তারাশংকর দে
(স্মৃতি গদ্য)
সময় বড় চুপচাপ জিনিস। সে কখনো ধেয়ে আসে না, হেঁটে যায়ও না—সে কেবল পেরিয়ে যায়, আমাদের ভিতর দিয়ে, আমাদের চোখের কোণে, কপালের রেখায়, ঘড়ির কাঁটার মতোই নিঃশব্দে। আমি যখন জানলার পাশে বসে বিকেলের আলো দেখি, ঠিক তখনই আমার ভিতরে জেগে ওঠে সেই ফেলে আসা দিনগুলোর গন্ধ—পাকা জামরুলের, ভেজা খাতার, বা বৃষ্টিতে কাঁপতে থাকা স্কুলব্যাগের।
আমাদের ছোট্ট শহরটা তখনও শহর হয়ে ওঠেনি। রাস্তায় রাস্তায় ধুলো, আর সন্ধ্যাবেলা বাতাসে গরুর ঘণ্টার শব্দ। টিউবওয়েলের ঠান্ডা জলে মুখ ধুয়ে দৌড়ে যেতাম পুকুরঘাটে। সেখানে পাড়ার ছেলেরা মাছ ধরত, আর মেয়েরা হাসতে হাসতে কাপড় কাচত। সূর্য ডুবে গেলে দূরের বাঁশবনে লুকিয়ে যেত আলো, আমরা তখনো ফিরতাম না। বাড়ি থেকে মা চেঁচিয়ে বলত, “আর কত খেলবি, বোকা ছেলে?” কিন্তু কে শোনে! সেদিনের সেই ডাক আজও কানে বাজে—সময়ের পর্দা পেরিয়েও।
রেডিও তখন আমাদের একমাত্র জানালা ছিল পৃথিবীর দিকে। রবিবার সকালে বিনোদন অনুষ্ঠান, বিকেলে নাটক। বাবা তখন খবর শোনার সময় মুখে চশমা পরে নীরবে বসে থাকতেন, যেন পৃথিবীর ভাগ্য সেই খবরেই নির্ধারিত হবে। মা রান্নাঘর থেকে হেসে বলতেন, “ওসব খবর শুনে কার কী আসে যায়, আগে ভাত খাও।” অথচ আজ বুঝি, খবর নয়—তখন সময়ের স্পন্দন শুনতাম আমরা, এক যুগের নিঃশ্বাস।
পাড়ার মেলা ছিল আমাদের বছরের শ্রেষ্ঠ উৎসব। লাল-নীল বেলুন, চিনি-মুড়ির ঘ্রাণ, আর ভাঙা রঙিন আলোয় ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ানো মানুষ। তখন টাকা মানে ছিল দুটো কয়েনের ঝনঝন, তবু সেই শব্দে জেগে উঠত পৃথিবী। একটা ঘুড়ি কিনতে না পেরে বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া, আবার পরক্ষণেই মিলেমিশে কাঁধে কাঁধ রেখে হাঁটা—এই সব ছোট ছোট ঘটনায় তৈরি হয়েছিল এক নিখুঁত মহাবিশ্ব। আজকের পরিপাটি জীবন সেই মহাবিশ্বের ধূলিকণাও নয়।
🍂
আমাদের স্কুলের ঘর ছিল টিনের চালায়, শীতে তার নীচে বসা মানে হাত জমে যাওয়া। কিন্তু সেই ঠান্ডা সকালে মাস্টারমশাইয়ের গলা শুনলেই মনে হত, আমরা কিছু বড় কাজের জন্য তৈরি হচ্ছি। সেই কালি-মাখা খাতায় যত ভুল বানান লিখেছি, আজ মনে হয় তাতেই লুকিয়ে ছিল জীবনের প্রথম কবিতা। এখন যেসব শব্দ লিখি, তাদের সবই যেন সেই সময়ের ঘ্রাণে ভেজা।
একদিন হঠাৎ সবাই বড় হয়ে গেলাম। কেউ কলেজে, কেউ চাকরিতে, কেউ শহর ছেড়ে অন্য দেশে। তখন ভাবিনি, আলাদা হয়ে যাব এত দূর। সময় ধীরে ধীরে গিলে নিলো আমাদের শৈশবের হাসি, মাঠ, রেললাইন, পুকুরঘাট। শুধু মাঝে মাঝে ট্রেনের শব্দে মনে হয়, কেউ যেন ডাকে—“চলো, আবার ফিরে যাই।” কিন্তু কোথায় যাব? পুরনো স্কুল এখন বহুতল ভবন, পুকুরে জল শুকিয়ে গেছে, মেলার মাঠে উঠেছে শপিংমল। আমরা নিজেরাই হারিয়ে ফেলেছি সেই জায়গাগুলো, যেন স্মৃতির মানচিত্রে ধূসর রেখা।
তবু স্মৃতি বড় জেদি। সে জানে কাকে ভুলে যাওয়া যায় না। তাই রাতে জানলার বাইরে চাঁদ উঠলে মনে হয়, ঠিক সেই চাঁদটাকেই তো দেখেছিলাম শিশুকালে, পিঁড়ির ওপর বসে। তখন মনে হত, চাঁদ আমাদের ঘরেরই মানুষ—যে জানে আমরা কী খাই, কতটা হাসি, কখন কাঁদি। এখন বুঝি, আসলে চাঁদ নয়, সেই সময়টিই ছিল আমাদের নিকট আত্মীয়।
কখনো মনে হয়, সময়ের কাছে একটা আবেদন জানানো যাক—“আমাদের একটু ফেরত দাও, অন্তত এক বিকেল।” আমি আবার দৌড়ে যাব নদীর ধারে, কাদায় পা ডুবিয়ে দেব, কাশবনে শুয়ে থাকব। বন্ধুরা এসে বলবে, “চল, আজ মেলা দেখতে যাই।” মা দূর থেকে ডাকবেন, “রাত হয়ে যাচ্ছে রে!” আর আমি হাসতে হাসতে বলব, “এই আসছি।”
কিন্তু সময়ের কোনো ফেরত নেই। সে কেবল সামনের দিকে এগোয়, ঠিক যেমন নদী। তবু আমাদের ভিতরে কিছু অংশ থাকে নদীর তলদেশের মতো—যেখানে স্রোত পৌঁছায় না, কিন্তু স্মৃতি থাকে শান্তভাবে জমে। সেখানেই আজও বেঁচে আছে আমার ফেলে আসা দিনগুলো। তারা আর ফিরে আসে না, কিন্তু কখনো হারায়ও না।
ফিরে দেখি, জীবনের সবকিছুই যেন সেই ছোট্ট সময়েরই সম্প্রসারিত প্রতিধ্বনি। তখন যা ছিল খেলার মাঠ, এখন তা অভিজ্ঞতার পরিধি। তখন যা ছিল বন্ধুত্ব, এখন তা নীরব শ্রদ্ধা। তখন যা ছিল ভালোবাসা, এখন তা চিঠিহীন এক মায়া।
ফেলে আসা দিন মানে আসলে হারিয়ে যাওয়া নয়—বরং তারাই আমাদের গড়ে তোলে, অদৃশ্যভাবে। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত, এমনকি প্রতিটি নিঃশ্বাসে লুকিয়ে আছে সেই দিনগুলোর পরম স্পর্শ। তাই মাঝে মাঝে আমি নিজেকে বলি—
“বেঁচে আছো তো তুমি? সেই ছোট্ট ছেলেটা, যে বৃষ্টিতে দৌড়াত?”
ভেতর থেকে উত্তর আসে,
“হ্যাঁ, আমি আছি, শুধু সময় বদলে গেছে।”
0 Comments