জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২৬১আলবেনিয়া (ইউরোপ)ঈগল পাখি দিল বর /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প— ২৬১

আলবেনিয়া (ইউরোপ)

ঈগল পাখি দিল বর

চিন্ময় দাশ


[আলবেনিয়া হোল ‘ঈগলের দেশ’। সোনালী রঙের ঈগল হোল আলবেনিয়ার জাতীয় পাখি। সে দেশের লাল রঙের জাতীয় পতাকায়, কালো রঙে জোড়া মাথা ঈগলের ছবি ছাপা থাকে। ঈগলের এই দুটো মাথা হোল, সে দেশের উত্তর এবং দক্ষিণ দুই এলাকার প্রতিনিধিত্বের প্রতীক।

আলবেনিয়ার সেই ঈগল নিয়ে, একটি ছোট্ট গল্প রইল এখানে।] 


বলকান হোল একটা উপদ্বীপ। এটির অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একেবারে উত্তর-পশ্চিম সীমায়। এই বলকানেরই ছোট্ট একটি দেশ হোল আলবেনিয়া।

ছোট হলে কী হবে, দেশটা ভারি সুন্দর। পাহাড় আর সমুদ্র – দু’জনে মিলে সাজিয়ে তুলেছে দেশটাকে। সমুদ্র তো আছে দেশটার পুরো পশ্চিম আর দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা জুড়ে। অনবরত ঢেউ আছড়ে পড়ছে ছলাৎ-ছলাৎ করে। গোঙানির বিরাম নাই সমুদ্রের। 

আর পাহাড়? সে তো ছড়িয়ে আছে সারাটা দেশ জুড়ে। যে দিকে তাকাও, শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সবুজ গালিচায় মোড়া ছোট-বড় হাজারো পাহাড়ের যেন মেলা বসে আছে সারা দেশটা জুড়ে। হরেক রকম পশুপাখির ভীড় পাহাড় আর বনগুলোতে।

একদিন একটা ছেলে বেরিয়েছে শিকারে। যেমন প্রতিদিন বেরোয়। হাতে একটা ধনুক আর কয়েকটা তীর। এক সময় মাথার উপর একটা শোঁ-শোঁ আওয়াজ। তাকিয়ে দেখল, বড়সড় একটা ঈগল উড়ে যাচ্ছে। আরও দেখল, ঠোঁটে একটা সাপ ঝুলে আছে ঈগলের। শিকার নিয়ে ঘরে ফিরছে পাখি। একটু বাদে, বেশ উঁচু একটা পাহাড়ের মাথায় নেমে গেল পাখিটা। 

খানিক বাদে দেখল, পাহাড় ছেড়ে আবার উড়ে গেল পাখি। ছেলেটা অবাক হয়ে গেল। শিকার করে আনল। কিন্তু খেলো না তো! নিশ্চয় বাসা আছে পাহাড়ের মাথায়। সেখানে রেখে গেছে সাপটাকে। 

কৌতুহল হোল ছেলের। একবার দেখে আসা যাক ব্যাপারটা। ঈগল হল সবার চেয়ে বড় পাখি। তার বাসাও সবার উঁচুতে। কোনদিন দেখা হয়নি। আজ একবার দেখে নেওয়া যাক। 

🍂

পাখিটা যেখানে নেমেছিল, পাহাড়টা বেশ উঁচু। একটু কষ্ট করেই চুড়ায় উঠে এল ছেলে। বাসাটা খুঁজে বের করতেও অসুবিধা হোল না। বাসার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল। বাসায় একটা ঈগলছানা। আর, বিষধর একটা সাপ ফনা তুলে আছে ছানাটার সামনে। 

নিশ্চয় ঈগল ভেবেছিল, সাপটা মারা গেছে। তাই নিশ্চিন্তে শিকার রেখে গিয়েছে নিজের বাচ্চার পাশেই। এখ সেই শিকারই তার বাচ্চাটাকে মারতে উদ্যত। সরু আর সূঁচালো দুটো দাঁত সাপের। বাচ্চাটার দিকে তাক করা। চোখ পড়তেই বুক কেঁপে উঠল। আহারে, ঐটুকু একটা বাচ্চা! সাপের বিষ থেকে বাঁচবে কী করে? মায়ের ভুলে বাচ্চার জীবন চলে যাবে।

মূহুর্ত দেরি করল না ছেলেটা। এক তীরেই গেঁথে দিল সাপটাকে। ভবলীলা খতম হয়ে গেল সাপের। 

এতদিন নীচ থেকে ঈগলকে উড়ে উড়ে যেতে দেখেছে। আজ নিজের চোখে পাখিটার বাসা দেখছে। দেখছে তার বাচ্চাটাকেও। ভারি লোভ হোল মনে। বাচ্চাটাকে নিয়ে গেলে, কেমন হয়? গাঁইয়ের সব লোক অবাক হয়ে যাবে দেখলে। আলতো হাতে বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে, পাহাড় থেকে নামতে লাগল। 

সবে বাড়ির পথ ধরেছে, আবার মাথার উপর শোঁ-শোঁ। আওয়াজটা এবার বেশ জোরে। যেন একেবারে মাথার ঠিক ওপরটাতেই। তাকিয়ে দেখল, বড়সড় একটা ঈগল। একেবারে মাথার উপর উড়ছে। 

ঈগল কর্কশ গলায় হেঁকে উঠল—তুমি আমার বাচ্চা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছো কেন? 

--তোমার বাচ্চা? ছেলেটা বলল—আমি প্রাণ বাঁচিয়েছি এর। এখন এই বাচ্চা আমার। তোমার হতে যাবে কেন? 

ঈগল অবাক গলায় বলল—তুমি আমার বাচ্চার প্রাণ বাঁচিয়েছ? মানে কী এ কথার? 

ছেলে বলল—তুমি ভেবেছিলে, সাপটা মরে গেছে। তা কিন্তু নয়। বেঁচে ছিল। ছোবল মারতে গিয়েছিল তোমার বাচ্চাকে। আমিই তাকে মেরেছি তীরে গেঁথে। দ্যাখো বাসায় গিয়ে, সত্যি বলছি কি না। 

এবার গলা বদলে গেল ঈগলের—আমার বাচ্চাকে বাঁচিয়েছ তুমি। আমি কৃতজ্ঞ। এবার দয়া করে বাচ্চাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দাও। 

ছেলে বলল—কিছু লাভ নাই। তুমি ভালো মা নয়। আমি রাখব একে। যত্ন করে রাখব । বড় করে তুলব। আমার শিকারের সাথী হবে এ। বন্ধু হবে আমার। 

ঈগল বলল—মায়ের চেয়ে ভালো যত্ন আর কেউ দিতে পারে না দুনিয়ায়। তুমি আমার বাচ্চা ফেরত দাও। তার বদলে আমিও কিছু দেব তোমাকে। 

ছেলেটা হেসে উঠল এই কথা শুনে—তুমি আবার কী দেবে আমাকে? থাকবার মধ্যে ছিল তো এই বাচ্চাটা। সেটাই মারা পড়ছিল আর একটু হলে। আর কী আছে তোমার, যে দেবে আমাকে?

ঈগল বলল—তুমি নিশয় জানো, ঈগলের চোখ কত তীক্ষ্ণ! দৃষ্টির সেই তীক্ষ্ণতা দেব আমি তোমাকে। তুমি নিশ্চিয়ই জানো, কী নিদারুণ শক্তি আমাদের ডানায়! সেই অমিত শক্তি দেব আমি তোমাকে। নিজেই দেখতে পাবে, এখন থেকে তোমার আশেপাশে, তোমার সারা এলাকায় তোমার সমকক্ষ কেউ থাকবে না। সবার উঁচুতে থাকবে তোমার মাথা। সমাজে একদিন অনেক অ-নে-ক বড় আসন পাবে তুমি।

এসব কী শুনছে সে? মুখে কথা সরছে না ছেলের। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে পাখিটার দিকে। 

ঈগল এবার বলল—বিশ্বাস করো আমাকে। ভরসা রাখো আমার কথায়। একদিন অজেয় হয়ে উঠবে তুমি। ঈগলের সাথে তোমার তুলনা করবে লোকেরা। তুমি শুধু বাচ্চাটাকে ফেরত দাও। একজন মা-কে দয়া করো তুমি। 

হাহাকার ফুটে উঠছে পাখিটার গলায়। আর দেরি করল না ছেলেটা। বাচ্চাটা ফিরিয়ে দিল মা-ঈগলকে। 

উড়ে যেতে যেতে ঈগল বলে গেল—দেখে নিও, আমি মিথ্যা বলে যাচ্ছি না। প্রতিটা কথাই সত্যি বলে গেলাম। জীবন বদলে যাবে তোমার। কেবল দয়ালু নয়, শক্তিমান বলে মানবে তোমাকে সবাই।

পাখির দিকে চেয়ে রইল ছেলেটা। একজন নিশ্চিন্ত জননী বুক ভরা শ্বাস নিয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে এক সময় একটা ছোট্ট বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল পাখিটা। 

কিছুদিন বাদে ছেলেটা লক্ষ্য করল, যখনই সে বাইরে বেরোয়, ছোটমতো একটা ঈগল উড়ে বেড়ায় তার মাথার উপর। সে ভাবে, তাহলে সেই বাচ্চাটাই বড় হয়ে গেছে এত দিনে। 

ছেলেটাও বড় হতে থাকল। সত্যি সত্যি দুরন্ত শিকারী হিসাবে সুনাম হতে লাগল তার। তীরের নিশানা ফসকায় না কখনও। বড় বড় জন্তু জানোয়ার শিকার করে আনে সে অবহেলায়। 

আরও বড় কথা, অন্য কোণও গোষ্ঠীর লোকেরা লড়াই করতে এলে, তাদের একজনও কেউ বেঁচে ফিরতে পারে না ।  তারপর একদিন গাঁয়ের সবাই মিলে, তাকেই মোড়ল বেছে নেওয়া হয়েছে। ‘ঈগলের বাচ্চা’ নামই হয়ে গেছে তার।  

তার পর? তার পর কী? ছেলেটার সুনাম ছড়িয়ে পড়ত দেরী হয়নি। গোটা দেশ জেনেছিল তার শক্তির কথা। তার বিবেচনার কথা। শুনেছিল তার দয়ালু মনের কথা। সবাই মিলে দেশের রাজার আসনে বসিয়ে দিয়েছিল ছেলেটাকে। 

Post a Comment

0 Comments