জ্বলদর্চি

"কুসুমে কুসুমে চরণ চিহ্ন দিয়ে যাও" / চিত্রা ভট্টাচার্য্য


"কুসুমে কুসুমে চরণ চিহ্ন দিয়ে যাও"

চিত্রা ভট্টাচার্য্য            
               

 প্রাত্যহিক জীবনে নীরব তবু অসম্ভব বাঙ্ময় প্ৰিয়সঙ্গী আমার সংগ্রহের বইগুলো নেড়ে চেড়ে সকালের ভাদুরের কড়ারোদে ছাতে মেলে দিয়ে মলাট খুলে প্রচ্ছদপটের " দিকে তাকিয়ে অতীতের স্মৃতিতে ভাসলাম। সময়ের কষাঘাতে বেলাশেষের প্রায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া সোনায় মোড়া কিশোরীবেলা সুদূরথেকে ডাকপাঠালো। ঝাপসা মনমুকুরে প্রতিবিম্বিত হয়ে এলো ছোট বেলার প্রতিচ্ছবি। সোনালী রোদে স্মৃতির পাখিরা মেঘ ঠেলে আলোর দিকে ধেয়ে আসছে। জীবন সায়াহ্নের এই ক্ষণে বর্তমানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ফিরে গিয়েছি অতীতের গহ্বরে।                                                   
  শরৎ সাহিত্যের উপন্যাস সমগ্র হাতে নিয়ে মনেপড়ে ভাদুরে সংক্রান্তির এই দিনে আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন  (15 th September.  1876 সাল)। ভ্যাপসা পচা গরমের ভাদ্র থেকে মুক্তি পেয়ে এবারে আশ্বিনের আগমনীর শুরু। উন্মুক্ত নীলাকাশে সাদামেঘের ভেলা ভাসবে । হুগলি জেলার অখ্যাত দেবানন্দপুরের পল্লী গ্রামের ভিটেতে পিতা মতীলাল চট্টপাধ্যায় মাতা ভূবন মোহিনী দেবীর ঘর আলো করে শরৎ নিশীর নির্মল আকাশে প্রতিভাত হলো  যে চন্দ্র তিনিই ভাবীকালের অমরকথা শিল্পী শরৎচন্দ্র বাংলা কথা সাহিত্যের আকাশে চিরস্মরণীয় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।               

                 রবীন্দ্রত্তোর যুগে যিনি বিরাজিত হয়ে স্রোতের ধারায় পরিবর্তন এনে কালক্রমে তাকে আরো অভাবনীয় সমৃদ্ধময় করে তুলেছিলেন সাহিত্যের প্রস্রবনি ধারা কে। সেই কালজয়ী অপরাজেয় সাহিত্যিক তথা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দরদী ঔপন্যাসিকের জন্মদিনে তাঁকে জানাই অন্তরের সশ্রদ্ধ প্রণাম। মনের ময়ূর মহলে অনবরত কড়া নেড়ে চলেছে তাঁর রচনাবলীর প্রতিটি খন্ড।  জীবনের সায়াহ্নে অখন্ড অবসরে কলম হাতে লেখার ছলে অসংখ্য মণিমুক্তো দিয়ে গাঁথা স্মৃতির সেই মালাখানি নিয়ে গভীর আগ্রহে ও শ্রদ্ধায় অর্ঘ্যথালা সাজিয়েছি যেন তাঁর ফিরে আসার প্রতীক্ষায়।     
🍂

 
 তখন সত্তরের  দশক,কিশোরীবেলার ঘেরাটোপের জীবনের একমাত্র মুক্তাঙ্গন ছিল আমার স্কুল S.K.V র  খেলার মাঠ। আর বিশাল লাইব্রেরী হল। প্রতিটা দেওয়াল জুড়ে বড়োবড়ো কাঁচের আলমারির অজস্র তাক ভরা অসংখ্য স্তরে স্তরে সাজানো নানা ধরনের নতুন বা পুরোনো বই। পাঠ্য পুস্তক তো আছেই এবং তার সাথে আছে নানান মহান কবি সাহিত্যিক লেখক লেখিকা দের অনবদ্য সৃষ্টির সম্ভার। লাইব্রেরী ঘরে ঢুকলেই এক অচেনা বিশ্বজগৎ হাতছানি দিয়ে ডাকে। 

বইয়ের তাক থেকে হ্যাঙ্গারে যত্ন করে রাখা দেশ বিদেশের ম্যাপ--  অজস্র বইয়ের স্তূপে ন্যাপথলিনের সাথে পুরোনো সোঁদাগন্ধর অদ্ভুত আকর্ষণে এক অজানা জগতের রহস্যময়তা।  ডানদিকের দেওয়াল জোড়া কাঁচের আলমারিতে স্তরেস্তরে সাজিয়ে রাখা নতুন খয়েরি মেরুন রঙের কাপড়ে বাঁধানো মলাটের গায়ে চকচকে সোনালী কালির আঁচরে মুদ্রিত সম্ভবত চৌদ্দখন্ডের "শরৎরচনাবলী" তে কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম টি স্বর্ণাক্ষরে উজ্জ্বল। বালিকা সুলভ কৌতূহলে সুযোগ পেলেই বইয়ের গায়ে হাত বোলানো ,এবং শুরু হলো বইয়ের প্রতি ভালবাসা ও পরিচয়। লাইব্রেরী দিদিচোখ রাঙাতেন ''বড়োদের বই।হাত দিও না। '' 
  
 তখন আমার গল্পের বইয়ের জগৎ উপেন্দ্র কিশোর ,সুকুমার ,সত্যজিৎরায় ,লীলা মজুমদার    সন্দেশ, শুকতারা, আনন্দমেলায় । অতিপ্রিয় গোয়েন্দাগল্প রহস্য উদ্ঘাটনে স্বপন কুমার। এবার সে সব ছেড়ে ইতিমধ্যে শরৎচন্দ্রের ছোটগল্প  অভাগীর স্বর্গ,মহেশ, রামের সুমতি বিন্দুর ছেলে মেজদিদি পড়ে চোখ লাল করে জামার হাতায় জল মোছা । বিভূতিভূষণের পথেরপাঁচালীর অপুদুর্গা , চাঁদের পাহাড় আরণ্যক মন কেড়েছে।                
 
 অবশেষে ক্লাস নাইন,এলাম বড়ো দের দলে। অফ প্রিয়োডে ও টিফিন টাইমে মাঠে আর খেলতে যাই না।লাইব্রেরী রুমে বসে শরৎ সাহিত্য পড়ার অনুমতি পেয়েছি । এক অদৃশ্য আলো আঁধারির জগতের অমোঘ টানে কোন অজানা পথের সন্ধানে হেঁটেছিলাম  জানিনা। জীবনের হিসেবের খাতায় সেই অঙ্কের রহস্যের সমাধান বুঝি সে সাহিত্য সম্ভারের মাঝে খুব ধীরে ধীরে বসন্ত বাতাসের মত সন্তর্পনে মনের আঙিনায় বয়ে চলেছিল। নিষেধের বেড়া টপকে বড়দের পাঠের এই উপন্যাস গুলো প্রকাশ্যে পড়তে কুন্ঠাবোধ হতো। তাই অনায়াসে পাঠ্য বইয়ের আড়ালে চলতো পাতা ওল্টানো।  

মনেপড়ে স্কুলে  টিফিনটাইমে পয়তাল্লিশ মিনিট ঐ লাইব্রেরী ঘরে নেশার মত গল্পেরপাতায় ডুবে থাকতাম।  টিফিন আওয়ার শেষ হয়ে পরের ক্লাস শুরু হলেও বেখেয়ালি  আমি চলেছি ইন্দ্রনাথের বাঁশির সুরের সাথে মোহিত হয়ে ভুতুড়ে বাঁশবাগানের গহীন অন্ধকারে গা ছমছম পথে। কিম্বা ঘোর অমাবস্যার রাতে আঁশশেওড়ার ঝোপের পাশ দিয়ে ডিঙি ঠেলে পাটের ক্ষেতে লুকিয়ে ইন্দ্রনাথ শ্রীকান্তের মাছ চুরির সঙ্গী হতে। কখোনো চলেছি অন্নদা দিদির এঁদোগাঁয়ের ঘরে মাছ পৌঁছে দিতে বা শাহুজীর সাপ ধরার মন্ত্রের কৌশল শিখতে। সাগরে পাড়ি দিয়ে বার্মা মুলুকের জাহাজে উঠে বসেছি অভয়াকে দেখতে চলেছি।      

পরিবর্তনের স্রোতে বড়ো হওয়ার পালায় রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তের প্রেমে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে জীবনের  নতুন রহস্যের উন্মুক্ত দ্বারে প্রবেশ করেছি। অন্যস্বাদে গন্ধে ভরা যৌবনের জীবন তরী এগিয়ে চলেছে পুকুর ঘাটে কখোনো দেবদাস পার্বতীর প্রেমে , ওদের  প্রেম ব্যর্থ হলে দুটি প্রাণের বিয়োগ ব্যথায় মর্মাহত হয়ে লেখকের ওপর রাগ করেছি। 

আবার পরিনীতায় পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদের মায়ায় পুতুলের বিয়ের ছলে শেখর ললিতার মালা বদলে আনন্দ উপভোগ করেছি। দত্তায় ব্যক্তিত্বময়ী বিজয়া মনের পাতায় ছায়া ফেলেছে। পল্লীসমাজ,বামুনের মেয়ে, পন্ডিত মশাই, চন্দ্রনাথ সব গল্প গুলো অদৃশ্য এক দড়ি ধরে টেনে  নিয়ে চলেছে সেই অশিক্ষা অপুষ্টি কুসংস্কারে পূর্ণ পাড়াগাঁয়ের কর্কশ ছন্দহীন কঠিন জীবনে ।  
-    
গরমের ছুটি পড়লে  ডাহুক ডাকা দুপুরে ছাতের চিলে কোঠার ঘরের নিরিবিলিতে বড়োদের কড়া শাসনের চোখ কে ফাঁকি দিয়ে  নিষিদ্ধ শরৎসাহিত্য  বয়সন্ধিকালের মন কে অচেনা পৃথিবীর রহস্যের দ্বারে পৌঁছে দিত। কী যে অপরিসীম আনন্দ পেতাম বাঁশের বাগান,সবুজ ধানের ক্ষেত, বারোয়ারী তলার মন্দির ছাড়িয়ে পল্লীগ্রামের এক হাঁটু কাদা মাখা পথে অথবা সাবেকী জমিদার বাড়ির পূজার দালানের মন্ডপে বসে আছি সন্ধ্যেআরতির শঙ্খ ঘন্টা বাজার অপেক্ষায়।  গ্রাম বাঙলার পট ভূমিতে জীবনের ওঠা নামার  চলার ছন্দে হাসি কান্না মাখা মন উদাস করা সেই সামাজিক চিত্রে।   
          
ভুলতে পারিনা মানব দরদী লেখকের মায়ার কাজলে দেখা জীবনের সত্য কে তুলে ধরে  সহজ ভাষায় গল্প বলার ধরন। যাযাবরের মত পথে ঘুরে বেঁচে থাকার রূপ রস গন্ধ কে আবিস্কার করে রচিত গল্প উপন্যাসের মায়াময় জগতে ডুবে থাকতে আজো অপরিসীম ভালো লাগা।

  যত দিন এগিয়েছে বহুবার ভেবেছি চরিত্রহীন উপন্যাসে কে চরিত্র হীন? শেষপ্রশ্নের শেষের প্রশ্ন টা ই বা কি? না সদুত্ত্যর আজো পাই নি। কৈশোরের পথ পরিক্রমার শেষে যৌবনের পরশ মণির ছোঁয়ায় বিশ্ব জগৎ ভুলে নিষিদ্ধ এক জগতের অমোঘ আকর্ষনে , গল্পের টানে বোঝা না বোঝার আলো আঁধারিতে তাঁর উপন্যাসের প্রতিটি ছত্রে কথার বাঁধুনিতে বিভোর হয়ে থাকতাম। স্বর্গীয় এক অনুভবের পরশ পেতাম পাতার পর পাতায়।  
 
প্রকৃত এক মানব দরদী শিল্পী মনের ছোঁয়া । গৃহিনীর হেঁশেলে বা অন্দর মহলে অনায়াশে স্নেহের হাত টি বুলিয়ে নির্দ্বিধায় সমব্যাথী হয়ে প্রবেশ করতেন দরদী লেখক। সামাজিক অত্যাচারের বলী অসম্মানিত অবলা নারীর বুকফাঁটা হৃদয়ের ক্রন্দন।  মুছিয়ে দিতেন দুঃসহ ব্যথা বেদনার অশ্রু। তাই তো তিনিই বলতে পারেন    " ভালবাসাটার মতো এত বড়ো শক্তি, এতবড় শিক্ষক সংসারে বুঝি আর নাই। ইহা পারে না এতবড় কাজ ও বুঝি কিছু নাই।"  সময়ের বিবর্তনে ছোটবেলার সেই মধুরস্মৃতির মেরুন কাপড়ের বাইন্ডিঙের ওপর সোনালী আঁচড়ে লেখা  শরৎসাহিত্যের প্রচ্ছদপটের সেই ঐতিহ্যময় গ্রন্থ সমগ্র আজ দুষ্প্রাপ্য। তবুও তাঁর রচিত উপন্যাসগুলো কে সাধারণ সাজে বইমেলায় বা চলতি পথে কলেজস্ট্রীটের বইয়ের দোকানের সেল্ফে সাজানো দেখলে ছোটবেলার স্মৃতিতে অকারণ ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে ভাষাহারায়। আজো সাহিত্য পিপাসু সকল মানুষের কাছে তাঁর রচনা সমগ্র এক অতুলনীয় সুখপাঠ্য কালজয়ী সৃষ্টির দাবী রাখে। স্মরণের আবরণে এই মহান মানব দরদী যুগপুরুষ কে পরম শ্রদ্ধায় অন্তরের উৎসারিত ফুলের গাঁথা মালায় অঞ্জলি নিবেদন করি ।

Post a Comment

0 Comments