জাদুগর
পুলককান্তি কর
কয়েক দফা হোয়াটসঅ্যাপ আর ফেসবুকে চোখ বুলাতে বুলাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল অলক্তা। ওর বত্রিশ বছরের জীবনে এমন নিস্তরঙ্গ দিন কখনও ছিল না বলে মনে পড়ে না। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে আগে মনে হত, পরীক্ষাটা শেষ হোক, তারপর কিছুদিন কেবল ঘুম আর ঘুম দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দেখা যেত খেলা আর আড্ডা মেরেই সময় কুলোতো না। তারপর মা আবার মাধ্যমিক শেষ হতে না হতেই ইলেভেনের জন্য তিনখানা টিউটর রেখে দিয়েছিলেন। প্রতি বছর বিধান ওর পুরোনো বন্ধুদের সাথে তিন-চারদিনের একটা ব্যাচেলার ট্যুরে যায় বটে, কিন্তু এবারে ওর ছ’বছরের ছেলে তোতনও মামার বাড়ী চলে গেছে – সুতরাং অবসর একেবারেই বিঘ্নহীন এবং চুপচাপ। গত তিন-চারদিন ধরেই অলক্তা মনে মনে একটা উত্তেজনা অনুভব করছে আসন্ন মুক্তির কথা ভেবে, অনেক রকমের বিকল্প পরিকল্পনা গেঁথেছে মনে মনে, কিন্তু গতকাল রাতে বিধান বেরিয়ে যাবার পর থেকে তার মনে এক শূন্যতা গ্রাস করে আছে। শূন্যতা যে স্বামী পুত্রের অভাব জনিত তা কিন্তু নয়, এই অভাব বোধটা সময়টাকে পুরোপুরি উপভোগ না করতে পারার আফসোস। আজ ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম ভেঙ্গে গেছে তার, অথচ রোজ একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমোনোর কী পরিমাণ আকূল বাসনা তার ছিল এতগুলো বছর! বিয়ের প্রথম প্রথম শ্বশুর বাড়ীতে সকলে উঠে পড়ার আগে উঠে পড়তে হতো। তোতন পেটে আসার পর তো শান্তির ঘুমই ছুটে গেছে তার। বিধান ফ্ল্যাটে উঠে আসার পরও ভোরে ওঠা থেকে রেহাই মেলেনি তার, বিধানের এখন যেখানে অফিস, সকাল আটটার মধ্যে খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। ওর খাওয়া, টিফিন, তোতন কে তৈরী করে স্কুলে পাঠানো – সব ওর একার হাতে, অথচ বিধান ওকে কোনওদিন সামান্যতম সংসারে কোনও কাজে সাহায্য করে না। এমনকি বাজার হাটও অলক্তা নিজের হাতে করে। রোজ সকালে যন্ত্রের মতো ঘড়ির কাঁটা মেনে ওর দিন যায়, অথচ আজ নিজের জন্য একটু চা বসাতেও ক্লান্তি আসছে তার। চন্দনাকে ফোন করলে হয়, কিন্তু ওর এখন অফিস যাওয়ার তাড়া। মোবাইলে কয়েকবার এদিক-ওদিক সার্ফিং করে বিছানায় ওটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল অলক্তা।
আজ আর কোনও জলখাবার বানাবে না সে। যদিও গতকাল রাতে ভেবে রেখেছিল আমূল দুধের গুঁড়ো, বেশি করে চিনি দিয়ে চিড়ে মেখে খাবে সকালে, যেমনটা ওর ছোটবেলায় মা মাখতো। সামান্য একটা জিনিস, অথচ বিয়ের পর এই সাত সাড়ে সাত বছরে একবারও খেয়ে ওঠার সুযোগ হয়নি তার। অথচ রান্নাঘরে গিয়ে একটু চিড়ে ধুয়ে ভিজিয়ে নেওয়ার উদ্যমটুকুও ওর নেই। জোর করে উঠে চা বসিয়ে টিভিটা খুললো সে। কিছু সিরিয়ালের রিপিট টেলিকাস্ট, যেগুলো জীবনে দেখে না সে। ইউটিউবে রোজ একটু রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনার অভ্যেস তার – আজ যেন কোনও গানই তাকে স্পর্শ করছে না, সবই বেসুরো লাগছে। করবে না করবে না ভেবেও চন্দনাকে ফোনটা লাগিয়েই দিল অলক্তা, ‘কী রে চন্দনা, তুই কি অফিস বেরোচ্ছিস?’
– না রে। আজ আমি ছুটি নিয়েছি। ব্যাঙ্ক পোস্ট অফিসের কিছু কাজ আছে। তা তুই এত সকালে, বর কোথায়? অফিস বেরিয়ে গেছে?
– ভুলে গেছিস তুই, বলেছিলাম তোকে – ওরা প্রত্যেক বছর বন্ধুরা মিলে যে ট্যুরে যায় …
– ও হো, বলেছিলি বটে। তা কবে গেল?
– কাল রাতে।
– কোথায় গেল যেন?
– ওই নেপাল বর্ডারের দিকে। এক্সাক্ট জায়গাটার নাম মনে নেই।
– তোতন কী করছে?
– মামার বাড়ী। দিদিমার আদর খাচ্ছে।
– বাব্বা। তুই তো একেবারে ঝাড়া হাত পা রে! তা ঘরে বসে আছিস কেন? বেরিয়ে পড়। কত কী করতে তো তোর ইচ্ছে করতো – একা একা বাগবাজারের গঙ্গার তীরে বসে থাকতে, লঞ্চ ধরে অকারণ এপার ওপার করতে, উদ্দেশ্য বিহীন ট্রামে চেপে ঘুরে বেড়াতে – সে সব কর।
– কোনটা দিয়ে শুরু করি বলতো?
– আগে তো বেরো ঘর থেকে। যখন চলাটা উদ্দেশ্যবিহীন, তাকে আর প্ল্যানবন্দী করে লাভ কি? বেরিয়ে পড়। সামনে যেদিকে প্রথম বাস পাবি, উঠে পড়বি।
– আসলে ভাবনাগুলোও এতখানি ছন্নছাড়া যে সেগুলোকে রূপ দেওয়ার উদ্যমটাই পাচ্ছি না চন্দনা। তুই তো ব্যস্ত, নইলে তোর সাথে কোথাও বেরোনো যেত।
– বিধান ফিরবে কবে?
– ছ’ দিন পরে। সামনের সোমবার।
– তুই এক কাজ কর না অলি, কাল বা পরশু আমার অফিসে চলে আয়, একটু ম্যানেজ করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাব। গড়িয়াহাটটা কাছেই পড়বে। ঘুরে এলে হয়।
– একটা মুভি দেখার প্ল্যান করলে হয় না?
– আমার তো আর তোর মতো বর ব্যাচেলার পার্টি করতে যায়নি! বর বাচ্চাকে ফেলে যাই কী করে বল?
– তা ঠিক। ঠিক আছে রে।
একটু চুপ থেকে চন্দনা বলল, ‘একটা কাজ কর না অলি, সৌকর্ষকে একবার ফোন কর। একটা ছোট ডে ট্যুর করে আয়।’ দুষ্টু হাসি হাসলো চন্দনা।
– ইয়ারকি মারিস না রে। তোর যতসব বদ বুদ্ধি।
– বদ বুদ্ধি কী দিলাম? এককালে সারা কলকাতা তো ওর সাথেই চষতিস, না কি? কোনও কারণে বিয়েটা হয়নি বলে যে ভালোবাসাটা মিথ্যে ছিল, তা তো নয়। জীবন একটাই, এনজয় কর।
– এভাবে বেরোনোটাকে এনজয় করা বলে না চন্দনা। ও এখন ওর জীবনে সেটলড। মিছিমিছি খুঁচিয়ে ঘা করে লাভ কী?
– অলি, সত্যি করে বল তো, বিধানকে নিয়ে কি তুই সুখী?
চুপ করে থাকল অলক্তা, চন্দনা বলল, ‘তোর মুখ থেকে যা শুনি, ও মোটেই তোর প্রতি কেয়ারিং নয়। তোর থেকে শুধু রিলেশনের ফায়দা তোলে। অথচ এই সাত আট বছর তুই তার কক্ষপথ ধরেই কেবল ঘুরে চলছিস, তার ভালো-মন্দ খুশী অখুশীকে প্রাধান্য দিয়েছিস; উল্টোটা কখনও পাসনি। সে বাড়ীতে থাকলে তোর দম বন্ধ লাগে। সেই দু চার দিন যদি তুই তোর মতো করে বেঁচে নিস, ক্ষতি কী?
– সৌকর্ষের সাথে দু চারদিন ঘুরে নিলে বুঝি বেঁচে ওঠা যাবে?
– তা নয়। তবে এক কালের ভালো লাগাতো! দু চারদিন সেই গন্ধ গায়ে লাগলে হয়তো পুরোনো মরে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে ছোঁয়া যাবে।
– তাতে তো ক্ষতি বেশী চন্দনা! যে স্হিতাবস্থা এখন চলছে দুই পক্ষেই, অকারণ জলে ঢিল মেরে লাভ কী?
– তুই কনজার্ভেটিভ, নইলে তোকে এর থেকেও এক্সাইটিং পরামর্শ দিতাম।
– কী সেটা?
– এসকর্ট সার্ভিস এর নাম শুনেছিস?
– সেটা কী জিনিস?
– এই পছন্দসই পুরুষ মহিলা চাইলেই ঘরে বা বাইরে হোটেলে…
– ছি ছি চন্দনা! তোর স্বভাব গেল না। তুই যা মুখে আসে তাই বলিস। খুব জোরে জোরে হেসে উঠলো চন্দনা। ওর হাসিটা বেশ ছেলেদের অট্টহাসির মতো, দিলখোলা। বলল, ‘জানিস না আমাদের লবঙ্গ মাঝে মাঝে এদের সার্ভিস নেয়?’
– কী যা তা বলিস চন্দনা! আমাদের লবঙ্গ লতার এত খিদে? ও তো খুব সরল সাদা সিধে টাইপের মেয়ে ছিল!
– তা ছিল। তবে কিনা সব সময় লবঙ্গ চুষে চুষে দেহে গরম বেড়ে গেছে নিশ্চই।
– আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না চন্দনা। ও এত সিম্পল আর খোলা মনের ছিল…
– অলি তুই বাংলায় ইংরেজীতে যেভাবেই বল সরল সাদাসিধের সাথে এই ব্যাপারটার কোন দ্বন্দ্ব নেই। এই ব্যাপারটা নিছক শারীরিক চাহিদা হয়তো নয়। হয়তো এটা কোনও কিছুর প্রতি বিদ্রোহ, কোনও কিছুর প্রতিবাদ।
– আমি মানতে পারলাম না চন্দনা। ইটস আ কাইন্ড অফ প্রস্টিটিউশন। পুরুষ এসব করে বলে বা আমার বর এসবে অভ্যস্ত বলে আমিও করবো – এই ধরনের বিদ্রোহ প্রতিবাদ নারীবাদ কোনও কিছুই আমি মানতে পারলাম না।
– সেটা আমি জানি। তুই খুব পিউরিটান তো। তবে কিনা আমার এইসব বায়াসনেস নেই। আমার ইচ্ছে হলে …
– ছি ছি চন্দনা। তুই আর সকাল সকাল এসব কথা বলিস না। যাকে চিনি না জানি না – পয়সা দিয়ে তার সাথে আদৌ কোনও সঙ্গ সুখ হয়?
– ছাড়। তোকে এত জটিল বিষয়ে মাথা ঘামাতে হবে না অলি। তোকে তো আমি অচেনা সঙ্গ করতে বলছি না। চেনা লোকই তো, ভালোবাসার ও। ডেকে নে দুপুর বেলা।
– ফোন রাখ।
– কেন রে? হাসলো চন্দনা। ‘মনে মনে দেয়ালা করবি?’
– তোর আজ কী হয়েছে রে? ঘুম থেকে উঠে আবোল তাবোল বকছিস! রাতে ঘুম হয়নি?
– ঘুম দিব্যি হয়েছে, আর আমিও দিব্যি নিজের মতো আছি। ভালো পরামর্শ দিলাম, নিলে নে, নইলে ছাড়।
দুপুরে একটু সিদ্ধ ভাত বসিয়ে নেবে নাকি জোমাটোতে খাবার অর্ডার দেবে ভাবতে ভাবতেই অলক্তার ফোন বেজে উঠলো। মা। সকাল থেকে অন্তত চারবার ফোন হয়ে গেল, চলে আয়, চলে আয়। জামাই ছেলে নেই যখন, ফাঁকা ফ্ল্যাটে একা একা হাত পুড়িয়ে সংসার ঠেলার অর্থ কী – বোধগম্য হচ্ছে না তাঁর। স্বাভাবিক, বিয়ের পর থেকে একটা দিনের জন্যও একা কখনও অলক্তা বাপের বাড়ী যায়নি। হয়তো নিভৃতে মায়েরও কিছু গোপন কথা বলার আছে তাকে, বা হয়তো নিতান্তই স্নেহের টানেই আশার আহ্বান তাঁর। এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়েই অলক্তি ফোনটা ধরল, ‘বলো’।
– কী করছিস?
মিথ্যেই বলল অলক্তা, ‘ঘরদোর গোছাচ্ছি।’
– রোজই তো গোছাস – চলে আয় না। তোর বাবা আজ ভেটকী মাছ এনেছে বাজার থেকে। ফুলকপি দিয়ে ঝোল করছি, তোর তো ফেভারিট।
– এখন কটা বাজে খেয়াল আছে?
– একটা দশ।
– এখন বেরিয়ে কখন বাড়ী পৌঁছাবো বলো দেখি?
– সে তো তোর দোষ। সকাল থেকে তো কতবার বললাম।
– ছাড়ো না মা। পুরো আলমারির জিনিসপত্র নামিয়ে বসে আছি। এভাবে মাঝপথে ফেলে যাওয়া যায় না।
– সে তো আমি জানি, না যখন বলেছিস একবার, সে কি আর ‘হ্যাঁ’ হবে।
– তা হলে বারবার বলছ কেন?
– এই তো সবে মা হলি, বুঝবি পরে।
মা’দের এই টিপিক্যাল কথাটা অলক্তার একদম ভালো লাগে না। অকারণ বাঁধন ভাল লাগে না তার। মা কে তার খুবই ভালো লাগে, কিন্তু এসব অতিরিক্ত আবেগ সে একদম নিতে পারে না। একটু থেমে মা বললেন ‘তুই কি এ ক’দিনের মধ্যে একবারও আসবি না?’
অলক্তা একটু রূঢ় গলায় বলল ‘না।’
– ছেলেটার জন্যও তোর মন কাঁদে না? আমাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম।
– আবার সেন্টিমেন্টাল সুড়সুড়ি শুরু করলে? আচ্ছা মা, জীবনে তিন চারটা দিন সবার থেকে দূরে একদম নিজের মত কাটাবার কি আমার স্বাধীনতা নেই?
– এ সব আবার কী কথা? মানুষ কি একা একা বাঁচতে পারে? কই আজ পঞ্চান্ন বছরে আমার তো কখনও মনে হয়নি, যাক বাবা, তোর বাবা বাড়ীতে নেই বাঁচা গেছে! আমার তো বরং সব সময় মনে হত লোকটা বাইরে গেছে, কেমন আছে, কী করছে, কি খাচ্ছে – এইসব! তোদের আজকাল ছেলেমেয়েদের সবকিছু যেন কেমন?
– সবকিছু নিজের অ্যাঙ্গেলে ভাবো কেন? আমার একটা ব্রেক দরকার মা। এতদিন সংসারের জাঁতাকলে পিষছি। এই ক’টাই তো দিন!
– কী করবি এই ছ’দিনে? তুই কি নেচে বেড়াবি, না কি উড়ে বেড়াবি?
– এতদিন তো নেচেই কাটছিলো মা। এই পুতুলের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গই তো অন্যের সূতোতে বাঁধা। সূতো ছেঁড়ার তো সাধ্য নেই, টান মারার লোকেরা যখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, সেই ফাঁকে আমি একটু জুড়িয়ে নিই না কেন?
– এ সব হেঁয়ালি আমি বুঝি না বাবা। দুম করে ফোনটা রেখে দিল মা।
অলক্তা ভাবে, মা কি সত্যি কোনও নিভৃতি চায় না? নাকি এত বছরের সংস্কার আর অভ্যেসে মা তার নিজের স্বতন্ত্র অস্তিত্বটাই ভুলে গেছে? অলক্তা আজ আর কিছু মনে রাখে না, অথচ সৌকর্ষের সাথে ওর বিয়ে না হওয়ার মস্ত কারণ ছিল মা। বাবাকে রাজী করানো খুব শক্ত হত না। শুধুমাত্র গায়ের রঙ একটু কালো বলে আর তুলনায় নীচু জাতের বলে মা সৌকর্ষকে পছন্দ করেনি। এমনও নয় সে বেকার পাত্র ছিল। ছেলেটাকে সারাটা জীবন জানানোই হল না, আদৌ তার কোনও অযোগ্যতা ছিল না। অলক্তার মনে পড়ে শেষ দিন সে ফোন করেই সৌকর্ষের সাথেই সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছিল। সেই সময় ওর সাথে দেখা করে ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার বা ওর পাশে দাঁড়ানোর সাহস করেনি। হয়তো ঠিকই করেছিল সে, তাতে কষ্ট হয়ত উভয়পক্ষে বাড়তো। সর্বোপরি বাবা মা’র পছন্দের কারণটা এত লজ্জার যে স্বীকার করতে তার কুণ্ঠার অবধি থাকতো না। সৌকর্ষ তাকে অসম্ভব ভালোবাসতো, যত্ন করতো। বিধানের থেকে কোনও অংশে কি তার অযোগ্যতা ছিল? সেই এক মাথা ঢেউ খেলানো চুল আর মায়াদার চোখের করুণ মুখটা বারবার মনে আসতে লাগলো অলক্তার। একবার ফোন করলে কেমন হয়? ভাবতেই বুকের মধ্যে যেন একসঙ্গে একশোটা মাদল বেজে উঠলো এখনও সৌকর্ষ ওর মধ্যে এতখানি ঝড় তোলে? ভাবতেই অবাক হল সে। গত সাত বছরে ওর সাথে একবারও ফোনে যোগাযোগ হয়নি, যদিও ওর ফোন নম্বর ওর কাছে সেভ করা আছে। দু একজন কমন বন্ধু-বান্ধবের মুখ থেকে মাঝে মাঝে ওর কথা শোনে সে, ফোন নম্বর যে ওর বদলায়নি, এ খবরও তার কাছে আছে। আজ এতদিন পরে ওকে ফোন করার এত অদম্য ইচ্ছে কেন হচ্ছে তার? এ কি চন্দনার কথায় প্রেক্ষিতে? না কি কোথাও তার অবদমিত ইচ্ছা সৌকর্ষর সাথে নিভৃত মিলনের অবকাশ খুঁজে এসেছিল এতদিন? ও ডাকলে সত্যি সত্যি সৌকর্ষ সাড়া দিয়ে আসবে তার বাড়ীতে? ওর আকর্ষণ কি এখনও ওকে পাগল করে? এখনও কি সৌকর্ষ মুগ্ধ বিষ্ময়ে তাকিয়ে দেখবে তার অজানুলম্বিত চুল, হরিণীর মতো চকিত চোখের তারা? অলক্তা জানে না তার চোখের তারা সত্যিই এখন আর হরিণীর মতো চমকে বেড়ায় কিনা! গত সাত বছরে কেউ তাকে বলেনি তেমন কথা। এখনও তার চলায় কি তেমনি বায়বীয় ছন্দ আছে? নাকি সামান্য পৃথু দেহভার ছিনিয়ে নিয়েছে তার পায়ে পায়ে উড়ে চলা? জানা দরকার। বড্ড জানা দরকার তার। উত্তেজনায় হাত কাঁপতে লাগলো তার। কাঁপা হাতে মোবাইলে ডায়াল করলো সৌকর্ষের নম্বর। গম্ভীর ভারী গলা, তবুও নিশ্চিত হয়ে নেওয়া – সৌকর্ষ কথা বলছেন?
– হ্যাঁ। বলুন।
– গলা শুনে চিনতে পারলে না? অলক্তার মনে ছিল না ও নতুন নম্বর থেকে ফোনটা লাগিয়েছে।
– তুমি অলক্তা?
– জিজ্ঞাসা কেন? নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না?
– অনেক দিনের অনভ্যাস তো। অনুমানের ঢিল ছুঁড়ে বিপদগ্রস্ত হওয়ার থেকে জিজ্ঞেস করে নেওয়া ভালো ।
– কেন? এরকম ঠকেছ বুঝি?
– ছাড়ো ওসব কথা। তুমি হঠাৎ ফোন করলে যে?
– কেন, করা বারণ?
– বারণ কোনও কালেই ছিল না। সাত বছর যদি সেটা পালন করে থাকো তো সেটাই নিয়ম মনে করা ভালো। অন্যথা হলে প্রশ্ন তো জাগবেই।
চুপ করে রইলো আলক্তা। ফোনটা সে আগে থেকে প্ল্যান না করেই করেছে। আগে থেকে ভেবে রাখলে এইসব বাক্য বান ভালো মত সামলানো যেত – কিন্তু যে তীর একবার জ্যা থেকে বেরিয়ে যায় তাকে আর ফেরানো যায় না।
একটুক্ষণ থেমে সৌকর্ষ জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার বর কই? অফিসে গেছে বুঝি?’
– না না। সে এখন পুরোনো বন্ধুদের সাথে ব্যাচেলার ট্যুর করতে গেছে পাহাড়ে।
– ও তাই বলো। ত্রিসীমানায় সূর্য নেই বলেই পুরোনো তারা চোখে পড়ছে।
বড় বোকা কথা বলে ফেলেছে অলক্তা। ওর বক্তব্যের যে কেউ এমন মানে করবে। তবু সপ্রতিভ হবার জন্য বললো, ‘তা কেন? ও কি সব সময় আমাকে ঘিরে বসে থাকে?’
সৌকর্ষ একটু থেমে খানিকটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, দ্যাখো অলক্তা, তুমি জানো পয়েন্টে পয়েন্টে কথা তুলে তর্ক করার প্রবৃত্তি আমার আগেও হত না এখনও হয় না। তবু তোমার কথার উত্তরে একটা কথাই মনে আসছে, তা যদি না হয় তো এখন কেন?
নিজেকে বড় অসম্মানিত আর হ্যাংলা মনে হলো অলক্তার। এ কি সৌকর্ষের এতদিনের পুষে রাখা রাগ? অভিমান? যে নাকি ওর জন্য এতখানি পাগল ছিল, ওকে না পেলে যার নাকি জীবন বৃথা হয়ে যাবে – সে কি কেবল প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এসব কথা বলেছে? নাকি সে তার জীবনে পুরোনো ইতিহাসের কথা ভেবে এখন আফসোস করে? মানুষের ভালোবাসাটা আসলে কী? কেবল স্বার্থ? বিপরীতে দাঁড়ানো মানুষটির কাছে নিজের ইগো কে অতুল্য দেখানো?
একটু পর স্বাভাবিক গলায় সৌকার্ষ বলল, ‘তোমার একটি ছেলে শুনেছিলাম, তাই আছে, নাকি আরো বেড়েছে?’
– তাই আছে।
– কী নাম রেখেছ?
– অর্ক।
– বাঃ। ভালো নাম। পাঁচ বছর হল বোধ হয় ওর।
– হ্যাঁ। তোমার ছেলে মেয়ে?
– এখনও হয়নি। হলে জানাবো।
অলক্তা শুনেছিল সৌকর্ষের বিয়েটা নাকি ভালো হয়নি। ওর বউ তো নাকি একবার ফোর নাইনটি এইট এর কেস দিয়েছিল সৌকর্ষ ও তার মা বাবার বিরুদ্ধে। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে হাতে পায়ে ধরে নাকি জেল হাজত থেকে বেঁচেছিল ওরা। নিজে থেকে না বললে এসব তো জিজ্ঞাসা করা যায় না। আবার ভদ্রতা করে ওর বউ এর কথা কিভাবে জিজ্ঞাসা করবে ভেবে উঠতে পারলো না অলক্তা।
দু চারটে একথা সেকথার পর সৌকর্ষ জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কি আমায় কিছু বলবার জন্য ফোন করেছিলে?’
– না না। সেরকম কিছু না। মাঝে মাঝে ভাবি ফোন করবো, খবর নেব, আজ সুযোগ হল।
– আমি তো প্রথমে তাই বলছিলাম অলি। তুমি তোমার প্রিয় মানুষটার প্রভাবে এতখানি আবৃত হয়ে আছো যে তার আড়ালে থাকা লোকজন আর চোখেই পড়ে না। ধাঁধস লেগে যায়। যাই হোক, ইচ্ছে হলে ফোন করো মাঝে মাঝে।
অনেক কথা বলার ছিল, কিছুই বলা হল না। হয়তো বলা যায় না কিছু। অলক্তা ভাবতে বসলো ওর আর সৌকর্ষের মধ্যে সত্যিকারের কি কোনও ভালোবাসা ছিল? নাকি পুরোটাই ইনফ্যাচুয়েশন। লোকে যে বলে প্রথম ভালবাসা আজীবন বেঁচে থাকে – তা কি পুরোটাই মিথ্যে? সৌকর্ষকে ফোন করার আগেও যতটুকু উত্তেজনা হচ্ছিল, এখন পুরোটাই গায়েব। এখন মনে হচ্ছে মিছিমিছি এই বাহুল্যটা না করলেই ছিল ভালো। কেমন যেন একটা গ্লানি এসে আঁকড়ে ধরলো ওর বুকের ভেতর।
(২)
বিধানের ফোন এসেছিল একটু আগে। রুটিন ফোন। মাঝে আর খালি একটা দিন। পরশুদিন ট্রেনে চেপে সোমবার ফিরবে ওরা। প্রতিদিনের এই ফোনটা এসে যেন যাচাই করে নেয় কক্ষপথে গ্রহের আবর্তন ঠিক কতটা। রোজ বিধান প্রথম প্রশ্নটাই করে ‘কী করছিলে?’ অলক্তা রোজ কিছু না কিছু উত্তর দেয়। সে বোঝে না তার উত্তরের মধ্যে বিধানের অভাব অনুভব করার সলজ্জ ইঙ্গিতটুকু কোথাও সে আশা করে কিনা! হয়তো করে, হয়তো করে না; কিন্তু অলক্তা সে পথ দিয়ে হাঁটার চেষ্টাই করে না। বিধান একটু নিরিবিলি খুঁজে দু’চারটে আদিম কথাও বলে নিল। আজ হয়ত মন ভালো আছে। থাকবারই কথা। পাহাড়ী পরিবেশ, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গ – সব অনুষঙ্গই মানুষকে কিছুটা বিশুদ্ধ করে দেয়। দৈনন্দিন কুট কাচালি, শহুরে ধন্ধ হয়ত সাময়িক কেটে যায় ওতে। বিধানের ফোনটা রেখেও ওর কথাগুলোর রেশ থেকে গেছে অলক্তার মনে। যে মানুষটাকে সাথে নিয়ে সারাটা জীবন কাটাতে হবে – তার অনুপস্হিতির প্রতিটা মুহূর্তে যে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার ইচ্ছে জাগাচ্ছে ওর মনে – এই বিষয়টা বড় গ্লানিকর। একটু বাদেই অলক্তা বেরোবার প্ল্যান করেছে চন্দনার সাথে, স্নানে ওঠার দরকার।
চন্দনা আজ সুন্দর একটা চুড়িদার পরে রাসবিহারীর মোড়টায় দাঁড়িয়ে আছে। এখনও ভারী সুন্দর ওর গড়ন। ফোনে কারও সাথে এক মনে কথা বলে যাচ্ছে। অলক্তা এসে কতক্ষণ যে ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, খেয়ালই করছে না সে। খানিকক্ষণ পরে নজর পড়তে বলল, ‘স্যরি, চল অটো ধরি।’
– কার সাথে এত মগ্ন হয়ে কথা বলছিলি? বিজয়দা?
– না রে। অফিস টাইমে ওকে কল করলে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে। বলে, বাড়ীতে সারাদিন থাকার সময় তোমার এ সব কথা বলতে মনে থাকে না?
– এটা সব বরদেরই বৈশিষ্ট্য। ফোন করলেই খালি ‘হুঁ,’ ‘না,’ ‘আর কিছু?’
– ঠিক বলেছিস। আমি তো নেহাৎ ঠেকা ছাড়া বিজয়কে ফোনই করি না।
– তা এতক্ষণ আধো স্বরে কার মনোরঞ্জন করছিলে সখী?
– কেন রে? তোর দরকার? দেব আলাপ করিয়ে?
– না রে। তোর সখা তোরই থাক। ‘পরধন লোভে মত্ত’ করি না ভ্রমণ।
– আরে তেমন কিছু না। এ হচ্ছে মিল্টনদা। তোকে বোধ হয় বলা হয়নি আগে। আমার এক অফিস কলিগের থ্রু দিয়ে আলাপ। এ হচ্ছে কলির কেষ্ট ঠাকুর। আমার মতো আরো অনেক গোপিনীর সখা।
– গোপিনী কেন? রাধা হতে পারিস নি?
– না রে। ও সবাইকে রাধাজ্ঞানেই প্রেম বিলোয়, তবে পার্মানেন্ট কোনও রাধা নেই।
– কেন রে, গোপিনীদের কাছে টি.আর.পি কমে যাওয়ার ভয়ে?
– হতে পারে।
– কী করেন ভদ্রলোক?
– নিজস্ব একটা চ্যাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির ফার্ম আছে। তবে মিল্টনদা সেটায় কখন মাথা ঘামায় জানি না। বড় বড় সি.এ পোষা আছে –তারাই সামলায় বোধ হয়। ও তো সারাদিন ফোনে বা সাক্ষাতে মেয়েদের সঙ্গ দিতে ব্যস্ত।
– মেয়েরা কি এই সঙ্গ লাভে সুখ পায়?
– কোয়ালিটি গ্যারান্টেড, ডার্লিং। সত্যি রে, মিল্টনদা জাদু জানে। ওর মধ্যে এমন একটা চার্মিং এবং অ্যাডোরেবল সেন্স আছে, ওর সাথে কথা বললে তুই মুগ্ধ হতে বাধ্য।
– তা সখা নিজেই ডাক পাঠান, নাকি গোপিনীরাই সুযোগ মত কল দেয়?
– ব্যাপারটা দ্বিপাক্ষিক। আমার নিজের যখন মন খারাপ লাগে, বা বোর হয়ে যাই কোনও পরিস্থিতিতে, ওকে কল করি।
– আজ তোর কিসের প্রয়োজন পড়ল?
– আজ ওর প্রয়োজন। ফোন করেছিল, একটা ভালো মুভির দুটো টিকিট আছে, যাব কিনা?
– তুই কী বললি?
– রাজি হওয়ার উপায় আছে অলি? তোকেই না বলে দিলাম! কাল শনিবার, বিজয় বাড়ী থাকবে।
– তা তুই ওর সাথে মুভি দেখেছিস?
– হ্যাঁ।
– তোর এভাবে যেতে খারাপ লাগে না?
– মিল্টনদা একেবারে সেফ। তুই না চাইলে ও কিছু করবে না।
– মানেটা কি? চাইলে বুঝি করবে?
– বেশী চেয়ে তো দেখিনি অলি। তবে টুকটাক কিছু ইচ্ছে হলে ওর মর্যাদা দেয়।
– তুই যেন কেমন হয়ে গেছিস চন্দনা। তুই কি তোর ভাবনাগুলোকে এখনকার যুগোপযোগী করে তুললে উঠে পড়ে লেগেছিস?
– ছাড় অলি। এসব তোর পছন্দও হবে না, তুই নিতেও পারবি না। চল আগে কিছু খেয়ে নিই, পরে রবীন্দ্র সরোবর পার্কে গিয়ে বসবো।
ঘন্টা দেড়েক বাদে ওরা পার্কে এসে একটা বেঞ্চে বসল। সামনের লেকটা বড় মায়াময় লাগছে। চার পাশে এত গাছ আর তাদের পাতায় পড়ন্ত সূর্যের লুকোচুরি – বড় মায়াময় করে তুলেছে চারপাশ। চারদিকে কত নাম না জানা পাখি। অলক্তার এ বিষয়ে আগ্রহ বড় কম। চেনা দু চারটে প্রজাতি ছাড়া অধিকাংশ পাখিই সে চেনে না। চন্দনা বোধহয় কোনও ভাবে আহত হয়েছে ওর কথায়। কিছুটা যেন সেই ক্ষতটা ছোঁয়ার ইচ্ছাতেই অলক্তা বলল, ‘স্যরি চন্দনা। তোকে আঘাত দেওয়ার কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না। আসলে আমাদের মনে ‘বিশ্বাস’ ‘ভরসা’ – এইসব বিষয়ে একটা সংস্কার রয়েছে, ওগুলোই কতকটা আমাদের বিবেক হয়ে সামনে দাঁড়ায়, ডাইরেকশন দেয় – তাই হয়তো!’
– আচ্ছা অলি, সৌকর্ষের সাথে তোর যে সাত-আট বছরের রিলেশন ছিল তুই বুকে হাত দিয়ে বলতো, তুই তার সাথে একবারও একটু হলেও ঘনিষ্ট হোস নি? একবারও ওর হাতটা টেনে নিজের বুকে রাখিস নি? সিনেমা হলে ওর কাঁধে মাথা রাখিস নি?
অলক্তা চুপ করে রইল। চন্দনা বলল, ‘তোর মৌনতাকে যদি সম্মতি ধরি, তারপর বিধানের সাথে তোর রিলেশন কি সৌকর্ষের সাথে বিশ্বাসভঙ্গ নয়? বা উল্টোটাও যদি ধরি – বিধান ও তো তোকে শরীরে মনে একশো শতাংশ ভার্জিন দাবী করতে পারে।’
– বিয়ের আগের সম্পর্ক নিয়ে তো আশা করা অন্যায়।
– বিষয়টা ওই অ্যাঙ্গেলে আমি বলতে চাইছি না অলি। যদি আমাকে সত্যি সত্যি বিবেকের নির্দেশ মেনে চলতে হয়, বিয়ের আগে পর্যন্ত শরীরেও মনেও আমার পরিপূর্ণ কুমারী থাকা উচিৎ। তুই যদি এভাবে দেখিস, তোর চারপাশে এক আধজন এমন কাউকে খুঁজে পাবে কিনা সন্দেহ।
– আমার বক্তব্যটা অন্য জায়গায় চন্দনা। আমি বর্তমান যে সম্পর্কে আছি, আমি কি সেই সম্পর্কে একশো শতাংশ দেব না?
– নিশ্চই দিবি। তোর কি মনে হয় না, আমি বিজয়কে একশো শতাংশ দিই?
– বুঝি না। বলছিস যখন দিস নিশ্চই।
– আর একটা বিষয়, একশো শতাংশ দেওয়া মানে কিন্তু শুধু শরীরে দেওয়া নয়। মনটাও দিতে হয়। কিন্তু সেটা সবসময় হয় না। আসলে জানিস তো, প্রতিটি সম্পর্কের মাঝেই একটা দুটো জানালা থাকা দরকার। বলতে পারিস মিল্টনদা আমার সেই রকম একটা জানালা। মিল্টনদা আছে বলেই আমি বিজয়কে অনেক বেশী কিছু দিতে পারি। ও আমার কাছে মুক্ত হাওয়া, অনাবিল আকাশ। ও আমায় ছুঁয়ে দিলে আমি সত্যি সত্যি চার্জড আপ হয়ে যাই অলি।
– বাঃ।
– আমি জানি অলি, তুই বা তোর মতো পিউরিটান যারা তারা এই ব্যাপারটাকে পছন্দ করবে না, বিষয়টাকে গর্হিত ভাববে। কিন্তু তুই ভাব তো, তোর স্বামী কদিন বাইরে গেছে বলে তুই যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় প্রতি বিন্দু সময়ের রুদ্ধশ্বাস ব্যর্থতা গুনছিস, সেটা কি আরও পীড়াদায়ক নয়? নাতো তুই তার অনুভপস্হিতির সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতাটাকে পুরো মাত্রায় এনজয় করতে পারলি, না তো তাকে মিস করলে হৃদয় থেকে।
– চন্দনা, আমি কিন্তু স্বাধীনতা মানে নিষিদ্ধ কোনও কিছু করার প্রতি আগ্রহের কথা ভাবিনি। আমি ভেবেছি সব সময় তো অন্যের ইচ্ছের ছায়ায় নিজেকে চলতে হয়। একদিন যদি নিজের খুশী মতো অ্যাটলিস্ট নিজেকে চালাতে পারতাম। শোওয়া-বসা ঘুম খাওয়া সবকিছু।
– নিষিদ্ধ গর্হিত এসব কিছুই আপেক্ষিক টার্ম অলি। ধর তোর বর তোর একা একা ধর্মতলায় ঘোরা পছন্দ করে না। এটা সে থাকলে তুই করতিস না। তার মানে এটাও তোর জন্য নিষিদ্ধ একটা আরোপ। প্রতিটি সম্পর্কে, সমাজের বাইরেও এরকম অনেক ব্যক্তিগত আরোপ থাকে। তুই কত মানবি?
– সম্পর্ক টেকাতে গেলে তো সে সব মানতে হয় চন্দনা। তুই কি এই ধরনের কোনও আরোপ মানিস না?
– মানি রে। মানতে হয় বলেই তো এরকম খোলা হাওয়া দরকার। কোথাও এ ধরনের সম্পর্ক একটা ব্যালেন্স করে দেয়। দাঁড়া তো দেখি, মিল্টনদা আবার ফোন করছে কেন?
চন্দনা একটু সরে গেল ফোনটা রিসিভ করতে। অলক্তার ভেতরটা হঠাৎ করে কেমন যেন বিষন্ন হয়ে গেল। ঠিক এই মুহূর্তের আকাশটার মতো। তীব্র গাঢ় নীল। তার মধ্যে সরু সরু ছেঁড়া মেঘের অগভীর অন্তরাল। একটা বাদামওয়ালা বারবার এসে ওর সামনে দাঁড়াচ্ছে। বাদাম খেতে ওর ভালো লাগে না, তবু কতকটা মুক্তি পাবার ঢঙেই বলল, ‘দাও ভাই দশ টাকার দু জায়গায়।’
চন্দনা ফিরে এসেছে। মুখটা বেশ চকচকে। বেশ খুশী খুশী ভাব নিয়ে বলল, ‘অলি, তোকে না বলেই একটা কাজ করে ফেলেছি।’
– কী কাজ?
– মিল্টনদা কে কাল তোর ব্যাপারে কনফার্ম করে দিয়েছি।
– মানে?
– মানে কাল তুই মিল্টনদার সাথে সিনেমা যাচ্ছিস।
অলক্তা একটু উঁচু স্বরে বলল, ‘কী বলছিস কী! কখনওই যাবো না। যাকে চিনি না জানি না …’
– চেনা জানাটা পথে নামলেই হয় অলি।
– তুই এক্ষুনি ফোন করে না বল।
– তাড়াহুড়োর কিছু নেই অলি। তুই চাপ নিস না। তুই না গেলে ওর লোকের অভাব হবে না। মিল্টনদা রাতে তোকে ফোন করবে। তোর কথা বলে ভালো না লাগলে যাস না।
– কেন আমাকে অকারণ ঝামেলায় জড়াচ্ছিস চন্দনা। বড় করুণ শোনালো অলক্তার গলা।
চন্দনা ওর মাথায় হাত রেখে বলল, ‘তোকে ভালোবাসি বলে। তোর কি আমি অনিষ্ট চাইবো?’
– আমার এসব বিষয়ে বড় অস্বস্তি হয়।
– তুই নিজে না চাইলে মিল্টনদা তোর কড়ে আঙুলটাও ছুঁয়ে দেখবে না অলি। তুই নিশ্চিন্ত থাক। তোর জীবনে ওর আসাটা দরকার।
একটু চুপ থেকে অলক্তা বলল, ‘চন্দনা ও তো একপ্রকার তোর বয়ফ্রেন্ড। এভাবে কেউ তার বয়ফ্রেন্ডকে নিজের বান্ধবীর সাথে শেয়ার করতে পারে?’
– মিল্টনদা ঠিক বয়ফ্রেন্ডের পর্যায়ে পড়ে না অলি। যেমন তুই কোনও ভালো ডাক্তারের সন্ধান পেলে তোর চেনা পরিচিতকে ওর রেফারেন্স দিস, বা কোন ভালো ফলস পিকো করার দোকানের সন্ধান পেলে পাড়া প্রতিবেশী বা বন্ধুদের আনন্দে জানাস – এ অনেকটা সেরকম। মিল্টনদা কোনওদিনই কারোর হবে না। ও সবার। আজ রাত ন’টায় সে ফোন করবে তোকে।
হঠাৎ করে যেন বুকে দামামা বেজে উঠলো অলক্তার। এটা ঠিক কোনও নিষিদ্ধ কাজ করার আগের উত্তেজনার মতো নাকি বেড়া ভাঙার উৎকন্ঠায় বুঝতে পারলো না সে। ঘোরের মধ্যে সে দেখলো, চন্দনা বাড়ী ফেরার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। তাকেও উঠে দাঁড়াতে হবে এবার। ফিরতে হবে লক্ষণের গণ্ডী কেটে দেওয়া চার দেওয়ালের ঘরে। পরশু থেকেই তো আবার গতানুগতিক সবকিছু।
0 Comments