বোকা নাপিত
সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস
কথক- লাবণ্যময়ী দাস, গ্ৰাম- বেড়াজাল, থানা-নয়াগ্ৰাম, জেলা-ঝাড়গ্ৰাম
পবনপুর নামে একটি গ্ৰামে মানব নামে এক ব্যবসায়ী বসবাস করত। আর তার একমাত্র সঙ্গী ছিল তার স্ত্রী গরিমা। মানবের প্রচুর ধনসম্পত্তি থাকলেও তার এবং তার স্ত্রীর কোনো অহংকার ছিল না। তারা দুজনেই ছিল দয়ালু প্রকৃতির মানুষ। এত ধনসম্পত্তি নিজেরা পুরোপুরি ভোগ করত না। তারা তা গরীব অসহায় মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দিত।
মানব নিজের জীবনে খুব কষ্ট করেছিল বলে সে সাধারণ মানুষের কষ্ট বুঝতে পারত। এমনকি তার স্ত্রী গরিমাও ছিল খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে। সে মানবের মতো সকলকে দু হাত ভরে দান করত। এই স্বভাবের জন্য পবনপুরে মানব এবং গরিমার খুব নামডাক ছিল।
বাড়ির প্রতিটি অনুষ্ঠানে তারা অনেক মানুষকে নিমন্ত্রণ করত। আর দামী দামী উপহারও দিত। তারা দুজনেই চেষ্টা করত প্রতিদিন যেন তারা কাউকে না কাউকে বাড়িতে খাওয়াতে পারে। আর তা তারা করতও। এতে যারা আমন্ত্রিত হয়ে আসত তারা খুবই খুশি হত আর মানবের জয়গান করত।
এইসব দেখে মানব গরিমাকে বলে-“দেখ গরিমা, সবাই আমাদের কত সম্মান করে, কত ভালোবাসে। এইরকম ভালোবাসা পেলে আমরা কোনোদিনও অভাবে পড়ব না। আর কোনোদিন যদি অভাবেও পড়ি তাহলে এইসকল মানুষরা ঠিকই আমাদের সাহায্য করবে।”
এই শুনে গরিমা বলে-“কী বলছ তুমি? তুমি কোনো কিছু পাওয়ার আসা না করে সবাইকে সব দিয়ে দাও বলে সবাই কী তাই করবে? তুমি হয়তো এটা জানো না এই সকল মানুষরা এখানে আসে কেবল দামী দামী উপহার ও ভালো ভালো খাবারের আশায়। তাই আমার মনে হয় আমরা যদি কোনোদিন বিপদে পড়ি তাহলে এরা আমাদের সাহায্য করবে না।”
তখন মানব বলে-“তুমি ভুল ভাবছ গরিমা। এরা আমাদের আপনজন। এরা কোনোদিন এইরকম করবে না।”
গরিমা বলে-“আমি জানি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না। আর আমি এও চাই যাতে আমার কথা সত্যি না হয়।”
কিন্তু গরিমার কথা খুব শীঘ্রই সত্যি হয়। একদিন মানব খবর পায় ওর মাল বোঝাই নৌকাগুলো ঝড়ের জন্য সব নদীতে ডুবে গেছে। সে সেখানে গিয়ে পাগলের মতো নৌকাগুলো খুঁজতে থাকে। কিন্তু নৌকার এক টুকরো অংশও সে খুঁজে পায় না। এতে তার ব্যবসার যথেষ্ট ক্ষতি হয়। এরফলে মানবকে অনেক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। বহু মানুষের দেনা বেড়ে যায়। এরজন্য সে বন্ধুদের কাছে সাহায্য চায়। কিন্তু কেউ মানবকে সাহায্য করে না। এতে বন্ধুদের চালাকি মানব না বুঝতে পারলেও তার স্ত্রী গরিমা সব বুঝতে পারে। কিন্তু মানবের কষ্ট হবে বলে সে কিছু বলে না।
এরপর মানব সব ধার দেনা মেটাতে তার সমস্ত জমিজমা বিক্রি করে দেয়। কিন্তু তাতেও যখন দেনা শোধ করতে না পারে তখন সে তার একমাত্র সম্বল বসত বাড়িটাও বিক্রি করে দেয়। যারফলে সব দেনা শোধ হয়ে যায়। কিন্তু এতে সে ধনী থেকে একেবারে দরিদ্র হয়ে যায়।
এরপর তারা এক কুঁড়েঘরে থাকতে শুরু করে। মানব অন্যের জমিতে চাষবাস করে সংসার চালায়। আর গরিমার আচার তৈরি করে বিক্রি করতে থাকে। এতে করে তাদের দুজনের সংসার ভালোভাবে চলে যায়। কিন্তু তাদের সঙ্গে এত কিছু হয়ে যাওয়ার পরও তাদের মধ্যে সেই দয়ালু স্বভাবটা চলে যায় না। নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েও তারা সেগুলো না ভেবে অন্যের সাহায্য করতে থাকে। তারা দুজন এতটা রোজগার করার চেষ্টা করত যাতে প্রতিদিন তারা তাদের বাড়িতে একজন হলেও মানুষের পাত ফেলতে পারে। তারা অতিথিদের দামী উপহার দিতে পারত না এটা ঠিক কিন্তু ভালো স্বভাব ও মিষ্টি কথা দিয়ে মানুষের মন ঠিকই জয় করে নিত।
এইভাবে দিন কাটতে থাকে। কিন্তু তাদের আপনজনরা কেউ তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসত না। এমনকি দেখা হলেও সেই সব লোক মানবের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। এইসব দেখে মানবের মন খুবই খারাপ হয়ে যায়।
সে তার স্ত্রী গরিমাকে বলে-“তুমি ঠিকই বলেছিলে গরিমা। এরা কেউ আমাদের আপনজন নয়। এরা আমাদের কাছে আসত কেবল টাকা দেখে। এখন আমি বুঝতে পারছি তখন আমি যদি তোমার কথা শুনতাম তাহলে ভালো হত। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমার ভুলের জন্য তোমাকে এমনভাবে জীবনযাপন করতে হচ্ছে।”
তখন গরিমা বলে-“এ তুমি কী বলছ। আমার কাছে তুমি আছ এই যথেষ্ট। আর আমি কিছু চাই না। আর একটা কথা আমাদের খারাপ সময়ে কেউ সাহায্য করেনি বলে আমরাও তাদের সঙ্গে তাই করব এটা হতে পারে না। তুমি যেমন আছ তেমনই থাকো। তুমি দেখ তোমার এই সততার জন্য তুমি একদিন না একদিন তার পুরস্কার পাবে।”
কিন্তু মানব এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে গরিমার কথা তার বিশ্বাস হয় না। সে মনে মনে ভাবে-“গরিমা এইসব কথা বলছে কারণ সে আমার ভালো চায়। কিন্তু আমি সারাটা জীবন যে বোকামি করেছি তার জন্য কোনোদিনও আমি ভালো ফল পাব না। আমি জানি সব দোষ আমার, আমার…..”
এইবলে সে নিজেকে দোষ দিতে থাকে। এরপর গরিমা বলে-“অনেক রাত হল এবার তুমি ঘুমিয়ে পড়।”
তখন মানব ঘুমিয়ে পড়ে। আর সে স্বপ্নে দেখে এক সন্ন্যাসী তাকে ডাকছেন। সন্ন্যাসী মানবকে বলেন-“মানব, মানব চোখ খোলো।”
এই শুনে মানব উঠে পড়ে। উঠে দেখে তার সামনে একজন সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছেন। সন্ন্যাসীকে দেখে মানব বলে-“কে, কে, কে আপনি?”
তখন সন্ন্যাসী বলেন-“আমি একজন সন্ন্যাসী। এখানে এসেছি তোমাকে সাহায্য করতে। সমস্যার মধ্যে থাকাকালীন তোমার মন ভেঙে গেলে চলবে না। সমস্যার সমাধান করতে হবে।”
মানব তখন বলে-“বাবা, আমি একজন মূর্খ মানুষ। নিজেই নিজেকে মুখ দেখাতে পারছি না।”
সন্ন্যাসী বলেন-“তুমি তো মূর্খ নও, মূর্খ তো সেই হয় যে সম্পূর্ণ সত্যিটা না জেনে কাজ করে। আর তোমার সঙ্গে যেটা হয়েছে সেটা হল একটা দুর্ঘটনা। আমি এখানে এসেছি তোমাকে সাহায্য করতে।”
তখন মানব বলে-“কী! আপনি, আপনি কী করে আমায় সাহায্য করবেন আর কেনই বা করবেন?”
সন্ন্যাসী তখন বলেন-“তোমার স্ত্রী ঠিকই বলেছিল, তুমি একদিন না একদিন তোমার সততার জন্য পুরস্কার পাবে। আর আমি তোমার এত বছরের কঠিন পরিশ্রম দেখে তোমার সততা দেখেই এখানে এসেছি। আর এই হল তোমার পুরস্কার। এবার আমার একটা কথা শোন, আগামীকাল সকালে আমি তোমার দরজায় টোকা মারব আমার এই একইরুপে। আমি ঘরে ঢোকার মাত্রই তুমি আমার মাথায় পেছনে একটা লাঠি দিয়ে ছোঁবে ঠিক তখনই আমি অনেকগুলো সোনার মুদ্রায় পরিণত হব। তোমার সৌভাগ্য যে আমি আবার ফেরত আসব। মনে রেখ অন্য কোনো ভিক্ষুককে কিন্তু মারবে না। তাহলে তার জন্য তোমায় শাস্তি পেতে হবে।”
এই বলে সন্ন্যাসী সেখান থেকে চলে যান। আর মানবের ঘুমও ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠে মানব বলে-“এ আমি কেমন স্বপ্ন দেখলাম? আমি হয়তো টাকার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাই হয়তো এইসব দেখেছি।”
এই বলে মানব ঘরের দরজা খোলে। আর সে দেখে অন্যান্য অনেক সন্ন্যাসী তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াত করছেন।
তখন সে ভাবে-“এটা কী তাহলে শুধুই স্বপ্ন? কিন্তু সন্ন্যাসী তো বলেছেন তিনি ওই একইরূপে আমার সামনে আসবেন। তাই আমি বাবা না জেনে শুনে কাউকে আঘাত করব না।”
এই ভেবে সে দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতরে গিয়ে বসে। ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ে। মানব ভাবে হয়তো সন্ন্যাসী এসেছেন।
🍂
সে তখন বলে-“কে, সন্ন্যাসী বাবা নাকি?”
তখন দরজার বাইরে থেকে আওয়াজ আসে-“না না দাদা, আমি নাপিত। আপনি আমায় আসতে বলেছিলেন।”
মানব বলে-“ও হ্যাঁ হ্যাঁ, আচ্ছা ভেতরে এসো।”
এরপর মানব চুল কাটতে বসে। ঠিক তখনই দরজায় আবার টোকা পড়ে। মানবের স্ত্রী গরিমা গিয়ে দরজাটা খোলে। আর মানবকে বলে-“শোন, একজন সন্ন্যাসী এসেছেন। আমি ওনাকে কী দেব বলো?”
এই শুনে মানব খুশিতে লাফিয়ে উঠে। সে তার স্ত্রীকে বলে-“কী বললে, সন্ন্যাসী? যাও যাও তাড়াতাড়ি আমাকে একটা লাঠি এনে দাও।”
গরিমা বলে-“লাঠি! লাঠি দিয়ে কী হবে?”
মানব তখন বলে-“আমার কাছে তোমাকে বোঝানোর মতো এত সময় নেই। যা বলছি তাই করো।”
নাপিতের চুল কাটা শেষ হওয়ার আগেই মানব লাঠি নিয়ে এগিয়ে যায় সন্ন্যাসীর কাছে।
আর এদিকে সন্ন্যাসীও ততক্ষণে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। মানব তখন সন্ন্যাসীর মাথার পেছনে লাঠিটা ছুঁইয়ে দেয়। আর ঠিক তখনই সন্ন্যাসী বহু সোনার মুদ্রায় পরিণত হন। এই দেখে মানব ও গরিমা অবাক হয়ে যায়।
গরিমা বলে-“এ কী, এ কী হল? এতগুলো সোনার মুদ্রা!”
মানব এইসব দেখে বলে-“আঃ কী মজা। আমরা আর গরীব থাকব না।”
মানব ও গরিমা এইসব দেখে এত খুশি হয়ে যায় যে তারা একেবারেই ভুলে যায় যে তাদের সঙ্গে সঙ্গে নাপিতও পুরো ঘটনাটা দেখেছে।
নাপিত তখন মনে মনে ভাবে-“ও আচ্ছা এইভাবেও ধনী হওয়া যায় বুঝি? কিন্তু এ কাজ তো ততটা কঠিন নয়। এটা তো আমিও করতে পারি।”
তাই নাপিত সেখান থেকে বাড়ি এসে একটা ফন্দি আঁটে। এরপর পরেরদিন সে ওই জায়গায় যায় যেখানে সন্ন্যাসীরা থাকেন। আর নাপিত সেখানে গিয়ে সন্ন্যাসীদের তার বাড়িতে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করে। সন্ন্যাসীরা প্রথমে না বলেন কিন্তু নাপিত জোরাজুরি করায় তারা আর না করতে পারেন না।
এরপর সন্ন্যাসীরা নাপিতের সঙ্গে তার বাড়ি যান। আর সন্ন্যাসীরা বাড়িতে ঢোকা মাত্রই নাপিত ঘরের দরজা বন্ধ করে লাঠি দিয়ে সন্ন্যাসীদের মাথায় আঘাত করতে থাকে।
তখন সন্ন্যাসীরা বলেন-“এ কী, এ কী তুমি এসব কী করছ? আমাদের মারছ কেন? কেউ আছো আমাদের বাঁচাও, বাঁচাও।”
সন্ন্যাসীরা সেখান থেকে পালানোর অনেক চেষ্টা করেন কিন্তু নাপিতের নাগাল থেকে পালাতে পারেন না। কোনো প্রকারে একজন সন্ন্যাসী বাইরে বেরিয়ে আসেন। আর তিনি গ্ৰামের সবাইকে বলেন বাকি সন্ন্যাসীদের রক্ষা করতে। তখন গ্ৰামবাসীরা নাপিতের ঘরের দরজা ভেঙে সন্ন্যাসীদের রক্ষা করে। আর এই কর্মের জন্য নাপিতকে সবাই উচিত শিক্ষা দেয়। তাকে সবাই গ্ৰাম থেকে বের করে দেয়।
মানব এবং গরিমা পুরো ঘটনাটা দেখে। তখন মানব গরিমাকে বলে-“জানো গরিমা, সন্ন্যাসী ঠিকই বলেছিলেন মূর্খ তো সে যে পুরো সত্যিটা না জেনে কাজ করে বসে। আর এই মূর্খ নাপিত শুধু এটাই জানত যে আমি সন্ন্যাসীর মাথায় লাঠি দিয়ে ছুঁয়ে এত এত সোনার মুদ্রা পেয়েছি। কিন্তু সে তো আমার স্বপ্নের ব্যাপারে কিছুই জানত না। তাই সে না জেনে শুনে এই কাজটি করে বসেছে। আর ভুল সন্ন্যাসীকে মারার জন্য সে তার যথোপযুক্ত শাস্তিও পেয়েছে।”
0 Comments