সেই বিপর্যয়ের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সমকালের পত্রিকায়ও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায় ৷
‘পণ্ডিত বিদ্যাসাগর ও বাবু অক্ষয়কুমার দত্ত দুইজনে বঙ্গভাষার দুই হস্ত।...
এমন শিক্ষিত বা অৰ্দ্ধ-শিক্ষিত বাঙালী কেহ নাই যিনি বলিতে পারেন, “আমি এই ব্যক্তির পুস্তক স্পর্শ করি নাই”।’
শুধু সাহিত্য নয়, জীবনের সমাজ-সংস্কৃতিতে এই বন্ধুত্ব দুজনেরই উপকার করেছিল। তবে অনেক বেশি উপকৃত হয়েছিল বাঙালি সমাজ, যা আজও বিদ্যমান ।
এই বন্ধুত্বের (‘শুভ-সংযোগ') প্রথম ফল অক্ষয় দত্তের উদ্যোগে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার ‘পেপার কমিটিতে বিদ্যাসাগরের যোগদান। ১৮৪৭ সালে তত্ত্ববোধিনী সভার অন্তর্গত গ্রন্থাধ্যক্ষ-সভা নামে একটি সভা গঠিত হয়, যার অনুমতি ছাড়া তত্ত্ববোধিনী সভা থেকে কোনও পুস্তক বের হতে পারত না। অক্ষয় দত্ত ছিলেন গ্রন্থ-সম্পাদক। আদতে দেবেন্দ্রনাথের উদ্যোগে এশিয়াটিক সোসাইটির ‘পেপার কমিটি'-র অনুকরণে এটা গঠিত হয়। ১৮৪৮ সালে অক্ষয় দত্তের প্রস্তাবে ও অন্যান্য সভ্যগণের সমর্থনে বিদ্যাসাগর এই কমিটির সভ্য হন। বিদ্যাসাগর ব্যতীত ওই সভার বাকি সদস্যরা ছিলেন আনন্দকৃষ্ণ বসু, রাজনারায়ণ বসু, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাধাপ্রসাদ রায়, শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়, প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী ও আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ (তথ্যসূত্র বিহারীলাল সরকারের বিদ্যাসাগর, পৃ. ৭৭)। এই সূত্রেই বিদ্যাসাগর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় লেখা শুরু করেন। মনে রাখা দরকার—
‘ব্রাহ্ম-সমাজের সহিত বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোন সম্বন্ধ ছিল না। পেপার কমিটি বা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সঙ্গে সম্বন্ধ ছিল, কেবল সাহিত্যের সংস্রবে, ধর্মের টানে নহে।’
কিন্তু এটা তো প্রত্যক্ষ ফল। পরোক্ষে দুজনেরই দুটি উপকার হয়েছিল।
প্রথমত অক্ষয় দত্ত, ব্রাহ্ম সমাজের ধর্মীয়-গোঁড়া মনোভাবের মধ্যে একাকী হয়ে পড়েছিলেন। এর চরমরূপ ১৮৫৫ সালে অক্ষয় দত্তের পদত্যাগ। কিন্তু মধ্যবর্তী (১৮৪৮-১৮৫৫) সাত বছরে অক্ষয় দত্তের একলা-নির্বান্ধব অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল বিদ্যাসাগরের বন্ধুত্ব-সাহচর্য। ফলে কালক্রমে অক্ষয় দত্ত ব্রাহ্ম সমাজের প্রগতিশীল দলের প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলেন। অনেকেই বলতে পারেন, অক্ষয় দত্ত স্বয়ং ব্রাহ্ম হয়েও ব্রাহ্ম সমাজে বিচ্ছিন্ন হবেন কেন? আসলে তাঁর কাছে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ ছিল নিতান্তই সামান্য-তুচ্ছ বিষয়। মূলে ছিল কাণ্ডজ্ঞান। তিনি সমমনস্কদের সঙ্গে দলবেঁধে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রগতিশীল চিন্তাধারার জন্য ক্রমশই একলা হয়ে পড়ছিলেন, যেহেতু দুজনেই একই চেতনা-স্তরে বিরাজ করতেন, তাই বিদ্যাসাগর ছিলেন তাঁর প্রধান ভরসা।
অপরদিকে ব্রাহ্মসমাজের ধর্মীয় পরিবেশেও বিদ্যাসাগর তাঁর কাজের একটা উপযুক্ত, উদার, সংবেদনশীল পরিমণ্ডল পেয়েছিলেন। তখন রাধাকান্ত দেব (যিনি বিদ্যাসাগরকে অত্যন্ত স্নেহ করলেও, বৈষয়িক বা ধর্মীয় কারণে বিধবাবিবাহ প্রচলন সমর্থন করেননি)-এর নেতৃত্বে বাঙালি হিন্দু সমাজের অধিকাংশ, সমকালের অধিকাংশ পত্র পত্রিকা (সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তো ব্যক্তিগত আক্রমণ পর্যন্ত করতেন) বিদ্যাসাগরের তীব্র বিরোধিতা করতেন। এমতাবস্থায় বিধবাবিবাহ, স্ত্রীশিক্ষা, মাতৃভাষায় শিক্ষা ইত্যাদির প্রেরণা তিনি তত্ত্ববোধিনী সভার পরিমণ্ডল থেকে পেয়েছেন। উপরন্তু তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ও তার সম্পাদক অক্ষয় কুমার দত্ত ছিলেন বিদ্যাসাগরের সকল সমাজসংস্কার কর্মে প্রধান প্রচারক ও সমার্থক।
আদর্শগত লড়াই ও আন্দোলনে অক্ষয় দত্ত সর্বদা বিদ্যাসাগরের পাশে থাকতেন, আবার ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনায় বিদ্যাসাগর বন্ধুর মতো পাশে থেকেছেন, সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন।
১৮২০ সালে নবদ্বীপের কাছে চুপী গ্রামে অক্ষয় দত্তের জন্ম হয়। দশ বছর বয়সে খিদিরপুরে আসেন। ষোল বছরে গৌরমোহন আঢ্য প্রতিষ্ঠিত স্কুল ওরিয়েন্টাল সেমিনারি-তে ভর্তি হন। কিন্তু তিন বছরের মাথায়, বাবার মৃত্যুর কারণে, জীবিকা অর্জনে বাধ্য হন। ১৮৪০ সালে, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর সৌজন্যে, তত্ত্ববোধিনী সভা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পাঠশালাতে ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষকতা লাভ করেন। পরে ১৮৪৩ সালে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হলে সম্পাদক হন এবং দারিদ্র দূর হয়। তিনি প্রথম বারো বছর পত্রিকার সম্পাদক।
১৮৫৫-র ১৭ জুন বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে নর্মাল স্কুলের প্রথম শ্রেণীর শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। ক্ষীণজীবী ছিলেন। বেশিদিন চাকরিটা করতে পারেননি।১৮৫৫-এ অসুস্থ হয়ে পরেন, যা থেকে তাঁর নিরাময় হয়নি। ১৮৮৬ সালে মৃত্যু হয়। জীবনের অবসরকাল উত্তরপাড়া-বালির গঙ্গাতীরে এক উদ্যানবাড়িতে উদ্ভিদ তত্ত্বের আলোচনা করে কাটিয়েছিলেন।
লেখক হিসাবে অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন বিদ্যাসাগরের পূর্বসূরী। বিদ্যাসাগরের প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার আগেই তাঁর ‘ভূগোল’ (১৮৪১) এবং ‘শ্রীযুক্ত ডেভিড হেয়ার সাহেবের নাম স্মরণার্থ তৃতীয় সাম্বৎসরিক সভার বক্তৃতা' (১৮৪৫) নামক দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়’, শারীরিক অপটুতার মধ্যেই লিখিত। ভারতবর্ষীয় উপাসক-সম্প্রদায়-এর প্রথম ভাগ (১৮৭০) ও দ্বিতীয় ভাগ (১৮৮৩) সম্ভবত উনিশ শতকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গদ্য রচনা। আশীষ লাহিড়ীর মতে এই গ্রন্থ তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার ফল।
ভারতবর্ষের উপাসক সম্প্রদায় সম্পর্কে এত মৌলিক তথ্য পরবর্তী কোনও রচনাতেও পাওয়া যায় না। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর দুজনেই বইটির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল হিন্দু স্মৃতি ও দর্শনশাস্ত্র অসাড় নয়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে প্রকৃত সারবত্তা খোঁজা আমাদের কর্তব্য।
শিশুপাঠ্য ‘চারুপাঠ’-এর তিনটি ভাগই তৎকালে খুবই জনপ্রিয় ছিল।
একটা মজার গল্প প্রচলিত আছে। বালির উদ্যানবাড়ি দেখতে গিয়ে বিদ্যাসাগর রসিকতা করে বাড়িটিকে চারুপাঠের চতুর্থ পাঠ বলে অবহিত করেন। প্রকৃতপক্ষে এই জনপ্রিয় পাঠ্যপুস্তকগুলি তাঁর আয়ের প্রধান উৎস ছিল। এছাড়াও তাঁর রচিত ধর্মনীতি (১৮৫৬), পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬), প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্য বিস্তার (১৯০১ সালে মৃত্যুর পর প্রকাশিত) প্রভৃতি গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা’। কথাটি অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পর্কেও সমানভাবে সত্য। তিনি বিদ্যসাগরের পরম বন্ধুও ছিলেন। তাঁরা দুজনই যুগপৎভাবে বাংলা ভাষা গদ্যের মজবুত ও আধুনিক ভিত্তি নির্মাণ করে গেছেন।
সকল বাঙলা-ভাষা-প্রেমিক দু-বন্ধুর কাছেই ঋণী। রসসাহিত্যের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর বাঙলা ভাষার শরীরে লাবণ্যের সঞ্চার করেছিলেন, আর অক্ষয় দত্ত দান করেছেন দার্ঢ্য। আর একটি মহান কীর্তি বাংলা প্রতিশব্দর সৃষ্টি। তাঁর সৃষ্ট বহু শব্দ, যেমন কম্পাস, মাধ্যাকর্ষণ, দ্রাঘিমা প্রভৃতি বাংলার নিজস্ব শব্দভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। এছাড়া প্রসন্নচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে যৌথ ভাবে "বিদ্যাদর্শন" নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করতেন। (১৮৪২ সালে মাত্র ছয়টি সংখ্যা বেরিয়েছিল।)
বিদ্যাসাগর অক্ষয় দত্তের পরিণত বয়েসের বন্ধু। পরিচয়ের পর থেকেই অক্ষয় দত্তের আর্থিক অবস্থা বিদ্যাসাগরকে পীড়িত করত। তিনি বোধহয় সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। বাংলায় শিক্ষাকার্যক্রম চালু হলে বিভিন্ন স্কুল দেখাশোনার জন্য ‘ডেপুটি ইন্সপেক্টরের পদ সৃষ্টি হয়। গুণমুগ্ধ বিদ্যাসাগর বন্ধু অক্ষয়কুমারের জন্য চাকরিটার ব্যবস্থা করেন। মাসে দেড়শো টাকার বেতন। অত্যন্ত লোভনীয় ৷
তদুপরি সাহেবদের সঙ্গে ওঠাবসার সুযোগে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির সম্ভাবনায় সেকালের মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে এই রকম চাকরি ছিল হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। কিন্তু তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদকের কাজ ছাড়তে অক্ষয় দত্ত রাজি হলেন না। কারণটা শিবনাথ শাস্ত্রী সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন—
‘ইতিমধ্যে অর্থোপার্জ্জনের কত উপায় তাঁহার হস্তের নিকট আসিয়াছে,তিনি তাহার প্রতি দৃকপাতও করেন নাই। তত্ত্ববোধিনীর সম্পাদনা কার্য্যে তিনি এমনি নিমগ্ন ছিলেন যে এক এক দিন জ্ঞানালোচনাতে ও প্রবন্ধ লিখতে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া যাইত, তিনি তাহা অনুভবও করতে পারিতেন না। ‘
বিদ্যাসাগর কিন্তু হাল ছাড়লেন না। ১৮৫৫ সালের জুলাই মাসে নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হল। বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে অক্ষয়কুমার দত্ত প্রধান শিক্ষক রূপে মনোনীত হলেন। এবার আর তিনি প্রত্যাখান করলেন না। নর্মাল স্কুলটি দুটি ভাগে বিভক্ত। উচ্চ শ্রেণির ভার নিলেন প্রধানশিক্ষক শ্রী অক্ষয়কুমার দত্ত।স্কুল প্রতিষ্ঠার আগে শিক্ষা বিভাগের অধ্যক্ষকে বিদ্যাসাগর চিঠিতে লিখলেন -
" For the post of Head Master of the Normal classes, I would recommend Babu Akshay Kumar Dutt, the well known editor of the 'Tatwabodhini Patrika'. He is one of the very few of the best Bengali writers of the time. His knowledge of the English language is very respectable and he is well informed in the elements of general knowledge, and well acquainted with the art of teaching."
কিন্তু শরীর তাঁকে এক বছরের বেশি কাজ করতে দিল না। কায়িক ও মানসিক পরিশ্রম থেকে সারা জীবনের জন্য অবসর নিতে হল। অসুস্থতা ও দারিদ্র্য তাঁর সঙ্গী হয়ে গেল। আবারও এগিয়ে এলেন বিদ্যাসাগর। সেকালের পক্ষে অভাবনীয়, বেসরকারি ক্ষেত্রে পেনসনের ব্যবস্থা করলেন। তত্ত্ববোধিনীনসভা থেকে অক্ষয় দত্তকে মাসিক পেনসন দেওয়ার প্রস্তাব নেওয়া হল। যুক্তি ছিল তাঁর পরিশ্রম ও কর্মতৎপরতায় সভার আর্থিক উন্নতি হয়েছে, তাই আর্থিক অনটনের সময় তাঁকে সাহায্য করা সভার কর্তব্য। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্মতি দিলেন না। আর এক প্রভাবশালী সভ্য কানাইলাল পাইনের সহায়তায় বিদ্যাসাগর মাসিক পঁচিশ টাকা বৃত্তি মঞ্জুর করালেন। পুরো বিষয়টি ১২৬৪ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত হল।
..... শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়কুমার দত্ত এই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সৃষ্টির প্রধান উদযোগী এবং এই পরোপকারিণী পত্রিকার অসাধারণ শ্রীবৃদ্ধিলাভের অদ্বিতীয় কারণ বলিয়া বোধ হইবে। ... দীর্ঘকাল দুরন্ত রোগে আক্রান্ত থাকাতে, অক্ষয়কুমার বাবুর আয়ের সঙ্কোচ, ব্যয়ের বাহুল্য এবং তন্নিবন্ধন অশেষ ক্লেশ ঘটিবার উপক্রম হইয়া উঠিয়াছে। ... তদনুসারে অদ্য সমাগত সভ্যেরা নির্ধারিত করিলেন,অক্ষয়কুমারবাবু যতদিন পর্যন্ত সুস্থ ও স্বচ্ছন্দ শরীর হইয়া পুনরায় পরিশ্রমক্ষম না হন, ততদিন তিনি সভা হইতে আগামী আশ্বিন মাস অবধি পঞ্চবিংশতি মুদ্রা মাসিক পাইবেন।’পত্রিকাতে এই অংশটি স্বয়ং বিদ্যাসাগরের রচিত।
অপরপক্ষে অক্ষয় দত্ত বিদ্যাসাগরের সামাজিক সংস্কারে যে ভাবে সাহায্য করেছেন তাতে প্রমাণিত যে তাঁরা ছিলেন অবিচ্ছিন্ন, ঐক্যবদ্ধ এবং দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। স্বাস্থ্যের কারণে অক্ষয় দত্ত অন্যান্য বন্ধুদের মতো বিদ্যাসাগরের সংস্কারকার্যে সর্বদা প্রত্যক্ষ-অংশ নিতে পারতেন না। কিন্তু মানসিকভাবে বিদ্যাসাগরকে সব সময় দৃঢ় সমর্থনের মাধ্যমে সাহায্য করে গেছেন। বিদ্যাসাগর রচিত ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব' গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর ১৮৫৫-র জানুয়ারিতে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল। মস্তিষ্কের এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অক্ষয়কুমার দত্ত কিছুদিন এলাহাবাদে বায়ু পরিবর্তনের জন্য ছিলেন। তখন কলকাতায় প্রায়শই বিধবাবিবাহ সম্পন্ন হচ্ছিল। এই খবর শুনে এলাহাবাদ থেকে অক্ষয় দত্ত আফসোস করেন যে শারীরিক অসুস্থতার জন্য বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে সেখানে অবস্থান করে আনন্দ ও বেদনার শরিক হতে পারলেন না। আবার, বহু বিবাহের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগরের আন্দোলন শুরুর আগেই ১৮৫৫ সালের গোড়ার দিকে সুহৃদ সমিতি সরকারের কাছে বহুবিবাহ নিবারণের জন্য আবেদন করেন। এই সুহৃদ সমিতির দু-জন সম্পাদক— কিশোরীচাঁদ মিত্র ও অক্ষয়কুমার দত্ত। এও বাহ্য। তাঁদের দুজনের বন্ধুত্বের প্রকৃত ভিত্তি ছিল তাঁদের মানসভূমিতে।
বস্তুবাদী আধুনিক মানসিকতা, অধর্মীয় মনোভাব ও আচরণ-সাদৃশ্য তাঁদের বন্ধুত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করেছিল। পরিশ্রম=শস্য/পরিশ্রম+প্রার্থনা=শস্য/... প্রার্থনা (ভগবান) = শূন্য - এই অবিস্মরণীয় সমীকরণটির দ্বারা অক্ষয় দত্তের ঈশ্বরে অবিশ্বাস বহুচর্চিত। আবার বিদ্যাসাগরের বেশ কিছু উক্তি যেমন—
(কাশীতে) ‘বিশ্বেশ্বর মানি না'; (১৮৮৭-র জুন মাসে পুরীগামী জাহাজের ৮০০ যাত্রীসহ ডুবে যাওয়া প্রসঙ্গে) ‘এই সকল দেখিলে, কেহ মালিক আছেন বলিয়া সহসা বোধ হয় না’; ‘এই বিধাতা ও বিধান এতই গম্ভীর রহস্য যে মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি আরও অনেক উন্নত হলেও তার যথার্থ সন্ধান পেতে বহু বিলম্ব হবে’— প্রভৃতি থেকে ঈশ্বর সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্রের নিরাসক্তির পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যায়। শুধু উক্তি বা সমীকরণে নয় উভয়ের জীবনযাত্রার মধ্যেই, উনিশ শতকের পক্ষে নিতান্তই বেমানান, প্রগতিশীল সংস্কারমুক্ত এক স্বাধীন জীবনযাপন প্রণালীর দেখা পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগরের চিঠির উপর ‘শ্রীশ্রীদুর্গা শরণং’ লেখা বা পৈতা রাখা নিয়ে বা অক্ষয় দত্তের ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
কিন্তু দু-জনের ক্ষেত্রেই এগুলি ছিল নিতান্তই তুচ্ছ। তাঁদের ‘কাণ্ডজ্ঞান'-এর পরিচায়ক। দুজনেই প্রচলিত অর্থে বাঙালি ছিলেন না। তাঁরা অবস্থার বশীভূত না হয়ে, অবস্থাকে বদলাতে চেয়েছিলেন।
বিজ্ঞানমনস্কতা, অর্থাৎ যুক্তির পারম্পর্য সম্পর্কে সচেতনতা ছিল তাঁদের প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিদ্যাসাগর, তাঁর বর্ণপরিচয়ে গোপাল-রাখালকে পদবীমুক্ত করেছেন। বংশ-কুল বাদ দিয়ে মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে দেখা, সে সময়ের নিরিখে যে কতটা বিপ্লবাত্মক, তা আজকের দিনে কল্পনাতীত। অপর দিকে অক্ষয় দত্ত তাঁর চারুপাঠ, দ্বিতীয় ভাগের (১৮৫৪) বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন,
‘এতদ্দেশীয় সংস্কৃত-ব্যবসায়ী পণ্ডিত মহাশয়দিগের মধ্যে অনেকে কেবল অবাস্তব উপাখ্যান অধ্যয়ন করাইতেই ভালবাসেন, বিশ্বের নিয়ম ও বাস্তব পদার্থের গুণাগুণ শিক্ষা করাইতে তাদৃশ অনুরক্ত নহেন।‘
সেকালের জনপ্রিয় পাঠ্যপুস্তক ‘চারুপাঠ’ -এর প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ হিন্দি ও ওড়িয়া ভাষাতেও অনূদিত হয়।
দু-জনেরই বস্তুবাদী-ধর্মনিরপেক্ষ-শিক্ষা-প্রণালী ‘খৃশ্চান ভার্নাকুলার এডুকেশন সোসাইটি'র ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক রেভ. জন, মার্ডককে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল।১৮৭৩-এ মার্ডক সরাসরি বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ এবং বোধোদয়-এর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি চিহ্নিত করে মিশনারি স্কুলে এগুলি পড়ানোর তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁর তীব্র আপত্তি ছিল অক্ষয়কুমার দত্তের চারুপাঠ সম্পর্কেও। তাঁর অভিযোগ বিদ্যাসাগরের বই দুটি ‘নিম্নমানের হীন নীতিশিক্ষা'র (low miserable morality) উদাহরণ। তাছাড়া বইগুলি ‘চূড়ান্ত বস্তুবাদ' (rank materialism) শেখানোর উদ্দেশেই রচিত। অর্থাৎ শিক্ষার প্রধান অভিমুখ যে— বস্তুবাদী ধর্মনিরপেক্ষতা, তার সূচনা এই দুই বন্ধুর হাতেই।
তত্ত্ববোধিনী সভার মধ্যমণি ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বেদকে অভ্রান্ত ও ঐশ্বরিক শাস্ত্র বলে বিশ্বাস করতেন। তার সঙ্গে অক্ষয় দত্তের ছিল ‘আকাশ-পাতাল-প্রভেদ'। প্রভেদটা ছিল সামাজিক, আর্থিক এবং মানসিক।এতদ্সত্ত্বেও অক্ষয় দত্তের যুক্তি মেনে দেবেন্দ্রনাথকে স্বীকার করতে হল, বেদ মানুষের রচনা এবং তা অভ্রান্ত নয়। আজকের দিনে বিষয়টাকে হালকা মনে হলেও উনিশ শতকে ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ সমাজসংস্কার। অপরদিকে বিদ্যাসাগরের দীপ্ত ঘোষণা— ‘বেদান্ত ও সাংখ্য ভ্রান্ত দর্শন’— তো এক বৈপ্লবিক ঘটনা।
১৮৫৩ সালে কাশীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ড. জে. আর ব্যালান্টাইনের প্রস্তাবের বিরোধিতায় বিদ্যাসাগরের সেই চিঠি [‘That the Vedanta and Sankhya are false system of Philosophy is no more a matter of dispute.'] আমাদের শিক্ষার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। মাত্রার তারতম্য থাকতে পারে, কিন্তু দু-বন্ধুই সঠিক নিশানায় আঘাত হেনেছিলেন।
মেদিনীপুরের ব্রাহ্ম সমাজে প্রদত্ত রাজনারায়ণ বসুর একটি বক্তৃতা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার গ্রন্থাধ্যক্ষেরা (পেপার কমিটি) পত্রিকায় প্রকাশযোগ্য মনে করলেন না।মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ক্ষিপ্ত হয়ে রাজনারায়ণ বসুকে চিঠিতে লিখলেন, ‘কতকগুলান নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে, ইহাদিগকে এ পদ হইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে আর ব্রাহ্মধর্ম্ম প্রচারের সুবিধা নাই।' স্বভাবতই বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্ত ছিলেন নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষের অন্যতম। আরও নানা কারণে অক্ষয় দত্ত তত্ত্ববোধিনী সভা ও পত্রিকা উভয় স্থান থেকে মুক্ত হন। বিদ্যাসাগর থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু বেশিদিন নয়। ১৮৫৯ সালে ধর্মতত্ত্ব অপেক্ষা বিধবাবিবাহে অধিক উৎসাহ দেখে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তত্ত্ববোধিনী সভাকে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন।
বিদ্যাসাগর এবং অক্ষয় দত্তের মধ্যে চিন্তা ও কর্মের যে ঐক্য দেখা যায় তা উনিশ শতকে আর কারও মধ্যে দেখা যায়নি। দুজনের চরিত্রে আর একটা বিশেষ মিল লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যই ছিল তাঁদের স্বভাবের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। দুজনের কেউই কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছের লোক ছিলেন না।
আজকের এই তীব্র ধর্মীয় মেরুকরণের যুগে, পুরাণকে ইতিহাসে পরিণত করার যুগে বিদ্যাসাগর ও অক্ষয় দত্তের প্রগতিশীল চিন্তাই আমাদের অন্যতম আয়ুধ ।
সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্য চয়ন : ----
1. অক্ষয়কুমার দত্ত : আঁধার রাতে একলা পথিক- আশীষ লাহিড়ী(2019), দ্বিতীয় সংস্করণ, দেজ পাবলিশিং
2. সেকালের কৃতী বাঙালি-- মন্মথনাথ ঘোষ(2020)
3. সাহিত্য সাধক চরিতমালা (প্রথম খণ্ড) ---- বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ(2016)
4. History of the Brahmo Samaj-- Shivnath Sastri(1993)
5. মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী
6. বাংলা গদ্যের পদাঙ্ক-- সম্পাদনা: প্রমথনাথ বিশী ও বিজিতকুমার দত্ত(1426)
7. উনিশ শতকের বাংলা সংবাদ ও সাময়িকপত্র- স্বপন বসু(2018)
8. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, কামারের এক ঘা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ইন্সটিটিউট
9. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান.
10. অক্ষয় কুমার দত্ত, বিস্মৃত অবিস্মৃত - পীযূষ কান্তি সরকার।
11. গদ্য শিল্পী অক্ষয় কুমার দত্ত ও মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর --- নবেন্দু সেন।
0 Comments