সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিচ্ছবি
সত্যজিৎ পড়্যা
বাংলা কথাসাহিত্যের পরিসরে সমরেশ মজুমদার এক বিশেষতর নাম, যিনি তাঁর আখ্যানভুবনে বারবার প্রত্যাবর্তন করেছেন মধ্যবিত্ত জীবনের অন্তর্গত সংকট, দ্বন্দ্ব ও স্বপ্নসন্ধানী মনোভাবকে। তাঁর সাহিত্যকীর্তি পাঠ করলে বোঝা যায়, বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ কেবলমাত্র একটি আর্থসামাজিক শ্রেণির নাম নয়, বরং তা এক বহুমাত্রিক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, যেখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সীমাবদ্ধতা, আদর্শ ও ভ্রান্তি, প্রগতি ও রক্ষণশীলতা একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে। সমরেশের কলমে এই সমাজ কখনও দমবন্ধ অবস্থার প্রতীক, আবার কখনও তা হয়ে ওঠে পরিবর্তনের অগ্রদূত।
সমরেশের উপন্যাসে মধ্যবিত্ত চরিত্ররা অধিকাংশ সময় এক দ্বৈত মানসিকতার ভেতরে অবস্থান করে। তারা যেমন প্রগতির স্বপ্ন দেখে, তেমনি বাস্তব পরিস্থিতি তাদের সেই স্বপ্নপূরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক অনটন, সামাজিক মর্যাদাবোধ ও পারিবারিক দায়বদ্ধতা তাদের বারবার এক সীমারেখার ভেতরে বেঁধে ফেলে। এই সীমারেখাই বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা সমরেশ তাঁর উপন্যাসে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ধরতে পেরেছেন।
🍂
অঞ্জন-ত্রয়ী—‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’—এর পটভূমিতে এই মধ্যবিত্ত সংকট তীব্রতর হয়ে ওঠে। নকশাল আন্দোলনের মতো রাজনৈতিক উত্তালতার ভেতর সমরেশ যুব সমাজের দোলাচলকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে অঞ্জন কেবল একজন চরিত্র নয়, বরং মধ্যবিত্ত বাঙালির অস্তিত্বসংকটের প্রতীক। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি অসন্তোষ, নতুন জীবনপথের সন্ধান এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভিলাষ—এই সমস্ত কিছু একসঙ্গে তাকে দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে। এর ভেতর দিয়েই ধরা পড়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত মানসের অস্থিরতা, যা একদিকে ইতিহাস-রাজনীতির স্রোতে ভেসে যায়, অন্যদিকে আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিতে শেকড় আঁকড়ে ধরে।
প্রেম ও সম্পর্কের প্রশ্নেও সমরেশ মজুমদার মধ্যবিত্ত সমাজের বাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর আখ্যানের প্রেম কখনও স্রেফ আবেগঘন নয়; বরং তা এক সামাজিক লড়াই। দাম্পত্যের ভাঙাগড়া, সম্পর্কের জটিলতা, দেহমুখী আকর্ষণ ও মানসিক টানাপোড়েন—সবকিছুর মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন মধ্যবিত্ত জীবনের অব্যক্ত দ্বন্দ্বকে। তাঁর নারী চরিত্রেরা এই প্রেক্ষাপটে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তারা প্রথাগত নারীত্বের সীমানা ভাঙতে চায়, কিন্তু সামাজিক পরিমণ্ডল তাদের বারবার বাধা দেয়। ফলে জয়িতা, মাধবীলতার মতো চরিত্ররা হয়ে ওঠে মধ্যবিত্ত সমাজে নারী-অস্তিত্বের সংগ্রামের জীবন্ত দলিল।
সমরেশের উপন্যাসে স্থানও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দার্জিলিং, উত্তরবঙ্গ কিংবা কলকাতা—প্রতিটি ভূগোলেই তিনি মধ্যবিত্ত জীবনের ভিন্ন ভিন্ন রূপকে চিত্রিত করেছেন। পাহাড়ি প্রান্তরের বিচ্ছিন্নতা, উপনিবেশোত্তর রাজনৈতিক টানাপোড়েন কিংবা মহানগরের দ্রুত পরিবর্তনশীল জীবনধারা—সবই মধ্যবিত্ত মানসকে নতুনভাবে রূপ দিয়েছে। এই ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের ভেতর দিয়েই সমরেশ দেখিয়েছেন কীভাবে স্থান-কাল-পরিস্থিতি বাঙালি মধ্যবিত্ত চেতনার গঠনে নির্ণায়ক হয়ে ওঠে।
নৈতিকতার প্রশ্নে সমরেশের চরিত্ররা সবসময় দোলাচলে থাকে। পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও তারা প্রথার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারে না। পরিবার, সমাজ ও ব্যক্তিসত্তার মধ্যবর্তী এই টানাপোড়েনই মধ্যবিত্ত মানসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সমরেশের কলমে এই দ্বন্দ্ব কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং এক সমগ্র সামাজিক চেতনার প্রতিফলন।
তাঁর আখ্যানশৈলীও মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিচ্ছবিকে উজ্জ্বল করে তোলে। সহজবোধ্য ভাষা, সংলাপনির্ভর উপস্থাপনা এবং চরিত্রের মানসিক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে তিনি পাঠকের নিকট জীবনঘনিষ্ঠ এক অভিজ্ঞতা পৌঁছে দেন। মধ্যবিত্ত পাঠকের কাছে এই সহজ অথচ দার্শনিক ভঙ্গি বিশেষ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
সমসাময়িক অন্যান্য ঔপন্যাসিকদের তুলনায় সমরেশের বিশেষত্ব এখানেই যে, তিনি মধ্যবিত্ত জীবনের ভেতরে ইতিহাস ও রাজনীতির প্রবাহকে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত করেছেন। তাঁর চরিত্রেরা নিছক দৈনন্দিন সংকটের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়; তারা বৃহত্তর সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কিত। ফলে তাঁর সাহিত্য হয়ে ওঠে একাধারে বাস্তব ও প্রতীকী, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত।
অতএব বলা যায়, সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসে বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ কেবল একটি পটভূমি নয়, বরং এক জীবন্ত চরিত্র, যার ভেতরে নিহিত রয়েছে ইতিহাসের অভিঘাত, রাজনৈতিক উথালপাতাল, অর্থনৈতিক অনটন এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন। সমরেশ তাঁর সাহিত্যকর্মে দেখিয়েছেন, এই সমাজ একদিকে যেমন অনিশ্চয়তা ও দ্বন্দ্বে জর্জরিত, তেমনি অন্যদিকে পরিবর্তনের সম্ভাবনাও তার অন্তরে নিহিত। তাঁর উপন্যাসগুলো তাই বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের দলিলস্বরূপ, যা কেবল সাহিত্যিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, গবেষণামূলক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
0 Comments