জ্বলদর্চি

লজ্জার পকেট ও অন্যান্য কবিতা /অয়ন মুখোপাধ্যায়

লজ্জার পকেট ও অন্যান্য কবিতা 

অয়ন মুখোপাধ্যায় 


লজ্জার পকেট

আলমারি খুলে দেখি—
জামাগুলোর ওপর ধুলো পড়ে গেছে।
দেখলাম, আমার পাঞ্জাবির
বুক পকেটটা এক্কেবারে খালি।

ওইখানে তো থাকা উচিত ছিল—
এক টুকরো সত্য,
এক চিমটি সাহস,
আরেকটু লজ্জা।

সেই লজ্জাটাকেই কারা যেন
বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে— কেজি দরে।
শুনতে অবাক লাগলেও, এটাই সত্যি—
আলু, পটল আর সত্যি
এখন বাজারে একই দরে পাওয়া যায় কিন্তু সস্তায়।

শুনলাম, কালকে পাশের পাড়ার
একজন নাকি ভোরবেলা চেঁচাচ্ছিল—
“ধর্ম বাঁচাও! ধর্ম বাঁচাও!”
অনেকে বলছে,
তারা দেখেছে তার মুখে নাকি
একটা পাঁচশো টাকার নোট লেগেছিল,
হাতে ছিল লেগ পিস।

আমি তখন ভাবলাম—
ধর্মটা ঠিক কোন পকেটে রাখা আছে?
সেই পকেটটা যদি ছিঁড়ে যায়,
তবে কি ধর্মও বাজারে
টুকরো টুকরো করে বিকোবে?

আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি—
কেউ প্রার্থনা করছি,
কেউ টেন্ডার চাইছি।


আর আমি? আমি কিছুই করছি না 
আমি শুধু দেখছি
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মানুষটা কে,
যে চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে থাকতে
স্ট্যাচু হয়ে গেছে—
যে আজকাল হাসতেও পারে না,
কাঁদতেও পারে না।


🍂


সেবকের গাড়ি

জ্যাঠামশাই ঘরে পুজো করছেন,
আর পুজোর থালার ওপর রাখা আছে
লটারির টিকিট।
আমি জানতাম—
পুজো শেষে দেবতা নাকি প্রসাদ দেন,
এখন দেখছি দেবতা
লটারির লাকি নম্বরও দিচ্ছেন।

আমাদের নেতা গলায় গলায় বললেন

“সত্যিই আমি জনগণের সেবক।”
আপনি যদি সেবকই হন,
তাহলে আপনার গাড়ির আওয়াজে
কেন এত ‘মহারাজা-মহারাজা’ সুর বাজে?

রাস্তায় হাঁটছিলাম—
একজন ভিখারি হাত বাড়িয়ে দিল।
আমি পকেটে হাত ঢোকালাম,
টাকা-পয়সা উঠল না,
শুধু একটি স্লোগান উঠল—
“মানুষ বাঁচাও!”

ভিখারি হেসে বলল—
“ওটা দিয়ে আমার কি হবে, বাবু?
ওটা কি আমাকে খাওয়াবে?”

আমরা তাই বেঁচে আছি—
কেবল বক্তৃতায়,
ধর্ম কেবল পোস্টারে,
আর মানুষ কেবল ভোটবাক্সে।




মিথ্যার দাম

শ্মশানে বডি পোড়ানো হচ্ছে,
পাশেই সেলফি তুলছে তিনজন যুবক।
এখন বুঝি— মৃত্যুও ফেসবুকে আপলোড না হলে
মরা ঠিক মতো মরা হয়ে ওঠে না!

মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক ভিখারি—
তার পেটে ভাত নেই,
কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে—
তার সামনে গন্ধ বেরোচ্ছে হাজার টাকার আতরের,
আকাশে পাক খেয়ে উড়ে যাচ্ছে ধূপের ধোঁয়া।

আমার প্রশ্ন—
ভিখারির এই দীর্ঘ নিঃশ্বাসটা
কোন ধর্মের ভেতরে গিয়ে লাগছে?

প্রতিদিনের মতো একদল ছাত্রছাত্রী
স্কুলের প্রার্থনা সভায় জাতীয় সংগীত গাইছে—
শিক্ষক বললেন, “জোরে জোরে গাও!”
কিন্তু যে ছেলেটা বুঝেছে—
স্কুলে পড়াশোনা করলে চাকরি পাবে না,
সে অন্য কোথাও রোজগার করবে বলে
বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকল।
তার গলায় কি, জাতীয় সংগীতের সুর উঠল?

আমরা তাই শিখেছি—
সত্যি বড় ভালো জিনিস,
তবে সেটা বেশি দামে বিকোয়।
আর ধর্ম—
ধর্ম বড় শক্তিশালী,
তবে সেটা সবচেয়ে নিরাপদ
চোরেদের কাছেই।



প্রতিনিধিদের গল্প

মন্দিরে শুনলাম—
“মানুষ মানুষ ভাই ভাই।”
বাইরে বেরোতেই পুরোহিত বললেন—
“জুতোটা বাইরে খুলে রাখুন,
মানুষটা ভেতরে যাবে তো?”

রাজনীতির সভায় গিয়ে দেখি—
মঞ্চে বসা সবাই বলছে,
“আমরা জনগণের প্রতিনিধি।”
আমি পাশের ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম—
“তাহলে জনগণটা কোথায় বসেছে?”
তিনি চুপচাপ হেসে বললেন—
“ওরা ভোটের দিনে
দুই মিনিটের জন্য বসে,
তারপর আবার উঠে দাঁড়ায়।”

আজকাল ডাক্তাররা রোগী দেখেন
শুধু রিপোর্ট দেখে।
রোগী যদি বলে—
“বাবু, খুব কষ্ট পাচ্ছি।”
ডাক্তার উত্তর দেন—
“অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া
কষ্ট দেখানো যাবে না।”

শেষমেশ মনে হয়—
সত্যি আছে, ধর্মও আছে, নীতিও আছে—
সবই আছে, কিন্তু কাগজে।
আমরা শুধু কাগজ ভাঁজ করি,
তার ভেতরে ভরে রাখি আশায় আশায়।
কেউ কেউ তো মরে গিয়েও ভাবে

“হয়তো পরকালে গিয়েই
এবার সত্যিটাকে পাব!”


ঈশ্বরের কাণ্ডজ্ঞান

অনেক ঘুরে ঘুরে বুঝলাম—
আমাদের চিন্তা, ভাবনা, ধর্ম, নীতি, সত্য—
সবই এখন দোকানে বিকোয়।
কেউ বিক্রি করে বক্তৃতায়,
কেউ বিক্রি করে স্লোগানে,
আর আমরা ক্রেতা হয়ে
টোকেন কেটে লাইনে দাঁড়াই।

বাজারে এখন এক কেজি আলুর দরে
মেলে সততা,
আর একটু বেশি দাম দিলে
বিনামূল্যে সঙ্গে মিথ্যাও পাওয়া যায়।

মসজিদ, মন্দির, গির্জা—
সবই আলোয় ঝলমল,
শুধু দরজার বাইরে দাঁড়ানো
ক্ষুধার্ত, পাগল মানুষটাই
থাকে অন্ধকারে।

তাকে কেউ দেখে না,
কারণ সে ভোট দেয় না,
দানবাক্সে টাকা ফেলে না,
স্লোগানও তোলে না।

শেষমেশ মনে হলো—
আমরা সবাই বড় ধার্মিক,
শুধু ঈশ্বরটাই
একটু নাস্তিক হয়ে গেছেন।

Post a Comment

2 Comments

  1. ভাস্কর সেনOctober 24, 2025

    অয়ন মুখোপাধ্যায়ের 'লজ্জার পকেট ও অন্যান্য কবিতা' - অসাধারণ।

    ReplyDelete
  2. কলমকে কুর্নিশ জানাই,, সব গুলোই ভীষন ভালো লাগলো,তবে প্রথম কবিতাটা সংগ্রহে রাখলাম ।

    ReplyDelete