দূর দেশের লোকগল্প—
সন্ধে হলে শেয়াল ডাকে
ফিনল্যাণ্ড (ইউরোপ)
চিন্ময় দাশ
এক বুড়ো কাঠুরিয়া আর তার বুড়ি থাকে একটা কুঁড়েঘরে। একটি মাত্র ছেলে তাদের। ছেলেটির নাম—মিকো। বুড়ির তখন ভারি অসুখ। বাঁচে কি বাঁচে না। মিকো কাঁদছে বুক ভাসিয়ে—মা, তুমি চলে গেলে, আমাকে কে দেখবে?
বুড়ি শান্তনা দেয় ছেলেকে—মা-বাপ কি আর কারও চিরকাল থাকে না, বাছা। তাছাড়া, তোমার বাবা তো রইল। চিন্তা কীসের?
বুড়ি মারা যাবার পরে পরেই বুড়োও অসুস্থ হয়ে পড়ল। মিকো বুঝতে পারল, এবার সত্যিই সে একা হয়ে পড়বে। আপনার বলতে কেউ আর থাকবে তার এই দুনিয়ায়।
মারা যাওয়ার আগে, বুড়ো মিকোকে ডেকে বলল—আমারও যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। কিছুই দিয়ে যাওয়ার মত নেই তোমাকে। থাকবার আছে তিনটে ফাঁদ। তাই দিয়ে জীবজন্তু শিকার করে, পেট চালিয়েছি এতদিন। সেগুলোই শুধু তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি।
--তুমি অতো চিন্তা কর না, বাবা। আমি ঠিক চালিয়ে নেব।
বুড়ো বলল—আমি মারা যাবার পর, একবার জঙ্গলে যেও। তিনটে ফাঁদ পাতা আছে সেখানে। কোনও একটা ফাঁদে যদি শিকার পড়েছে দেখতে পাও, মেরে ফেলো না সেটাকে। বরং ঘরে নিয়ে এসে, রেখো যত্ন করে।
বুড়ো মারা যেতে , জঙ্গলে গিয়েছে মিকো। প্রথম ফাঁদে শিকার নেই। পরেরটাও খালি। শেষ ফাঁদে গিয়ে দেখল, একটা লাল রঙের শেয়ালছানা ধরা পড়েছে।
বাবার কথা মনে পড়ল মিকোর। শেয়ালটাকে আদর করে কোলে তুলে, বাড়ি ফিরে এলো। ফাঁদে আটকে, রক্তপাত হচ্ছিল একটা পায়ে। যত্ন করে ভেজা ন্যাকড়া জড়িয়ে বেঁধে দিল শেয়ালের পায়ে।
নিজে যা খায়, তা থেকেই খাওয়ায় শেয়ালকে। রাতে ঘুমোবার সময়, মিকোর পায়ের কাছটিতে গুটিসুটি মেরে ঘুমায় শেয়ালছানাও।
এইভাবে বেশ ভাবসাব গড়ে উঠল দুজনের। একদিন শেয়াল বলল—সব সময় এমন মনমরা হয়ে থাকো কেন বল তো?
--কী করব বলো? এই দুনিয়ায় কেউ নাই আমার। একেবারে একলা একজন মানুষ।
--ছিঃ। এটা একজন যুবক ছেলের মুখের কথা হোল? আমার কথা শোন। বিয়ে করে, ঘরে বউ নিয়ে এসো। একলা একলা ভাব কেটে যাবে।
--বিয়ে? কী যে বলো না তুমি? মিকো বলল—কে বিয়ে করবে আমাকে? কোনও বড়লোকের মেয়ে আমাকে বিয়ে করবে না। ওদিকে, আমিও কোনও গরীবের মেয়েকে বিয়ে করব না। কেননা, আমি গরীবের চেয়েও গরীব।
--একেবারে বোকার বেহদ্দ তুমি। শেয়াল বলল—সদ্য যুবক তুমি। চেহারাপাতিও তো বেশ ভালোই। তার চেয়ে বড় কথা, তুমি ভারি দয়ালু। এবং বেশ ভদ্রও। বড়লোকের মেয়ে কী বলছ গো? যে কোনও রাজকুমা্রি তোমাকে পছন্দ করবে।
মিকো হা-হা করে হেসে উঠেছে এ কথা শুনে। শেয়াল বলল—হেসো না। আমার কথার জবাব দাও।
–বলো, কী কথা তোমার।
--এই দেশের রাজকুমারি সম্পর্কে জানো কিছু? তাকে তোমার পছন্দ?
আরও জোরে হেসে উঠল মিকো। বলল—জানি সে মেয়ে সম্পর্কে। দুনিয়ায় এমন সুন্দরী মেয়ে আর দুটি নাই। কত রাজা আর রাজকুমার সে মেয়েকে বিয়ে করবার জন্য মুখিয়ে আছে।
শেয়াল বলল—ঠিক আছে। এই মেয়ের সাথে তোমার বিয়ের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি আমি।
পরদিনই সোজা রাজবাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছে শেয়াল। নেহাতই দায়সারা গোছের একটা সেলাম ঠুকে বলল—মহারাজ মিকো আপনার কাছে পাঠালেন আমাকে। আপনার দাঁড়িপাল্লাটা একদিনের মতো দিতে হবে।
মহারাজ মিকো, দাঁড়িপাল্লা—কিছুই মাথায় ডুকছে না রাজার। বললেন—মহারাজ মিকো? সেটা আবার কে?
--ইসসস…। রাজাকে থামিয়ে দিয়ে, শেয়াল বলে উঠল—চুপ, চুপ। দেওয়ালেরও কান আছে। মহারাজ মিকো সম্পর্কে এভাবে কেউ কথা বলে না।
রাজা বললেন—কিন্তু কে তিনি?
শেয়াল বলল—আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, আপনি মহারাজ মিকোর কথা জানেন না? এ তল্লাটের ছোট-বড় যত রাজা-রাজড়া সবাই তাঁর নামে মাথা নামায়। আর, আপনি—
রাজা একটু থমকে গিয়ে, নিজেকে সামলে নিলেন। কিছুই মাথায় ঢোকেনি রাজার। কিন্তু মুখে বললেন—হ্যাঁ, এবার বুঝেছি। তা, দাঁড়িপাল্লা কেন চাইছেন মহারাজ?
--কিছুদিনের জন্য একটু বাইরে যাবেন মহারাজ। বিশেষ কিছু জিনিষ মাপবার দরকার পড়েছে। তাই।
দাঁড়িপাল্লা নিয়ে শেয়াল এসে ঢুকল বনের ভিতর। পাথরের আড়ালে জিনিষটা লুকিয়ে রেখে, খোঁড়াখুঁড়িতে লেগে গেল। সেকালে লোকজন তাদের টাকাকড়ি, সোনাদানা সব মাটির নীচে পুঁতে রাখত। শেয়াল জাতটাই তো রাতচরা। সকলের সব গোপন কাজকর্ম তাদের জানা। খোঁড়াখুঁড়ি করে কিছু টাকা, সোনা আর রূপোর মোহর উদ্ধারও করে ফেলল।
পরের দিন রাজার সভায় গিয়ে শেয়াল হাজির। বলল—দাঁড়িপাল্লাটা দিয়েছিলেন। সেজন্য আমার মনিব, মহারাজ মিকো অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছেন আপনাকে।
দাঁড়িপাল্লা হাতে নিয়ে রাজা অবাক। পাল্লাটার খাঁজেখোঁজে সোনা আর রূপোর কয়েকটা মোহর গোঁজা হয়ে আছে। বুঝে গেলেন, মিকো কতো বড় মহারাজ। ব্যস্ত হয়ে বললেন—তোমার মহারাজের সাথে আলাপ করবার ভারি ইচ্ছে। তোমরা কষ্ট করে একটি বার আসতে পারবে আমার রাজবড়িতে।
দু’দিন ধরে শেয়াল যা কিছু করেছে, সে তো এই কথাটা শুনবে বলেই। বলল—আমন্ত্রণ জানাবার জন্য ধন্যবাদ। তবে, আমার ধারণা, মহারাজ আপনার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারবেন না।
--কেন? পারবেন না কেন?
--আসলে, মহারাজের ইচ্ছা, তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেরে ফেলেন। বিদেশের বেশ কয়েকজন রাজা মহারাজা কিছুদিন ধরে খুব পীড়াপীড়ি করছেন, তাঁদের মেয়েদের দেখতে যাওয়ার জন্য। সেইসব রাজকুমারিদের দেখবার জন্যই তো লম্বা সফরে বের হচ্ছেন আমার মহারাজ।
একথা শুনে, রাজামশাই তো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঘরে নিজের একটি মেয়ে আছে তাঁর। ভাবলেন, মহারাজকে একবার যদি নিজের মেয়েটিকে দেখানো যায়, নিশ্চয় তাঁর পছন্দ হয়ে যাবে। ব্যাগ্র হয়ে বললেন—অন্য রাজকুমারিদের দেখতে যাওয়ার আগে, তোমার মহারাজকে একটি বার আমার এখানে নিয়ে এসো। আমার ধারণা, এ কাজটা তুমি পারবে।
শেয়াল এমন ভাব করতে লাগল, যেন ভারি সমস্যায় ফেলে দেওয়া হয়েছে তাকে। বলল—তাহলে, খোলাখুলিই বলি আপনাকে। আগেই আপনার মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। সত্যি কথা হোল, আমাদের মহারাজকে স্বাগত জানাবার মতো ঐশ্বর্য আপনার নাই। তাছাড়া, প্রতিদিন যে অসংখ্য অতিথি অভ্যাগত মহারাজের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন, তাঁদেরও তো জায়গা কুলোবে না এখানে।
শুনে রাজার তো একেবারে নাজেহাল অবস্থা। শেয়ালকে বললেন—যেভাবে হোক, তুমি একটা ব্যবস্থা করে দাও। এজন্য যা চাও তুমি, আমি দেব তোমাকে।
শেয়াল মাথাটাথা নেড়ে, নাটক করতে লাগল। এবার রাজা বললেন—আচ্ছা, তাঁকে একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে কম লোকলস্কর নিয়ে আসতে বলতে পারবে না তুমি?
শেয়াল মাথা দুলিয়ে বলল—সেটি কোনমতেই সম্ভব নয়। এলে তিনি পুরো দলবল নিয়েই আসবেন। তবে, একটা ব্যবস্থা করা যায়।
রাজা উদ্গ্রীব হয়ে বললেন—কী ব্যবস্থা?
--মহারাজের নিয়ম হোল, কোথাও গেলে সদলবলে যাবেন। নইলে, ধরুন একজন সাধারণ কাঠুরিয়ার বেশে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে যাবেন। যাতে রাজা-প্রজা কেউই তাঁকে দেখে চিনতে না পারে। কেবল আমিই সাথে থাকব তাঁর।
--তাহলে, সেই ব্যবস্থাই করো তুমি। গরীব কাঠুরিয়ার বেশেই আসবেন। এখানে তাঁর জন্য উপযুক্ত পোষাকের ব্যবস্থা করে রাখব আমি।
শেয়াল হেসে বলল—আমার মনে হয় না, তিনি পরেন তেমন পোষাক আপনার দেরাজে আছে।
--ঠিক আছে। তুমি এসো আমার সাথে। নিজের চোখে দেখে নাও আমার পোষাকগুলো।
শেয়ালকে নিয়ে একটা হলঘরে ঢুকে পড়লেন রাজা। হুকুম পেয়ে কর্মচারীরা পোষাক দেখাতে লাগল। কোনটাই পছন্দ হয় না শেয়ালের। সব শেষে রাজার নিজের দামী পোষাক নামানো হোল আলমারি থেকে।
সব দেখেটেখে শেয়াল বলল—কী আর করা যাবে? আমি বলব মহারাজকে, দু-চার দিনের তো ব্যাপার। এগুলোতেই চালিয়ে নেন যেন। আপনি কিছু ভাববেন না। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
রাজা বললেন—পোষাক-আশাক, অতিথিশালা, বাবুর্চিখানা সবই সাজিয়ে রাখছি আমি। দেখো বাপু, হতাশ কোর না যেন। নিয়ে এসো মহারাজকে।
সাধ্যমত চেষ্টা করবে, এই কথা দিয়ে, রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো শেয়াল।
পরের দিন। দোতলার বারান্দায় দোলনায় বসে দোল খাচ্ছিল রাজকুমারি। এমন সময় সুঠাম চেহারার এক যুবককে এগিয়ে আসতে দেখল। সাথে একটা শেয়াল দেখে, রাজকুমারি বুঝে নিয়েছে, সাধারণ পোষাকে আছেন বটে, এ-ই মহারাজ মিকো।
রাজকুমারির মনে হোল, মহারাজ না হয়ে, একজন সাধারণ কাঠুরিয়াও যদি হয়, এমন সুন্দর চেহারা, এমন সরল মনের একজন যুবককে পছন্দ না করে পারা যায় না।
রাজামশাইর সেরা পোষাকটি পরিয়ে, মিকোকে যখন দরবারে নিয়ে আসা হোল, সবাই দেখে অবাক। সকলেরই পছন্দ হয়ে গেল তাকে। কত বড় একজন মহারাজ। অথচ কত নিরহঙ্কার। কতো সহজ সরল। আহা, দুনিয়ায় এমন মানুষও আছে!
পরদিন চুপি চুপি রাজার কাছে গিয়ে শেয়াল বলল—আমাদের মহারাজ কম কথার মানুষ। দরকারী সিদ্ধান্ত নিতেও দেরি করেন না তিনি। তিনি আপনাকে জানাতে বলেছেন, আপনি অনুমতি করলে, আপনার মেয়ের সাথা একবার কথা বলতে চান তিনি।
রাজার তো আনন্দ ধরে না। তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হতে চলেছে। কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, শেয়াল বলল—ব্যস্ত হওয়ার কারণ নেই। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। চিন্তাভাবনা করুন। আগামী কাল জানাবেন আমাকে।
মেয়ে তো রাজি হয়েই ছিল। রাজার পারিষদবর্গও এক কথায় সম্মতি দিয়ে দিল। রাজাও সময় নষ্ট করলেন না। ধুমধাম করে মিকোর সাথে বিয়ে হয়ে গেল রাজকুমারির।
মিকোকে একলা পেয়ে শেয়াল বলল—তোমাকে বলেছিলাম কি না, রাজকুমারির সাথে বিয়ে দিয়ে দেব তোমার।
মিকো বলল—অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। তুমি কথা রক্ষা করেছ। কিন্তু এভাবে এই রাজবাড়িতে চিরকাল থাকতে পারব না আমি।
--কিচ্ছুটি ভাবতে হবে না তোমাকে। সেসব ব্যবস্থাও ভেবে রেখেছি আমি। তোমার কাজ হোল, আমি যেমনটি বলব, করে যাওয়া। পরে দেখে নেবে, আফশোস করতে হবে না তোমাকে। আর শোন, রাতের বেলা একবার রাজামশাইর সাথে কথা বলতে হবে তোমাকে।
মিকো আঁতকে উঠেছে—ওরে ব্বাবা, রাজার সাথে কথা? সে আমি পারব না।
শেয়াল বলল—ভাবছ কেন, সবই শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছি তোমাকে।
রাতের বেলা মিকো রাজাকে বলল—এখন আপনার পক্ষে উচিত কাজ হোল, একবার আমার সাথে যাওয়া। নিজের চোখে দেখা দরকার, কেমন প্রাসাদে মহারানি হয়ে থাকবে আপনার মেয়ে।
রাজা তো যারপরনাই খুশি। মনের ভার নেমে গেল তাঁর। একটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, কাজটা ঠিক করলেন তো? কোনও খোঁজখবর করলেন না। একটা বনের পশুর কথায় একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। তাও একেবারে অচেনা অজানা একজনের সাথে।
মিকোর কথা শুনে, একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন রাজা। পরদিনই সবাই ইলে মিকোর প্রাসাদে যাওয়া স্থির হয়ে রইল।
ভালো করে সকাল হয়নি তখনও। শেয়াল বলল—আমি এগিয়ে যাছি। সবকিছু ব্যবস্থা করে রাখতে হবে তো। তোমরা সবাই একসাথে এসো।
মিকো চেঁচিয়ে উঠল-- হায়, হায়। আমাকে একা ফেলে, কোথায় যাচ্ছো তুমি?
--কিচ্ছু ভেবো না। ভরসা রাখো আমার উপর। শোন, কয়েকটা কথা বলে যাচ্ছি তোমাকে। এখান থেকে রওণা দিয়ে, দিন তিনেক যাওয়ার পর, বিশাল একটা প্রাসাদ আছে। এক ড্রাগনের প্রাসাদ। সেটা তোমার পক্ষে মানানসই হবে বলে আমার বিশ্বাস।
--সে তো নাহয় হোল। কিন্তু সেটা আমাদের হবে কী করে?
শেয়াল জবাব দিল-- সে ভাবনা আমার। বয়স হয়েছে ড্রাগনের। তবে, ভয়াণক ধূর্ত। তোমাকে যা করতে হবে, সেটা বলি। কাল দুপুর পর্যন্ত যাওয়ার পর, একটা চৌমাথা দেখবে। সেখান থেকে বামহাতি পথে এগোতে থাকবে তোমরা। পথে যার সাথেই দেখা হবে, জিজ্ঞেস করবে—কার লোক তোমরা? যে জবাবই তারা দিক না কেন, শুনবে। কিন্তু কিছুতেই অবাক হবে না। মুখে হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে চলবে।
বিদায় নেওয়ার সময় শেয়াল বলল—চলি, বন্ধু। সেই সুন্দর প্রাসাদে আবার দেখা হবে আমাদের। তোমার যাত্রা শুভ হোক।
শেয়াল যেতে যেতে বড় রাস্তার চৌমাথা পেরিয়ে বাঁক নিয়েছে, দশ জন কাঠুরিয়ার একটা দলের সাথে দেখা। শেয়াল বলল—কেগো তোমরা? চললে কোথায়?
লোকগুলো বলল—আমরা হলাম গিয়ে ড্রাগন রাজার লোক। বনে যাচ্ছি কাঠ কাটতে।
--সর্বনাশ। সামনে অতবড় বিপদ। কী সাহসে তোমরা ঘর থেকে বেরিয়েছ?
--কীসের বিপদ? কী হয়েছে?
শেয়াল বলল—আরে, জানো না? মহারাজ মিকো তাঁর পুরো বাহিনী নিয়ে আসছে, শয়তান ড্রাগনটাকে নিকেশ করবে বলে। তার প্রজারাও কেউ রেহাই পাবে না।
কাঠুরিয়ার দল চেঁচিয়ে উঠল—রেহাই পাবার কোনও উপায় নাই আমাদের?
মাথাটাথা চুলকে, শেয়াল বলল—একটা উপায় হতে পারে। পথে যে-ই তোমাদের জিজ্ঞেস করবে, তোমরা জবাব দেবে—আমরা মহারাজ মিকোর লোক। ভুল করেও যেন ড্রাগনের নাম মুখেও এনো না।
খানিক দূর গিয়েছে, এবার জনা কুড়ি সেপাইর সাথে দেখা। তাদের সাথেও একই রকম কথাবার্তা হোল শেয়ালের। ‘আমরা মহারাজ মিকোর লোক’ এই কথা আওড়াতে আওড়াতে চলে গেল সেপাইগুলো। এবার শেয়ালের দেখা হোল, তিরিশ জন রাখালের সাথে। কয়েক হাজার ভেড়া নিয়ে চরাতে বেরিয়েছে তারা। একই রকম ভাবে তাদেরও শিখিয়ে দিল শেয়াল। তারাও ভয়ে ভয়ে একই কথা রপ্ত করতে করতে চলে গেল।
এইভাবে একসময় ড্রাগনের প্রাসাদে এসে হাজির হোল শেয়াল। বুড়ো ড্রাগন তখন অলস ভাবে বাগানে পায়চারি করছিল। বিশাল চেহারা। বয়সকালে বিরাট যোদ্ধা ছিল সে। এই প্রাসাদ, সেনাবাহিনী, লোকলস্কর আজ যা কিছু, সবই সে যুদ্ধ করে অধিকার করেছিল। বহুকাল আর যুদ্ধের দরকার পড়ে না। বসে বসে বয়সও হয়েছে ড্রাগনের। তেমনি ভুঁড়ি বাগিয়ে অকর্মণ্য আর আলসেও হয়েছে সেইসাথে।
শেয়াল তার সামনে গিয়ে, লম্বা করে একটা সেলাম ঠুকল—আপনিই তো ড্রাগন রাজা?
ড্রাগন গম্ভীর গলায় বলল—হ্যাঁ, আমিই মহান ড্রাগন রাজা। তুই কে? এখানে কেন?
শেয়াল ভারি উত্তেজিত আর আতঙ্কিত হওয়ার ভান করে বলল—আপনার কথা ভেবেই, এখানে চলে এসেছি। সামনে যে ভারি বিপদ আপনার।
--বিপদ? আমার? বলছিসটা কীরে হতভাগা?
--জানেন না, মহারাজ মিকো আসছেন আপনাকে কোতল করতে। সাথে তাঁর বিরাট বাহিনী। সেই ভয়েই তো আমি পালাচ্ছিলাম। ভাবলাম, আপনাকে আগাম খবরটা দিয়ে যাই। যদি কোনও মতে কোথাও গা ঢাকা দিতে পারেন। যাইহোক, আমি চলি।
ড্রাগন আঁতকে উঠেছে শেয়ালের কথা শুনে। চিৎকার করে উঠল—নাহে, একটু দাঁড়াও। চলে যেও না।
ড্রাগন বুঝতে পেরেছে, ঘাড়ে বিপদ এসে পড়েছে। সেদিন আর নাই তার। এই বুড়ো বয়সে শরীরের যা অবস্থা, নড়াচড়া করাই মুসকিল। যুদ্ধ করবার প্রশ্নই ওঠে না। লুকিয়ে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
শেয়ালকে বলল—ঠিক বলেছ। লুকিয়েই পড়তে হবে। নইলে, এ যাত্রা বাঁচব না। একটু সাহায্য কর আমাকে। যা পুরষ্কার চাইবে, সব পাবে। কোনও কিছুর অভাব নাই আমার।
--কী করতে হবে, বলুন। তবে, খুব তাড়াতাড়ি। আমাকেও তো প্রাণ বাঁচাতে হবে। পালাতে হবে এক্ষুণি।
ড্রাগন কাতর গলায় বলল—না, না। দেরী করাব না তোমার। আমাকে শুধু একটু লুকিয়ে পড়তে সাহায্য করো।
শেয়াল মনে মনে একচোট হেসে নিল। বলল—কোথায় লুকোবেন? বলুন আমাকে।
ড্রাগন বলল—ঐ কাপড়চোপড়ের গুদামঘরটায় ঢুকে পড়ছি। তুমি কেবল বাইরে থেকে শেকলটা তুলে দাও। তাহলে আর মহারাজের সন্দেহ হবে না, আমি ওটার ভিতরে থাকতে পারি।
হাতে তো চাঁদ পেয়ে গেল শেয়াল। বলল—যেখানে যাবার তাড়াতাড়ি চলুন। দেরি করলে, আমিও মারা পড়ব।
একেবারেই দেরি নয়। তাড়াহুড়ো করে গুদামঘরে ঢুকে পড়ে, ড্রাগন রাজা বলল—বাইরে থেকে শেকলটা তুলে দাও দয়া করে। বাঁচাও আমাকে।
শেয়াল হাসিমুখে শেকল তুলে দিয়ে বলল—কিচ্ছু ভাবতে হবে না আপনাকে। সারা জীবনের মত মরার ভয় দূর করে দিচ্ছি আপনার। এই কথা বলে, বাইরে থেকে শেকল তুলে দিয়ে, গুদামঘরে আগুন ধরিয়ে দিল শেয়াল। মহারাজ মিকো আসবার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। এক্মুঠো ছাই ছাড়া, ড্রাগনরাজার কোনও চিহ্নই আর রইল না।
এবার প্রাসাদের সব লোকজনকে জড়ো করে, একই কথা বলে শোনাল, যা সে আসবার পথে কাঠুরিয়া, সেপাই আর ভেড়াপালকদের বলেছে। নিজের নিজের জীবনের ভয়ে, ‘আমরা সবাই মহারাজ মিকোর লোক’—কথাগুলো মুখস্থ করতে লেগে গেল সবাই।
এদিকে রাজবাড়ি থেকেও রওণা দিয়েছে সকলে। রাজামশাই তাঁর মেয়ে এবং রাজবাড়ির লোকলস্করদের সব্বাইকে সাথে নিয়েছেন। জামাইয়ের প্রাসাদ দেখাতে হবে সকলকে।
চলতে চলতে এক সময় সেই দশজন কাঠুরিয়ার সাথে তাদের দেখা। রাজামশাই ভাবলেন—একসাথে দশ দশজন কাঠুরিয়া! কারা এরা?
রাজা লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করল—ওহে, কারা তোমরা? পরিচয় কী তোমাদের?
শেয়ালের দেওয়া পরামর্শ মতো, লোকগুলো শেখানো বুলি আউড়ে গেল—কারা আবার? এখানে সবাই আমরা মহারাজ মিকোর লোক। জঙ্গলে চলেছি কাঠ কাটতে।
মিকোও শুনল। কিন্তু তার মুখে কথা নাই। রাজার লোকেরা সবাই অবাক।
খানিক দূর গিয়ে, কুড়িজন ঘোড়সওয়ারের সাথে দেখা। জিজ্ঞেস করাতে, তারা জবাব দিল—কারা আবার? এখানে সবাই আমরা মহারাজ মিকোর লোক। কুচকাওয়াজে চলেছি।
রাজামশাই ভারি খুশি। শেয়াল তাহলে মহারাজ মিকোর সম্বন্ধে বাড়িয়ে কিছু বলেনি।
এর পর রাজার দেখা হোল তিরিশ জন রাখালের সাথে। কয়েক হাজার ভেড়া নিয়ে চলেছে তারা। এক সাথে এত বড় ভেড়ার পাল দেখে রাজা বেশ অবাক। লোকগুলোকে জানতে চাইলেন—ওহে, শোন। তোমরা কারা?
সেই একই শেখানো বুলি আওড়াল লোকগুলো—কারা আবার? এখানে সবাই আমরা মহারাজ মিকোর লোক। দেখছেন না, তাঁর কিছু ভেড়া নিয়ে চরাতে বেরিয়েছি।
রাজার চক্ষু চড়কগাছ। তাঁর জামাই হাজার হাজার ভেড়ারও মালিক। নিজেকে গরীব মনে হতে লাগলো তাঁর।
শুধু কি রাজা একা। তাঁর লোকলস্কর সবাইও বিস্মিত। এমন একজন বড়লোক। অথচ কোনও অহঙ্কার নাই। দম্ভ নাই। একেবারে একজন অতি সাধারণ মানুষ। দেখনদারীর ধার ধারে না, দুনিয়ায় এমন আর একজনও নাই নিশ্চয়।
এইভবে চলতে চলতে এক সময় সবাই ড্রাগনের বিশাল প্রাসাদের সামনে এসে হাজির হোল। সদর দেউড়িতে কাতারে কাতারে উর্দিধারী সৈন্য। দুটি সারিতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। তাদের পরে এসেছে ড্রাগনের খানসামা-বাবুর্চি, আর লোকলস্করের দল। রাজামশাই এসে পড়াতে সবাই একসাথে কুর্ণিশ জানিয়ে, চিৎকার করে উঠল—রাজামশাই, মহারাজ মিকোর প্রাসাদে আপনাকে স্বাগত। আপনি দীর্ঘজীবি হোন।
সবই শেয়ালের কারসাজি। সবাইকে শিখিয়ে পড়িয়ে অভিনয় করিয়েছে। মিকোর মধ্যে কোনও হেলদোল নাই। রাজামশাইকে নিয়ে প্রসাদের ভেতরে চলল সে। আসলে, তার সামনে সামনে চলছে শেয়াল। তার পিছন পিছন পা ফেলে চলেছে মিকো। অভিভূত রাজামশাই আর তাঁর লোকজনের মুখে কথা সরছে না।
বিশাল প্রাসাদ ড্রাগনের। বৈভব বা বিলাসিতার কোনও অভাব নাই। লোভনীয় সব খাবার দাবারের ভূরিভোজ। নাচ-গান-বাজনার আসর। এত আনন্দের আয়োজন তাঁর নিজের রাজবাড়িতে নাই।
বেশ ক’দিন জামাইয়ের প্রাসাদে কাটিয়ে, নিজের রাজবাড়িতে ফিরে চললেন রাজা। মিকোকে বললেন—দ্যাখো, বাবা। তোমার প্রাসাদের তুলনায়, আমার রাজবাড়ি একটা কুঁড়েঘর বললেই চলে। তাই তোমাকে সেখানে যাওয়ার কথা বলতে মুখে বাধছে আমার।
মিকো তো সেই এক গরীব কাঠুরিয়ার অভাবী ছেলে। বেশ বিনয়ের সাথেই জবাব দিল—এ কথা আর বলবেন না কখনও। একমাত্র মেয়ে আপনার। যখনই মন চাইবে চলে আসবেন। নইলে, খবর পাঠাবেন, আমরা দুজনে গিয়ে হাজির হয়ে যাব।
রাজামশাই দলবল নিয়ে ফিরে গেলেন। শেয়াল বলল—বন্ধু, তুমি প্রাণ বাঁচিয়েছিলে আমার। আমিও আমার কথা রেখেছি। রাজকুমারির সাথে বিয়ে দিয়েছি তোমার।
তাকে থামিয়ে দিয়ে মিকো বলে উঠল—কী বলছো হে তুমি। তার চেয়েও অনেক বড় কাজ করেছ তুমি। কুঁড়েঘর থেকে তুলে, এই বিশাল প্রাসাদে এনে বসিয়ে দিয়েছ আমাকে।
শেয়াল বলল—প্রাসাদের চেয়েও অনেক বড় তোমার হৃদয়। মেরে না ফেলে, জীবন দিয়েছিলে আমাকে। তোমাকে তারই পুরষ্কার দিয়েছেন বিধাতা। প্রাসাদের চেয়ে জীবন অনেক অনেকই বড়, বন্ধু।
শেয়ালের কথা কানে যাচ্ছে না মিকোর। বাবার শেষ কথাগুলো মনে পড়ে, চোখ ফেটে জল নামছে তার। শেয়াল বলল—কান্নাকাটি পরে কোর। এখন আমাকে অনুমতি দাও, জঙ্গলে ফিরে যাই।
মিকো তো আঁতকে উঠেছে—জঙ্গলে ফিরে যাই, মানে? আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?
শেয়াল বলল—বনের জীব আমি। বনেই যেতে দাও আমাকে। আমি আর বেঁচে নাই ভেবে, আমার মা-বাবা কতো কষ্টেই না আছে। তাদের কাছে যেতে দাও আমাকে।
এ কথায় আপত্তি করা যায় না। মন মরা হয়েও, না করতে পারল না মিকো। বলল—যাও তাহলে। তবে, ভুলে যেও না আমাকে। শেয়ালেরও মন ভার। বলল—জীবন ফিরিয়ে দিয়েছ তুমি আমাকে। চিরকাল আমার মনে গাঁথা হয়ে থাকবে তুমি। আর শো্ন, প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করব আমরা। পাড়ার যত শেয়াল, প্রতিদিন নিয়ম করে জানান দেব, তোমাকে আমরা ভুলে যাইনি। তোমার মতো একজন দয়ালু মানুষকে শেয়ালরা কোনদিন ভুলে যাবে না।
মিকো খুশি হোল একথা শুনে—ঠিক বলছ তো?
শেয়াল বলল—প্রতিদিন সূর্য ঢলে পড়লে, সন্ধ্যা নামবে যখন, তখন কান পেতে রেখো। আমাদের পাড়াশুদ্ধ সবাই হাঁক পেড়ে জানিয়ে দেবে, তোমার উপকার ভুলে যাইনি আমরা।
সেই থেকে আজও কেবল ফিনল্যাণ্ড নয়, সারা পৃথিবীর শেয়ালের দল, সন্ধ্যেবেলা ডেকে ওঠে। জানান দিয়ে যায়, উপকারির কথা ভুলে যায়নি আজও।
0 Comments