জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের লোকগল্প /আসল গুপ্তধন সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস /কথক- চিত্তরঞ্জন দাস, গ্ৰাম- বেড়াজাল, থানা-নয়াগ্ৰাম, জেলা-ঝাড়গ্ৰাম

জঙ্গলমহলের লোকগল্প 

আসল গুপ্তধন 
সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস 

কথক- চিত্তরঞ্জন দাস, গ্ৰাম- বেড়াজাল, থানা-নয়াগ্ৰাম, জেলা-ঝাড়গ্ৰাম 

পলাশপুর নামে একটি গ্ৰামে ভানু নামের এক ব্যক্তি বসবাস করত। সে ছিল খুবই কুঁড়ে প্রকৃতির মানুষ। ভানু কোনো কাজকর্ম করত না, সারাদিন শুয়ে বসে দিন কাটাত। ভানুর এই অলসতা নিয়ে খুবই চিন্তিত থাকত তার বউ কমলা। কমলা বারবার ভানুকে বলত কিছু কাজবাজ করতে। কিন্তু ভানু তার কোনো কথাই কানে তুলত না। নিজের মর্জি অনুসারে সে চলত।

একদিন ভানু শুয়ে শুয়ে স্বপ্নের মধ্যে কী সব বলছিল। সেই মুহূর্তে তার বউ কমলা এসে বলে-“কী গো এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছো। বলি আজও কী কোনো কাজকর্ম হবে না। এইভাবে চললে তো আমরা একদিন না একদিন না খেতে পেয়ে মরে যাব। বলি আমি যা বলছি তুমি কী কিছু শুনেছ। কী এত বকবক করছ?”

কমলার চিৎকারে ভানুর ঘুম ভেঙে যায়। সে বলে-“আঃ গিন্নি, এত চেঁচাচ্ছ কেন? কত সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। দিলে তো ঘুমটা ভাঙিয়ে। বলি সকাল সকাল এত চিৎকার করছ কেন?”

তখন কমলা বলে-“আঃ মরণ, এদিকে ঘরে কিছু নেই আর উনি স্বপ্ন দেখছিলেন। বলছি যে ঘরে চাল বাড়ন্ত। একটা দানা চাল নেই। আমরা খাবটা কী। তোমার তো সারাদিন ঘুমানো ছাড়া কোনো কাজ নেই। কতবার বলেছি যাও কাজে যাও। কিন্তু না, কে শুনে কার কথা।”

ভানু তখন বলে-“আঃ গিন্নি, তুমি এত চিন্তা করছ কেন? আমার তো দু-দু বিঘা জমি। যার এত জমি আছে সে আবার কাজ করে নাকি। দেখবে গিন্নি আমি কদিন পরে বড়লোক হয়ে যাব। আর তুমি জানো না বড়লোকেরা কাজ করে না। অন্যকে দিয়ে কাজ করায়। তাই আমি যেহেতু কদিন পরে বড়লোক হব, তাই আমিও কাজ করব না।”
🍂

কমলা রেগে গিয়ে বলে-“উম্, বড়লোক হবে। সে যখন হবে তখন দেখা যাবে। এখন ঘরে যে একটা দানা চাল নেই তার দিকে খেয়াল আছে। যাও চাল নিয়ে এসো। তা না হলে আজকে না খেয়ে থাকতে হবে।”

ভানু বলে-“বলি গিন্নি, এইরকম এক আধটা দিন না খেলে কিছু হবে না। যখন আমরা বড়লোক হব তখন তো লোকজনকে বলতে পারবে আমরা কত কষ্ট করে বড়লোক হয়েছি। তাই একদিন না খেলে কিছু হবে না।”

তখন কমলা বিরক্ত হয়ে বলে-“হে ভগবান, কী যে পাপ করেছিলাম কে জানে। যার জন্য এই অল্প মানুষটাকে স্বামী হিসেবে পেয়েছিলাম। আমাকে রক্ষা করো ভগবান এই মানুষটার হাত থেকে আমাকে রক্ষা করো।”

এই বলে কমলা সেখান থেকে চলে যায়। 

কিন্তু কতদিন আর না খেয়ে থাকবে। তাই দিন কয়েক পরে কমলা ভানুকে বলে-“কী গো কিছু একটা করো। আর কদিন না খেয়ে থাকব।”

তখন ভানু বলে-“জানো গিন্নি, আমরা বড়লোক হয়ে গেলে আর আমাদের খাবারের অভাব থাকবে না।”

কমলা তখন বলে-“আঃ মরণ, কোনো কাজকর্ম ছাড়াই উনি বড়লোক হবেন। আচ্ছা আমি বলি কী আমাদের তো দু-বিঘা জমি। তাতে কিছু করলে হয় না।”

ভানু বলে-“কী করব?”

কমলা বলে-“যাও তো বাজার থেকে কিছু সবজির চারা নিয়ে এসো। আর সেগুলো নিয়ে গিয়ে জমিতে লাগিয়ে দাও। এরপর দেখবে আমাদের আর সবজির এমনকি খাবারের অভাবও হবে না।”

তখন ভানু বলে-“আমি এতসব করতে পারব না।”

এই শুনে কমলা খুব রেগে যায়। আর বলে-“তুমি যাবে না তো, ঠিক আছে তাহলে আমি আজকেই বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি।”

ভানু তখন আর কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে মাঠে যায়। আর বহুকষ্টে চারাগাছগুলো জমিতে লাগিয়ে দিয়ে আসে। 

বাড়ি ফিরতেই কমলা বলে-“কী গো, চারাগুলো ভালো করে লাগিয়েছ।”

ভানু তখন বলে-“হ্যাঁ।”

পরের দিন সকালে কমলা বলে-কী গো, কাল তো গাছগুলো লাগিয়ে এলে, তাতে জল দিবে না?”

ভানু বলে-“আজ জল দিতে হবে! তুমি দেখ গিন্নি আজ বৃষ্টি হবে। তাই জমিতে জলটল কিছু দিতে হবে না।”

কমলা তখন বলে-“আহা আমার জ্যোতিষ ঠাকুর এলেন গো। চারিদিকে খাঁ খাঁ রোদ, আর উনি বাড়িতে বসেই বসেই বলছেন বৃষ্টি হবে। যাও বলছি যাও এখুনি গিয়ে চারাগুলোতে জল দিয়ে এসো। তা না হলে গাছগুলো মরে যাবে যে।”

তখন ভানু আর কথা না বাড়িয়ে মাঠে যায় চারাগুলোতে জল দিতে কিন্তু গিয়ে দেখে সব চারা মরে গেছে।

ভানু তখন বলে-“দূর দূর এসব আমার দ্বারা হয় নাকি। যাই বাড়ি যাই, বাড়ি গিয়ে কোনো ব্যবস্থা করতে হবে। আমি বুঝে গেছি এই চাষবাস আমার দ্বারা হবে না।”

এই বলে সে ঘরে ফিরে আসে। ঘরে আসতেই কমলা বলে-“কী গো, এত তাড়াতাড়ি জল দেওয়া হয়ে গেল?”

তখন ভানু বলে-“না গো সব গাছ মরে গেছে। আমার দ্বারা কী এসব কাজ হয়।”

কমলা বলে-“তাহলে কী কাজ হয় শুনি। হায় হায় গো, এই মানুষটাকে নিয়ে আমি কী করব।” 

এই বলে কমলা কাঁদতে থাকে। 

তখন ভানু বলে-“আঃ গিন্নি, এত কান্নাকাটি করো না। ঠিক একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”

কমলা বলে-“ছাই হবে। যেদিন আমরা না খেতে পেয়ে মরে যাব সেদিন তোমার সব ব্যবস্থা হবে।”

সেই সময় ভানুকে কেউ একজন ডাকতে থাকে। ভানু তখন বাড়ির বাইরে আসে। বাইরে আসতেই দেখে ওদের গ্ৰামেই বসবাসকারী মধু নামের এক ব্যক্তি তাকে ডাকছে। 

ভানু তাকে বলে-“আরে এ যে মধু দেখছি। কী রে মধু কী হয়েছে, এত ডাকাডাকি কিসের?”

মধু তখন বলে-“ভানু ভাই, তোমার কাছে একটা আর্জি নিয়ে এসেছিলাম।”

ভানু বলে-“কী আর্জি?”

মধু বলে-“ভানু ভাই, তোমার তো দু-দু বিঘা জমি। জমিগুলো তো ফাঁকা পড়ে আছে। আমি বলি কী তুমি আমাকে কিছু জমি ভাগে দিবে আমি চাষ করতাম। তার বদলে আমি প্রতিমাসে তোমাকে হাজার টাকা করে দেব। কী বলো তুমি?”

ভানু বলে-“এ তো সোনায় সোহাগা। আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আমার অর্ধেক জমি তোকে ভাগে দিলাম। তুই সময়মতো আমাকে টাকাটা দিয়ে যাস।”

মধু বলে-“ঠিক আছে ভানু ভাই। আমি তাহলে আজ থেকেই কাজ আরম্ভ করে দি। আর এই নাও এই মাসের টাকাটা অগ্ৰিম দিয়ে গেলাম। আজ তাহলে আমি আসি ভানু ভাই।

ভানু বলে-“আচ্ছা ঠিক আছে আয় তাহলে।”

এরপর মধু সেখান থেকে চলে যায়।

ভানু তখন কমলাকে বলে-“দেখলে গিন্নি, বলেছিলাম না ঠিক একটা ব্যবস্থা হবে। এই দেখ টাকা। কাজ না করেও বড়লোক হওয়া যায়।”

তখন কমলা বলে-“উম্, হাজার টাকায় উনি নাকি বড়লোক হবেন।”

এইভাবে দেখতে দেখতে একমাস কেটে যায়। মধু এসে তার কথামতো ভানুকে টাকা দিয়ে যায়। 

ভানু বলে-“কী রে মধু, চাষবাস কেমন চলছে?”

মধু বলে-“খুব ভালো ভানু ভাই। বাজারে সবজির বেশ ভালোই দর আছে। এবার তাহলে আমি আসি ভানু ভাই। আমাকে আবার মাঠে যেতে হবে।”

তখন ভানু বলে-“আচ্ছা আর তাহলে।”

এরপর মধু সেখান থেকে চলে যায়। কিন্তু এদিকে যত দিন যাচ্ছে ভানুর অলসতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। যদিওবা অলসতা কাটাত, মধু মাসে মাসে টাকা দেওয়ায় সে আরও অলস হয়ে পড়ে।

হঠাৎ একদিন কমলা ভানুকে এসে বলল-“বলি শুনছ, তুমি এখানে পড়ে পড়ে ঘুমাও। আর এদিকে তোমার জমি চাষ করে মধু নতুন বাড়ি করছে।”

ভানু তখন বলে-“কী বলছ কী! একমাস চাষ করেই মধু নতুন বাড়ি করছে। না না তাই হতে পারে না। নিশ্চয়ই আমার জমিতে মধু কোনো গুপ্তধন পেয়েছে। আর সেই জন্য এতসব করছে। আমাকে ব্যাপারটা একবার দেখতে হচ্ছে।”

এই বলে ভানু মধুর বাড়ি যায়। মধুর বাড়ির কাছে পৌঁছে সে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখতে থাকে মধু গুপ্তধন কোথায় রেখেছে। ভানু দেখল মধু ঘরের সমস্ত কাজ শেষ করে মাঠের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। 

আর ভানুও মধুর ঘরে কিছু না পেয়ে মধুর পেছন পেছন মাঠে যায়। সে ভাবে হয়তো মধু ওই গুপ্তধন মাঠের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু সেখানে গিয়েও ভানু কিছু পায় না। সে দেখল মধু নিত্যদিনের মতো চারা লাগাচ্ছে, তাতে জল দিচ্ছে। কোনো কিছু না পেয়ে ভানু বাড়ি ফিরে আসে। 

বাড়ি ফিরতেই কমলা তাকে বলে-“কী গো কিছু পেলে?”

ভানু বলে-“না….কিছু পেলাম না। দেখলাম তো মধু সারাদিন মাঠে কাজই করে যাচ্ছে।”

তখন কমলা বলে-“আমি জানতাম তুমি কিছুই পাবে না। এ হল মধুর পরিশ্রমের ফল। মধু সত্যিই গুপ্তধন পেয়েছে। আর তা পেয়েছে তার পরিশ্রমের জোরে। আর সেটাই হল তার আসল গুপ্তধন। আমি বলি কী আমাদের তো বাকি অর্ধেক জমি পড়ে আছে, চল না গো আমরাও তাতে চাষ করি। আর আমরাও গুপ্তধন পাই।”

এত কিছুর পর ভানু তার নিজের ভুল বুঝতে পারে। আর বলে-“তুমি ঠিক বলেছ গিন্নি। এতদিন পর আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি মনে করেছি কোনো কিছু না করেই বড়লোক হওয়া যায়। কিন্তু এটা বুঝিনি যে পরিশ্রম ছাড়া কোনো কিছু সম্ভব নয়। মানুষ আসল গুপ্তধন যে তার পরিশ্রমের ফলে পায় তা আজ মধুকে দেখে আমি শিখেছি। দেখ গিন্নি এবার থেকে আমিও পরিশ্রমী হয়ে উঠব।”

এরপর ভানু পরিশ্রমী হয়ে উঠল। আর সেও গুপ্তধন পেল যা মধু পেয়েছিল।

Post a Comment

0 Comments