এলোমেলো পোশাক
কমলিকা ভট্টাচার্য
ভোর হলেই নীলা জানলার পর্দা সরিয়ে বারান্দার দরজা খুলে দেয়। মনে হয়, বারান্দা যেন তার পুরোনো প্রেমিক—প্রতিদিন নতুন করে তাকে এক মুঠো আবির আলো ছুঁড়ে দেয়। গেটের কাছে বসে থাকা কুকুরটা আড়মোড়া ভাঙে—যেন সেও সূর্য নমস্কার করছে।
নীলা ঝটপট নিজের মনের সিলিন্ডারে খানিকটা শুদ্ধ বাতাস ভরে নেয়। সংসার নামের সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দেওয়ার আগে এটাই তার ভোরের নিঃশ্বাস। মোবাইলের এলার্ম বলে ওঠে রেডি, দেওয়াল ঘড়ির ঘণ্টা বাজে স্টেডি, পেপারওয়ালার বেল যেন বলে গো—ব্যস, ঝাঁপ!
তারপর সকালটা কেটে যায় টুকরো টুকরো দমবন্ধ জলযাপনে। মাঝে মাঝে তিমি মাছের মতো একটু জলের ওপর উঠতে হয়—যদি ফোনে রিং বেজে ওঠে। কিন্তু সেসব কল বেশিরভাগই জাঙ্ক। তাকে ডাকবার মতো, তার খবর নেবার মতো আর বিশেষ কেউ নেই।
একসময় ছিল। কেউ একজন ফোন করত। প্রতিটি মুহূর্তের খবর রাখত। নিজের খবরও জানাতো। এখন করে না। তবে একেবারে কথা হয় না বললে ভুল হবে এইতো কদিন আগেই কথা হয়েছিল,সেদিন কোনো কারনে নীলার খুব মন খারাপ ছিল তাই নীলাই ফোন করেছিল। সে ভালো আছে জেনেই নীলা খুশি। নীলা কারও কাছে জোর করে কিছু চাইতে পারে না।
তবু মনে হয়—যদি সেও কারও কাছে ফোন করতে পারত! কিন্তু কেন করবে? সবাই ব্যস্ত, আর না-ই বা হবে কেন? তার আজেবাজে কথাগুলো শোনার সময় কার আছে? অথচ নীলা শুধু চায়—কেউ তার হাসি শুনুক, তার গল্প শুনুক, তাকে বোঝার চেষ্টা না করে শুধু পাশে বসে থাকুক।
🍂
তাই মাঝে মাঝে সে মিছিমিছি অভিমান করে। ঘরের দেওয়ালগুলোও তখন হেসে ওঠে তার বোকামি দেখে। বালিশটা বিরক্ত হয় অকারণে ভিজে।
সকাল এগারোটার পরেই তার একটু সময় থাকে—শুধু নিজের। একান্ত নিজের। তখন নীলা একদম আলাদা মানুষ। নিজের জন্য খানিকটা বোকা বোকা কাজ করে—সেলফি তোলে, ফুলের ছবি তোলে, বারান্দায় বাসা বাঁধা পাখিদের সঙ্গে গল্প করে। দালানে সাজানো গাছেদের শোনায় তার মনের গোপন কথা। মেঘকে মুঠোয় ধরে, বর্ষাকে কপালে মেখে নেয়। প্রজাপতির উড়ান দেখে মুগ্ধ হয়, পিঁপড়েদের ব্যস্ত যাতায়াতে থমকে দাঁড়ায়—ভাবতে থাকে, এরা নিশ্চয়ই নিজেদের মধ্যে কোনো গোপন কবিতা বলে চলে।
কখনও বুকমার্কে আটকে থাকা পুরোনো বইয়ের দু-পাতা উল্টে যায়। পৃষ্ঠার গন্ধে হঠাৎই ফিরে আসে শৈশবের দুপুর, কিংবা হারানো কিশোরীবেলার মেঘলা বিকেল।
এই সময়টুকুতে নীলা কারও কাছ থেকে কোনো প্রশ্ন, কোনো তর্ক, কোনো কঠোরতা চায় না। সে শুধু চায় নীরব এই ঘন্টাগুলো তাকে অক্ষত রাখুক। যেন কোনো শব্দ এসে তার ভেতরের এলোমেলো শান্তিকে না ভাঙে। যেন একটিমাত্র কঠিন বাক্যও তার ভেতরের নরম মেয়েবেলাকে আঘাত না করে।
আসলে এই সময়টাই তার কাছে আয়েশি স্বস্তি। এলোমেলো পোশাক পরে তখন সে যেন আরও নিজের মতো হয়—মেকি পরিপাটির আড়াল ছেড়ে, একেবারে আসল নীলা। কিন্তু দিন যত এগোয়, সংসারের নিয়ম মেনে তাকে আবার নিখুঁত, সাজানো-গোছানো এক নারী হতে হয়।
নীলা ভাবে—এইটুকু সময় কেন ছোটবেলার মতো বড্ড তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়!
ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে ওঠে।
নীলা অবাক হয়ে দরজা খুলল।
দেখে—পিয়ন দাঁড়িয়ে, হাতে একটা ছোট্ট পার্সেল।
প্যাকেট খুলতেই নীলার চোখ ভিজে উঠল—
তার শখের চোখ-পিটপিট পুতুলটা!
ক’দিন আগে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল, আর সেই রাতে সে ভীষণ কেঁদেছিল।
পার্সেল এসেছে লন্ডন থেকে।
কিন্তু....
ভিতরে একটা নোট
“আমার পুতুলের চোখে যে আমি জল দেখতে পারি না।”
নীলা দীর্ঘক্ষণ পুতুলটার দিকে তাকিয়ে রইল।
ঠিক তখনই আবার বেল বাজলো
পিয়নের সাথে পাশের বাড়ির সঙ্গীতা,বলল ,"ম্যাম আমার হাজব্যান্ড লন্ডন থেকে একটা গিফট পাঠিয়ে ছিল, মেয়ের জন্য ভুল করে আপনার কাছে চলে এসেছে।"
নীলা তাড়াতাড়ি পার্সেলটা সঙ্গীতার হাতে ফেরত দিয়ে বলল "আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমি না দেখেই খুলে ফেলেছিলাম।"
সঙ্গীতা বলে, "নো প্রবলেম ম্যাম।"
নীলা দরজা বন্ধ করে,
চুপচাপ বাবার ছবির দিকে তাকায়
ধীরে বলে,
“বাবা, তোমার পুতুলটাও ভেঙে গেছে…”
তারপর অনেকক্ষণ স্থির বাবার ছবির সামনে দাড়িয়ে রইল সে।
দেওয়ালের হাসি আজ থেমে গেছে,
নীলার সব কান্না নিঃশব্দে
দেয়াল আর ছবির ফ্রেমে শোষিত হয়ে গেল।
শুধু তার এলোমেলো পোশাকের আড়ালে
একটা ভেঙে পড়া মেয়েবেলা
আলগোছে কাঁদতে থাকল।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
6 Comments
বারান্দার প্রতি দুর্বলতা আর নিঝুম দুপুরের গল্প এক অন্য জগতে নিয়ে গেল। খুব সুন্দর!!
ReplyDeleteলেখকের বিচরণ তো মনোজগতে। ধন্যবাদ। 🙏
Delete❤️❤️❤️
ReplyDelete💚💚💚 thank you
Deleteএকাকিত্বের মুখগুলো বড় শুকনো হয়, ভাল লিখেছেন।
ReplyDeleteধন্যবাদ,প্রণাম নেবেন।
Delete