জ্বলদর্চি

ইতিহাসের ফাঁদ /পর্ব-১/অরিজিৎ লাহিড়ী

ইতিহাসের ফাঁদ 
পর্ব-১

অরিজিৎ লাহিড়ী

প্রাক্ -কথন

ঋতব্রত গুহ জানালার ধারে বসে ছিলেন। মুম্বইয়ের এক নিঃস্তব্ধ অ্যাপার্টমেন্টের ছোট্ট ঘর। চারদিকে ছড়িয়ে ছিল পুরনো কাগজ, গবেষণার খাতা, হলুদ হয়ে যাওয়া ফোটোকপি, বইয়ের স্তূপ। ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে ছিল, অথচ সময় এগিয়ে যাচ্ছিল নিজের খেয়ালে। মাথার ভেতর জমাট কুয়াশা। সেই পরিচিত অস্থিরতা, যা তাঁকে গবেষণার গভীরে ডুবে থাকলে প্রায়শই ঘিরে ধরে।

প্রথমে তিনি বুঝতে পারেননি শব্দটা কোথা থেকে আসছে। ধাতব ঘর্ষণের মতন একটা শব্দ। অদৃশ্য হাতের খোদাই করার আওয়াজ। শব্দটা ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছিল। একটা অদ্ভুত ঠান্ডা বাতাস জানালা-বন্ধ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল।

তারপর, অন্ধকারের ভেতর থেকে দৃশ্যটা গড়ে উঠেছিল। ধবলগিরি অথবা ওড়িষ্যার পাথরের গায়ে খচিত ছিল অদ্ভুত লিপি। সেই লিপির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন ছায়ামূর্তি—সম্রাট অশোক।

কিন্তু ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা করুণাময় অশোক নন। এ এক ভয়াবহ, নির্লিপ্ত, নিষ্ঠুর অশোক।
চোখে শূন্যতা, ঠোঁটে বিকৃত হাসি।

ঋতব্রত গুহ নড়তে পারছিলেন না। তাঁর শরীর জমে গিয়েছিল।তাঁর কানের মধ্যে বাজছিল ধাতব শব্দ।সেই পাথরের গায়ে ভেসে উঠছিল পালি ভাষায় লেখা—

‘সব ইতিহাস পুনর্লিখিত।
সব সত্য নির্মিত।
অতীত বলে কিছু নেই।
সবই খেলা।’

ঋতব্রত গুহ হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিলেন। বুকের ভেতর ধড়ফড়। মস্তিষ্কের কোণে প্রতিধ্বনি বাজছিল— কলিঙ্গ, কলিঙ্গ, কলিঙ্গ…

সম্রাটের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন—এই ইতিহাস মিথ্যে।এই করুণা এক মোড়কমাত্র।এই ন্যারেটিভ সাজানো।ভেতর থেকে কেউ যেন তাঁর স্মৃতির দরজা খুলে দিচ্ছিল।অদেখা, অজানা সব ছবি ফুটে উঠছিল চোখের সামনে।ঠিক তখনই এক ঝাঁকুনিতে জেগে উঠেছিলেন তিনি। ঘর নিঃস্তব্ধ। ঘড়ির কাঁটা চলছিল। কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিল যথাস্থানেই।কিন্তু ডেস্কের কোণে যেন একটা লালচে দাগ।রক্ত?অথচ কোথাও কোনও ক্ষত নেই।ঋতব্রত গুহ জানতেন না তিনি এখনও স্বপ্নে, নাকি জেগে উঠেছেন।তিনি শুধু বুঝেছিলেন—সবকিছু বদলে যাচ্ছে।ইতিহাস, বাস্তব, সত্য— সব।

আর এই অনিবার্য খেলার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি নিজে।এখান থেকে আর ফিরে যাওয়া নেই।


পর্ব ১

নভেম্বর মাসের রাত। সময়—আটটা।

দক্ষিণ কলকাতা। লেক রোড।চারুচন্দ্র কলেজের উল্টোদিকে, একটি পুরনো মাঝারি উচ্চতার অ্যাপার্টমেন্ট—নাম ‘প্রথম অ্যাপার্টমেন্ট’। এল ই ডি পথবাতির ফিকে আলো, দূরে কোথাও নরম পাতায় হাওয়ার দোলা—এই নিঃশব্দ অন্ধকারের মধ্যে দাড়িয়ে আছেন প্রফেসর ঋতব্রত গুহ।হাতের আঙুলে ধরা একটা সিগারেট, ঠোঁটের কোণে অন্যমনস্ক ছায়া।ধোঁয়া ওঠা বাতাসের দিকে তাকিয়ে একবার মনে হল, তিনি বুঝি নিজের সত্তাকেই দেখতে পাচ্ছেন—একটা অস্পষ্ট, কুয়াশার মতো অস্তিত্ব।
🍂

সিগারেটের ধোঁয়া গিলে গিলে ভাবছিলেন—‘আমি ঠিক কাজ করছি তো?’

না, এটা কোনও লজিক্যাল সিদ্ধান্ত নয়।এটা একটা টান, অদৃশ্য স্রোত, যা তাঁকে এই বাড়ির সামনে নিয়ে এসেছে।গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁর জীবনের নিয়মিত ছন্দ ছিন্নভিন্ন।স্মৃতির ভেতর ফাঁক, বাস্তব আর কল্পনার সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে রোজ।তিনি জানেন—অন্তত জানতেন—কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে।

কিন্তু এখন তাঁর ভিতরে, খুব গোপনে, একটা সন্দেহজনক প্রশ্ন জেগে উঠেছে—যার উত্তর খুঁজতেই তিনি এসেছেন। আর সেই উত্তরদাতা হতে পারেন শুধু একজন—ডক্টর হেমাঙ্গ হাজরা।

ডক্টর হেমাঙ্গ হাজরা একজন বিখ্যাত প্রবীণ স্নায়ুমনোবিজ্ঞানী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে মানব মস্তিষ্কের জটিলতা ও অজানা মানসিক অভিজ্ঞতা নিয়ে গবেষণা করেছেন।  সম্প্রতি মূলধারার গবেষণা থেকে অব্যাহতি নিয়ে নিজের খেয়ালেই প্যারাসাইকোলজির চর্চা করছেন , এবং এই ক্ষেত্রেও বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন । অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা ও মানসিক অবস্থার মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করার জন্য তিনি সম্পূর্ন নিজের আগ্রহেই আর্থিক বিষয়ের তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন মানুষের সমস্যার সমাধান করে দেন । অদ্ভুত মানসিক অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির বিকৃতি , অতিপ্রাকৃত ঘটনার যৌক্তিক ( বা অন্তত এমন কিছু যা মানুষের বোধশক্তির সীমার মধ্যে ) ব্যাখ্যা এবং স্নায়ুবিজ্ঞানের মাধ্যমে মানসিক রোগের বিশ্লেষণ করে তিনি গত তিন বছরে দুটি বই লিখে ফেলেছেন যা আন্তর্জাতিক মহলে এর মধ্যেই বেশ নাম করে ফেলেছে।

প্রথম অ্যাপার্টমেন্ট নামে ফ্ল্যাট বাড়ির দোতলায় তাঁর দু’কামরার আস্তানায় প্রথম ঘরটা দুনিয়ার বিচিত্র সব বইয়ের সম্ভারে ছোটখাট একটা লাইব্রেরির চেহারা নিয়েছে। তাঁর জীবন অনেকটা দুফাঁক করা দুই পৃথিবীর মতো।

তাঁর মনের ভেতরে একটা অংশ—অথেনটিক,একাডেমিক,বৈজ্ঞানিক। অন্যটা ধোঁয়াটে, সন্দেহভাজন, অতিপ্রাকৃত।তাঁর দু’কামরার ঘরটা যেন এই দুই মেরুর সম্মিলন। প্রথম ঘরে দেয়ালজোড়া বইয়ের তাক—মনোবিজ্ঞান, নিউরোসায়েন্স, ইস্টার্ন মিস্টিসিজম, দর্শন, প্যারানর্মাল স্টাডিজ, স্টিমপাঙ্ক আর সায়েন্স ফিকশনের অবিশ্বাস্য সংগ্রহ। সেইসব বইয়ের পাশে কখনও স্থান পেয়েছে পুরনো টাইপরাইটার, কখনও বা বিরল ফসিল, একটা ছোট্ট গ্রামোফোন আর কাচের জারে কিছু রহস্যময় ধুলোভর্তি বস্তু। ভেতরের ঘরটা তাঁর নিভৃত শয়নকক্ষ।সবকিছু নিখুঁত, পরিপাটি, অথচ কোথাও যেন একটা অদৃশ্য অস্থিরতা। যেন এই ঘরটার দেয়ালও রাতে পালটে যায়।

অ্যাপার্টমেন্টের গ্রাউন্ড ফ্লোরের এক কোণায় তাঁর ছোট্ট কনসালটেশন রুম—সেখানে এখন আর নিয়মিত বসেন না, তবু মাঝেমধ্যে দেশের নামী মনোচিকিৎসকরা ‘অসংজ্ঞায়িত মানসিক সমস্যার’ রোগীদের রেফার করেন তাঁর কাছে।ঋতব্রত ঘড়ি দেখলেন—রাত আটটা। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক সময়েই। এখন আর ফেরার উপায় নেই।এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়া। তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজায় টোকা দিলেন।

দরজা খুলে দিলেন নিজের হাতে—কালো বম্বার জ্যাকেট, ধূসর ট্র্যাক প্যান্ট , সাদা স্নিকার্স ।হাতে ধরা কালো ম্যাট ভেপ। ধবধবে সাদা চুল একেবারে আধুনিক ধাঁচে কাটা—সাইড একেবারে ছাঁটা, মাঝখানে সামান্য ঢেউ তোলা। চোখে পাতলা গোল টিন্টেড গ্লাস।বয়স আশি হলেও দেখলে মনে হয় চল্লিশের যুবক—উচ্চারণ, হাঁটার ভঙ্গি, চোখের ঝিলিক—সবকিছুই জেন-জি।

‘ইয়ো! দ্যাটস ইউ? মিস্টার ঋতব্রত, রাইট?’একবার দ্রুত চোখ বোলালেন, তারপর দাঁতে ঝিলিক—‘চিল ব্রো, কাম অন ইন। আমার টাইম লেজিট প্রাইসলেস—সো, লেটস ভাইব।’

ঋতব্রত মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন। এতটা ইনফর্মাল, এতটা আলট্রা-মডার্ন টোন—একজন প্রবীণ মনোবিজ্ঞানীর কাছ থেকে তিনি আশা করেননি।ঘরের ভেতরে ঢুকতেই বোঝা গেল—এই মানুষটার এস্থেটিক একেবারে অন্য।দেয়ালে নিয়ন সাইন, পুরনো বই আর হলোগ্রাফিক স্টিকার পাশাপাশি।এক কোণে ভিন্টেজ গ্রামোফোন, আরেকদিকে প্লে-স্টেশন ফাইভ। কফি টেবিলের উপর রাখা গা-ঢাকা ডার্ক ট্যারো কার্ড আর ব্রেন অ্যানাটমি স্কাল্পচার।

—‘সো, টেল মি, হোয়াটস বাগিং ইউ, ডুড।মেমোরি ডিসটরশন? ফল্স রিয়ালিটি? হ্যালুলু? অর… ইউ’র জাস্ট ট্রিপিন অন ইয়োর ওন কনশাসনেস?’

তিনি বসে ভেপ টানছেন, চোখের কোণে অদ্ভুত রকমের মজা।কিন্তু কথা বলার মধ্যে কোথাও যেন একটা ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তা ঝলসে উঠছে।

ঋতব্রত ধীরে ধীরে সোফায় বসে পড়লেন। ঘরের হালকা হলুদ আলো য় সময়টা যেন ঝুলে আছে। ডক্টর হাজরা ভেপের ধোঁয়া ছেড়ে চুপচাপ বসে আছেন, মৃদু হাসি ঠোঁটে। চোখদুটো স্থির।

ঋতব্রত একটু ইতস্তত করে বললেন—‘ডক্টর, ব্যাপারটা খুব জটিল… আমি জানি না ঠিক কীভাবে বোঝাব।’
তিনি গলা খাঁকারি দিলেন।

—‘আমি ইতিহাসের লোক। বড়জোর ফ্যাক্টস আর ডেটস—সেটা নিয়েই কাজ করি। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে আমার মনের মধ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটছে… যেগুলোর কোনও ব্যাখ্যা পাচ্ছি না।’

হেমাঙ্গ মাথা নাড়লেন।
—‘ডু ফিনিশ, ভাই।’
ভেপ টানার ফাঁকে ফিসফিসে গলা।

ঋতব্রত বললেন—‘আমার মনে হচ্ছে, আমার স্মৃতির মধ্যে কিছু অদৃশ্য পরিবর্তন ঘটছে।আমি নিশ্চিত ছিলাম, কলিঙ্গ যুদ্ধ ছিল এক মহান পরিবর্তনের মুহূর্ত। অশোকের জীবন বদলানোর গল্পটা তো সবাই জানে—
কিন্তু এখন, জানি না কীভাবে, বারবার আমার মাথায় আসছে—যুদ্ধটাই হয়তো ঘটেনি।মানে, আমার ভেতরে এমন সব স্মৃতি তৈরি হচ্ছে, যেগুলো আমি জানি আমি কখনও পড়িনি, জানতাম না, শিখিনি।কিন্তু তবু ওগুলো আমার নিজের স্মৃতির মতো দৃঢ়।’

হেমাঙ্গ এবার সোজা হয়ে বসলেন।গভীর চোখে তাকালেন।
—‘ইউ আর ট্রিপিং অন ইয়োর ওন রিয়ালিটি, ব্রো।বাট হোয়াট ইজ দ্য একচুয়াল ট্রিগার? শুধু মেমোরি গ্লিচ? অথবা—সামথিং এলস?’

ঋতব্রত পকেট থেকে একটা হলদেটে অনভেলপ বের করলেন। চোখে অস্বস্তির ছায়া।‘ডক্টর, আসল ঘটনা এইখানে।’ চিঠিটা বাড়িয়ে দিলেন।

—‘কয়েক সপ্তাহ আগে আমার মুম্বইয়ের বাড়িতে একটা অজানা ঠিকানা থেকে এই চিঠিটা এসেছে।

ডক্টর হাজরা ভেপ টানলেন। ঠোঁটের কোণে সেই চেনা খেলো হাসি। চিঠিটা নিয়ে খাম থেকে খুলে বের করলেন। আঙুলে ঝাঁকুনি নেই, মুখে একটা অনাবিল মজা।

—‘লেটস সি ভাই, কী লিখেছে তোমার সিক্রেট স্যান্টা।’

চোখ বোলাতে বোলাতে মুখে পড়তে শুরু করলেন, নাটকীয়ভাবে, ঠাট্টার সুরে—

‘ডিয়ার সিকর,

দ্য কলিঙ্গা ওয়ার নেভার হ্যাপেন্ড।

দ্য ট্রান্সফরমেশন অফ অশোক ইজ আ বিউটিফুলি কনস্ট্রাক্টেড লাই। 

ইয়োর হিস্ট্রি ইজ ফ্যাব্রিকেটেড—লেয়ার আপন লেয়ার অফ ফিকশন, ডিজাইন্ড টু কিপ ইউ অ্যাস্লিপ।

ইয়োর মেমোরিজ আর নট ইয়োরস।

দে আর কেয়ারফুলি প্লেসড, এডিটেড, অ্যান্ড রিরিটেন—অগেইন অ্যান্ড অগেইন।

ইউ আর নট দি অথর অফ ইয়োর লাইফ।

ইউ আর প্লেয়িং আ রোল রিটেন বাই হ্যান্ডস ইউ উইল নেভার সি।

ওয়েক আপ।
ফাইন্ড দ্য ক্র্যাকস।
ডিকোড দ্য লাই।

— কে’

চিঠির নীচে ডান দিক করে আবার একটা অদ্ভুত ঠিকানা লেখা।

বি-১-জি-০-০ / কে-এইচ / সেক্টর নাল
মেমোরি কারেকশন ইউনিট
রেড জোন—৭২
(নো পোস্টাল কোড ফাউন্ড)

ডক্টর হাজরা চিঠিটা পড়া শেষ করে থামলেন।ধীরে ধীরে কাগজটা ভাঁজ করে পাশে রাখলেন।ভেপের ধোঁয়া ছেড়ে ঠান্ডা গলায় বললেন—‘ভাই, একটা কথা বলি… এই জিনিসটা তুমি নিজেই বানিয়ে থাকলে আমি অবাক হব না।’

ঋতব্রত হতভম্ব।
—‘আমি… আমি কেন বানাব?’

হেমাঙ্গ একটু হেসে উঠলেন—‘দেখ, রিয়ালিটি আর ইল্যুলু-এর গ্যাপ এত পাতলা যে, তুমি নিজেই জানো না তোমার মাথা কখন কোথা থেকে ফেক নিউজ টেনে আনছে। তুমি ভাবছ এই চিঠিটা কারা যেন পাঠিয়েছে। কিন্তু… তুমি নিজেই পাঠাওনি তো?’

ঋতব্রত কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।

হেমাঙ্গ এবার ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বললেন—‘ওকে, সো, লেটস ডু দিস প্রপারলি।’

‘একটা পেন আর কাগজে এখনই নিজের নাম-ঠিকানা-ফোন নম্বর আর আজকের তারিখ লেখো। স্পেসিফিকালি লেখো: আমি এই চিঠিটা লিখিনি। আর সেটা লেখার সময়ও ব্রেনের মধ্যে যা যা ভাবছ, মুখে আওড়াবে।’

হালকা হাসি।
—‘স্মৃতি ভাঙতে গেলে স্মৃতি তৈরি করতে হয়, ব্রো।’

ঋতব্রত এবার ঘামতে শুরু করলেন।সঙ্গে সঙ্গে ভাবলেন—‘আমি কি সত্যিই লিখিনি? সত্যিই তো… লিখিনি… লিখেছি? আমি তো জানি না…’

হেমাঙ্গ ততক্ষণে পাশ থেকে একটা নোটপ্যাড আর পেন এনে ঋতব্রতের দিকে এগিয়ে দিলেন।
—‘ভালো করে লেখো। স্পেলিং ভুল কোরো না। আর আমি শুনতে পাব এমন করে আওড়াও।’

তিনি তখনও ভেপ টানছেন, মুখের কোণে সেই অদ্ভুত হাসি—যেন তিনি আগে থেকেই জানেন, অসত্য আর সত্যের মাঝখানটাই আসল থ্রেট।

ঋতব্রত উচ্চারণ করলেন—‘আমি ঋতব্রত গুহ।আমি এই চিঠি লিখিনি।’

হাত চলছিল।কিন্তু হঠাৎ… তিনি থেমে গেলেন।

হাতের লেখা কেমন যেন অচেনা লাগছে।অক্ষরগুলো বিকৃত, কখনও কাঁপা, কখনও মসৃণ। নিজের লেখার মধ্যে যেন অন্য কারও হাতের ছায়া। তিনি চমকে গেলেন।

—‘এটা… এটা তো আমার লেখা নয়!’

কণ্ঠস্বর কাঁপছিল ঋতব্রতের।

হেমাঙ্গ চোখ খুললেন। ধোঁয়া ছেড়ে শান্তভাবে বললেন—‘প্যাটার্ন মিসম্যাচ। স্মৃতির মধ্যে কারা যেন ঢুকে পড়েছে।’

তিনি হাত থেকে কাগজটা নিলেন।দেখলেন—একই শব্দ, কিন্তু অক্ষরের গঠন খাপছাড়া। কোথাও খামতি, কোথাও অদ্ভুত সূক্ষ্ম টান।

তারপর চিঠিটা আর সেই অদ্ভুত লেখা পাশাপাশি রেখে বললেন—‘ঠিক আছে। এইবার শোন। এই ঠিকানাটা—’
চিঠির পেছনের সেই ভৌতিক ঠিকানায় আঙুল ছুঁইয়ে বললেন—

বি-১-জি-০-০ / কে-এইচ / সেক্টর নাল
মেমোরি কারেকশন ইউনিট
রেড জোন—৭২

—‘এটা কোথাও নেই। কোনও ম্যাপে না, কোনও পিন কোডে না। এটা একটা… কী বলি…এমন কোনও জায়গার নাম, যেটা রিয়ালিটির বাইরে।এবং কেউ যদি এমন অ্যাক্সেস রাখে… সে আমাদের টাইমলাইন, ইতিহাস—সবকিছু বদলে দিতে পারে।এমনভাবে… যাতে কেউ জানতেও না পারে।’

কথাগুলো একটু ভাবুকের মতই নীচু গলায় বললেন হেমাঙ্গ।

তিনি ভেপের ধোঁয়া ছেড়ে গম্ভীর গলায় বললেন—‘তুমি এখন শুধু একটা প্রশ্নের মুখোমুখি—কবে থেকে তুমি ভুলে গেছ কোনটা সত্যি আর কোনটা নয়?’

ঘরের বাতাস থমকে গেল। কুয়াশার মতো ধোঁয়া ঘিরে ধরল দু’জনকে।

ঋতব্রতর হাত এখনও কাঁপছে।ডক্টর হাজরা চোখ বন্ধ করে ধোঁয়া ছাড়লেন—ঘরের বাতাসে যেন ভারী কুয়াশা জমে উঠছে।

—‘ভাই, এবার বলো, ঠিক কী জানো? কেন এসেছো?’
স্বরে ছিল অদ্ভুত নির্লিপ্তি, আর একরাশ সন্দেহ।

ঋতব্রত গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন—‘আমি… আমি আসলে এই বিষয়টা নিয়ে পড়তে শুরু করেছি প্রায় এক বছর আগে।’

তাঁর আওয়াজের মধ্যে একটা ভয় ছিল, একটা অবিশ্বাসও।

‘শুরুটা হয়েছিল একটা অবস্কিওর একটা পডকাস্ট শুনে। সেখানে বলা হচ্ছিল, কলিঙ্গ যুদ্ধ আদৌ ঘটেনি। সেটা একটা মোরাল ফিকশন—একটা তৈরি করা গল্প। তারপর… আমি ডুবতে শুরু করি।’

তিনি থামলেন। পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিন জ্বালালেন।

‘অ্যাকাডেমিক জার্নাল, অবস্কিওর ব্লগ, রেডিট থ্রেড, পুরনো আর্কিওলজিক্যাল রিপোর্ট—আমি সব পড়েছি। মিলিয়েছি।কিন্তু বারবার একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছি—ল্যাক অফ মেটেরিয়াল এভিডেন্স।’

ঋতব্রত শ্বাস নিলেন।

‘কলিঙ্গ যুদ্ধের কোনও ধ্বংসাবশেষ নেই। কোনও শত্রুপক্ষের লেখা নেই। অশোকের এই রূপান্তরের সমস্ত উৎস একতরফা—শুধু ওঁর নিজের শিলালিপি আর পরে বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ।’

‘তারপর,’—ঋতব্রত চোখ নামালেন—‘আমার মনে হতে থাকল… যদি পুরো ইতিহাসটাই—আমাদের কালেক্টিভ মেমোরি—ফ্যাব্রিকেটেড হয়?’

হেমাঙ্গ চুপ করে শুনছিলেন। ভেপের ধোঁয়া ঘুরছে, চোখের কোণে সেই হাসিটা স্থির।

—‘তুমি তো পুরোদস্তুর র‍্যাবিট হোল-এ পড়ে গেছো, ভাই।’

অথচ ডক্টর হাজরার গলায় ছিল না স্পষ্ট অবিশ্বাস। বরং… ছিল পুরনো কোনও সুপ্ত আগ্রহের ইঙ্গিত।

—‘আর এই চিঠি?’
হেমাঙ্গ আঙুল ছুঁইয়ে দেখালেন কাগজটা।
—‘এটা কোথা থেকে? কে পাঠাল?’

ঋতব্রত চাপা গলায় বললেন—‘জানি না। কোনও রিটার্ন অ্যাড্রেস নেই, আপনারও তো মনে হল এই ঠিকানা একেবারেই ধাপ্পাবাজি। খামের সিল… অদ্ভুত। আর হ্যান্ডরাইটিং… সেটা একদম… অচেনা। আমার ধারণা এটা কোনও… অর্গানাইজেশন, কোনও ক্ল্যান্ডেস্টাইন গ্রুপ—যারা আমাদের ইতিহাসের বাইরে থাকে, আমাদের টাইমলাইনের বাইরে।’

হেমাঙ্গ এবার একটু উঠে দাঁড়ালেন।ভেপের শেষ টানটা নিয়ে বললেন—‘আমি এখনই কিছু বলব না।তবে, তুমি যা বলছ, সেটা একদম ফেলে দেওয়ার মতোও নয়।’

হালকা হাসি।

—‘পোস্ট-ট্রুথ রিয়ালিটিতে, ফ্যাক্ট আর ফিকশন-এর মাঝে দেয়াল থিনার দ্যান ইউ থিঙ্ক, ব্রো।’

ঋতব্রত এবার দৃঢ় গলায় বললেন—‘আমি জানি না কোথায় যাব, কিন্তু আমাকে জানতেই হবে। আমাদের শেখানো ইতিহাস, আমাদের কলেক্টিভ বিলিফ—সব যদি মিথ্যা হয়?’

হেমাঙ্গ তাকালেন।কোনও কথা বললেন না।শুধু মুখের কোণে একটুকরো রহস্যের ছায়া।ঘরের বাতাস নিঃশব্দ হয়ে এল।

হেমাঙ্গ হাজরা একদৃষ্টে ঋতব্রতের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর ধীরে ধীরে বললেন—‘ভাই, তোমার মাথা অনেকদূর গেছে। এখন আমাদের দরকার গ্রাউন্ডেড থাকা।তুমি তোমার এই সংক্রান্ত সব নোটস, লিংকস, রিসার্চ—যা কিছু জোগাড় করেছ, আমাকে দেবে। আমি দুদিন সময় নিচ্ছি—পুরোটা স্টাডি করে দেখব।’


ঋতব্রত মাথা নাড়লেন।

‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। আমার বেশ কিছু ডক্যুমেন্ট আর পুরনো রিপোর্টস আছে। এসেছি কাল রাতে। পৈতৃক বাড়ি চন্দননগরে—সেখানে উঠেছি। এখানেই আছি—একমাস।’

হেমাঙ্গ চশমা খুলে চোখ ঘষলেন।

‘চন্দননগর? নাইস প্লেস। তোমার লিমিটেড টাইম । এই একমাসেই ক্লিয়ার করতে হবে—সবটাই গাঁজাখুরি গল্প, না কি ভয়ানক সত্যি।’

তারপর হালকা হাসলেন—‘তুমি এখন চলো। তোমার নোটস কাল সকালেই পাঠিয়ে দিও। আমি দুদিনের মধ্যে জানাব—কীভাবে এগোব।’

তিনি সামান্য ঝুঁকে বললেন—‘এবং জানিয়ে রাখছি…
যদি এই গল্পটা সত্যি হয়—তাহলে তুমি আর আমি দুজনেই বোধহয় খুব বেশিদিন… এই টাইমলাইন-এ থাকব না।’

ভেপের ধোঁয়া যেন আরও ঘন হয়ে ঘরের বাতাস ছেয়ে ফেলল।ঋতব্রত উঠে দাঁড়ালেন। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন। নভেম্বরের হৈমন্তিক বাতাস তাঁর গায়ে ছুঁয়ে গেল।

নভেম্বরের কুয়াশা-ঢাকা রাস্তায় নিজের সঙ্গে নিয়ে আসা গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ঋতব্রত বুঝতে পারেননি, কখন তাঁর চোখের সামনে সবকিছু বদলে গেল।

তাঁর চারপাশে এখন আর দক্ষিণ কলকাতা নেই।শুধু ধূলিধূসর, পাথুরে এক উপত্যকা—শূন্য দিগন্তের দিকে ছড়িয়ে আছে।আকাশ ধোঁয়ায় ভরা। কোথাও একটা বিষণ্ণ বাঁশির আওয়াজ।

দূরে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মানুষ—অর্ধনগ্ন, কাঁধে একফালি বস্ত্র, গা জুড়ে যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন। তিনি ‘অশোক’—কিন্তু তাঁর মুখ একদম অন্যরকম, চোখে নির্মমতা।

Post a Comment

4 Comments

  1. সূচনা ভালোই। পরের পর্বের অপেক্ষায়।

    ReplyDelete
  2. ভালো লেখা। আসতে থাকুক। নতুন ধরনের লেখার চেষ্টা জারি থাকুক।

    ReplyDelete
  3. Kamalika BhattacharyaOctober 10, 2025

    বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো,নতুন পর্ব আসুক।

    ReplyDelete
  4. শুরুটা ভালো লেগেছে।

    ReplyDelete