জ্বলদর্চি

নানা পালা পার্বণ এর সেকাল ও একাল/কথাকলি সেনগুপ্ত

নানা পালা পার্বণ এর সেকাল ও একাল

কথাকলি সেনগুপ্ত 


আমাদের ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার পথের পালা পার্বণ উৎসব এগুলোর কথা মাঝে মধ্যে ভাবি; বন্ধু স্কুলের থাকলেও তথাকথিত 'প্লে ডে' যথেষ্ট কম ই অনুষ্ঠিত হতো; যদি দুই বাড়ির বড়রা একমত হতেন, তখন একে অন্যের বাড়িতে মাসে দুই মাসে এক বার যাও য়া হতো; খাওয়া নিয়ে মাথা তো ঘামানো হতো না, একসাথে বসে গল্প আর যদি সামনের পার্ক এতে গিয়ে খেলে নেয়া যেত, তার থেকে আনন্দের আর কিছু ভাবতেই পারা যেত না।

আগরতলায় থাকতে দাদা বা দিদি'কে এরকম কিছু করতে দেখেছি বলে তেমন তো মনে পড়ছে না; তবে দিদির একজন বন্ধু কাঁকড়ী টিলার দিকে থাকতো; বড় সুন্দর দেখতে ছিল আর নামটিও তেমনি, ঝুমকাবতী চাকমা; একদিন অল্প সময়ের জন্যে দিদি তার বাড়িতে গিয়েছিলো; আমিও সাথে ছিলাম, ওরা একই ক্লাস এতে পড়তো আর ওই মেয়েটি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল দিদির কাছেই শুনেছি।

আমার ক্লাস ফাইভ এতেও চাকমা সম্প্রদায়ের একটি দুর্দান্ত দুষ্টু ছেলে ছিল, ললিত চাকমা তার নাম ছিল; সব ধরণের শয়তানি পড়া না করা এসব এর জন্যেই সে প্রসিদ্ধ ছিল; একদিন ক্লাস ফাইভ র পূর্ণিমা দিদিমনি ওকে বেঞ্চের ওপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন; পেছনের খোলা জানালার কাছেই সেই বেঞ্চ টি ছিল; সে সেখানে খানিকটা সময় দাঁড়ানো অবস্থায় ই  তার পকেট থেকে একটা পাতলা দড়ি বার করে `এবারে আমি ফাঁসি দিয়ে দি নিজেকে' বলে জানালার সঙ্গে বেঁধে নিয়ে গলায় দিয়ে টান দিয়ে লাফ দিচ্ছি দিলাম কিন্তু করতে লেগেছিলো; আমাদের পড়া তো মাথায়, দিদিমনি সোজা তাকে নিয়ে হেড স্যার এর কামরার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিলেন।

তা যে কথা বলছিলাম; তখন মানে সেই '৬৭ '৬৮ সালে আগরতলায় পরিচিতি বা আত্মীয় কারুর বিয়ে হবে শুনলে পর বেশ উৎসাহী হয়ে উঠতাম; তত বেড়ানোর তো ব্যাপার এমনিতে ছিল না; মনে পড়ে - কুঞ্জবনের এক অংশে গুর্খাবস্তির ওদিকে রুখু দি নামের একজন মনিপুরী বয়সে বড় মেয়ের বিয়েতে একবার যাবার কথা; আমি এর আগে এরকম কোনো বিয়েতে যাই নি; তবে একটু আগেই চলে গিয়েছিলাম, রুখুদী বসে ছিল আর তার দুই বন্ধু তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিচ্ছিল।

ওর কথা আরো মনে আছে এই জন্যে, যে ওর দুই `মা' ছিল; বড় জন, মানে ও যার মেয়ে আর ওর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী, ওরা সবাই একসাথেই থাকতেন; রুখুদি'র ছোট মা বড় সুন্দরী আর কি অল্প বয়সের ছিলেন, প্রায় দিনেই আমি যখন আমার সকালের স্কুল সেরে ফিরে আসছি, উনি বালতি হাতে জামাকাপড় নিয়ে স্নানে চলেছেন; আমাদের তখন কানে সবে দাদু ফুটো করে দিয়েছেন, ওই একটা ফুটোর ব্যাথায় আমায় আর দিদিকে কতদিন কষ্ট দিয়েছিলো আর ওনার কানে চার থেকে পাঁচটি ফুটো ছিল আর তাদের প্রতিটি তেই হয় ছোট রিং নইলে ফুল এসব গয়না পরা থাকতো, নাকেও সোনার ফুল আর গলায় হার হাতের চুড়ি এসব তো ছিলই।
🍂

দিদার কাছে গোপনে জানতে চেয়েছিলাম একবার, যে রুখুদির দুই মা কেন? দিদা বলেছিলেন যে ওদের সমাজে এটা চলে, রুখুদি ওরা তিন বোন, ওদের কোনো ভাই হয় নি বলে নাকি ওই ছুতো দিয়ে ওদের বাবা যথেষ্ট প্রৌঢ বয়সে গিয়ে ওই অল্পবয়সের সুন্দরী বড় গরিব ঘরের মেয়ে কে বিয়ে করে নিয়ে এসেছিলেন।

মোটামুটি '৬৮ কি '৬৯ সালের কথা হবে; আগরতলা শহরের ওদিকে আমাদের দাদুর সম্পর্কে এক বোন জ্যোৎস্না দিদা থাকতেন; তিনি দাদুর থেকে অনেকটাই ছোট ছিলেন, আর তাঁকে মা মামা ওনারা `জ্যোসি পিসি' বলে সম্বোধন করতেন; মহারানী তুলসীবতী স্কুল এতে তিনি পড়াতেন, আর তাঁর স্বামী ডাক্তার ছিলেন; তা সেই জ্যোসি দিদার মেয়ে মিষ্টু মাসির বিয়েতে যাবার ঘটনা আমার বেশ মনে পড়ে; ওটাই আমাদের আগরতলায় প্রথম কোনো আত্মীয়র বিয়ে ছিল; ওই মাসি'র বিয়ের দিনে বিকেলে বেশ তাড়াতাড়ি ই আমরা ওঁদের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম; তখন মাসির বন্ধুরা তাঁকে বড় সুন্দর করে সাজিয়ে সামনের ঘরে বসিয়েছে, তত্বের মিষ্টি সব এসে গেছে সেগুলো পাঠানো চলছে, আর কিছুটা উপস্থিত আত্মীয় ওঁদের মধ্যে চা এর সাথে দেয়া চলছে।

মা আর দিদা ভেতরের দিকে জ্যোসি দিদা'এ সাহায্য করতে ব্যস্ত; আমি এদিক ওদিক দেখছি - একসময় একটু আলোড়ন উঠলো `ডক্টর রথীন দত্ত সস্ত্রীক এসেছেন'! তাঁকে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বারান্দায় বসানো হলো, আর তাঁর স্ত্রী (ওনার নাম তো মনে নেই, উনিও যতদূর মনে পড়ে একজন ডাক্তার ই ছিলেন) আর সাথে দুই কি আড়াই বছরের ওঁদের ছোট্ট মেয়ে! শেষের দুই জন ভেতরের বড় ঘরটিতে এসে বসলেন; সবাই ওই সুন্দর গুটগুটে বাচ্ছাটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো; ফিস্ ফিস্ করে ওই বাড়ির দাদু আমাদের জানালেন যে রথীন দত্ত আসার পর থেকেই আগরতলায় আগে হতো না এমন অস্ত্রোপচার ও করা শুরু হয়েছে!

ওনার নামটি শুনে থেকেই আমার যেন মনে হচ্ছিলো যে এঁর বিষয়ে কোথাও আগেই শুনেছি; একটু চিন্তা করতে করতেই মনে পড়ে গেলো সেই প্রসঙ্গ টি; আমাদের গৃহশিক্ষক শ্রী দীঘল স্যার এর কাছে; ওনার প্রথম নাতনি হয়েছে সবে শিশুটির মাথায় তথা ক্রেনিয়াল ক্যাভিটি তে অংশতঃ `জল' ছিল; বোধহয় সেটি কে ডাক্তারি পরিভাষায় `হাইড্রোসেফালি' বলা হয়ে থাকে; স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের স্যার এর বাড়ির সবাই এর মন বড় খারাপ হয়ে গিয়েছিলো, কি করে তাকে বাঁচানো যায় আর সুস্থ্য করে তোলা যায় তা নিয়ে ওঁরা বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন; ডাক্তার রথীন একটি বিশেষ ধরণের অপারেশন করে ওর কানের পেছনে একটি সুইচ এর মতন জিনিস বসিয়ে দিয়েছিলেন; দিনে বার দুয়েক বিশেষ কায়দায় সেটিকে চেপে ধরলে একটু একটু করে সেই জল বের হয়ে যেত; স্যার এর কাছেই আমি এসব জেনেছিলাম; এর আগে এরকম কোনো জটিল অপারেশন আগরতলায় হতো না, কলকাতায় নিয়ে যেতে হতো।

বিয়ের কথায় আবার ফিরে আসি; সেই সময় এর প্রথা মতন বাড়িতেই ভিয়েন বসিয়ে জ্যোসি দিদা খাবার ব্যবস্থা করেছিলেন; সরু লম্বা কাঠের বেঞ্চি, তার ওপরে সাদা কাগজের রোল পাতা হতো, আর তার পরে কলাপাতা মাটির খুড়ি করে জল দেয়া হতো; পাতের ডান কোণে লেবু নুন দেয়া থাকতো, আর লোকে এসে বসবার পর বাকি পদ পরিবেশন শুরু হতো; বেশ মজার ব্যাপার ছিল সেসব।

'৭০ কি '৭১ সালের কথা হবে; আমাদের গোরামামা'র বিয়ের পর বৌভাত হয়েছিল তখন কলকাতার দক্ষিণের একটি অভিজাত হল ভাড়া করে; তার দু দুটি তলা ই ভাড়া নেয়া হয়েছিল; একটিতে মস্ত বড় হলে নতুন মামীমাকে সাজিয়ে বসানো হয়েছিল; পাটনা ইউনিভার্সিটি'র ঈশান স্কলার সেই মামিমা বেশ মিশুকে ছিলেন; সময় সময় সারা দিনে তাঁর কাছে গিয়ে বসে একটু গল্প করে নিচ্ছিলাম; আবার সম বয়সের বোনেরা একসাথে হয়ে হৈ চৈ করা ও চলছিল; রাত্তিরের খাওয়া পর্ব মিটলে পর আমরা যে যার বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম।

মামা মামিমা যে তলায় খাওয়া দাওয়া হয়েছিল, তার ই ওপরের তলায় যেখানে সব জিনিস পত্র রাখা তার পাশের একটি ঘরে তাঁদের ফুলশয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছিল; বাড়ির খুব বয়স্ক আর বিশ্বস্ত একজন কাজের লোক আর গোনাগুন্তি এক কি দুই জন্যে সেখানে হলঘরে তে ছিল; অনেক রাত্তিরে তাঁদের তলার দরজায় ধাক্কা পড়ে; তখন খুলে সেই বয়স্ক মহিলাটি দেখেন যে হাতে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে কিছু ছেলে দাঁড়িয়ে; তারা বলে যে `বাড়িতে কে আছে? আমাদের খেতে দিতে হবে; আর যা কিছু দামি আছে, তাও বিনে ঝামেলায় আমাদের হাতে তুলে দিলে কোনো গোলমাল হবে না; নইলে...!

বয়স্ক মহিলাটির উপস্থিত বুদ্ধি খুব ছিল; সেই সময় নকশালী আমল, প্রায় বিয়ে বাড়িতেই এরকম তারা খেতে চলে আসতো; কিন্তু রাত্তির একটাতে আবার কোথায় খাওয়া মজুদ থাকে? তিনি বুঝতেই পেরেছিলেন যে এরা আসলে দামি জিনিসপত্রের খোঁজেই এসেছে, খাবার কথাটা কিছুই নয়; এদিকে মামা মামিমা ওঁরা তো ওই হলঘরের পাশের ঘরেই রয়েছেন; মামিমার গায়ে প্রচুর সোনার হীরের গহনা, কি হবে? মাথা খুব ঠান্ডা রেখে তিনি একটুও অপ্রতিভ না হয়ে উত্তরে বলেছিলেন `খাওয়া তো সব অনেক আগেই মিটে গেছে, কিছু জিনিস পত্র কেবল পড়ে আছে তাই আমায় রেখে গেছে, সকালে নিয়ে যাবে বলে'; একবার ও উনি যদি বলে ফেলতেন যে `নতুন বর ও বৌ' ও এখানে আছে, তাহলেই চিত্তির বেঁধে যেত; ওরা একটু দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলে ভেতরে আর ঢোকে নি, বের হয়ে চলে গেছিলো; আর বিরাট এক বিপদের হাত থেকে এভাবে সেদিন বেঁচে যাওয়া হয়েছিল।

অনেক বড় হয়ে চাকরি করতে আর তার পর বিয়ে হয়ে যখন আমার দিল্লি তে পাকাপাকি ভাবে বসবাস শুরু হলো, দু দুটি খুব ধনী পরিবারের বিয়েতে উপস্থিত হবার সুযোগ হয়েছিল; '৯৭ '৯৮ সালের কথা হবে; ওদের মধ্যে একটি খুব পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ী পরিবার; ওঁদের বাড়ির এক ছেলের বিয়ে; বিয়ের কার্ড এর সাথেই বড় এক বাক্স মিষ্টি আর আমার জন্যে শাড়ী চলে এসেছিলো, যা আগে আমি তো কখনো দেখি নি; খুবই অপ্রস্তুত লাগছিলো সন্দেহ নেই!

তার পর বিয়ের দিন টিতে  - অনুষ্ঠান যেখানে হচ্ছিলো সেটি মস্ত বড় একটি পার্ক; তাতে যে কত ধরণের ফুড ষ্টল চারিদিকে লাগিয়ে রাখা ছিল, আর তার থেকে ধোপ দুরস্ত পোশাকের লোকেরা ট্রে করে বসে থাকা সব অতিথি ওঁদের সামনে `ফিঙ্গার ফুড' সুখাদ্য এনে বারে বারে ঘুরে চলছিলেন, বর বৌ এসে বসবে যেখানে সেই স্টেজ টি তো দুর্ধর্ষ ভাবে মরশুমি নানা ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো; গান বাজনা চলছিল! এক একটি স্টল এর সামনে তো বেশ অনেক লোকের লাইন লেগে পড়েছিল, সাবেক দিনের কেউ কাউকে `আসুন খেয়ে যাবেন কিন্তু বসুন' গোছের আপ্যায়ন তো চোখেই পড়ে নি।

 তবে হ্যাঁ, ঢোকার মুখে সেসব পেয়েছিলাম আর শুধু মানুষে নয়, বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে দু দুটি হাতি কেও সেখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল; বছর সাতেক এর মেয়ে তখন, তাকে কাছ থেকে হাতি দেখাবো বলে নিয়ে গেছি, সেও খুব খুশি, হঠাৎ বাড়ির কারোর ইঙ্গিতে মাহুত হাতিকে তার শুঁড় টি তুলে `স্যালুট' করবার ইশারা করে দিয়েছিলো; আমি বোকার মতন সেটা তো বুঝে উঠে সময় মতন সরে আসতে পারি নি, গদাম করে সেই শুঁড় টি গিয়ে বেচারা মেয়ের মুখে লেগে বসলো; 

হাতির দোষ ছিল না, মেয়ের ও নয়, শুধু তার মায়ের পাগলামির জন্যে সে বেচারির নাক আর ওপরের ঠোঁট টি ঠিক টেপির নামের প্রাণীর মতন ফুলে উঠেছিল; কী কান্ড!

অপর বিয়েতে তো এসবের ওপরে একটি লাইভ ব্যান্ড এসে তৎকালীন সিনেমার নানা চটুল গান ও তার সঙ্গে অঙ্গ ভঙ্গি করে স্বল্প পোশাকের নৃত্যের ও আয়োজন করে রেখেছিলো; রাত্তির যত বাড়ছিল, ততই ঘোষক এর রঙ্গ রসিকতা আর পরিবেশনা তো আমার চোখে অশ্লীল বোধ হতে লেগেছিলো; অথচ তা নিয়ে সেই বাড়ির লোকেদের তো কোনো হেলদোল দেখছিলাম না; যেন বিয়েতে এসব ই খুব স্বাভাবিক ব্যাপার; তাই তাড়াতাড়ি মেয়ে কে নিয়ে সেখান থেকে বাড়ির পথে রওনা হয়ে গিয়েছিলাম।

Post a Comment

0 Comments